ব্যক্তিত্ব

আগল ভাঙার দূত : ভারতের প্রথম মহিলা আইনজীবী কর্নেলিয়া সোরাবজী

টিম সিলি পয়েন্ট June 23, 2021 at 8:10 am ব্যক্তিত্ব

বহু শতাব্দীর সংস্কার-বিশ্বাসের বন্ধ আগল খোলা সহজ কথা না। নারীদের জন্য অর্ধেক আকাশের অধিকার আজও সুদূরপরাহত ঠিকই, কিন্তু আজ যে অন্তত এই কথাগুলো বলা যায় বা এই নিয়ে চিৎকারটুকু করা যায় - সেইটুকু অধিকার যাঁরা আমাদের দিয়ে গেছেন তাঁদের সংগ্রামের কথা প্রতিদিন মন্ত্রের মতো স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য। চিকিৎসা জগতে যেমন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, আইনের দুনিয়ায় তেমন কর্নেলিয়া সোরাবজী। গত শতকের গোড়াতেও মহিলারা আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পেতেন না, আর তার কয়েক দশক আগে পর্যন্ত মহিলাদের আইন পড়ারই অনুমতি ছিল না। নিয়ম ভেঙেছিলেন মহারাষ্ট্রের এক পারসি পরিবারের কন্যা, কর্নেলিয়া সোরাবজী। তিনি বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতক, পাশাপাশি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়া প্রথম মহিলা। ভারতের প্রথম মহিলা আইনজীবী তো বটেই, আরও কৃতিত্বের কথা, ব্রিটেনে ওকালতি করা প্রথম মহিলাও তিনিই।

কর্নেলিয়ার জন্ম ১৮৬৬ সালের ১৫ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের মহারাষ্ট্রে দেওলালি শহরে। তাঁর পিতা, রেভারেন্ড শোরাবজী কারসেদজী একজন খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ছিলেন। তবে দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি ছিলেন উদারনৈতিক। তবে কর্নেলিয়ার ওপর বেশি প্রভাব ছিল তাঁর মা ফ্রান্সিনা ফোর্ডের। বারো বছর বয়সে এক ব্রিটিশ দম্পতি ফ্রান্সিনাকে দত্তক নেন এবং সেই পরিবারেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। প্রগতিশীল, নারীস্বাধীনতায় বিশ্বাসী ফ্রান্সিনার চরিত্রের প্রতিফলন ঘটেছিল কর্নেলিয়ার মধ্যে। মিশনারি স্কুলের পরে তাঁর পড়াশোনা ডেকান কলেজে । ডিগ্রি কোর্সের ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। ফলে ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তিলাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হন। কিন্তু কোনও নারীকে সেই বৃত্তি দেবার চল ছিল না বলে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়। তাঁর পিতা শোরাবজী ১৮৮৮ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনকে কর্নেলিয়ার শিক্ষা সমাপ্ত করতে সাহায্য করার জন্য চিঠি লেখেন। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, অ্যাডিলেড ম্যানিং, স্যার উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন, মেরি হবহাউজ, আরথার হবহাউজ প্রমুখ অনেক বরেণ্য ইউরোপীয় মানুষজন এ ব্যাপারে তাঁদের সাহায্য করেছিলেন। এঁদের উদ্যোগেই কর্নেলিয়ার বিদেশযাত্রার খরচ যোগাতে তহবিল তৈরি হয়। ১৮৮৯ সালে শোরাবজি ইংল্যান্ডে পৌঁছান। অনেক আবেদন এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৮৯২ সালে ডিক্রি দ্বারা তাঁকে বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়, প্রথম মহিলা হিসাবে অক্সফোর্ডের সমারভিল কলেজ থেকে নাগরিক আইনে স্নাতক পরীক্ষা দেবার জন্য। 

১৮৯৪ সালে ভারতবর্ষে ফিরে এসে কর্নেলিয়া সহায়হীন নারীদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেন। ভারতীয় নারীরা সে সময় মূলত পর্দানশীন থাকতেন। অনেক ক্ষেত্রেই, এই মহিলাদের মালিকানাধীন প্রচুর সম্পত্তি ছিল, কিন্তু তা রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি পরামর্শ পাবার কোনও উপায় তাঁদের ছিলনা। কর্নেলিয়া সেই অভাব পূরণ করেছিলেন। কিন্তু আদালতে তাঁদের পক্ষ নিয়ে আইনি লড়াই লড়ার সুযোগ কর্নেলিয়ার ছিল না, কারণ তখনও তিনি পেশাদার আইনজীবী হবার ছাড়পত্র পাননি। তখন মহিলাদের আইনচর্চার লাইসেন্স দেওয়ার রীতিই ছিল না। এজন্য কর্নেলিয়া ১৮৯৭ সালে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি পরীক্ষায় এবং ১৮৯৯ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টে আইনজীবীর পরীক্ষায় বসেন। দুটি পরীক্ষাতেই তিনি সফল হন। কিন্তু কাগজে-কলমে স্বীকৃতি আদায় হলেও কর্নেলিয়াকে ব্যারিস্টার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হত না। ১৯২৩ সালে মহিলাদের আইন ব্যবসা করার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার আগে পর্যন্ত এই অবস্থাই চলছিল। অবশ্য তিনি থেমে থাকেননি।  ১৯০২ সাল থেকেই তিনি ইন্ডিয়া অফিসে আবেদন শুরু করেন আইনি উপদেষ্টা হিসাবে প্রাদেশিক আদালতে নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিনিধিত্ব করার অনুমতির জন্য। ১৯০৪ সালে বাংলার তত্ত্বাবধায়ক আদালতে তিনি মহিলা সহকারী নিযুক্ত হন। ধীরে ধীরে তাঁর কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। বাংলা ছাড়াও বিহার, ওড়িশা, এবং আসামেও কাজ শুরু করেন। এভাবে দীর্ঘ ২০ বছরে তিনি আনুমানিক ৬০০ মহিলা ও অনাথকে আইনি লড়াইয়ে সহায়তা করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে বিনামূল্যেও মহিলাদের সহায়তা দিয়েছেন। ১৯২৪ সাল ভারতবর্ষের আইনি দুনিয়ায় একটি মাইলফলক, কারণ এই বছরই মহিলাদের আইনকে পেশা হিসাবে নেবার অধিকার স্বীকৃত হয়। এরপর কর্নেলিয়া কলকাতায হাইকোর্টে কাজ করা শুরু করেন। তবে এরপরেও তাঁর জন্য কাজের উপযুক্ত অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। মামলায় সওয়াল করার বদলে, কর্নেলিয়াকে শুধু মতামত প্রস্তুত করতে দেওয়া হত। গোটা কর্মজীবন জুড়ে এইসব পুরুষতান্ত্রিক প্রতিকূলতার জগদ্দল পাথর ঠেলতে ঠেলতে তাঁকে এগোতে হয়েছে। কিন্তু লড়াই ছাড়েননি। আর ছাড়েননি বলেই মহিলাদের এই পেশায় আসার রাস্তা তৈরি হয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু বই। এছাড়া লিখেছেন গল্প, নিবন্ধ ইত্যাদি। 

আরও পড়ুন : ভারতবর্ষে আধুনিক দন্তচিকিৎসার অগ্রদূত ডঃ রফিউদ্দিন আহমেদ / টিম সিলি পয়েন্ট

১৯২৯ সালে কর্নেলিয়া কলকাতা হাইকোর্ট থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং পাকাপাকিভাবে লন্ডনে বসবাস শুরু করেন।  ১৯৫৪ সালের ৬ই জুলাই, ৮৭ বছর বয়সে তিনি লন্ডনের গ্রিন লেনের নর্দামবারল্যান্ড হাউসে নিজের বাড়িতে মারা যান। লন্ডনের লিংকনস ইন এলাকায় কর্নেলিয়ার একটি মূর্তি রয়েছে। 

....................... 

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া

 

#সিলি পয়েন্ট #ওয়েব পোর্টাল #ওয়েবজিন #Web Portal #ফিচার #Cornelia Sorabji #first female advocate #টিম সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

17

Unique Visitors

219121