তিল থেকে টাকে চুলের তাল? হদিস দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা
টাক। একটা আ-কার জুটলেই জীবনে চিন্তা থাকত না। কিন্তু তার বদলে ইনি চলে এলে দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে, অকালে চুল ঝরে যাওয়ার বিরহে প্রাণে যে হাহাকার ওঠে, প্রেমের বিচ্ছেদেও বোধহয় তত হয় না। মনের সুখে চিরুনি চালানোর মাঝে যেদিন ইন্দ্রলুপ্তির সামান্য আভাসটুকু চোখে পড়ে, আয়নার সামনে দাঁড়াতে কান্না পায় না, এমন স্থিতধী মানুষ কমই আছেন। আর এ এমন সমস্যা, যার কোনও ধরাবাঁধা সমাধান নেই। কেউ বলবেন মাথায় ক্যাস্টর অয়েল মাখ, কেউ বলবেন ভিটামিন-ই ক্যাপসুল খাও, আবার কেউ বলবেন মিনক্সিডিল মেখে তাঁর কতই না উপকার হয়েছে। মজার ব্যাপার হল, প্রত্যেকটাই হয়ত কার্যকরী, কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সব উপায় কাজ করে না। আর টাক পড়ার কারণ যদি হয় বংশগতি, যার পোশাকি নাম অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেশিয়া, তাহলে এসবের কোনোকিছুই একশো শতাংশ কাজ করবে না।
সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, গায়েপড়ে গজিয়ে যাওয়া তিল-আঁচিলেই থাকতে পারে চুল ফেরতের চিকিৎসা। বিজ্ঞানীদলের প্রধান, ম্যাকসিম প্লাইকাস, বহুদিন ধরেই স্টেম কোশ এবং মানবত্বকের জরাগ্রস্ত কোশদের নিয়ে কাজ করে চলেছেন। তাঁর বরাবরই মনে হত, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যে তিল, আঁচিল ইত্যাদি গজায়, তার থেকে দিব্যি নধর কয়েকগাছি চুল বেরোয় কী করে! এমন মনে হওয়ার কারণ, ওই সমস্ত জায়গার কোশগুলি আসলে জরাজীর্ণ, অতএব বিভাজনে অক্ষম। তাই সেখানে চামড়ার রঞ্জককণা মেলানিনের এত আধিক্য। তা এহেন অস্থানে হঠাৎ চুল গজিয়ে শরীরের কী লাভ? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তাঁরা জেনেছেন এক নতুন তথ্য। ত্বকের উপরিভাগে থাকা কোশদের অন্যতম প্রধান কাজ, ত্বকের গাঢ়ত্ব নির্ণয়কারী রঞ্জক মেলানিন তৈরি করা, এদের বলে মেলানোসাইট। এই মেলানোসাইটরা যখন জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন কখনও কখনও অনেকে মিলে একজায়গায় জড়ো হয় – একসঙ্গে প্রচুর মেলানিন জমে চামড়ার রঙ হয়ে যায় আরও গাঢ়, আমরা দেখি তিল। গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখলেন এই তিলের তলায় থাকা জরাগ্রস্ত মেলানোসাইটরা শুধু একগাদা মেলানিনই নয়, সেই সঙ্গে তৈরি করছে আরও একধরনের প্রোটিন কণা – অস্টিওপন্টিন। ত্বকের উপরিভাগের ঠিক নিচেই থাকে রোমকূপ, যার মূলে থাকে এক ধরনের স্টেম কোশ। অস্টিওপন্টিন এই স্টেম কোশকেই নতুন করে উত্তেজিত করে ঘুমিয়ে থাকা রোমকূপকে জাগিয়ে তোলে। তিল থেকে উঁকি মারে অনাকাঙ্ক্ষিত লোম।
সাধারণ কোশের সঙ্গে স্টেম কোশের পার্থক্য এখানেই যে সাধারণ কোশের বিভাজন ক্ষমতা বা বৃদ্ধি খুবই সীমিত, তুলনায় স্টেম কোশ দীর্ঘজীবী এবং আমৃত্যু সক্ষম। শরীরে সর্বত্র যত রোমকূপ, তাদের অনেকেই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে আসে, তাদের গোড়ায় লেগে থাকা স্টেম কোশ আলগা হয়ে যায়। ফলত একবার চুল ঝরলে তখন আর গজায় না। কিন্তু কোনোভাবে যদি স্টেম কোশকে আবার উত্তেজিত করা যায়, তারা ফিরতি সংকেত পাঠায় রোমকূপকে। সেই রাসায়নিক সংকেতের উত্তরে আবার গা-ঝাড়া দিয়ে চুল গজানো শুরু করবে রোমকূপ। অস্টিওপন্টিন ঠিক সেই কাজটাই করছে। প্লাইকাস ও তাঁর সহকর্মীরা ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, অস্টিওপন্টিনের প্রয়োগে স্টেম কোশ নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করছে, ঝিমিয়ে থাকা রোমকূপ থেকে আবার গজাচ্ছে চুল। তবে কি আমাদের চকচকে মরুতেও ফুল, থুড়ি, চুল ফোটানো যাবে এইভাবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, আলবাত যাবে! বোটক্স করার পদ্ধতিতেই অতিসূক্ষ্ম সূচ দিয়ে মাথায় বসিয়ে দিতে হবে অস্টিওপন্টিনের আঁতুড়ঘর। তারপরেই ম্যাজিক। তাহলে কি মাথা জুড়ে চুলের সঙ্গে তিলের বোনাস বয়ে বেড়াতে হবে? বিজ্ঞানীরা আশ্বস্ত করছেন, মেলানিনের সঙ্গে অস্টিওপন্টিনের কাজের কোনও সম্পর্ক নেই। আপনি রঙ বদলালেও মাথার রঙ বদলাবে না।
কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে এখনও কিছুটা দূরত্ব আছে। সবে তো ইঁদুর গেল, মানুষে পরীক্ষা করার ছাড়পত্র চেয়ে আবেদন করেছেন গবেষকরা। সেসব পরীক্ষানিরীক্ষা না মিটলে সাফল্যের শতকরা হার বিচার করা যাবে না। এই নতুন পদ্ধতিকে বাজারজাত করার যোগ্য করে তুলতে প্লাইকাস ও আরও কিছুজন মিলে খুলে ফেলেছেন “অ্যামপ্লিফিকা” নামে একটি কোম্পানি। এমন চিকিৎসা যেদিন পরিপূর্ণরূপে বাজারে আসবে, সেদিন যে তা সাধারণের সাধ্যের মধ্যে থাকবে, এমন কথাও জোর দিয়ে বলা যায় কি? তবু বিজ্ঞান তো আমাদের বারবার আলোর দিশা খুঁজে পেতেই শেখায়, নাহয় সে আলোতে আপাতত টাকই চকচক করুক।
........................
তথ্যসূত্র : Signalling by senescent melanocytes hyperactivates hair growth, Nature, 2023