ভুলতে বসা এক বাঙালি শিল্পোদ্যোগী : যন্ত্রকারিগর জগদীশ্বর ঘটক
বাঙালি সম্পর্কে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে নতুন ব্যবসা বা শিল্পোদ্যোগে বাঙালি আগ্রহী নয়। তুলনামূলক ভাবে শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতে অনেক বেশি সাবলীল। বাঙালির ইতিহাস কিন্তু এমন একপেশে কথা বলে না।
আসলে বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস ও বিবর্তন যতটা চর্চিত, বাণিজ্য বা শিল্পস্থাপনের ইতিহাস আজও ততটা প্রচারের আলো পায়নি। এই বিষয়ের ইতিহাস খানিক ঘাঁটলেই দেখা যাবে, উনিশ শতকের শেষদিকে বাংলায় গড়ে উঠেছিল অজস্র ছোটো ছোটো কারখানা ও ক্ষুদ্র-শিল্প। এই কারখানাগুলি চালাতেন বাঙালিরাই, এমনকী কারখানার যন্ত্রপাতিও তৈরি করেছিলেন নিজেরাই। ফলে কারিগরিবিদ্যায় বাঙালির উদ্ভাবনী বুদ্ধি যে নিতান্ত হেলাফেলা করার মতো ছিল, তা নয়।
প্রাচীন ঘরোয়া পদ্ধতির পরিবর্তে উৎপাদনে দরকার সংগঠিত ব্যবস্থা-কারখানাতে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। এদেশে কারখানা স্থাপনের শুরুও ব্রিটিশদের হাত ধরেই। বাংলার প্রথম ভারী শিল্প ছিল পাট শিল্প।কিন্তু বাংলায় সবচেয়ে বেশি চাষ হয় ধান। আর ধান ভাঙানোর যন্ত্র হিসেবে প্রচলিত ছিল প্রাচীন ঢেঁকি। তবে তা বেশ সময়সাপেক্ষ। ইউরোপে যেহেতু ধান ভাঙানোর কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি, তাই এদেশে প্রচুর ধান চাষ হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজরা ধান ভাঙানোর জন্য কোনো যন্ত্রের কথা ভাবেনি। বাঙালিদের প্রধান খাদ্যের উৎসই হল ধান। এজন্য আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করারও প্রয়োজন দেখা দিচ্ছিল। এই প্রয়োজন মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন এক বঙ্গসন্তান। জগদীশ্বর ঘটক।
নাম শুনে বেশি মানুষ চিনবেন না। কিন্তু ইনিই সেই বাঙালি, যিনি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে নিজের উদ্যোগে যন্ত্রপাতি বানিয়েছিলেন আর সেইসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন বাণিজ্যিকভাবে। ১৮৯৬ সালে স্টেটসম্যান পত্রিকার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জগদীশ্বর ঘটক নামে এক ব্যক্তি 'রাইস হাস্কিং মেশিন' তৈরি করেছেন। এই যন্ত্রে কম সময়ে বেশি ধান ভাঙানো যেত। জগদীশ্বর ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত আইনজীবী কাশীশ্বর ঘটকের সন্তান। নিজে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বড়ো হয়েছিলেন। তবে মেধা আর উদ্ভাবনী শক্তিকে তিনি শুধু নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করেননি। উনিশ শতকের শেষদিকে এই 'রাইস হাস্কিং মেশিন' আবিষ্কার তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি। এছাড়াও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে তাঁর পারদর্শিতার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৮৮৫ সালে জগদীশ্বর আবিষ্কার করেছিলেন তিন চাকার জলচর সাইকেল। এই জিনিসের কোনো প্রামাণ্য ছবি বা বর্ণনা এখন আর পাওয়া যায় না। তবে সেকালের ধনাঢ্য বাঙলিদের এই সাইকেল বেশ পছন্দ হয়েছিল, তা জানা যায়। তবে এই আবিষ্কারের জন্য তিনি পেটেন্ট পাননি।
জগদীশ্বরের 'রাইস হাস্কিং মেশিন' বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৮৯৮ সালে একটি শিল্প-বাণিজ্যের প্রদর্শনীতে এই মেশিনের জন্য স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন তিনি। ওই বছরেই 'বয়েলড রাইস কুকিং অ্যাপারেটাস' নামক আরেকটি যন্ত্রের জন্য পেটেন্ট পান জগদীশ্বর। 'রাইস হাস্কিং মেশিন' আবিষ্কারের প্রায় সমসময়ে, ১৮৯৬ সাল নাগাদ তিনি আবিষ্কার করেন আরেকটি যন্ত্র - 'পাংখা পুলিং মেশিন'। সেকালে ধনী বাড়িতে টানা পাখা ব্যবহারের রেওয়াজ ছিলো। তার জন্য গৃহকর্তাকে পাংখা-পুলার নিযুক্ত করতে হত। জগদীশ্বরের এই যন্ত্র ব্যবহারের ফলে পাংখা পুলার নিয়োগের আর দরকার হত না।এই যন্ত্রটির জন্য তিনি পেটেন্টের আবেদন করেছিলেন। এরপরেও আরও দুটি যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য পেটেন্ট পেয়েছিলেন জগদীশ্বর। ১৯০২ সালে 'প্যাডি হাস্কিং অ্যান্ড ক্লিনিং মিল' আর ১৯০৪ সালে 'মেশিনারি ফর ট্রিটিং প্যাডি উইথ স্টিম, হট অ্যান্ড কোল্ড এয়ার' যন্ত্রের জন্য।
আরও পড়ুন: জাপানে রাসবিহারী বসুর রেস্তোরাঁ /মন্দিরা চৌধুরী
এইরকম সময়েই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত রাঢ় অঞ্চলে বেশ কিছু চালকল বা রাইস মিল গড়ে ওঠে। এই শিল্পোদ্যোগের পিছনে জগদীশ্বরের আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলির গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। বাংলার বিভিন্ন চালের বিপুল চাহিদা তৈরি হয়েছিলো তখন, আর সেই সেই চাহিদা মেটাত এইসব ছোটো ছোটো চালকলগুলো। এর ফলে বিশেষত গ্রামবাংলার অর্থনীতিতেও বদল আসে। জগদীশ্বর শুধু বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে ক্ষান্ত হননি, তাঁর আবিষ্কারগুলির অর্থনৈতিক গুরুত্বও বুঝতে পেরেছিলেন। তাই সমস্ত যন্ত্রের পেটেন্ট নিয়েছিলেন এবং তার যথাযোগ্য ব্যবহারও করেছিলেন। কিন্তু আত্মবিস্মৃত বাঙালি বড় সহজেই ভুলে গেছে জগদীশ্বর ঘটককে। এমনকি তাঁর কোনও ছবি খুঁজে পাওয়াও এখন দুষ্কর।
….…………………….
তথ্যসূত্র : কলের শহর কলকাতা, সিদ্ধার্থ ঘোষ
#জগদীশ্বর ঘটক #বাংলা #বাঙালি শিল্পদ্যোগী #রাইস হাস্কিং মেশিন #বয়েলড রাইস কুকিং অ্যাপারেটাস #কলকাতা #মন্দিরা চৌধুরী