নিবন্ধ

একটি হিমশীতল স্বীকারোক্তি : শামশের আনোয়ারের কবিতা

আহ্নিক বসু Nov 25, 2020 at 7:06 am নিবন্ধ

[এক]
"Without cruelty there is no festival" —Friedrich Nietzche

চারপাশের বাতাসও জমে বরফ হয়ে থাকে। কেউ কেউ এমনই হিমশীতল হন। কাছে গেলেই ফ্রস্ট বাইট হয়ে যায়। সরীসৃপ একটা অস্বস্তি শিরদাঁড়া বরাবর উঠে আসে। সাদা মৃত্যু গলা টিপে ধরে। 

শামশের আনোয়ারের কবিতাকে একটিমাত্র শব্দে ব্যাখ্যা করতে হলে, সে শব্দটি হবে ‘অস্বস্তিকর’। ভদ্রলোক আমাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে অনেকটা দূর হেঁটে গেছেন।  সেসব শুভ্র মেরুর দেশ খালি চোখে দেখা যায় না। খোদ ভাস্কর চক্রবর্তী বন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “শামশেরের সঙ্গে বন্ধুত্বটা ছিল একটা বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্বের মতো...।”১ কেন? ভাস্কর বলছেন, "এতটাই উদ্দামতা, সজীবতা, দুঃসাহসিকতা ছিল শামশেরের— এতটাই আক্রমণাত্মক, বিষণ্ণ আর ক্ষুব্ধ— এতটাই আন্তরিক ছিল শামশের— এতটাই আন্তরিক, যে প্রকৃত শামশেরকে খুঁজে পাওয়াই ছিল মুশকিল।"

অব্যর্থ এই অবলোকন। আর ক'জন বাংলায় এত অসহ্য ব্যক্তিগত কবিতা লিখেছেন মনে করা সত্যিই মুশকিল। কবিতার সঙ্গে শামশের কোনো ঢাকঢাক গুড়গুড় করেননি। তাই তাঁর যাপন আর কবিতার মধ্যে একটি সুতোরও ব্যবধানে নেই। ভাতঘুমে বিশ্বাসী পাঠককে তাঁর কবিতা লাঞ্ছিত করবেই। ছিনিমিনি খেলবেই তার সহ্যের সীমা নিয়ে। 

"আমার মায়ের গর্ভে যে বাদুড়ের ছায়া ঘুরতো

  সেই বাদুড়ের ছায়া এসে ঝাপট মারছে গায়ে

  আমি আলো জ্বালবো মা

 কেননা আমার মায়ের গর্ভে কোনো আলো ছিল না

  দিন গুলি তাই অপ্রতিভ সংকোচে মুখ ফিরিয়ে থাকে

  আর সন্ধ্যা হতেই ফ্যাকাশে রক্তহীন আমি

 চোখের পাতা বুজিয়ে ফেলি 

নিমীলিত চোখ থেকে একটা বাদুড় উড়ে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খায়

দেয়াল থেকে ফ্যানের হুক, সেখান থেকে আছড়ে পড়ে

আমার গায়ে..."  (সেই বাদুড়ের ছায়া/ শিকল আমার গায়ের গন্ধে)

বেশি লেখেননি। সাকুল্যে তিনটে কবিতার বই। মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে, মূর্খ স্বপ্নের গান আর শিকল আমার গায়ের গন্ধে। তাতেই হাল্লা ফেলে দিয়েছিলেন। কৃত্তিবাস পুরস্কারের প্রথম বিজেতা। ষাট-সত্তরের বাংলা কবিতা শামশের আনোয়ারকে নিয়ে তখন তোলপাড়। ছয়ের দশকে বাংলা কবিতায় যে আত্মজৈবনিক কবিতার ধারা দেখা গেছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে সাহসী কলমটির মালিক শামশের। কবিতা তাঁর কাছে কবুলিয়ত। তাঁর কোর্টরুম। নিজেকে উন্মোচনের সাহসিকতায় তিনি অন্যদের থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। 

"...আমি তোমার সবুজ তলপেট জরায়ু আর হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে

ফিরে পেতে চেয়েছিলাম স্মৃতির ধ্বংসাবশেষ। 

কুসুমিত স্তন দুটির কাছে প্রার্থনা ছিলো

তোমার মায়ের কৈশোরিক গোলাপের ঘ্রাণ 

অই সুরঙ্গেতে আছে তার বালিকাবেলার অব্যবহৃত চোরাকুঠুরি

অথচ তুমি কোনোদিনই গর্ভধারণের মতো ঘনিষ্ঠ হলেনা।" 

(মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে/ ঐ)

শুধু ভাস্কর নন, অন্যান্য কবি বন্ধুদের বয়ান থেকে জানা যায় ব্যক্তিজীবনে কতটা বেপরোয়া ছিলেন শামশের। তেমনই বেপরোয়া ছিলেন কবিতাতেও। কলমে কার্যত কোনো সেন্সর ছিলনা বললেই চলে। আর এখানেই ছিল তাঁর শক্তি। এই অকপট আত্ম উন্মোচনে। আর ছিল বর্শাফলকের মতো শব্দ। শামশেরের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় ভাস্কর লিখছেন, "আমাদের ভাষায় এমন এক সশস্ত্র আধুনিক কবি, সত্যিই খুঁজে পাওয়া ভার।"

"টমাটোয় থাকে ঘনীভূত বীর্যের খোয়াব, 

সূর্য ও নারীর শ্রেষ্ঠতা এনে দেয় যা আমাদের

টমাটোর পাতার ধারাল চাবুকের গন্ধ অনুভূতিকে প্রখর করে —

আমাদের এনে দেয় লাল ও টাটকা ভোরের আস্বাদ,

টমাটো যুবতীদের হাসি, যুবতীদের পাছা ও যুবতীদের স্তনের গোল সারাৎসার

টমাটোর স্বপ্ন ও প্রতিভায় ফুলে ওঠে আমাদের প্রত্যেকের অন্ডকোষ:

কেননা টমাটোতেই থাকে লাল ও পরিপক্ক মৃত্যু। " (টমাটো/ মূর্খ স্বপ্নের গান) 

শামশেরের মধ্যে স্পষ্টত একটা অস্তিত্বের সংকট ছিল। ঈর্ষা, রিরংসা, আত্মকরুণা, প্রেম, প্রেমহীনতা সবই জটিল হিংস্র অন্ধকারের মতো ছেয়ে থাকে প্রায় সব কবিতায়। দম বন্ধ হয়ে আসতে পারে কবির আত্মপীড়ন দেখে। 

"ব্যর্থতা ও গ্লানির ক্ষুধায় হস্তমৈথুনের সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েই 

আমি পুনরায় ব্যর্থতা ও গ্লানির নিঃসীম তটে ফিরে আসি

খোলা ব্লেড দেখলেই তৃষ্ণায় আমার গলা জ্বলে

পাখার হুক দেখলেই মনে পড়ে যায় সোনালী ফাঁসের কথা..." 

(কলকাতা আর আমার নিঃসঙ্গ বিছানা/ মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে) 

কিংবা, " আজ আমি খুরপি নিয়ে শুয়েছি

     কোপাবো নিজেকে

মাটিতে গড়াবে শামশেরের বীজ...।" (শিকল আমার গায়ের গন্ধে)


 [দুই]

"Man is always prey to his truth." —Albert Camus

শামশেরের কবিতাকে টিপিকালি অস্তিত্ববাদী বলা চলে কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু চেতনাপ্রবাহের গূঢ় রাস্তায় নিজের অস্তিত্বের নিংড়ে দেওয়া সারাৎসারের ওপর দিয়েই হেঁটে যান তিনি -  

"আমার এ ঘর চতুষ্কোণ, অন্ধকার 

অনন্ত অন্ধকারে আমি সাঁতার কাটি, হামাগুড়ি দিই...

দ্বিতীয় কোনো লোক না থাকায় নিজেকে লক্ষ্য

করেই আমার সমস্ত শাসন, আঘাত, অভিমান ও ভালোবাসা 

বিষণ্ণ বোধ করলে নিজের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিই

নিজের সঙ্গে দীর্ঘকাল কথা বলিনা।

সংগমের ইচ্ছা হলে নিজেকে জড়িয়ে ধরে সংগম করি..."  

(ঘর/ মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে) 

টিপিক্যাল ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন দেখা যাবে অনেক কবিতায়। নাছোড় ঈদিপাস কমপ্লেক্স দীর্ণ করেছে শামশেরকে— "তোমার স্তনের উৎসে মুখ রেখে শুষে নিয়েছিলাম দুঃখের কালো দুধ/ সেই থেকে আমি বৃক্ষহীন নিজের ছায়ার গায়ে কুঠার মারি" (মাতৃবন্দনা/ মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে) 

কখনো তীব্র বিষাদ— "এই অবসর যেন এক লম্বা শববস্ত্র/ মুড়িয়ে রেখেছে আমাকে।" (দীর্ঘ অবসর/ মূর্খ স্বপ্নের গান) 

কখনো বিষাদ হয়ে যায় তীব্র রাগ— "যে চোখ দিয়ে মানুষ তাকায় ও বিচার করে/ ইচ্ছা হয় সেই চোখের ভিতর/ মর্মান্তিক ক্লিপ অবধি/ ঢুকিয়ে দিই আমার কলম।" (মর্মান্তিক ক্লিপ অবধি/ মূর্খ স্বপ্নের গান)

কখনো অনির্দেশ্য ঈর্ষা—" আমার মুঠোর ভেতর ঈর্ষার ছুরি/ অন্য কোনো কারণে নয়/ নির্জন বৃষ্টির মধ্যে তুই আমার চেয়েও দুঃখিত লোকের মত হেঁটে যেতে পারিস...।" (ঈর্ষায় রচিত কবিতা/ মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে) 

এই সবকিছুর মূলেই বোধহয় রয়েছে প্রচন্ড অবদমন। তার ফলেই খাঁচায় বন্দি শ্বাপদের অস্থির হয়ে ওঠেন শামশের। মেতে উঠতে চান আত্মধ্বংসের খেলায়। কবিতাও হয়ে ওঠে আরও আরও মরবিড। আসলে এ এক তীব্র অস্বীকার। সমসময়কে, চারপাশের সমাজটাকে। 

কেমন ছিল সেই সমাজ? বাইরে স্বাধীন ভারতের স্বপ্নের ধ্বংসস্তূপ, প্রত্যাশার লাশ, চীন-ভারত যুদ্ধ, কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন, নকশাল আন্দোলন। আর ভেতরে মেধাজীবী মধ্যবিত্তের বিষণ্ণ নিরক্ত একাকিত্ব। এই দশকেই সোমেন নন্দীর নাটকে অ্যাবসার্ড চিন্তাধারার সাথে আমাদের পরিচয়। অন্তঃসার শূন্য ছকে বাঁধা জীবন নিয়ে প্রশ্ন এই প্রথম। এই দশকেই বাদল সরকারের 'এবং ইন্দ্রজিৎ'। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু সংবাদ। কবিতার ক্ষেত্রেও পাল্টে গেল অনেক কিছু। এই দশকেই হাংরি, শ্রুতি আর শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন কবিতার যাবতীয় প্রচলিত নন্দনতত্ত্ব ও মূল্যবোধগুলোকে আক্রমণ করল। শামশের এর কোনোটারই সরাসরি অংশীদার ছিলেন না সেভাবে। সমাজবিপ্লবের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ ছিলনা। কিন্তু সমকাল তাঁকে ভয়ংকর নৈরাজ্যবাদের রাস্তায় ঠেলে দিয়েছিল। "শামশেরের কবিতা যেন এক অনিবার্য কল্পনাতীত থেকে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের দিকে অভিযাত্রা...," গবেষক অর্ণব সাহা বলছেন, "জীবনানন্দের 'মহাপৃথিবী' বইয়ের 'আমিষাশী তরবার' অংশের 'মৃত মাংস' কবিতার সেই ডানা ভেঙে ঘাসের ওপর পড়ে যাওয়া অন্ধকার হিম নিরুদ্দেশ পাখিটির মতই যেন, যাকে কেড়ে নিয়েছে ঈর্ষা বা হিংসা নয়, বেদনা, যার ক্লান্ত ডানা ঝাড়ার শব্দে মুছে যায় রূপালি বৃষ্টির গান, রৌদ্রের আস্বাদ, বেদনাকে অগ্রাহ্য করার ব্যর্থ চেষ্টা।"৪

মাঝে মাঝে মনে হয় শামশের এই অন্ধকূপ থেকে আদৌ মুক্তি চান নি। রিপু নিয়ে খেলতে খেলতে, ধ্বস্ত হতে হতে তারই নেশায় পড়ে গেছিলেন। মাদকের মত নিষিদ্ধ নেশা। আত্মপীড়নের সুখ। নইলে কেউ কেনই বা লিখবে : " এ জটিল পুজো ছেড়ে কীভাবে তোমাদের কাছে যাব?/ হে অখন্ড মন্দির! হে পতাকা! " (ব্যক্তিগত কাটামুন্ডের পুজো/ মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে)। আসলে তিনি বোধহয় জানতেন মুক্তি বলে কিছু হয়না। জানতেন এভাবে চলতে চলতেই দুম করে একদিন শেষ হয়ে যাবে খেলা। তাই প্রতিটা জন্মদিন আসত আর খুব অবাক হয়ে যেতেন। আরো একটা বছর কেটে গেল? কী আপদ! ১৯৬৪ সালের ৩০ এপ্রিল জন্মদিনের সকালে লিখলেন: " ২০ বছর হয়ে গেল প্রতীক্ষায় আছি। " (জন্মদিনে/ মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে)

২৩ বছরের জন্মদিনেও লিখেছিলেন এরকমই উদগ্র মৃত্যুবাসনার কথা:

"২৩ টি ৩০ এপ্রিল ২৩ টি বধ্যভূমির মতো পেরিয়ে যাওয়ার পর

১৯৬৭ সালের দুপুর বারোটায়, তখন তোমার শরীর 

নৃশংস কাঁটার মতো বেঁকে গিয়ে

সময়ের ঠিক বুকের ওপর 

গম্ভীর মৃত্যুদন্ডাজ্ঞার মতো বেজে ওঠে বারো বার

জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক রেখা বিলুপ্ত হয়ে যায়।" 

(দুপুর বারোটা/ মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে) 

পাঠকের মনে পড়বে আর্তুর রাবো বা সিলভিয়া প্লাথকে। মনে পড়তে পারে শামশেরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু, ষাটের আরেক দিকপাল কবি, 'ব্যান্ডমাস্টার' তুষার রায়ের কথা। মৃত্যুর জন্য তিনিও এভাবেই বরণডালা সাজিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু তুষারের কবিতা এতটা অস্বস্তি সঞ্চারিত করে দেয় না। শামশেরের মতো এমন ছ্যাঁকছ্যাঁকে, এমন হিম স্বীকারোক্তি বাংলা কবিতা কি আর দেখেছে? শামশের আনোয়ারের গোটা কবিতা-জীবনটাই একটা লম্বা স্বীকারোক্তি। 

মৃত্যুও তাই। ১৯৯২ এর অক্টোবরের এক রাতে শ-দেড়েক ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেন। বেশ কয়েক মাস কোমায় থাকার পর ১৯৯৩ এর ১২ জুন পি.জি. হাসপাতালের বেডে মৃত্যু।

দরজা বন্ধ করে গ্যাস বার্নারের সুইচ অন করার আগে সিলভিয়া প্লাথ টেড হিউজের মুখটাই ভাবছিলেন কিনা বলা মুশকিল। কিন্তু ঘুমের ট্যাবলেট মুখে দেওয়ার আগে শামশের আনোয়ার নির্ঘাত গোটা সমাজব্যবস্থাকে আরও একবার রিজেক্ট করতে চাইছিলেন। বলতে চাইছিলেন: "আমি তোমাদের মুখের ওপর ছড়িয়ে দিই থুতুর নক্ষত্রমালা।" (থুতু/ মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে) 


উল্লেখপঞ্জী

১/ ভূমিকা, শামশের আনোয়ারের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে'জ পাবলিশিং। 

২/ ঐ

৩/ আমিশাষী তরবার, কবিসম্মেলন, জুলাই ২০১০, পৃষ্ঠা ৩৭।


#শামসের আনোয়ার #কবি #বাঙালি কবি #Bengali Poet #নিবন্ধ #আহ্নিক বসু #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

91

Unique Visitors

183111