বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

একটি মানবিক সমস্যা

অনর্ঘ বিশ্বাস Sep 29, 2020 at 8:00 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি


“এই যে শুনছেন? একটা ভালো উপায় বাতলান তো।”
“কীসের উপায়?”
“ঐ যে, কী যেন বলে না, পেস্ট কন্ট্রোল! কোথায় সাহায্য পাওয়া যায় বলুন তো? আর পারা যাচ্ছে না, বিশ্বাস করুন। সংখ্যায় যা বেড়েছে, মানে আর কী বলব? হেন জায়গা নেই যেখানে পৌঁছয়নি। তার উপর সর্বভূক, যা পায় তাই খায়! কিভাবে যে এদের আটকাই, ভেবে পাচ্ছি না।”
“বাসাগুলো খুঁজে খুঁজে ভেঙ্গে দিন, না হয় জ্বালিয়ে দিন। নিদেনপক্ষে জল ঢেলে দেখুন”।
“সব করেছি। কিছু মরে ঠিকই, কিন্তু যে হারে পয়দা হচ্ছে তাতে ঐ ছোটোখাটো টোটকাতে কিছু হবে না।”
“এক কাজ করুন, দু’দলের মধ্যে লড়াই লাগিয়ে দিন। শুম্ভ-নিশুম্ভের মতো নিজেরাই ক্যালাকেলি করে কেলিয়ে যাবে!”
“গ্রেট আইডিয়া, বাট অলরেডি অ্যাপ্লাইড। বেশ কয়েকবার ভালো ফলও পেয়েছিলাম, জানেন? তবে মালগুলো হেব্বি ঢ্যাঁটা তো, ইদানীং আর সে পথ মাড়ায় না। মানে ছোটোখাটো লড়াই যে হচ্ছে না, তা নয়, তবে আশানুরূপ রেজাল্ট নেই।”
“আচ্ছা খাবার যাতে না পায় তার ব্যবস্থা করলে হয় না?”
“করেছি তো, ফি বচ্ছর বেশ কিছু অক্কা যাচ্ছে তাতে। কিন্তু বাকিগুলো এমন সব জায়গায় ঢুকে বসে আছে না, কী বলব! খাবারও পাচ্ছে, এমনকি যারা পাচ্ছে না, তাদের সাপ্লাইও করছে! আমার হয়েছে যত জ্বালা, সবাইকে দেখে রাখতে রাখতে আর পেরে উঠছি না।”
“তা হলে এক-আধটা বায়োলজিকাল এজেন্ট ঝেড়ে দিন। চরম এফেক্টিভ।”
“হুঁ, ভালোই বলেছেন। আগেও ক’বার বেশ কাজে দিয়েছিল।”
“আহা, একই ওষুধ কিন্তু বার বার কাজ করবে না। অ্যাডাপ্ট করে নেবে। বিভিন্ন ডোজে দেবেন, বুঝলেন?”
“জানি, জানি। পেটে পেটে শয়তানি সবকটার। মাথা কেটে দিলেও, বিশল্যকরণী লাগিয়ে হাইড্রা মার্কা রিবাউন্ড করে কী করে, বুঝতেই পারি না! মাঝেমধ্যে মায়াও হয়। কিন্তু যখন দেখি, একে অন্যকে কাঠি করতে করতে নীচতার শেষ সীমা পেরিয়ে গেছে, ধ্বংস করছে যা কিছু সভ্য ও সুন্দর, তখন ভাবি – দেব নাকি ঝেড়ে সেই আল্টিমেট অস্ত্রটা!”
“সেই, সেইটার কথা বলছেন নাকি? উফ্, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার! সে তো মশাই লেজেন্ডারি ব্যাপার! সেবার যখন টিকটিকি-গিরগিটিতে ছেয়ে গেছিল, যা একখানা ঝেড়েছিলেন না! পুরো রজনীকান্তের অ্যাকশন। এখনও মুখে মুখে ফেরে গল্পটা।”
“অতো হাসবেন না তো বাপু। টিকটিকিগুলোকে সাফ করার পরেই তো এই দু’পেয়েগুলোর বাড়বাড়ন্ত হল। এদের সরালে, না জানি কীসব আসবে আবার!”
“আহা! চিন্তা কীসের? সময় লাগবে তো। আগের বার যেমন লেগেছিল, প্রায় কুড়ি কোটি বছর!”
অলীক আলাপচারিতা।


সঙ্গে ক’টা পরিসংখ্যান দিচ্ছি, সেগুলো খাঁটি বাস্তব। পৃথিবীর ইতিহাসে কতবার প্রাণের ব্যাপক বিলুপ্তি (Major Mass Extinction) হয়েছে তারই হিসেব -


(সৌজন্যে Wikipedia এবং Encyclopedia Britannica)


উপরোক্ত পাঁচটি বিলুপ্তির পর বিজ্ঞানীরা বলছেন আরও একটি mass extinction-এর কথা। Anthropocene extinction, যা এই সময়ে চলছে এবং যার কারণ – মানুষ ও তাঁর কার্যকলাপ!

না না, শিল্পবিপ্লবের পরের কথা নয়, তার আগে থেকেই মানুষ কিন্তু প্রাণীকুল ও বৃক্ষপ্রজাতিকে ধ্বংস করে আসছে। আপনি বলবেন, সে তো যে কোনো শ্বাপদের ধর্ম; তৃণভোজীরাও গাছ খেয়ে সাবড়ে দেয়। পার্থক্য আছে। শ্বাপদ শিকার করে অপরিণত, বয়স্ক কিংবা আহত পশুকেই। দশবারের মধ্যে সাড়ে ন’বার তারা প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ-সবল প্রাণীকে এড়িয়ে চলে; অনেকটা সেই সোনার ডিম দেওয়া হাঁসের মতো। প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণীটি বেঁচে থাকে, বংশকে এগিয়ে নিয়ে যায়, শিকারের সংখ্যা সরলরেখায় বাড়ে।

তৃণভোজীরাও গাছ পুরো মুড়িয়ে খায় না। গাছও তো জ্যান্ত, সেও জানে কী করে গোল না খেয়ে থাকতে হয়। একটা উদাহরণ দিই – মানুষের যেমন মোবাইল, গাছেদের তেমন বাতাসিয়া বার্তা আদানপ্রদানের চমৎকার ব্যবস্থা আছে। আছে কিছু বিশেষ হরমোন, ফেরোমোন বা বৃক্ষরস, যাতে খবর ভরা থাকে; বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে একে অপরকে কুশল মঙ্গল জানায় তারা। ধরুন আফ্রিকার সেরেঙ্গেটিতে একদল জিরাফ, তাদের লম্বা গলা বাড়িয়ে বেগুনি জিভ লকলকিয়ে, কচি কচি অ্যাকাশিয়া বা আকাশমণির পাতা (কাঁটা বেছে!) ছিঁড়ে হেব্বি ফিস্টি লাগিয়েছে। দেখতে দেখতে গোটা আষ্টেক গাছের কচি পাতাটাতা সব ন্যাড়া, শুধু কাঁটা দিয়ে আর আটকানো যাচ্ছে না। তা হলে উপায়? উপায় হল ট্যানিন। আরে চা-পাতায় যে জিনিসটা থাকে, বেশি ভিজে গেলে চা তেতো হয়ে যায় এর জন্যই। তা অ্যাকাশিয়ার পাতাও ট্যানিন বানাতে ওস্তাদ। মানে এ্যায়সা লেভেলে র‍্যাপিড প্রোডাকশন করতে পারে যে, মিষ্টি কচি পাতা কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো নিমের পাঁচন! যেই না গাছে জিরাফ জিভ লাগালো, গাছ ঐ ফেরোমোন ছড়াতে শুরু করল, অর্থাৎ গাছের ভাষায় চেঁচাতে থাকল – “খাইসে, জিরাফ আইসে!” সেই ফেরোমোন বাতাস বয়ে পৌঁছল অন্য গাছে, যারা খবর পেয়েই শুরু করে দিল ট্যানিনের কারখানা। সবুজ পাতা, ‘খয়ের খাঁ’ হয়ে জিরাফের জিভের দফারফা করতে তৈরি হয়ে গেল। পুরো ব্যাপারটা ঘটতে সময় লাগল আনুমানিক আধঘন্টা। জিরাফরাও কম যায় না, মিনিট কুড়ির বেশি একই গাছে নৈব নৈব চ! তারপরেই তারা চলে যায় অন্য গাছে, হাওয়ার উল্টো দিকে। সে গাছগুলো বেচারা খবর পায় নি, তাদের ট্যানিন শিল্পে তখনও লকডাউন। সব মিলিয়ে, জিরাফের পেটও ভরল, অ্যাকাশিয়াও দিব্যি টিকে রইল। এভাবে দেখলে মনে হয়, প্রকৃতি যেন কমল গুহর স্কিল নিয়ে পায়ের পাতায় বল ব্যালান্স করে রেখেছে।

সবই বেশ ট্রাপিজের তারে রাখা ছিল, শুধু ছক ভেঙ্গে ঢুকে পড়লাম আমরা। সব নিয়ম তছনছ করাতেই আমাদের পারঙ্গমতা। এমনি এমনি শিকার করলাম সবচেয়ে বড় প্রাণীগুলোকে, যাতে বাচ্চাগুলো না খেতে পেয়ে মরে। শুধু বন্দুক নয়, যখন কিছুই ছিল না প্রায়, তখন পাথর ছুঁড়ে কোণঠাসা জানোয়ার মারলাম ইচ্ছেমতো। দলে দলে ম্যামথকে পাহাড় থেকে তাড়া করে ফেলে দিলাম, মজার ছলে। আর গাছের কথা আলাদা করে কী বলব? যেখানে ডাল কাটলে হত, পুরো গাছটাই কেটে ফেললাম। কারণ – পারি, তাই! ফাঁকা ময়দান বানালাম মহীরুহদের উপড়ে – উদ্দেশ্য, ঘাস গজাবে আর তার বীজটাকে সেদ্ধ করে খাব। সে ঘাস যে কালে কালে তার শিকড়ে আমাদেরই বেঁধে ফেলবে, তা বুঝিনি। য়ুভাল নোয়াহ্ হারারি-র মতে “Humans were domesticated by wheat and not the other way around” – মানুষকে গৃহপালিত করেছে গম, যব, ভুট্টা, ধান এই ঘাসগুলো। এদের বাঁচাতে গাছেদের মেরেছি গোড়া কেটে। ফেরোমোন ছড়িয়ে খবর পাঠিয়েছিল কিনা কে জানে। হয়তো বলেছিল, ‘জিরাফে আছি, বাঁদরে নেই’।

Anthropocene Extinction-এর বাংলা সম্ভবত নৃতাত্ত্বিক বিলুপ্তি, একে মানবিক বিলুপ্তিও বলা যায় কি? ম্যামথ, বিশালাকায় শ্লথ, বিরাট পাখি, এখনকার বাঘ-সিংহ-হাতি সবাই যার সাক্ষী ও ভুক্তভোগী।

আরেকটা পরিসংখ্যান দিলাম – পৃথিবীর স্তন্যপায়ীদের সংখ্যা সংক্রান্ত।

বর্তমান পৃথিবীর মোট স্তন্যপায়ী প্রজাতির সংখ্যা – ৫৪৮৮

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মোট সংখ্যা - ১৩০০০ কোটি

মোট সংখ্যার বিচারে প্রথম দশটি প্রজাতিকে ঊর্ধ্বক্রমে সাজালাম। বলে রাখা ভালো, সব কটি প্রাণীই কিন্তু গৃহপালিত।


কিছু বুঝলেন? স্তন্যপায়ী যুগের শেষ প্রান্তে এসে গেছি আমরা। ডাইনোসররা সাড়ে ষোলো কোটি বছর ধরে পৃথিবী শাসন করেছিল। তারাও এত ব্যাপক বংশ বিস্তার করেছিল কিনা সন্দেহ আছে, মাত্র আঠাশ লক্ষ বছরে আমরা যা করেছি! পৃথিবী কিন্তু নিয়ম মেনেই প্রতিষেধক বার করেছে – ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ঘূর্ণিঝড়, মহামারী মায় পঙ্গপাল পর্যন্ত – সবচেয়ে বড় ভাইরাস থেকে বাকিদের বাঁচাতে।

সমস্যাটা একান্ত ভাবেই জৈবিক, তাই সমাধানটাও জৈবিক হওয়া দরকার; ধর্মীয় নয়, অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক তো নয়ই। দশ কম্যান্ডমেন্ট বা দশমহাবিদ্যা, দাস ক্যাপিটাল হোক অথবা চন্ডীদাসের পদ, সন্ন্যাসীকে ফেরারি বেচার মন্ত্র থেকে মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালাদের সিক্স সিগমা সার্টিফিকেট – কেউ কিছুমাত্র পথ বলতে পারছে না। একমাত্র ভরসা এখন এইচ. এম. এস. বীগলের সেই বছর বাইশের ছোকরা, চার্লসের ১৯৩৮-এর থিয়োরি! প্রকৃতিকেই বেছে নিতে বলি তাহলে?


#Science #Darwin #Evoluion #Major Mass Extinction #Anthropocene extinction #ফেরোমোন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

32

Unique Visitors

219175