ফিচার

'পথের পাঁচালী' ও সত্যজিতের আপনজনেরা : মিথের বাইরে

মন্দিরা চৌধুরী Aug 26, 2020 at 4:54 am ফিচার

'পথের পাঁচালী' ছায়াছবি নিয়ে গর্ব করে না, এমন বাঙালি নেই। শুধু বাঙালি তো নয়, গোটা বিশ্বের তাবড় ফিল্ম-সমালোচক ও সিনেমাপ্রেমী দর্শককে কয়েক দশক ধরে মুগ্ধ করেছে এই সিনেমা, এবং এখনও করে চলেছে। ১৯৫৫ সালে ২৬ আগস্ট, অর্থাৎ আজকের দিনে মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি। প্রত্যেক প্রদীপ জ্বলার আগে থাকে দীর্ঘ এক সলতে পাকানোর ইতিহাস। পথের পাঁচালীর এই ‘হয়ে ওঠা’ নিয়ে মিথ আছে বিস্তর। সত্যজিৎ-গবেষকদের কল্যাণে ভেঙেও গেছে অনেক মিথ। প্রযোজক খুঁজে পাওয়া, অভিনেতা খুঁজে পাওয়া বা দীর্ঘকালীন শুটিং-এর নানা ওঠাপড়া, অনিশ্চয়তা - সিনেমা হয়ে ওঠার এইসব নেপথ্যকাহিনী আজ আমরা প্রায় সবাই কমবেশি জানি। নানা ঘটনার ভিড়ে মনে রাখা দরকার সেইসব দিনে সত্যজিতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ পরিজনদের ভূমিকার কথাও। তাঁর প্রথম সিনেমা বানানোর দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় কেমন প্রতিক্রিয়া ছিল তাঁর মা কিংবা স্ত্রী-র?

সত্যজিৎ রায়ের মা সুপ্রভা দেবী কিন্তু শুরুতেই অকুন্ঠভাবে ছেলের তালে তাল মেলাতে পারেননি। তাঁর আশঙ্কা ছিল ছেলে বিফল হতে পারে। তবে তখনও তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা ছিল যে সত্যজিৎ তখনও চাকরি ছাড়েননি। তাই তিনি খানিকটা নিমরাজি হয়েছিলেন ছেলের সিনেমা বানানোতে। পরে অবশ্য সুপ্রভা দেবী ছেলের সাফল্যে যথেষ্ট গর্বিত হয়েছিলেন। স্ত্রী বিজয়া রায়ের কিন্তু প্রথম থেকেই সত্যজিতের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিলো। বস্তুত, বিজয়ার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং সাহচর্য ছাড়া সত্যজিতের 'পথের পাঁচালী' হয়ে ওঠা দুষ্কর ছিল। ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার সময়ে জাহাজে সত্যজিৎ 'পথের পাঁচালী'র চিত্রনাট্য লেখা  শুরু করেন। কলকাতায় ফেরার পর বিজয়াই প্রথম এই চিত্রনাট্য পড়েন। এই সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে রিলিজ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন বিজয়া। সিনেমা তৈরির প্রায় সবরকম বন্দোবস্ত শুরু হয়ে গেলেও তখনও অপু চরিত্রাভিনেতা পাওয়া যাচ্ছিল না। বিজ্ঞাপন দিয়ে, পরিচিতদের মাধ্যমে প্রচুর ছেলেকে দেখেও কাউকেই সত্যজিতের পছন্দ হচ্ছিল না। এমন সময়ে একদিন বিজয়া দেখেন তাঁদের বাড়ির সামনের রাস্তায় একটি ছেলে খেলছে। তাকে বিজয়ার অপু হিসেবে মনে ধরে। শেষপর্যন্ত বিজয়াই পাশের বাড়ি থেকে সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্থাৎ 'পথের পাঁচালী'র অপু-কে খুঁজে বার করেন। এছাড়াও দুর্গার চরিত্রাভিনেত্রী উমা দাশগুপ্ত-কে  যখন নিয়ে আসা হয়, তখন বিজয়াই তাঁকে শহুরে আধুনিক মেয়ে থেকে ‘গ্রাম্য’ দুর্গা করে তুলতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। 

'পথের পাঁচালী'র যাবতীয় খরচ শুরু হয়েছিল সত্যজিতের পুঁজি ভাঙিয়ে, সেই পুঁজি ফুরোতেও বেশি সময় লাগেনি। তখন একদিন টাকার প্রয়োজন হলে সত্যজিৎ সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্র-কে বলেন বিজয়ার থেকে তাঁর গয়নার বাক্স এনে তা বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করতে। সুব্রত মিত্র-র কাছে একথা শুনে বিজয়া তৎক্ষণাৎ তাঁর হাতে নিজের গয়নার বাক্স তুলে দেন বিনা বাক্যব্যয়ে! এতটাই সহজ আর সাবলীল ছিল সত্যজিৎ-বিজয়ার বোঝাপড়া। শুটিং শুরু হওয়ার পর বিজয়া নিয়মিত যেতেন শুটিং দেখতে। এইরকম সময়েই বিজয়া অন্তঃসত্ত্বা হন। সত্যজিৎ তখনও চাকরি করছেন, তাই সারা সপ্তাহ অফিসের পর শনি-রবি শুটিং হতো। সেই অবস্থাতেও বিজয়া যেতেন শুটিং দেখতে, কারণ তিনি জানতেন তাঁর ওপর সত্যজিতের নির্ভরতার কথা। এমন সময়েও যে সত্যজিৎ তাঁকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেননি, তা নিয়ে বিজয়া কখনও অনু্যোগ করেননি। শুটিং চলাকালীনই তাঁদের সন্তান সন্দীপের জন্ম হয়। তার আগে ও পরে দীর্ঘদিন বিজয়া শুটিংয়ে উপস্থিত থাকতে পারেননি, কিন্তু গোটা প্রক্রিয়াটার থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হননি।  সবসময় স্বামীর সব কাজেই তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সমর্থক। ঘরে-বাইরে সর্বত্র বিজয়ার সর্বাঙ্গীণ সমর্থনই যে সত্যজিতের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশে সহায়ক হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই।


তথ্যসূত্র- আমাদের কথা/বিজয়া রায়/ আনন্দ পাবলিশার্স           

#পথের পাঁচালী #সত্যজিৎ রায় #বিজয়া রায় #সুপ্রভা রায় #ফিচার #ফিল্ম #মন্দিরা চৌধুরী #বিনোদন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

6

Unique Visitors

219109