হাওয়া-জল খেয়ে দিন কাটানো মানুষদের কথা
আকাহি রিকার্ডো আর ক্যামিলা ক্যাস্টেলো সুখী এক দম্পতি। আলাপ-পরিচয় হওয়ার বছর তিনেক বাদে ওঁরা বিয়ে করেন, ২০০৫ সালে। এখন থাকেন কানাডায়। আর পাঁচটা দম্পতির চেয়ে ওঁরা আলাদা, এবং খবরে আসবার মতো যে কাজটা ওঁরা করেছেন, তা হল ওঁরা বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, যাঁরা নিজেদের বলেন ‘ব্রেথারিয়ান’ (Breatharian)। ওঁরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে সুস্থভাবে জীবনযাপনের জন্য দরকার নেই কিচ্ছু খাওয়ার। কিছু নির্দিষ্ট নিয়মে আসন করে আর স্রেফ সূর্যের অপর্যাপ্ত আলো আর অফুরন্ত বাতাস, এই দুটো জিনিস শরীরে জুটে গেলেই দিন কাটানো যায় সুস্থভাবেই! যাচ্ছেও। অন্তত এই দম্পতির মতো বেশ কয়েকজনের ক্ষেত্রে।
এমনিতে এই মহাবিশ্ব ছোট নয় নেহাত। আর সেই মহাবিশ্বের এক কোণে থাকা ক্ষুদ্র এক প্রজাতি আমরা, এই মানুষ। মহাবিশ্বের যে অসীম শক্তির ভাণ্ডার, তাকে যদি ঠিকঠাক ভাবে কাজে লাগানো হয়, তবে তো কষ্ট করে খাবার তৈরির দরকারই পড়ছে না আর। ঠিক যেমনটা মেনে চলছেন এই দম্পতি, তেমনটা অনুসরণ করে গেলেই হয়। এতে খরচ যেমন বাঁচে, তেমনই বাঁচানো যায় দিনের অনেকটা সময়। আর এড়ানো যায় রান্নার মতো বিরক্তিকর একটা কাজের বোঝাও।
না, এ কোনো কল্পকাহিনী নয়; একেবারে বাস্তব। ওই দম্পতি গত ২০০৮ সাল থেকে প্রায় কিছুই না খেয়েই টিকে রয়েছেন এখনও পর্যন্ত। সুন্দর, স্বাভাবিক শরীর। তবে একেবারে কিচ্ছু খান না বলাটা ভুল, ওঁরা সপ্তাহে বড় জোর এক বা দু-বার একটা ফল বা একটা কোনো সবজি খান, তাও নেহাত ইচ্ছে হলে বা কোথাও নেমন্তন্ন রক্ষা করতে গেলে তবেই। ওঁদের এক পাঁচ বছরের ছেলে আর দু-বছরের মেয়েও রয়েছে, এখনও পর্যন্ত সকলেই সুস্থ। আরও আশ্চর্যের, ওঁদের দাম্পত্যজীবনের অন্যসময়ের কথা বাদ দিলেও ক্যামিলা গর্ভবতী হয়ে থাকার যে ন-মাস সময়কাল, তখনও এই নিয়মই কড়াভাবে অনুসরণ করেই চলেছিলেন তিনি। কালেভদ্রে হয়তো একটু ফল বা একটু জুস, এই-মাত্র খেতেন তখন; আর আশ্চর্য এই যে প্রথম সন্তান জন্মানোর কিছুদিন পরেই তাঁর শরীরের আকার আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এজন্য কোনো শারীরিক সমস্যাই হয়নি।
ওঁদের বক্তব্য, কেন মিছিমিছি খাবারের পিছনে গাদাগাদা খরচ করা? ওই সময়টাকে যদি ধ্যান বা ওরকম কোনো মানসিক শান্তিদায়ক কাজে লাগানো হয়, আর ওই বাঁচানো টাকাটাকে নিয়ে যদি ভ্রমণ-কাজে লাগানো যায়, তাহলে কত সুখেই না কাটে জীবন! শরীর আর মন, দুটোই থাকে চাঙ্গা, তরতাজা।
এটাই ব্রেথারিয়ানদের মূল মন্ত্র। নিয়মটা মোটামুটি এইরকম: প্রথম দিকে খাওয়া আস্তে আস্তে কমানো, তারপর আমিষ বন্ধ করা, তারপর ভেগান ডায়েট, তারপর স্রেফ ফল খেয়ে কয়েক দিন কাটিয়ে শুরু হয় ব্রেথারিয়ান পদ্ধতি।
প্রথমে সাত দিন বাতাস ছাড়া কিচ্ছু খাওয়া যাবে না। এর পরের সাত দিন সামান্য জল আর ফলের রস তাও পাতলা। আর এরপরের সাত দিনও চলবে এই খাবারই, তবে আরও অনেক অল্প পরিমাণে। এই একুশ দিন কাটলে এরপর নাকি খিদে আর থাকবে না, খাবার ইচ্ছেটাই যাবে কমে। এরপরে ওঁরা পুরোপুরি বন্ধ করে দেন সলিড খাবার। টানা তিন বছর সেরকম কিছুই খাননি।
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বাচ্চা দুটিও কি এই পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে? ওঁরা জানাচ্ছেন, না। ওদের এখন কোনোভাবেই জোর করে না খাইয়ে রাখা হয় না। ওরা স্বাভাবিকভাবেই খায়। তবে দম্পতির ইচ্ছে, ওরা যখন আরও একটু বড় হবে, ওদেরকেও এই পদ্ধতির সুফল বোঝানোর চেষ্টা করবেন। তখন যদিও ওরাও এই পদ্ধতি মেনে চলতে ইচ্ছুক হয়, ওদের শেখানো হবে।
২/
‘ব্রেথারিয়ানিজম’ (Breatharianism) মতবাদে বিশ্বাসীরা হিন্দু ধর্মের নানা তত্ত্বে বর্ণিত প্রকৃতির ‘প্রাণ শক্তি’ কথাটায় বিশ্বাস করেন। সূর্যের আলো বা বাতাস, এই ধরনের জিনিসের মধ্যেও রয়েছে প্রাণ শক্তি, তাই ও ধরনের জিনিস শরীর গ্রহণ করতে পারলে আর দরকার পড়ে না কোনো খাবারের— ধারণা ওঁদের। সেই সত্তরের দশক থেকে আমেরিকায় তৈরি হয়ে আছে ‘ব্রেথ্রারিয়ান ইনস্টিটিউট অব আমেরিকা’, যেটা বানিয়েছিলেন উইলি ব্রুকস নামে এক ব্যক্তি। ইনি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে এসে একাধিকবার দাবি করেছিলেন যে তাঁর জীবনের প্রায় কুড়ি বছর কাটছে পুরোপুরি আলো আর বাতাসের ওপর। তবে পরে ইনি যে ভণ্ড এবং মিথ্যেবাদী সেটাও জানাজানি হয়ে গিয়েছিল সকলের কাছে। লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁর খাওয়ার ছবি ছড়িয়ে পড়বার পরে এই বিপত্তিটা ঘটে।
এবার আসা যাক সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায়। সকলেই যে এই পদ্ধতি মেনে খুব সুখে-শান্তিতে আছেন, এমনটা নয় কিন্তু। ব্রেথারিয়ান পদ্ধতি মেনে চলতে গিয়ে মারা পর্যন্ত গেছেন, এমন উদাহরণ রয়েছে বইকি। এক উনপঞ্চাশ বছরের অস্ট্রেলিয়ান মহিলা ভেরিটি লিন প্রয়াত হন ১৯৯৯ সালে, মৃত্যুর কারণ হিসেবে জানা যায় ডিহাইড্রেশন আর হাইপোথার্মিয়া। তাঁর কাছে পাওয়া গিয়েছিল একটি বইও, ‘living on Light: The Source of Nourishment for the New Millenium’, বিষয় দেখে নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছে যে এটা ব্রেথারিয়ান গোষ্ঠীর কাছে বাইবেল-স্বরূপ একটি বই। ভদ্রমহিলার শরীর না-খেয়ে থাকাটা সহ্য করেনি, কী আর করা যাবে!
আবার সুস্থ রয়েছেন এমন উদাহরণও বিরল নয়। এই লেখার শুরুর ওই দম্পতি ছাড়াও আমরা বলতে পারি আরও একজনের নাম— নিকোলাস পিলার্তজ। ফ্রান্সে জন্ম হলেও ইনি থাকেন ইতালিতে। ‘লিভিং অন লাইট’ নামে একটি ডকুমেন্টারি সিনেমা দেখে এঁর জীবনের গতিপথ বদলে যায়, এখন এঁর বয়স পঞ্চাশ, নিজেই দাবি করেন যে সপ্তাহে একদিন মাত্র সলিড খান, বাকি সময়ে স্রেফ তরল পদার্থ খেয়ে কাটিয়ে দেন। এইভাবেই চলছে গত দশ বছর। জীবন-যাপন স্বাভাবিক, যোগ-ব্যায়াম করেন না বিশেষ। প্রথম দিকে বেশ অনেকটাই ওজন কমে গিয়েছিল, পরে সেটা কাটিয়ে উঠেছেন। কেন অন্য অনেকে এই ধরনের পদ্ধতি মেনে চলতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলেন, এর জবাবে ইনি জানান যে ফুটবল খেলতে গিয়েও তো হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এমন উদাহরণ আছে। তাহলে কি ধরে নেওয়া হয় যে ফুটবল খেললে হার্ট অ্যাটাক হয়? তাঁর আরও বক্তব্য, যদি কারও আগে থেকেই শরীরে কোনো রোগ বাসা বেঁধে থাকে, তবে তাঁর এই পদ্ধতি মেনে চলা উচিতই নয়। আর অন্য অনেকে যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ব্রেথারিয়ান পদ্ধতি অনুসরণ করেননি, যে কারণে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।
সুতরাং যাঁরাই এই পথে আসতে চাইবেন, আগে ব্যাপারটা ঠিকঠাক বুঝে নিয়ে, প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এবং যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে তবেই আসা উচিত বলে মনে করেন এঁরা। আর এমনিতে আমাদের সমাজে যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে বা আড্ডায় বা সামাজিক জমায়েতে খাওয়াটাই প্রাধান্য পায়, সুতরাং ব্রেথারিয়ানিজমের ভক্ত হয়ে পড়লে সেরকম অনুষ্ঠানগুলোয় নিঃসঙ্গ আর অস্বস্তিতে পড়বার সম্ভাবনা ষোল আনা, এটাও মাথায় রাখা উচিত।
৩/
কিন্তু কী বলছে বিজ্ঞান? বা ডাক্তারিবিদ্যা? সত্যিই কি এইভাবে উপবাসে থেকে খুব সামান্য খাবার পেটকে দিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখা সম্ভব? ডাক্তাররা বলেন, জল না খেয়ে তিন থেকে চার দিন সুস্থ থাকা সম্ভব, আর খাবার না খেয়ে থাকা যায় আট থেকে দশ দিন মাত্র। আমাদের বাঙালি বিপ্লবী যতীন দাস একটানা তেষট্টি দিন অনশন করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, সেই ঘটনাই তাঁকে অমর করে দিয়েছে। তবে এতদিন ধরে না খেয়ে থাকা সত্যিই অসম্ভব। শরীরের প্রাথমিক বিকাশের জন্য কিছু ধরনের খাবার আমাদের দরকার পড়েই। সেই যে ছোটবেলায় পড়েছিলাম: শর্করা, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, খনিজ মৌল আর জল— এই ছ-ধরনের বস্তু যেন রোজকার খাবারে কম-বেশি থাকে, তবে শরীরের দরকারি পুষ্টি ও বিকাশ ঘটবে। ব্রেথারিয়ানিজমে বিশ্বাসীরা এই নিয়মের তোয়াক্কা না করেই সামান্য খাবার আর সামান্য জল খেয়েই নাকি কাটিয়ে দিচ্ছেন বছরের পর বছর, শুধু নিজেরাই নন; এঁরা আবার দল ভারী করবার চেষ্টাও করছেন।
ব্রেথারিয়ান মতবাদ আগামী দিনে টিকবে কি না, তা সময়ই বলবে। আর আমাদের দেশে এমনিতেই প্রচুর মানুষ অনাহারে বা স্বল্পাহারে থাকতে বাধ্য হন, সুতরাং আশা করা যায় যে আমাদের দেশে এই পদ্ধতির বহুল প্রচার ঘটলে ওই মানুষরা সবচেয়ে আগে এই পদ্ধতিতে যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে চাইবেন। অবশ্য সেটা হলে তা হবে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
………………………………