৺ওরা ‘নামে’ যেভাবে
৺ওরা থাকে ওপারে (ষষ্ঠ কিস্তি)
১.সবাই জানেন, ভূতকে চাইলে নেমন্তন্ন করে ডেকে আনা যায় এই মর্তধামে। সেই নিমন্ত্রণ-পদ্ধতির নাম ‘প্ল্যানচেট’ বা ‘সিঁয়াসে’। বাংলায় বললে ‘প্রেতচক্র’। ‘প্রেতচক্র’ নিয়ে সত্যি মিথ্যে হরেক গল্পে জমজমাট বাংলা সাহিত্য। সত্যজিৎ রায়ের গল্পে-উপন্যাসে হরবখত আসত প্ল্যানচেট। ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ উপন্যাসে প্ল্যানচেটের আসরেই ধরা পড়ে খুনির ভাঁওতা আর ‘গোরস্থানে সাবধান’-এ প্রেতচক্রের জমায়েত থেকেই ফেলুদা হাতিয়ে আনে আইভরি ক্যাস্কেট। ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’ হোক বা ‘নরিস সাহেবের বাংলো’ সব ঠিক-ভুল প্ল্যানচেটে ভর্তি! নারান গাঙ্গুলির টেনিদার ‘সাংঘাতিক’ গল্পে প্ল্যানচেট করে হারু পণ্ডিতকে ডেকে, অঙ্কের প্রশ্ন জেনে নেওয়ার প্ল্যান যেভাবে ভণ্ডুল হয়ে যায়, তা পড়তে পড়তে পেটে খিল লেগে যায়! প্ল্যানচেটকে ভর করে সিরিয়াস গল্প লিখেছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। নাম ‘দেহান্তর’।
২. ‘জীবনস্মৃতি’-তে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন তাঁর ছোটবেলার প্ল্যানচেট করার খবর আর অমিতাভ চৌধুরী ‘রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা’ বইতে বেশ রসিয়ে লিখেছেন প্রেত-চক্র–পুরোহিত রবীন্দ্রনাথের প্রৌঢ় বয়সের ছেলেমানুষির বিস্তর সংবাদ! কিন্তু ১৯৪৫ সালের ২৩শে ডিসেম্বর এক প্রেতচক্রে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই যে সাড়া দিয়েছিলেন, জানা আছে কি কারও সে কথা ? সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘পরলোকের বিচিত্র কাহিনী’ বই থেকে শুনুন তবে সেদিনের বর্ণনা – প্রশ্ন - আপনি কে ? উত্তর - আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । - আপনার মহাযাত্রার বর্ণনাটি লিখে নিতে চাই। - বেশ, লিখে নাও । আমি যখন কলকাতায় দেহত্যাগ করলুম, তখন দেখলুম যে দেহ থেকে একটা সাদা কুয়াশা যেন বেরিয়ে এলো! দেহ এখনও শয্যার উপর পড়েই ছিল। সেই কুয়াশাটা ক্রমে আমার কাছে এল… আমি তার ভিতরে প্রবেশ করলুম। তখন দেখতে লাগলুম যে আমার আত্মীয় পরিজনেরা আমার সেই দেহটি ঘিরে কাঁদছে। আমি কয়েকবার তাদের বললুম যে, ‘ওগো আমি মরিনি। এই তো আমি তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’ তারা আমার কথা শুনলো না... কাঁদতেই লাগলো - তাদের জন্য আমার বড় দুঃখ হতে লাগলো... ভাবলুম , যাক... আবার দেহটার মধ্যে প্রবেশ করি। চেষ্টা করলুম... কিন্তু কিছুতেই তা হলো না। সে-সময় আমার চেহারা ছিল ধোঁয়ার আকার... যাকে বলে, সূক্ষ্ম শরীর। হাত-পা সবই তখন আমার ছিল... কিন্তু সবই ছিল ধোঁয়ার তৈরি। আমি আমার স্থূল দেহের ভিতর প্রবেশ করতে না পেরে বিরক্ত হয়ে উঠলুম। তখন পর্য্যন্ত আমি ঠিক বুঝতে পারিনি যে আমার মৃত্যু হয়েছে! আমি মনে করছি, স্থূল দেহ থেকে বেরিয়ে এসেছি... বাইরের একটু হাওয়া-বাতাস লাগিয়েই আবার দেহের মধ্যে ফিরে যাবো।
৩. প্রেতচক্রে এসে রবীন্দ্রনাথ যদি ডিকটেশন দিয়ে থাকেন, তবে বঙ্কিম এককাঠি বাড়া! তিনি নিজেই নাকি লিখে গেছেন মরণোত্তর আত্মকথা!! রাখালদাস সেনগুপ্তর ‘মরণের পরে’ বইতে পাওয়া যাবে সে-বিবরণ। নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে অবিরত লিখতে দেখে রাখালদাস জিজ্ঞাসু হলে – নগেনবাবু বলিলেন - ‘না, আমি লিখি নাই, বঙ্কিম লিখছে । বঙ্কিম - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়… বঙ্কিম আমার বন্ধু। …বঙ্কিম আসতেই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম - তুমি কোথায় থাক, কি কর, সেখানে আর কারা সব থাকে বলতে পার? উত্তরে বঙ্কিম বলেছিল - সে অনেক কথা। বলতে পারি, লিখে দিতেও পারি। কিন্তু আমার তো লেখবার মত হাত নেই, লেখবার কোন উপকরণও নেই। তবে তোমার যদি হাতটা দাও আর কাগজ কলম বা পেন্সিল দাও তো আমি অনেক কথাই লিখে দিতে পারি। তাই আমি বঙ্কিমকে আমার হাত, কাগজ ও পেন্সিল দিয়েছি, সে লিখছে। ওর সঙ্গে আমার কোন সম্বন্ধ নেই।’ আমি কিন্তু বঙ্কিমবাবুকে দেখিতে পাইলাম না। অথচ কাগজে লেখা চলিতেছে দেখিয়া বিস্মিত হইলাম। শুনিয়াছি সেই বিদেহী আত্মার লেখা তদানীন্তন “নব্যভারত পত্রিকায়” “বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মকথা” নাম দিয়া প্রকাশিত হইয়াছিল এবং তাহার প্রথমেই বঙ্কিমবাবু লিখিয়াছিলেন -”মরণের পরেও যে কলম ধরিতে হইবে তাহা জানিতাম না।
#নিবন্ধ সিরিজ #নিবন্ধ #ওঁরা থাকে ওপারে # নির্মাল্যকুমার ঘোষ