সারারাত জুড়ে আঁকা লড়াকু ছবিতে শামিল ‘স্ত্রী ২’
ছবি: স্ত্রী ২পরিচালনা: অমর কৌশিকপ্রযোজনা: ম্যাডক ফিল্মসঅভিনয়: রাজকুমার রাও, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, শ্রদ্ধা কপূর, অপারশক্তি খুরানা, অভিষেক ব্যানার্জি প্রমুখ
বাঙালি ঘরে বড় হবার দরুন আমরা কমবেশি সকলেই হয়তো বেড়ে উঠেছি পেত্নী, শাঁকচুন্নি আর ডাইনি বুড়ির গপ্পো শুনে। বড় হয়ে অবশ্য জেনেছি, অন্যান্য আত্মার মতোই মেয়েদের ভূত হয়ে ফিরে আসার পিছনে কাজ করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কাটানো জীবনের অপ্রাপ্তি, আকাঙ্ক্ষা, কিংবা প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ। বছর ছয়েক আগে যখন মুক্তি পেয়েছিল অমর কৌশিকের চলচ্চিত্র ‘স্ত্রী’, হরর কমেডির মোড়কে এ ছবির গল্প বলার সংবেদনশীলতা মুগ্ধ করেছিল দর্শককে। ‘প্রেতিনীর জিঘাংসা’ বা ‘আঁধার রাতের আর্তনাদ’, নজরকাড়া এমন সব নামের নীচে হাড় হিম করা চটি ভূতের বইয়ের বড়পর্দা সংস্করণ নয়, ফাটাফাটি বিনোদনের মোড়কে ‘স্ত্রী’ যত্ন করে বুঝিয়েছিল কীভাবে সমাজের চাপা পড়ে যাওয়া শোষণ ও অবিচার জন্ম দেয় আত্মার। লীলা মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে জগৎকে হিন্দি ছবির পর্দায় উঠৈ আসতে দেখে দারুণ আনন্দ পেয়েছিল বাঙালি। ছবির শেষে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে চান্দেরি গ্রামের বাসিন্দারা ঘরের বাইরে লিখে রেখেছিল– ‘স্ত্রী, রক্ষা করুন’, ঘৃণিত আত্মা হয়ে উঠেছিল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্রী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘রঙ্কিণী দেবীর খড়্গ’ মনে পড়ে যায়, তাই না?
এই ছবির সিকোয়েল নিয়ে তাই প্রত্যাশার পারদ ছিল তুঙ্গে। সাম্প্রতিক কালে একের পর এক নিম্ন এবং মধ্যমানের ছবি দেখে ক্লান্ত বলিউডপ্রেমীরা আশা করছিলেন, ‘স্ত্রী টু’ অবশেষে তাঁদের জন্য নিয়ে আসবে একটা ভালো গল্প। বলতেই হচ্ছে, সে পরীক্ষায় দুর্দান্তভাবে উপরে গিয়েছেন অমর কৌশিক। আগের ছবির স্বাদ সম্পূর্ণ বজায় রেখে তিনি সফলভাবে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন এবারের গল্পে, পিতৃতন্ত্রকে ছিঁড়ে ফালাফালা করবার জন্য ব্যঙ্গের শানিত ফলা হয়ে উঠেছে আরও তীক্ষ্ণ, আরও নির্মম। ছবির শুরুতেই ধর্মীয় রাজনীতিকে সপাটে থাপ্পড় কষিয়ে রুদ্র ভাইয়াকে বলতে শোনা গেছে, ‘উর্দু পড়িস না? মূর্খ!’ ছবি যত এগিয়েছে, তাসের মতো ভেঙে পড়েছে একের পর এক স্টিরিওটাইপ। আপাদমস্তক অনায়কোচিত এক দর্জিকে আবার নামতে হয়েছে চান্দেরি গ্রামের পরিত্রাতার ভূমিকায়, পুরুষদের বাঁচাতে রণাঙ্গনে উপস্থিত হয়েছে নারী, সবচেয়ে নির্বোধ বন্ধু লাভ করেছে দিব্যদৃষ্টি, আইটেম গানে এসেছে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কনসেন্টের গুরুত্বের প্রসঙ্গ।
গথিক সাহিত্যে যেমন অলৌকিক ঘটনার পিছনে থাকে গোপন অতীত, চান্দেরি গ্রামে স্কন্ধকাটার আবির্ভাবের কারণ তেমনি রাজপরিবারের পুরুষতান্ত্রিক অনাচার। স্কন্ধকাটার অনুগামীরা তাই সামাজিক শৃঙ্খলার নামে উগ্র পুরুষবাদের সমর্থক। আর জি করে ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনার বিপন্নতায় এ রাজ্যের দিকে দিকে মেয়েরা যখন রাত দখলের ডাক দিচ্ছে, ঠিক তখনই এ ছবির শেষে ছেলেদের হাত থেকে মহাপূজার অধিকার ছিনিয়ে নিতে পথে নামছেন গ্রামের মহিলারা। ক্লাইম্যাক্স মনে করিয়ে দিচ্ছে মা চণ্ডীর অসুর নিধনের কাহিনি।
অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে টানটান চিত্রনাট্যে নিয়ে আসা হয়েছে কিছু বিশেষ ক্যামিও, মানানসই আবহ তৈরি করেছে পরিপাটি ক্যামেরা ও ভিএফএক্স। অভিনয়ে রাজকুমার ও পঙ্কজ ত্রিপাঠী যথারীতি দুর্দান্ত, তিন বন্ধু এবং রুদ্র ভাইয়ার বোঝাপড়া দ্বিতীয় ছবিতে আরও নিখুঁত। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন বাংলার ছেলে অভিষেক ব্যানার্জি। দুঃখের কথা, ছবির গানগুলি একটিও মনে দাগ কাটার মতো নয়।
কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার জো নেই, অভিনয়, চিত্রনাট্য বা পরিচালনার কৃতিত্ব ছাপিয়ে এ ছবির মূল বাজি হয়ে আসলে লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে খোলা জেহাদ। সারা রাজ্য যখন আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে, ছবিতে পঙ্কজ ত্রিপাঠী বলছেন, “ছেলেরা পড়ে কোথায়? যেখানে লেখা ‘প্রস্রাব করবেন না’ ঠিক তার উপরেই ট্যাঙ্ক খালি করে চলে আসে!” আর হল জুড়ে হাসিতে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। শ্রদ্ধা কপূরের রণরঙ্গিনী মূর্তি দেখে তুমুল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ছে প্রেক্ষাগৃহ।
মেয়েদের অধিকার বুঝে নেবার এই উত্তাল সময়ে পাওনা হিসেবে এটুকুই বা কম কী?