যুযুধান দুই মহাদানব: গডজিলা ভার্সাস কং ও মানবকেন্দ্রিক চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতা
ছবি: গডজিলা ভার্সাস কংপরিচালনা: অ্যাডাম উইনগার্ডপ্রযোজনা: লেজেন্ডারি পিকচার্সঅভিনয়: আলেকজান্ডার স্কার্সগার্ড, রেবেকা হল, মিলি ববি ব্রাউন, ব্রায়ান টাইরি হেনরি, কেইলি হটল প্রমুখ
অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিসিজম বা মানবকেন্দ্রিক ভাবনার বীজ প্রোথিত রয়েছে খ্রিস্টিয় ধর্মভাবনার গোড়াতেই। ঈশ্বরের সৃষ্ট নদী পর্বত বাগান পশু পক্ষী সমস্তই তৈরি হয়েছে তাঁর প্রতিচ্ছবি মানুষের ব্যবহারের জন্য, এই চিন্তা প্রথমেই মানুষকে অন্যান্য জাতিদের থেকে স্বতন্ত্র একটি উচ্চাসনে বসিয়ে দিতে চায়। বহুচর্চিত রেনেসাঁ যুগেও পাই সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, গ্রেট চেইন অফ বিইং এর গঠনে ঈশ্বর ও দেবদূতদের পরেই স্থান পেয়েছে মানুষ। আধুনিক সভ্যতা এই আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাধারাকেই বহুতর রূপে প্রসারিত করে, প্রকৃতির বিবিধ সম্পদকে কেবলই বৈজ্ঞানিক ও নাগরিক অগ্রগতির কাঁচামাল হিসেবে দেখতে চায়। তাই আত্মরক্ষার তাগিদে প্রাকৃতিক দূষণের বিপদ সম্বন্ধে আশঙ্কিত হলেও, শুধুমাত্র ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীর স্বাস্থ্য রক্ষার্থে আধুনিক জীবনযাপন পরিত্যাগ করতে সে নারাজ, কারণ মুখে যাই বলুক, মনে মনে মানুষ নিজেকে এই গ্রহের অবিসংবাদিত শাসক বলেই মনে করে।
লেজেন্ডারি পিকচার্সের মন্সটারভার্স ফ্র্যাঞ্চাইজির ছবিগুলি প্রথম থেকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে মানবকেন্দ্রিক ভাবনার এই প্রচণ্ড শ্লাঘাকে। গডজিলা ছবিতে আমরা দেখেছি, কীভাবে পারমাণবিক পরীক্ষা নিরীক্ষা জাগিয়ে তুলেছে পৃথিবীর গভীরে লুক্কায়িত ভয়ঙ্কর টাইটানদের। দানবিক মোথরাদের ঘায়েল করতে মানুষ যখন সেই পারমাণবিক শক্তিকেই হাতিয়ার করে, ডঃ সেরিজাওয়ার মুখে শোনা যায় এক অমোঘ উপলব্ধি- “Man's arrogance is in believing that he is in control of Nature, and not the other way around.” পারমাণবিক অস্ত্র নয়, মোথরাদের সঙ্গে টক্কর নিয়ে পৃথিবীকে মহাপ্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা করে মহাপরাক্রমশালী টাইটান গডজিলা।
'কং: স্কাল আইল্যান্ড' ছবিতেও পাই একই বার্তা। ভিয়েতনাম ফেরত মার্কিন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্যাকার্ড উপলব্ধি করেন, স্কাল আইল্যান্ডে আধুনিক প্রযুক্তি কোনো কাজেই আসবে না, একমাত্র কংই পারে ভয়াবহ স্কালক্রলারদের পরাজিত করে দ্বীপের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করতে। 'গডজিলা ভার্সাস কং' ছবিতে দুই দানবের যে দ্বৈরথ, তা বহুলাংশেই সৃষ্ট মানুষের স্বার্থপর কার্যকলাপের ফলে। গডজিলা আচমকা ফ্লোরিডার অ্যাপেক্স গবেষণাগারে আক্রমণ করে বসলে তাকে গণমাধ্যমে দাগিয়ে দেওয়া হয় মানবতার শত্রু হিসেবে, কিন্তু কিশোরী ম্যাডিসন রাসেল অ্যাপেক্সের প্রাক্তন কর্মচারী বার্নি হেয়েস ও বন্ধু জশের সাহায্যে আবিষ্কার করে, গডজিলার আক্রমণের পিছনে রয়েছে অ্যাপেক্সের কর্ণধার ওয়াল্টার সিমন্সের এক ভয়ঙ্কর চক্রান্ত। বিশালবপু এক যান্ত্রিক গডজিলা বানিয়ে পৃথিবীর উপর আধিপত্য কায়েম করতে চায় সে। কংয়ের সাহায্যে ও অ্যাপেক্সের অর্থানুকূল্যে ডঃ রবার্ট লিন্ড ও বৈজ্ঞানিক ইলিয়ানা অ্যান্ড্রুজ ভূ গর্ভে যে অভিযান চালান, তাঁরা না জানলেও সেই অভিযানের গোপন উদ্দেশ্য হল সিমন্সের এই বিরাট যন্ত্রকে চালনা করবার জন্য উপযুক্ত শক্তির উৎসের সন্ধান। অ্যাপেক্সের যান্ত্রিক গডজিলা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে সবার আগে আক্রমণ করে বসে সিমন্সকেই, আমাদের মনে পড়ে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসের বার্তা- বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যবহার ডেকে নিয়ে আসতে পারে চরম সর্বনাশ। চিরাচরিত শত্রুতা ভুলে মানব সৃষ্ট যান্ত্রিক গডজিলার মোকাবিলায় হাত মেলায় দুই মহাদানব, গডজিলার পারমাণবিক নিঃশ্বাসে বলীয়ান কুঠারের আঘাতে যান্ত্রিক দৈত্যকে পরাজিত করে কং। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, কং গডজিলার সঙ্গে মৈত্রীস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় কোনো ‘সভ্য’ মানুষের নির্দেশে নয়, আদিবাসী বালিকা জিয়ার অনুরোধে। অ্যাপেক্সের অত্যাধুনিক যানের সাহায্যে কংয়ের প্রাণদান মনে করিয়ে দিতে ভোলে না বিজ্ঞানের কল্যাণকর রূপটির কথাও।
ভূ-গর্ভের দৃশ্যগুলি মনে করিয়ে দেয় জুল ভার্নের জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দি আর্থ বা এডগার রাইস বারোজের অ্যাট দি আর্থ’স কোর প্রভৃতি ‘হলো আর্থ’ ধারার বিখ্যাত উপন্যাসগুলিকে। গডজিলাকে নিয়ে ইতিমধ্যে মন্সটারভার্সে দুটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র হয়ে গেছে বলেই বোধহয় এই ছবিতে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে কংকে, গডজিলা প্রেমীরা কিঞ্চিৎ আশাহত হতেই পারেন। এ ছবির মূল আকর্ষণ অবশ্যই বিশালদেহী দানবদের সংঘর্ষের দৃশ্যায়ন, বেন সেরেসিনের ক্যামেরার গুণে যা যথাযথ সুন্দর হয়ে উঠেছে। টম হলকেনফিল্ডের আবহ সঙ্গীত লঘু মুহূর্তগুলিতে সুন্দর, তবে মারামারির সময় অতিরিক্ত কানফাটানো জগঝম্প আওয়াজ মাঝেমধ্যে বিরক্তি এবং অস্বস্তির সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত শিল্পী নেবার ফলে ঠিকঠাক ব্যবহার করা যায়নি অনেককেই, আলেকজান্ডার স্কার্সগার্ড, রেবেকা হল, কাইল শ্যান্ডলার প্রভৃতি কলাকুশলীদের প্রত্যেকেই আটকে গিয়েছেন চরিত্রের একমাত্রিকতায়, ওয়াল্টার সিমন্সের চরিত্রটি জটিল হলেও তা ফুটিয়ে তোলার জন্য স্ক্রিপ্টে যথেষ্ট জায়গাই পান নি ডেমিয়ান বিশির। ম্যাডিসন রাসেলের চরিত্রে মিলি ববি ব্রাউন সপ্রতিভ হলেও ইনোলা হোমস দেখে ফেলা দর্শকেরা এই ছবিতে তাঁর চরিত্র চিত্রায়ণে আলাদা কিছুই পাবেন না। বরং মন কেড়ে নিয়েছে বার্নি হেয়েসের চরিত্রে ব্রায়ান টাইরি হেনরির সাবলীল সংলাপ ও মূক বধির আদিবাসী বালিকার চরিত্রে কেইলি হটলের অভিব্যক্তিগুলি। করোনাকালে বিধ্বস্ত মানবসমাজ যখন ক্রমশ উপলব্ধি করছে প্রযুক্তিনির্ভর নাগরিক সভ্যতার সীমাবদ্ধতা, সেই সময়ে এই ছবি শুধু বড় পর্দায় ধুন্ধুমার অ্যাকশন দেখিয়েই বাজিমাত করতে চায় নি, সেইসঙ্গে ছবির গল্পের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি বার্তাও দিতে চেয়েছে।
#Godzilla vs. Kong #film review #Adam Wingard #monster film #action #sci fi #Millie Bobby Brown #Alexander Skarsgård #অ্যাডাম উইনগার্ড #গডজিলা ভার্সাস কং #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য #সিলি পয়েন্ট