‘The Power of the Dog’: দৃশ্য ও শব্দের কোলাজে ব্যতিক্রমী থ্রিলার
চলচ্চিত্র: The Power of the Dog পরিচালনা: Jane Campion শ্রেষ্ঠাংশে: Benedict Cumberbatch, Kristen Dunst, Jesse Plemons, Kodi Smit-McPhee মাধ্যম: Netflix
সাইকোলজিকাল থ্রিলার কাকে বলে? ঠিক কী কী আয়োজন থাকে কোনও আদর্শ সাইকোলজিকাল থ্রিলারে? মনের সর্পিল গুহাপথ চুঁইয়ে তীক্ষ্ণ অস্বস্তিকর অনুভূতির আনাগোনা? খুব সন্তর্পণে চরিত্রদের হিংস্র-অপরাধপ্রবণ অন্তরমহলের রহস্যজাল খোলা? এগুলোর সবকটা থাকার পরেও এ ছবিকে বিশুদ্ধ মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার আদৌ বলা যায় কিনা সে নিয়ে তর্ক উঠতেই পারে। ‘হযবরল’-র বেড়ালটি থাকলে হয়তো বলত – ‘থ্রিলারও বলতে পারো, পিরিয়ড পিসও বলতে পারো, আবার ভালোবাসার গল্পও বলতে পারো।’
প্রেইরি তৃণভূমি আর রকি পর্বতমালার ছোটোবড়ো শৈলশিরায় ঘেরা উত্তর আমেরিকার মন্টানা। সাল ১৯২৫। এখানে ওখানে ছড়িয়ে গবাদি পশুদের ফার্মহাউস। সময়ের গতি এখানে শ্লথ। নিপাট মসৃণ আধুনিক যাপনের আলো আসতে চেয়েও যেন থমকে আছে তার চৌকাঠে। এ সমাজ সুসভ্য মহলের আদবকায়দা এখনও রপ্ত করে উঠতে পারেনি পুরোপুরি।
এমনই এলাকায় এক খামারবাড়ির যৌথ মালিক ফিল ও জর্জ বার্কব্যাঙ্ক। ফিলের রয়েছে নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত ক্ষমতা। চেহারায় স্বভাবে সে ইস্পাতসুলভ কঠিন আর শীতল। বুদ্ধিদীপ্ত ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ভাই জর্জ ঠিক এর বিপরীত। দাদার ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব তার নেই। দরদি নরম মন, সহানুভূতি আর নতুনকে গ্রহণ করার সাগ্রহ চেষ্টা তাকে আলাদা করে দেয় গ্রাম্য প্রাচীনপন্থী মানসিকতা থেকে। এই স্বভাবের জেরেই সে বিয়ে করে ডিনার-লেডি বিধবা রোজ গর্ডনকে। দায়িত্ব নেয় তার ছেলে পিটারের।
ভাইয়ের এই সিদ্ধান্ত কিন্তু মেনে নিতে পারে না ফিল। বহিরাগত নতুনত্বের হাওয়া গায়ে ঠেকাতে নারাজ সে। অতীতকে আঁকড়ে থাকতে চায় দৃঢ়মুঠিতে। একরোখা জেদ আর অনমনীয় কাঠিন্য নিয়ে সে দর্শক হয়ে থাকে ভাইয়ের নতুন জীবনের। শুধু দর্শক নয়। চোরা পথে শানিয়ে নেয় আক্রমণের অন্ধিসন্ধি। সূক্ষ্ম অথচ নিষ্ঠুর শীতলতায় নবাগত ভ্রাতৃবধূর জীবনে তৈরি করে হাড়-হিম করা ভয়ের বাতাবরণ। প্রায় অলক্ষ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় রোজের সমস্ত গতিবিধি। অদৃশ্য সুতোয় বাঁধতে চায় তার সাবলীল বিচরণ। এদিকে মায়ের যন্ত্রণা পিটারের নজর এড়ায় না।
তারপর কোনদিকে মোড় নেয় ঘটনাক্রম? সব রহস্য ফাঁস না করেও বলা যায় এ ছবিতে গল্পের চেয়ে বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে গল্প বলার পদ্ধতি। বারো বছর পর পরিচালনায় ফিরে জেন ক্যাম্পিয়ন ন্যারেটিভ তৈরির যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তা সত্যিই অনবদ্য। টমাস স্যাভেজের উপন্যাসকে চিত্রায়িত করতে গিয়ে মূল থেকে প্রায়শই সরে এলেও নিষ্ঠুরতা ও সৌন্দর্যের যে যুগলবন্দি পরিবেশন করেছেন পরিচালক, তা স্বতন্ত্র শিল্পরূপ হয়ে ওঠার দাবি রাখে।
কথার ব্যবহার এ ছবিতে ন্যূনতম। সংলাপ এখানে যত কথা বলে তার চেয়ে ঢের বেশি কথা বলে ক্যামেরা আর আবহসংগীত। কথা বলে হলদেটে মাটি-পাহাড়ের ওপর মেঘেঢাকা ছাইরঙা আকাশের গম্ভীর বিস্তৃতি, শস্যের শিষে লেগে থাকা চাপ চাপ রক্তের ছিটে, পিয়ানোর টুংটাং, ব্যাঞ্জোর মাটিঘেঁষা সুর, চিরুনির দাঁতে নখ ঘষার অস্বস্তিকর আওয়াজ কিংবা হুইসলের গা-শিরশিরে ধ্বনি। বারেবারে তৈরি হতে থাকে ছবি-শব্দ-সুরের আশ্চর্য কোলাজ। দৃশ্য আর শব্দের কাব্যে ভরপুর একটি উত্তরাধুনিক ছোটগল্প পড়ার অনুভূতি যেন চারিয়ে যায় দর্শকের বোধে।
দুটি চরিত্রের কথা বিশেষভাবে না বললে এ ছবির আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রথমত ফিল। দ্বিতীয়ত পিটার। ম্যাস্কুলিনিটি সংক্রান্ত প্রথাগত ধারণাকে এলোমেলো করে পিটারের চরিত্র। পিটার চরিত্রে কোডি স্মিট-ম্যাকফির বাহুল্যহীন অভিনয় এককথায় অতুলনীয়। ফিলের পুরুষতান্ত্রিক অবদমন সূক্ষ্ম হলেও কামেরায় স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। কিন্তু তথাকথিত ‘ফেমিনিন’ পুরুষের মধ্যেও কি চুপিসাড়ে প্রবেশ করতে পারে পুরুষতন্ত্রের বিষ? প্রতিশোধস্পৃহা মানুষকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে? কাগজের ফুল তৈরি করা পেলব আঙুলের আড়ালেও লুকিয়ে থাকতে পারে জিঘাংসার প্রণোদনা! পিটার চরিত্রকে শেষ পর্যন্ত দেখলে এর উত্তর মিলবে।
অন্যদিকে অতি অল্প কথায় নৃশংসতার আলেখ্য রচনা করতে, পর্দায় ফিলের মতো মেধাবী, আপাত-রুক্ষ অথচ ট্র্যাজিক ফুটিয়ে তুলতে যে শ্রম ও সংবেদনের প্রয়োজন তা যথাযথভাবে দিতে পেরেছে বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচের অভিনয়। তাঁর কণ্ঠ, তাঁর দেহভঙ্গিমা অতিলৌকিকের বিন্দুমাত্র স্পর্শ ছাড়াই দর্শকের শিরদাঁড়ায় বইয়ে দিতে পারে আতঙ্কের শিহরন। অভিনয়গুণে পর্দাজোড়া পাথুরে জমি তার তীব্র sensuality সহ কেবল সিনেমার প্রেক্ষাপট হয়ে থাকে না, ধুলো-মাটি-ঘাম-রক্তে মেশা ফিলের ব্যক্তিসত্তারও অনিবার্য উপাদান হয়ে ওঠে। মনে হয়, গম রঙের বিবর্ণ ল্যান্ডস্কেপ যেন তারই অনুচ্চারিত হাহাকার আর শূন্যতার প্রতিচ্ছবি। সবার অগোচরে প্রতিটি রুক্ষ মানুষ হয়তো বহন করে চলে এক বা একাধিক সম্পর্কের মৃতদেহ। কাঠিন্যের পরত খসে গেলে বেআব্রু হয় প্রাক্তন ক্ষতচিহ্ন। ফিলের কাহিনি এই চিরাচরিত ফর্মুলাকেই আরও একবার সত্যি প্রমাণ করে।
তবে লম্বা স্ক্রিন টাইম জুড়ে বেনেডিক্টের মতো দ্যুতিমান অভিনেতার উপস্থিতিতে যাবতীয় স্পটলাইট ব্যক্তিবিশেষের ওপর গিয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ ছবিতেও সেই সম্ভাবনা ছিল। তার পরেও ব্যক্তিবিশেষের নায়কোচিত দীপ্তিতে আচ্ছন্ন হয়নি এ ছবি। তার চেয়ে অনেক বেশি চোখ টানে প্রাচীন প্যাস্টোরাল সমাজ ও আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার দ্বন্দ্ব, একাধিক চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন। এ বিষয়ে অবশ্যই ক্যামেরার অন্যপারে পরিচালনা-এডিট-কস্টিউম ডিজাইনের সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষগুলির সাধুবাদ প্রাপ্য।
ব্রঙ্কো হেনরি এ ছবিতে বিন্দুমাত্র স্ক্রিন প্রেজেন্স ছাড়াই এত তাৎপর্যপূর্ণ একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে - ভাবলে বিস্ময় লাগে বৈকি। ভারতীয় দর্শকের মনে পড়ে যেতে পারে ‘Memories in March’-এর সিদ্ধার্থের কথা। কোনও সিকোয়েন্সকেই এখানে অনর্থক দীর্ঘায়িত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে গল্প হয়েছে নাটকীয়তাবর্জিত, সংহত, ছিমছাম। ছোট ছোট অঙ্কে বা অধ্যায়ে ভাঙা হয়েছে ন্যারেটিভকে। এ সিনেমার অন্যতম সম্পদ তার মিতবাচন। দর্শককে বারবার ‘between the lines’ পড়ে নিতে হয়। এত পরিমিত হাতে-গোনা সংলাপে ট্রাজেডির এমন তীব্র অভিঘাত আনা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। ‘প্রেম’ ও ‘প্রতিশোধ’-এর মতো বহুব্যবহৃত থিমকে যদি কেউ নতুনভাবে পড়তে চান, যদি চান ছবির কুশলী বাঙ্ময়তার মুখোমুখি দাঁড়াতে, তিনি ‘The Power of the Dog’ একবার দেখতেই পারেন।