বেদনাবিহীন এক ব্যতিক্রমী
ছবি: মর্দ কো দর্দ নহি হোতা মুক্তি: ২০১৮ চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: বসন বালা প্রযোজনা: রনি স্ক্রুওয়ালা অভিনয়: অভিমন্যু দাসানি, রাধিকা মদন, গুলশন দেবাইয়া, মহেশ মঞ্জরেকর
মনে পড়ে সলমান রুশদির মিডনাইট’স চিলড্রেন উপন্যাসের নায়ক সলিম সিনাইয়ের কথা? জন্ম থেকেই তার সমস্যা ছিল অতিকায় নাক নিয়ে, কখনও তা ছিল অবিরাম এবং অস্বস্তিকর সর্দির উৎস, কখনও বা সারা ভারতের মানুষের গোপন ভাবনা জানবার জাদু দরজার চাবিকাঠি। বসন বালার মর্দ কো দর্দ নহি হোতা ছবির নায়ক সূর্যা সলিমের মতোই বম্বে থুড়ি মুম্বইয়ের ছেলে, নাকের বদলে তার সমস্যা গোটা শরীর জুড়েই, জন্মাবধি সে কোনোরকম ব্যথা অনুভব করে না। পুরুষের বেদনাবোধ থাকতে নেই, দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় মননে গেঁড়ে বসে থাকা যে ভাবনা ভিক্টোরিয় যুগে প্রায় স্বতঃসিদ্ধান্তের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, সেই ধারণার গালে সজোরে থাপ্পড় কষান পরিচালক যখন বাল্য অবস্থাতেই নায়ক বলে ওঠে, ‘আমার কোনো বেদনাবোধ নেই। এটা কোনো সুপার পাওয়ার নয়, একটা ব্যাধি।’ ‘দুঃখেনুদ্বিগ্নমনা সুখে বিগতস্পৃহ’, অ্যাবসার্ড নাটকের মূলমন্ত্রও সেটাই নয় কি?
উত্তরাধুনিকতাবাদ সংস্কৃতির শ্রেনিবিভাজনে বিশ্বাস করে না, অবহেলার বদলে জনসংস্কৃতির মোহিনী শক্তিকে সে জানায় সশ্রদ্ধ কুর্নিশ, আবার তথাকথিত কালচার কাকুদের ঔদ্ধত্যের সম্মুখে বের করে আনে ব্যঙ্গের শাণিত তলোয়ার। নায়িকা সুপ্রির মুখে তাই শোনা যায় উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতির অধুনা ধ্বজাধারী রুমির কবিতা নিয়ে খিল্লি। রুশদির সলিম ভক্ত ছিল মুম্বই সিনেমার, সূর্যার যাবতীয় আগ্রহের কেন্দ্র দেশবিদেশের অ্যাকশন ফিল্ম, সেখানে ব্রুস লি’র কিংবদন্তি এন্টার দ্য ড্রাগন ছবির পাশেই সদম্ভে উপস্থিত কমল হাসনের গিরেফতার। ছবির এক তৃতীয়াংশ জুড়ে বি গ্রেড হিন্দি ছবির নিয়ম মেনে হাজির ধুন্ধুমার অ্যাকশন, যদিও ফাইট ডিরেক্টর কুশলী ছোঁয়ায় প্রত্যেকটি ফ্রেম চোখধাঁধানো সুন্দর। একাধিক সিকোয়েন্সে ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে চালু হিন্দি ছবির গান, বাজারের চেনা ছকের আদলে রয়েছে মাতৃহীন নায়ক, মদ্যপ বাবা, ভালো/খারাপ যমজ ভাই, মার খেয়ে উল্টে পড়ার জন্য একরঙা পোশাকে গুণ্ডার দল, এমনকি রোমান্টিক কমেডির অতিপরিচিত এয়ারপোর্ট সিন। আর উত্তরাধুনিক শিল্পের নিয়মে আছে প্রতিটি ফ্রেমে অসাধারণ রসবোধ, গভীর সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, প্যারডি ও প্যাস্টিশ। বাস্তব জীবন বড় রূঢ়, এখানে জুতোয় ভিডিও টেপ জড়িয়ে পড়ে গিয়ে নায়কের বাবার হাত ভেঙে যায়, ক্যাসেটের সর্বশক্তিমান কারাটে ম্যান পরিণত হয় মদ্যপ ভগ্নস্বাস্থ্য হতোদ্যম প্রশিক্ষকে। জনসংস্কৃতিকে প্রতিটি মুহূর্তে মান্যতা দেয় যে ছবি, সে কী করে অগ্রাহ্য করে সমসাময়িক বহুজাতিক শহরগুলির শিশুদের মনে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী সুপারহিরোর মিথগুলি? সূর্যার মায়ের মৃত্যু ঘটেছিল হার ছিনতাইকারীদের পাল্লায় পড়ে, সুপ্রিকে সে বারেবারেই বলত চোখ থেকে লেসার রশ্মি নিক্ষেপ করবার জন্য। আজ্ঞে হ্যাঁ, এ ছবির মারকুটে নায়ক নায়িকার পিছনে দাঁড়িয়ে বিপুল জনপ্রিয় দুই মার্কিন সুপারহিরোর ছায়া- ব্যাটম্যান ও সুপারম্যান।
মধ্যবিত্ত মূল্যবোধলালিত চিরাচরিত ধারণাগুলিতে প্রতি মুহূর্তে আঘাত হেনেছে এই ছবি। তাই সূর্যার ঠাকুর্দা এখানে গ্রামভারী গুরুজন নয়, মনের দিক থেকে সতেজ এই বৃদ্ধ নিঃসঙ্গ কিশোরের সবচেয়ে বড় সহমর্মী বন্ধু। সূর্যার বাবার নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটিকে বিন্দুমাত্র মেলোড্রামার ব্যবহার না করে দেখানো হয়েছে গভীর বাস্তববোধ ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে, যার পুরোটাই এসেছে হাসির মোড়কে। লিঙ্গবৈষম্যের চেনা ছকের মুখে ছাই দিয়ে নায়ক এখানে শিশুসুলভ, আবেগতাড়িত, অন্যদিকে নায়িকা অনেক বেশি বাস্তববোধসম্পন্ন ও সপ্রতিভ, হিন্দি ছবির কুণ্ঠায় ভরা যৌনমিলনের দৃশ্যগুলিকে দশ গোল দিয়ে এখানে সুপ্রি নিজেই সূর্যাকে কাছে টেনে নেয়। সূর্যা ও সুপ্রির ভূমিকায় যথাযথ অভিনয়ের পাশাপাশি অভিমন্যু দাসানি ও রাধিকা মদন আলাদা করে নজর কেড়েছেন অ্যাকশনের সাবলীল দৃশ্যগুলিতে, গুলশন দেবাইয়া ও মহেশ মঞ্জরেকর যথারীতি দুর্ধর্ষ। ভালো লেগেছে প্রেরণা সায়গলের টানটান সম্পাদনা ও করণ কুলকার্নি-দীপাঞ্জন গুহ’র ঝকঝকে সঙ্গীত, বিশেষ করে ‘নখরেওয়ালি’ গানটি শ্রোতার প্রশংসা আদায় করবে নিশ্চিতভাবেই। সর্বোপরি বলতে হবে ছবির পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার বসন বালার কথা, একটেরে দেশপ্রেম, গ্যাদগেদে প্রেমকাহিনি বা মোটা দাগের হাসির বলিউডের চেনা ধাঁচ চুরমার করে যিনি দুর্দান্ত বুদ্ধিদীপ্ত একটি ছবি উপহার দিয়েছেন দর্শককে। এ ছবি মুক্তির পর সেভাবে কোনো আলোচনাই হয়নি, এটা অবশ্যই দুঃখের কথা।