‘রক্তকরবী’ পরিচালনা করেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে ‘রক্তকরবী’ নাটকের মঞ্চ প্রযোজনা এক বহুচর্চিত অধ্যায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ করতে পারেননি, নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি প্রযোজনা করতে চেয়েও শেষমেশ করে উঠতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে এ নাটকের একটিমাত্র অভিনয়ের খবর পাওয়া যায়। ১৯৩৪ সালের ৬ এপ্রিল ‘দি টেগোর ড্রামাটিক গ্রুপ’-এর উদ্যোগে কলকাতার নাট্যনিকেতনে ‘রক্তকরবী’ অভিনীত হয়। অনেক পরে ১৯৫৪ সালে শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’-ই এই নাটকের প্রথম স্মরণীয় মঞ্চায়ন; সম্ভবত শ্রেষ্ঠতমও। তবে অনেকেরই জানা নেই, বহুরূপীর সেই বিখ্যাত প্রযোজনার বেশ কয়েক বছর আগে ১৯৪৭ সালে রক্তকরবী প্রযোজনা করেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। হ্যাঁ তিনিই, রবীন্দ্রসংগীতের ‘ব্রাত্যজন’ জর্জ বিশ্বাস। এবং সেই নাটকে রাজার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শম্ভু মিত্র।
রবীন্দ্রনাথ ‘রক্তকরবী’ লিখেছিলেন ১৯২৬ সালে। ‘রক্তকরবী’-র অন্তর্নিহিত অর্থ সেদিন বাংলার বহু বিখ্যাত মানুষই বুঝতে পারেননি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত নাটকটিকে ‘দুর্বোধ্য’, ‘অবোধ্য’, ‘তত্ত্ব নাটক’ অসংখ্য নাম দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে তখনকার পেশাদার নাট্যমঞ্চে লঘু হাস্যরসের নাটকগুলি ছাড়া রবীন্দ্রনাথের নাটকের খুব একটা জনপ্রিয়তা ছিল না। তাই রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ‘রক্তকরবী’ প্রকাশের আগে একবার অভিনয় করে নিতে। সেই অনুযায়ী বিশু পাগল চরিত্রে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দিনী চরিত্রে কখনও রেবা রায়, কখনও অমিতা ঠাকুরকে নিয়ে তিনি প্রযোজনার কথা ভেবেছিলেন। ‘রাজা’র চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা মঞ্চস্থ করা হয়ে ওঠেনি। পরে রামকিঙ্কর বেজের উদ্যোগে একবার শান্তিনিকেতনে ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ করার কথা হয়েছিল। যেখানে নন্দিনী চরিত্রে ছিলেন রাণু ঘোষ ও বিশু পাগল চরিত্রে ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ। সে পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়।
আরও পড়ুন : রবীন্দ্রনাথ ও যদুনাথ সরকারের মৈত্রী থেকে মনান্তর : কারণ বিশ্বভারতী / টিম সিলি পয়েন্ট
‘রক্তকরবী’ প্রকাশের আগে রবীন্দ্রনাথ নিজেই শিশিরকুমার ভাদুড়িকে নাটকটি পেশাদার মঞ্চে অভিনয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। শিশির ভাদুড়ির প্রতিভার উপর পূর্ণ আস্থা ছিল রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু শিশির ভাদুড়িও ‘রক্তকরবী’-র প্রযোজনাকে রূপ দিতে পারেনি। তাঁর পরিকল্পনার ব্যর্থতা নিয়ে অনেক কানাঘুষো শোনা যায়। এমনকি এও শোনা যায় যে পরবর্তীকালে তাঁর ছাত্র শম্ভু মিত্র ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনা করতে চাইলে তিনি নাকি অনৈতিকভাবে বাধা দিয়েছিলেন। ও হ্যাঁ, বিশু পাগল চরিত্রে তিনি কাকে ভেবেছিলেন জানেন? কাজি নজরুল ইসলামকে! সে গল্প না হয় আরেকদিন বলা যাবে।
আরও পড়ুন : গোপাল হালদারকে ‘রকের ছেলে’ বলেছিলেন শম্ভু মিত্র / অর্পণ দাস
১৯৫৪ সালে শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় শিয়ালদহের ই. বি. আর ম্যানসন ইনস্টিটিউটে ‘রক্তকরবী’ প্রযোজিত হয়। যে প্রযোজনা রবীন্দ্র-নাটককে বাংলা রঙ্গমঞ্চে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি বাংলা থিয়েটারের গতিপথও বদলে দেয়। রাজার চরিত্রে শম্ভু মিত্র ছাড়াও অভিনয় করেছিলেন তৃপ্তি মিত্র (নন্দিনী), শোভন মজুমদার (বিশু পাগল), অমর গঙ্গোপাধ্যায় (সর্দার), কুমার রায় (গোঁসাই)। মঞ্চপরিকল্পনায় ছিলেন খালেদ চৌধুরী এবং আলোক নির্দেশনায় তাপস সেন। বহুরূপীর প্রযোজনা ‘রক্তকরবী’-কে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, যে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলা থিয়েটার ‘রক্তকরবী’র প্রযোজনায় হাতই দেয়নি।
শিশিরকুমারের পরিকল্পনা থেকে শম্ভু মিত্রের প্রযোজনা, এই কুড়ি বছর সময়ের মধ্যে বেশ কিছু রবীন্দ্র অনুসারী সংগঠন ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনা করেছিল। তবে সাধারণ মানুষ তো বটেই, বাংলার নাট্যমোদী মানুষের অনেকে তার স্বাদ অনুভব করতে পারেননি। বা খুব উচ্চমানের প্রযোজনাও হয়নি। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে ‘রক্তকরবী’-র প্রযোজনায় অংশগ্রহণ করেন দেবব্রত বিশ্বাস। ‘গীতবিতান’ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষায়তনের প্রযোজনায় নাটকটিতে তিনি বিশু পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তার কিছুদিন পরে তিনি নিজেই ‘রক্তকরবী’ পরিচালনার কাজে হাত দেন। প্রযোজনায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মহিলা সংগঠন ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’। অভিনীত হয়েছিল শ্রীরঙ্গম মঞ্চে। অভিনয়ে ছিলেন শম্ভু মিত্র (রাজা), কণিকা মজুমদার (নন্দিনী), দেবব্রত বিশ্বাস (বিশু পাগল), তৃপ্তি মিত্র (চন্দ্রা), কালী ব্যানার্জি (সর্দার), সজল রায়চৌধুরী (গোঁসাই) এবং কয়েকজন ট্রাম শ্রমিক। মঞ্চ পরিকল্পনায় ছিলেন সূর্য রায় এবং খালেদ চৌধুরী। মঞ্চে রাজাকে আড়াল করার জন্য একটা বিরাট জাল তৈরি টাঙিয়ে তার ভিতরে একটা ছোট ঘর তৈরি করা হয়েছিল। কলাকুশলীদের প্রায় প্রত্যেকেই তখন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। প্রযোজনাটি উচ্চমানের হয়েছিল তো বটেই, পাশাপাশি তার দরজা খোলা ছিল সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের জন্য।
ইতিহাসের কী অদ্ভুত সমাপতন! রবীন্দ্রনাথের নাটকের অভিনয় হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির মহিলা সংগঠন, গণনাট্যের শিল্পী আর ট্রাম শ্রমিকদের যুগলবন্দিতে। কোন নাটক? যে নাটকে যক্ষপুরীর শ্রমিকরা সমস্ত বন্ধন ভেঙে রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নেপথ্যে শোনা যায় কৃষক রমণীর সোনার ফসল ঘরে তোলার ডাক। যেখানে স্বয়ং রাজা তার ‘সিস্টেম’-এর জাল ভেঙে শ্রমিকদের সংগ্রামে যোগ দেন। আর প্রথমবার সেই নাটক অভিনয়ের সাক্ষী হচ্ছেন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। পরিচালনা করছেন রবীন্দ্রসংগীতের ‘ব্রাত্যজন’ দেবব্রত বিশ্বাস আর ‘রাজা’র চরিত্রে শম্ভু মিত্র। সময়কালটাও ছিল অদ্ভুত! মাত্র কয়েকমাস আগে দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই স্বাধীনতার রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে অনেকের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনার মাস খানেক পরেই কমিউনিস্ট পার্টি ‘ঝুটা স্বাধীনতা’ ঘোষণা করে। আর তার প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলেন ‘বুর্জোয়া’ অচ্ছুৎ। যে পথ নির্মাণের কাজ দেবব্রত বিশ্বাসের পরিচালনায় শুরু হয়েছিল, আচমকা তার ব্যাটনটা হাত থেকে ফসকে গেল। অথচ ইতিহাসটা অন্যভাবেও লেখা হতে পারত। এ বিষয় নিয়ে কোনো সংশয় নেই যে বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’র জনপ্রিয়তা আর মঞ্চনৈপুণ্য দেবব্রত বিশ্বাসদের প্রযোজনার তুলনায় অনেক গুণে এগিয়ে ছিল। কিন্তু প্রশ্নটা সাফল্যের নয়, প্রশ্নটা সাধারণ মানুষের মাঝে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কারের। অন্যদিকে শম্ভু মিত্র গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের দল ‘বহুরূপী’ তৈরি করলেন। ১৯৫৪ সালে প্রযোজনা করলেন ‘রক্তকরবী’। রবীন্দ্রনাথকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করল বাংলা নাট্যমহল। ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রইল শম্ভু মিত্রের নাম। যার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। অভিনয়ে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র তো ছিলেনই, মঞ্চ পরিকল্পনায় খালেদ চৌধুরী দুটি প্রযোজনাতেই ছিলেন। রাজার জালের দৃশ্যের মঞ্চসজ্জা দুটি অভিনয়ে একই রকম ছিল। কে বলতে পারে শম্ভু মিত্রের কল্পনায় ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনার ‘ড্রেস রিহার্সাল’ ১৯৪৭-এই হয়ে যায়নি?
.................................
#রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর # দেবব্রত বিশ্বাস # জর্জ বিশ্বাস # রক্তকরবী # বহুরূপী # শম্ভু মিত্র # ভারতীয় গণনাট্য সংঘ # কমিউনিস্ট পার্টি #ফিচার # সিলি পয়েন্ট # বাংলা পোর্টাল # ওয়েবজিন #web portal #অর্পণ দাস