আবু ঘ্রাইব: গণতন্ত্রের প্রহসন
আবু ঘ্রাইব মার্কিন গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত অস্বস্তিকর এবং একইসঙ্গে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি অধ্যায়। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পরে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন বা’থিস্ট সরকারের এই বন্দীশালাটিকে মার্কিন সেনারা একটি পুরোদস্তুর সামরিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে। ২০০৪ সালে সিবিএস নিউজ চ্যানেলে সম্প্রচারিত খবরে জানা যায়, আবু ঘ্রাইবে বন্দী একাধিক ইরাকির উপর মার্কিন সেনারা জেরার নামে শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও মানসিক নিপীড়ন চালিয়েছে এবং সগর্বে সেগুলি ক্যামেরাবন্দি করেছে। ইন্টারনেট মারফত ছড়িয়ে পড়ে আঁতকে ওঠার মতো সব ছবি - বন্দির গলায় বেড়ি পরিয়ে ছাগলের মত টেনে নিয়ে যাচ্ছেন পিএফসি লিন্ডি ইংল্যান্ড, নগ্ন বন্দিদের দিয়ে বানানো মানব পিরামিডের সামনে সহাস্যে পোজ দিচ্ছেন স্পেশাল অফিসার চার্লস গ্রেনার ও লিন্ডি, বন্দিকে নগ্ন করে তার সারা শরীরে মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে বিষ্ঠা, অথবা তার মুখে জড়িয়ে রাখা প্রস্রাব সিক্ত অন্তর্বাস। স্বাভাবিকভাবেই তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদে ফেটে পড়ে রেডক্রস ইন্টারন্যাশনাল, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রভৃতি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলি। বিশ্বব্যাপী ধিক্কারের মুখে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয় বুশ প্রশাসন। এগারোজন সৈন্য কোর্টমার্শাল ও কারাবাসের পরে বাহিনী থেকে বিতাড়িত হয়। বুশ প্রশাসন দাবি করে, আবু ঘ্রাইব একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা - তা কখনোই মার্কিন সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক আচরণ ও নীতিবোধের পরিচায়ক নয়। কিন্তু কয়েক বছর বাদে কিছু গোপন নথিপত্রের মাধ্যমে জানা যায়, ইরাক হামলার অব্যবহিত পূর্বেই নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ থেকে সেনাবাহিনীকে কিছু ‘বিশেষ তদন্ত পদ্ধতি’ প্রয়োগ করবার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। সঙ্গে এ-ও জানিয়ে দেওয়া হয় যে, জেনেভা কনভেনশন দ্বারা গৃহীত যাবতীয় নিয়ম এক্ষেত্রে খাটবে না।
বুদ্ধিজীবী মহলের মতে, আবু ঘ্রাইবের ঘটনার সামাজিক তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। মানবদেহ এখানে শুধু নিপীড়িত হয়নি, ক্যামেরাবন্দি সেই নিপীড়ন হয়ে উঠেছে বিনোদনের উপাদান। নিপীড়ন নিজেই এখানে হয়ে উঠেছে সযত্নে রেকর্ড করা প্রদর্শনমূলক বিষয়বস্তু। আধুনিক বিচারব্যবস্থা দমনপীড়ন অপেক্ষা নজরদারির উপর জোর দেয়, মিশেল ফুকোর এই তত্ত্বটিকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় এই ঘটনা। এ যেন নতুন মোড়কে সেই মধ্যযুগীয় সর্বসমক্ষে নির্যাতন প্রদর্শনের পদ্ধতিটির প্রত্যাবর্তন। আবু ঘ্রাইবের ঘটনা প্রকাশ্যে আসবার বছরেই মুক্তি পায় ‘Saw’ ছবি ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম ছবি এবং হলিউড একটি নতুন ঘরানার ছবির সঙ্গে পরিচিত হয় - টর্চার পর্ন। এই ঘরানার আরেকটি বিখ্যাত ছবি ‘Hostel’ মুক্তি পেয়েছিল ঠিক তার পরের বছরেই।
আবু ঘ্রাইবের একাধিক ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, মহিলা নির্যাতনকারী অবতীর্ণ ডমিন্যাট্রিক্সের ভূমিকায়। যৌন নির্যাতনের পরিচিত সমীকরণ ভেঙে এখানে নির্যাতিত পুরুষ, কারণ মহিলাটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। সযত্নে সংরক্ষিত ও বণ্টিত দৃশ্যগুলি যেন বুঝিয়ে দেয়, এই গোলোকায়িত সমাজের পুরোটাই আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরবন্দি, সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত হলে যে কারও উপরে যখন তখন নেমে আসতে পারে অকথ্য অত্যাচার।
আরও পড়ুন : নাটক বন্ধ কর তো! / সৌপ্তিক
আঠারো বছর কেটে যাওয়ার পরেও, আবু ঘ্রাইবের ভূত আজও আমাদের পিছু ছাড়েনি। আজ আমাদের দেশে যখন সংখ্যালঘু যুবককে পিটিয়ে মেরে বা অসহায় মহিলাকে ধর্ষণ করে সেই নারকীয় দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করা হয়, আমরা বুঝতে পারি, আবু ঘ্রাইব নির্যাতনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। নাবালিকা আসিফার ধর্ষণের পর তাই পর্ন সাইটের সার্চ তালিকায় শীর্ষে থাকে সেই দৃশ্যের ভিডিও। উত্তরাধুনিক সমাজের কাছে আজ নির্যাতনের দৃশ্যও একটি ভোগ্যপণ্যবিশেষ। আবু ঘ্রাইব ও আফগানিস্তান ইরাক যুদ্ধের অন্যান্য ঘটনা তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। তৈরি হয়েছে ‘বয়েজ অফ আবু ঘ্রাইব’, ‘জারহেড’, ‘আমেরিকান স্নাইপার’ প্রভৃতি একের পর এক ছবি। ভিয়েতনামের মতোই আজ আফগানিস্তান ও ইরাক যেন মার্কিন সুশীল সমাজের কাছে আত্মসমীক্ষার অপর নাম। অতি সম্প্রতি মার্ভেল নির্মিত ‘দ্য ফ্যালকন অ্যান্ড দ্য উইন্টার সোলজার’ সিরিজেও দেখা গেছে, আফগানিস্তান ফেরত জন ওয়াকার ক্যাপ্টেন আমেরিকার তকমা পাবার পরেই সর্বসমক্ষে পিটিয়ে হত্যা করে এক ব্যক্তিকে, অনিবার্যভাবে উঠে আসে আবু ঘ্রাইব, গুয়ান্তানামো বে প্রভৃতি সামরিক বন্দিশালার অস্বস্তিকর অনুষঙ্গ। আবু ঘ্রাইব তাই কোনওভাবেই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তা আমাদের এই উত্তরাধুনিক গোলোকায়িত সমাজের প্রচার করা তথাকথিত গণতন্ত্রের ধারণাটিকে প্রশ্ন করতে শেখায়।
.....................................
[পোস্টার : অর্পণ দাস]