প্রাদেশিক সাহিত্য

অযোনি : একটি রূপকথার অপমৃত্যুর গল্প

জুঁই নিয়োগী July 28, 2020 at 5:21 am প্রাদেশিক সাহিত্য

হাওয়াইয়ান মিথোলজিতে আমরা কাপো নামে এক মেয়ের গল্প শুনেছিলাম। সে নাকি ইচ্ছে করলেই তার শরীর থেকে যোনিকে বিচ্ছিন্ন করতে পারত। একদিন তার উড়ন্ত বিচ্ছিন্ন যোনি, দুর্বৃত্ত দেবতা কামাপুয়াকে কীভাবে দুর্বিপাকে ফেলেছিল, সে ঘটনার খুঁটিনাটি এই গল্পেই আছে। অর্ধেক মানুষ- অর্ধেক শূকর কামাপুয়া এই আখ্যানে যেন মেল শভিনিজমের একটি শূকরায়িত প্রতীক। যার কাছে নারী শুধুই একটি যোনি। আর কাপো এই কাহিনিতে কামাপুয়ার রাক্ষুসে পৌরুষকে পাথরে গুঁড়িয়ে একটি রূপকথার ডানা মেলার গল্প হয়ে ওঠে।

আমাদের গল্পেও আমরা একটি মেয়ের কথা শুনি, যার নাম নেই। অথচ যে নিজেই নিজের গল্প শোনাতে শোনাতে বলে -“সকলের কাছে আমার গল্পটাকে পৌঁছে দেওয়াটাই আমার একমাত্র ইচ্ছা। আর এই ইচ্ছেটা এমন প্রবলভাবে আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে যে শুধু এটা লেখার জন্যই আমি গত একবছর ধরে বেঁচে আছি। গল্পটা শেষ করেই আমি মারা যাব। ... একটা শব্দ আমি খুঁজছিলাম গল্পটার জন্য, যদি শব্দটা আগে জানতাম, তবে অনেক আগেই গল্পটা লিখে মরে যেতে পারতাম। ঠিক যখন শব্দটার অভাবে আমি ধীরে ধীরে গল্পটার সম্পর্কেই আমি অনিশ্চিত হয়ে পড়ছিলাম, তখনই সেই শব্দটা আমি খুঁজে পেলাম।…..যোনি, যোনিজা, অযোনিজা…আমার মাথার মধ্যে যেন কিছু একটা হচ্ছিল। হঠাৎ একটা ব্যথা চিড়িক করে উঠল আমার মাথায়।...জীবন কী সুন্দর হত যদি আমি অযোনি নিয়ে জন্মাতাম! অযোনি শব্দটা আমি কত ভালোবাসি!” মেয়েটি কাপোর মতো কোনো দূরদেশের দেবী নয়, আমাদের ঘরের মেয়ে, দেশের মেয়ে। এই মেয়েটির গল্প আমাদের কাছে নিয়ে আসেন তেলেগু লেখক পপুরি ললিতা কুমারী। ভোলুগা ছদ্মনামেই বিশেষভাবে তিনি পরিচিত ও জনপ্রিয়। জন্ম ১৯৫০ সালে। ১৯৯১ সাল অর্থাৎ লেখালিখির শুরু তিনি থেকেই অস্মিতা নামে একটি এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত, যে সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে মেয়েদের অজস্র সমস্যা নিয়ে সামনাসামনি লড়াই করে আসছে। ফলে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন এ দেশের মেয়েদের ক্ষত-যন্ত্রণা-লড়াই। তারপর তাঁর সংবেদনশীল মন নিজের মতো করে সেইসব যন্ত্রণার নিজস্ব পাঠ তৈরি করেছে। ‘অযোনি’ গল্পটিও অভিজ্ঞতাজাত।

এই গল্পের মুখ্য চরিত্র একটি মেয়ে, যার নাম নেই। তাই সে অনায়াসেই তার মতো অন্য অনেক মেয়ের হয়ে কথা বলতে পারে। মেয়েটি স্বপ্ন দেখত একদিন একটা আশ্চর্য রূপকথা লিখে গোটা পৃথিবীকে মুগ্ধ করে দেবে। একদিন সেই রূপকথা প্রকাশ পাবে চাঁদমামাতে। সকলে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করবে তার আখরমালা। চাঁদমামা, “খোলা আকাশের নিচে খাটিয়ায় দিদার পাশে শুয়ে আর চাঁদ দেখতে দেখতে দিদার গল্প” শোনা, রেডিওর গান আর আলপনা আঁকা নিয়ে ওই মেয়েটি যে নিজস্ব পৃথিবী গড়ে নিয়েছিল তা রূপকথার মতোই মেদুর বর্ণময়। তার সজীব সুন্দর সংবেদনশীল ভিতরমন যে কল্পনা দিয়ে পাখা মেলতে চেয়েছিল, ওই রূপকথার শব্দগুলোই ছিল তাদের ডানা। একদিন খুব সকালে হলুদ, কুমকুম, আর বানতি ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে এক সদ্যকিশোরী যখন তার ভিতরকার ছবিগুলোকে ফুটিয়ে তুলছিল, তখন সেই ছবিতে ধরা পড়ে একজোড়া সাপ। সাপ সম্পর্কিত ফ্রয়েড-এর সেই বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত, যেখানে সাপ একটা “phallic symbol” এবং যার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, “emphasizes a relashionship to sextuality and male figures.” একজন কিশোরীর প্রথম যৌনবোধের বিকাশ আর তারপর সেই তিরতিরে মুহূর্তেই ওই মেয়েটির যৌনতা কীভাবে কতগুলো রাক্ষুসে আগ্রাসনের কাছে দলিত মথিত হচ্ছে, তার কয়েকটি ভয়ংকর ইমেজ মেয়েটির আত্মকথনেই উঠে আসছে – “আমি রাস্তা পার হচ্ছিলাম... এমন সময় দুটো সাপ আমাকে ঘিরে ধরল আর হিঁচড়ে টেনে গাড়িতে তুলল। তারা আমার উপর বিষ ঢালল। আমি ভাবলাম মরে যাচ্ছি।” এভাবেই কত শত ভারতীয় কিশোরীর যৌনতা রংর মেলবার আগেই ধর্ষণের শিকার হয়। পুর্নবাসনের অভাবে মেয়েটির শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হয় পতিতালয়ে।গল্পের শেষে দেখি রূপকথা হতে চাওয়া মেয়েটি কামাপুয়ার রাক্ষুসে গ্রাসের কাছে হেরে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে নিজেই নিজের মৃত্যু দ‍্যাখে—“আমি এক্ষুনি মারা যেতে পারি। আমি মারা যাচ্ছি।” ভোলগা, নারীবাদী লড়াইয়ে বিশ্বাসী ভোলগা মেয়েটিকে হেরে যেতে দেন। ডানামেলা যোনির উড়ন্ত উড়ান নয়, মৃতপ্রায় এক মেয়ের অযোনি হওয়ার বাসনা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়ে থাকে। রূপকথার আরাম নয়, তিনি চান পাঠক জেগে থাক তীক্ষ্ণ সত্য আঘাতে।



কভার পোস্টার : অর্পণ দাস

#প্রাদেশিক সাহিত্য

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

21

Unique Visitors

219065