ফিচার

এক ‘প্রবাসী’ বাঙালি সম্পাদক ও জগদীশচন্দ্র

অর্পণ পাল Nov 1, 2022 at 5:37 am ফিচার

বিলেতের কেমব্রিজ থেকে বিজ্ঞানের ডিগ্রি নিয়ে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন আঠাশ বছরের তরুণ জগদীশচন্দ্র। অধ্যাপনার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে বক্তৃতা দিতে যেতেন মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এ, আর অবসর সময়ে মেতে থাকতেন ফটোগ্রাফি বা ফোনোগ্রাফিচর্চা নিয়ে। কলকাতার বিশিষ্ট বাঙালিদের অনেকের সঙ্গে তাঁর আলাপপরিচয় থাকলেও বলার মতো কোনো কাজ তখনও তিনি করে উঠতে পারেননি।

তবে ১৮৯৪ সালে, ততদিনে তাঁর অধ্যাপনার বয়েস আট পেরিয়েছে, একই সঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটল। ‘দাসী’ নামে একটি পত্রিকায় ওই বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হল ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’ নামে একটি রচনা, এবং মাস কয়েক পর নভেম্বরের তিরিশ (সেদিনটা ছিল তাঁর জন্মদিন) তারিখে তিনি কলেজের একটা ছোট্ট ঘরে কিছু যন্ত্রপাতি সাজিয়ে শুরু করলেন মৌলিক গবেষণা। পরবর্তীকালে যে গবেষণা-কাজ তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেবে। 


তবে জগদীশচন্দ্রের প্রথম বাংলা রচনা কিন্তু ওটা নয়, সেটা প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায়, কিন্তু দুঃখের কথা যে সে লেখাটির আজ আর সন্ধান পাওয়া যায় না। আর এ-কথা জানা যায় এক প্রবাসী বাঙালির স্মৃতিচারণ থেকে, যাঁর নাম রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। তিনি লিখছেন: ‘আমার যতদূর মনে পড়ে, তিনি ইংল্যান্ড হইতে ফিরিয়া আসিয়া প্রথমে ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় একটি বাঙ্গলা প্রবন্ধ লেখেন। তাহাতে ফসেট্‌ পরিবারে তিনি যে আদর ও প্রীতি পাইয়াছিলেন তাহার উল্লেখ ছিল।’ (‘প্রদীপ’ পত্রিকায় মাঘ ১৩০৪-এ প্রকাশিত স্মৃতিচারণ। এই বছরের পৌষ মাস থেকেই, অর্থাৎ ১৮৯৭ সালের ডিসেম্বর থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে ‘প্রদীপ’ পত্রিকা, সম্পাদক ছিলেন সেই রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। 


'প্রদীপ' পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের লেখাপত্র সম্বন্ধে জানতে অবসর ডট নেট-এ প্রকাশিত লেখাটি পড়া যেতে পারে। দেখুন নীচের লিঙ্ক: 

https://abasar.net/abasarold/abasar/mag_bangla_Pradip.htm 

এলাহাবাদের একটি কলেজের অধ্যক্ষ রামানন্দবাবুরই একান্ত আগ্রহে জগদীশচন্দ্র কলম ধরেছিলেন বাংলায়। তাঁর সম্পাদিত দাসী পত্রিকায় যে লেখাটি প্রকাশ পায়। আর এই প্রবন্ধ সম্বন্ধে ‘সাহিত্য’ সম্পাদক নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করেনঃ “ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে” একটি সুন্দর প্রবন্ধ। লেখক কবিতার ভাষায়, গানের ঝঙ্কারে, বিজ্ঞানের গভীর তত্ত্ব গল্পের মত বর্ণনা করিয়াছেন।’

‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’ লেখাটি পড়লে সত্যিই বোঝাই যায় না যে সেটি বেরিয়েছে এক বিজ্ঞান-অধ্যাপকের কলম থেকে; তখনও যাঁর বিজ্ঞান-গবেষণায় বলার মতো কোনও কাজই প্রকাশ পায়নি। প্রকাশ পায়নি পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞান-গবেষণা পেপারও। মজার ব্যাপার, এই লেখাটিকে সহ-অধ্যাপকের লেখা বলে প্রথমে মনেই করেননি প্রফুল্লচন্দ্র। তিনি ভেবেছিলেন এটি জগদীশচন্দ্রের বোন লাবণ্যপ্রভার লেখা। পরে যদিও তাঁর সে ভুল ভেঙেছিল। 

তবে এই লেখার মাধ্যমেই যে সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ এবং ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে জগদীশচন্দ্রের, এমনটা কিন্তু পুরোপুরি সত্যি নয়। পরবর্তীকালে দেখব তাঁরই সম্পাদিত একাধিক পত্রিকায় (যেমন ‘দাসী’ বা ‘প্রবাসী’) জগদীশচন্দ্র লিখবেন সাতটি দীর্ঘ প্রবন্ধ এবং তাঁকে নিয়ে প্রকাশ পাবে বহু ব্যক্তির লেখা নিবন্ধ, স্মৃতিচারণ বা সংক্ষিপ্ত খবর। বস্তুত জগদীশচন্দ্রকে নিয়ে সমকালে বাংলা আর কোনো পত্রিকাতেই এত বহুল পরিমাণে খবর বা গদ্য প্রকাশ পায়নি। 

তবে ব্যক্তি রামানন্দবাবুর সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের সম্পর্কের সূত্রপাত কয়েক বছর আগেই, যখন বাঁকুড়া থেকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এসেছিল এক তরুণ ছাত্র। 


২/ 

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৬৫ সালের ২৯ মে, বাঁকুড়ার পাঠকপাড়ায়, বয়সে তিনি জগদীশচন্দ্রের চেয়ে সাত বছর আর রবীন্দ্রনাথের চেয়ে চার বছরের ছোট। বাঁকুড়া জিলা স্কুলে পড়বার সময় কেদারনাথ কুলভী নামে এক শিক্ষকের সংস্পর্শে এসে তাঁর মধ্যে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। পড়াশুনোয় তিনি ছিলেন প্রথম সারির, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েছিলেন। 

এরপর ১৮৮৪ সালে রামানন্দ আসেন কলকাতায়, ভরতি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু বছরখানেক পড়বার পর এই কলেজ ছেড়ে ভরতি হন সেন্ট জেভিয়ার্সে, আবার তৃতীয় বছরে এসে চলে আসেন প্রেসিডেন্সিতেই। তখন এখানে অধ্যাপনা করছেন জগদীশচন্দ্র। এবার তাঁর ক্লাস করবার সুযোগ পেলেন তিনি, রামানন্দবাবু প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্রের ছাত্র ছিলেন মাত্র কয়েক মাস। তবু ওই সময়কালে তাঁর সঙ্গে অল্প হলেও হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল রামানন্দের। 

১৮৮৮ সালে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন রামানন্দ। ইতিমধ্যে তিনি প্রেসিডেন্সি ছেড়ে চলে এসেছেন সিটি কলেজে, এখান থেকে বিএ পাশ করেন ওই ১৮৮৮ সালেই; ইংরেজি অনার্সে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। 

ওই সিটি কলেজেই বিনা বেতনে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবনের শুরু। প্রথম দু-বছর মাইনে না পেলেও তৃতীয় বছর থেকে একশো টাকা মাইনে পেতে থাকেন। আর এই অধ্যাপনা করবার সময়েই রামানন্দ প্রথমবার সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন, ‘দাসী’ নামের সেই পত্রিকাটির।

১৮৭/২/৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে ছিল দাসাশ্রম নামে একটি দুস্থ মহিলাদের সেবাশ্রম তৈরি হয় বসিরহাটের জালালপুর মহকুমার মৃগাঙ্কধর চৌধুরী আর ক্ষীরোদচন্দ্র দাস-এর উদ্যোগে, ১৮৯১ সালে৷ এই আশ্রমেরই মুখপত্র হিসেবে ‘দাসী’ প্রকাশ পেতে শুরু করে ১৮৯২ সালের জুলাই মাস থেকে, প্রথম সম্পাদক হন রামানন্দবাবু, এবং পাশাপাশি যুক্ত হয়ে পড়লেন এই আশ্রমের নানাবিধ সেবামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে৷ যেমন একটি মেডিকেল হল বানানো হয়, যার দায়িত্ব নিয়েছিলেন নীলরতন সরকার আর প্রাণকৃষ্ণ আচার্য৷ এছাড়া এখানে নানাভাবে সাহায্য করতেন মহেন্দ্রলাল সরকার, আনন্দমোহন বসু বা শিবনাথ শাস্ত্রীরা। 


‘দাসী’ পত্রিকা সম্বন্ধেও ভালো একটি লেখা রয়েছে আন্তর্জালে দেখুন নীচের লিঙ্কে : 


https://parabaas.com/PB65/LEKHA/pShampa65.shtml   

প্রথম দিকে এই পত্রিকায় কোনো লেখকের নাম থাকত না, আর থাকত প্রতিষ্ঠানের নানারকম কাজকর্মের বিবরণ, প্রচার, সাহায্যের আবেদন, এরপর বছর দেড়েক বাদে এই পত্রিকায় নিবন্ধ, কবিতা, বিজ্ঞান, বইয়ের সমালোচনা ইত্যাদি প্রকাশ পেতে শুরু করে৷ এরপর এলাহাবাদে কায়স্থ পাঠশালা নামে একটি স্কুলে অধ্যক্ষ হিসেবে চাকরি পেয়ে রামানন্দ পাড়ি দিলেন প্রবাসে, ১৮৯৫ সালে। ওখানেই তিনি এর বছর দুয়েক বাদে প্রকাশ করেন 'প্রদীপ' নামে একটি পত্রিকা। এই পত্রিকায় ছাপা হত বিভিন্ন ধরনের নিবন্ধ, গল্প, উপন্যাস বা বৈজ্ঞানিক গদ্য, এবং অবশ্যই মনীষীদের জীবনী। জগদীশচন্দ্রকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকাতেই। 


৩/ 

তবে ‘দাসী’ বা ‘প্রদীপ’-কে জনপ্রিয়তায় (এবং মানের দিক থেকেও) অনেক পিছনে ফেলে দেয় ‘প্রবাসী’। এলাহাবাদে থাকাকালীনই ১৯০১ সালের এপ্রিলে (বাংলা ১৩০৮ সালের বৈশাখ) মাসিক সচিত্র সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে 'প্রবাসী' (বছর কয়েক পরে অবশ্য প্রকাশ পেতে থাকে কলকাতা থেকেই)। আর সেই প্রথম কোনো পত্রিকার পাতা তিন রঙে ছাপা হল৷ প্রথম দর্শনেই পত্রিকাটিকে ভালবেসে ফেললেন বাঙালি পাঠক। আর বৈচিত্র্য? থাকত বিভিন্ন প্রদেশের সাহিত্যের অনুবাদ, গল্প, কবিতা, নিবন্ধ, দেশ-বিদেশের দরকারি খবরাখবর, খেলা, বিজ্ঞান-শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে গদ্য, এবং অবশ্যই উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের গোরা, শেষের কবিতা বা মুক্তধারা-র মতো বেশ কয়েকটি উপন্যাস বা গীতিনাট্য ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছে ‘প্রবাসী’-তে। আর তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত লেখাপত্রের তো পরিসীমাই নেই। 

‘প্রবাসী’র প্রতি সংখ্যাতেই থাকত একাধিক সম্পূর্ণ পাতা রঙিন ছবি, আর প্রচুর সাদাকালো ছবিও৷ এই ছবিগুলি ছাপতে সাহায্য করতেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তাঁর ইউ রে অ্যান্ড সন্স-এর নামেই ছাপা হত রঙিন ছবিগুলি। 

‘প্রবাসী’-র প্রচার বা বিক্রি ছিল দারুণ। সে আমলে প্রায় সাড়ে সাত হাজার প্রবাসী বিক্রি হত গোটা বাংলায়। একটানা বেয়াল্লিশ বছর সম্পাদনা করেন রামানন্দবাবু, তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৪৩ সালে, এরপরে পত্রিকার সম্পাদক হন তাঁর ছেলে কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়। 


৪/ 

রামানন্দবাবুই ‘প্রবাসী’র পর একটি ইংরেজি পত্রিকা ‘মডার্ন রিভিউ’ প্রকাশ করতে শুরু করলেন ১৯০৮ সাল থেকে৷ এই পত্রিকায় থাকত নানা গুরুগম্ভীর বিষয়ের ওপর গদ্য, বিদেশি পত্রপত্রিকা থেকে বাছাইকৃত খবর বা নিবন্ধ, এবং রবীন্দ্রনাথের মূল লেখা আর তার ইংরেজি অনুবাদ৷ আর থাকত, অবশ্যই জগদীশচন্দ্র বিষয়ক খবর। 

এই পত্রিকাতেই ১৯১২ সালের আগস্ট মাসে দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ লেখেন An evening with Rabindra', যেটাকে অনেকে বলেন রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কোনো ইংরেজের লেখা প্রথম রচনা৷ 

‘প্রবাসী’ আর ‘মডার্ন রিভিউ’-এ প্রকাশিত জগদীশচন্দ্র বিষয়ক লেখাপত্রের চমৎকার দুটি সংকলন বাজারে পাওয়া যায়, অনেকেই খবর রাখেন বলে মনে হয় না। ‘গ্রন্থমিত্র’ ও ‘মিত্রম’ আর এঁদের ইংরেজি বইয়ের বিভাগ ‘Progressive Publishers’-এর উদ্যোগে প্রকাশিত এই বইদুটির নাম ‘প্রবাসী পত্রে জগদীশচন্দ্র’ আর ‘Acharya Jagadish Chandra Bose in Modern Review’. দুটি বইয়েরই সম্পাদনা অসীম কুমার মুখোপাধ্যায়ের। প্রসঙ্গত জগদীশচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পেয়েছিল এই ‘প্রবাসী’–তেই, রবীন্দ্রনাথের চমৎকার একটি মুখবন্ধ-সহ। পরে সেই চিঠিগুলি একত্রিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে বেশ কয়েকটি বইয়ে। ‘প্রবাসী’-র পাতায় চিঠিগুলির পাঠ আর বইয়ে প্রকাশিত পাঠে লক্ষ করা যায় বেশ কিছু তফাৎ, অর্থাৎ বইয়ে চিঠিগুলির পূর্ণতর পাঠ মেলে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে চার খণ্ডে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার নির্বাচিত রচনার সংকলন পাওয়া যায়, যার প্রথম খণ্ডটিতে আলাদাভাবেই সংকলিত হয়েছে জগদীশচন্দ্র বিষয়ক লেখা ও খবরগুলির বাছাই করা বেশ কয়েকটি, তবে চিঠিপত্র ছাড়া। 

এ কথা আমাদের স্বীকার করতেই হয় যে জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার নিয়ে গদ্য বা তাঁকে নিয়ে আলোচনা ও খবরাখবর প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তাঁকে বাঙালি এবং ভারতীয় পাঠকদের কাছে হাজির করবার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল ‘প্রবাসী’ আর ‘মডার্ন রিভিউ’, আর এর পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের। 

........................... 


#জগদীশ চন্দ্র বসু #প্রবাসী পত্রিকা #রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় #Jagadish Chandra Bose #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

6

Unique Visitors

219248