পনেরো বছর বয়সেই 'সাঁতারের রানি', অর্থাভাবে অলিম্পিক যাওয়া হয়নি বাণী ঘোষের
বিদিশা বিশ্বাস
April 8, 2022 at 9:34 am
ফিচার
আজ কালের কথা নয়। দেশ তখনো পরাধীন। সে যুগে মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়েদের দৌড় ঘরকন্না আর সন্তানপালনের চৌহদ্দিতেই আটকে। এমন সময় দাঁড়িয়ে বছর পনেরোর এক কিশোরী স্বপ্ন দেখছেন বার্লিন অলিম্পিকে অংশ নেবার, স্বপ্ন দেখছেন ইংলিশ চ্যানেল পার হবার - এ সত্যিই অভাবনীয়। এমন স্বপ্ন দেখবার জন্য কেবল প্রতিভা থাকলেই চলে না। সমাজ সংসারকে এক কথায় উড়িয়ে দেবার সাহসও থাকা চাই। আর সে সাহস দেখিয়েছিলেন বাণী ঘোষ। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত বাণী ছিলেন কার্যত ভারতীয় সাঁতারের রানি।
বাণী ঘোষের বাবা বেঙ্গল ন্যাশনাল ভলেন্টিয়ার কোরের মেজর দেবেশ চন্দ্র ঘোষের অনুপ্রেরণাতেই বাণী পা রাখেন খেলাধুলার জগতে। লাঠি ছুরি খেলাতেই ছিল তাঁর প্রথম অনুরাগ। পঞ্চু বল্লভের কাছ থেকে লাঠি, এস মিত্রের কাছ থেকে অসি এবং এস রায়ের কাছে ছোরা খেলার কৌশল রপ্ত করে বাণী ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। এমন সময়ই পাকচক্রে সাঁতারের দুনিয়ায় তাঁর প্রবেশ। অচিরেই একের পর এক সেরার শিরোপা নিজের ঝুলিতে ভরতে থাকলেন বাণী। প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে কলেজ স্কোয়ারের ট্যাঙ্কে ১৬ ঘন্টা অবিরাম সাঁতারের রের্কড গড়লেন। সেই সঙ্গে লাঠি ছোরা খেলাও চলতে থাকল পুরোদমে। প্রবর্তক, প্রবাসী, বিচিত্রা, বসুমতী, অমৃতবাজার, আনন্দবাজারের মত সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রে ড: যতীন্দ্রনাথ মৈত্র, মেয়র নলিনীরঞ্জন সরকার ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন বাণীকে। ভারতীয় অলিম্পিক সাঁতারের পর অমৃতবাজার পত্রিকার ২৯/১০/১৯৩৫ তারিখের কাগজে 'The Undisputed Queen' শিরোনামে বাণী ঘোষকে নিয়ে লেখা আর্টিকেল চারিদিকে সাড়া ফেলে দিল।
প্রফুল্ল ঘোষের তত্ত্বাবধানে বাণী ইতিমধ্যেই দূরপাল্লার কষ্টসাধ্য সাঁতারে যথেষ্ট পটু হয়ে উঠেছেন। একবার গৌহাটি পুলিশ রিজার্ভ ট্যাঙ্কের প্রদর্শনী সাঁতারের পর ওখানকার জনসাধারণ আবদার করে বসল - ও সাঁতার সাঁতার নয়। ব্রম্ভপুত্র নদী সাঁতার কেটে পার হতে পারলে তাকেই বলব সাঁতার। Public demand এ বাণী ভয়াবহ খরস্রোতা ব্রম্ভপুত্র পাড়ি দিলেন অনায়াসে। সাঁতার কেটে ব্রম্ভপুত্র পার হবার প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বাঙালি মেয়ে বাণী। বাণী ঘোষ যেখানেই যেতেন সেখানেই পোস্টারে প্রফুল্ল ঘোষের চ্যালেঞ্জ থাকত - যে কেউ বাণীকে হারাতে পারবে তাঁকে একটি সোনার মেডেল দেওয়া হবে। ১৯৩৭ সালে পুরীতে এক মজার ব্যাপার ঘটল। পুরীর মহারাজা বিখ্যাত চন্দনপুকুরে এক সাঁতারের আয়োজন করলেন। উড়িষ্যার লাট সাহেব থেকে আরম্ভ করে গণ্যমান্যরা সেখানে নিমন্ত্রিত। বাণী ঘোষের সঙ্গে ওখানকার সাঁতারুদের পাল্লা। কিন্তু সাঁতার আরম্ভের সময় যারা এসে পৌছল তাদের সাঁতারু না বলে সামুদ্রিক জলজীব বলাই ভাল। এলো পাঁচ ছয়জন নুলিয়া। একটি ১৫ বছরের মেয়ের সঙ্গে নুলিয়াদের প্রতিযোগিতা? লাট সাহেব ব্যাপারটি ভাল চোখে দেখলেন না। লাট পত্নীও ভ্রুকুটি মেশানো চোখে চাইলেন মহারাজার দিকে। বাণী ঘোষ যখন নুলিয়াদের হারিয়ে প্রথম স্থান দখল করলেন তখন ভাবাবেগে লাটপত্নী জলে নেমে বাণীকে কোলে টেনে নিলেন।
সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতার গ্লানিও বাণীর পিছু ছাড়েনি গোটা জীবন। কেবলমাত্র অর্থের অপ্রতুলতার কারণে অলিম্পিকে অংশ নেওয়া হয়ে ওঠেনি বাণীর। প্রফুল্ল ঘোষের তত্ত্বাবধানে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার পথে বহুদূর এগিয়েও তাঁকে অসফল হতে হয় সেই অর্থের কারণেই। আজ থেকে এতগুলো বছর আগে এক ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের মেয়ে বাণী যে পথ দেখিয়েছিলেন, সে পথ ধরেই প্রায় বছর কুড়ি পরে আরতি সাহা প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পার হবার শিরোপা অর্জন করবেন। ইংলিশ চ্যানেল পার হবার স্বপ্ন বাণী সফল করতে পারেননি ঠিকই, তাই বলে তাঁর কৃতিত্ব তাতে এতটুকুও ম্লান হয়ে যায় না।
........................
তথ্য: খেলাধূলায় বাঙলার মেয়ে/ মুকুল
আরও পড়ুন:সশস্ত্র বিপ্লবের ছক কষছেন খোদ রবীন্দ্রনাথ, অভিযোগ উঠেছিল মার্কিনি মামলায়/তোড়ি সেন