ছকভাঙা এক মাতৃত্বের গল্প বলে 'মিমি'
ছবি: মিমি পরিচালক: লক্ষণ উটেকর প্রযোজনা: দীনেশ ভিজন, জিও স্টুডিওস শ্রেষ্ঠাংশে: কৃতি শ্যানন, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, সাই তমহনকর, সুপ্রিয়া পাঠক মুক্তি: ২০২১
প্রথমেই বলে রাখা যাক, এ ছবিতে সারোগেসির দৃশ্যায়নে বিস্তর গোলমাল রয়েছে। ২০১৫ সালে ভারতীয় সরকার আইন করে এ দেশে এসে বিদেশিদের সারোগেসির মাধ্যমে প্রজননের চেষ্টাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে। এছাড়া বিবাহিত ও অন্তত এক সন্তানের জননী না হলে কোন মহিলা সারোগেট মা হতে পারবেন না, এবং সেক্ষেত্রে তাঁর স্বামীর মত থাকা জরুরি। কাজেই মিমির মত একটি অবিবাহিতা মেয়েকে যেভাবে হুট করে সারোগেসির জন্য রাজি করিয়ে ফেলা হল, তা কেবল অবাস্তব নয়, রীতিমতো হাস্যকর।
তবে তথ্যগত ভুল থাকলেও, উড়িয়ে দেওয়া যাবে না এ ছবির মূল বক্তব্যকে। আমেরিকা থেকে ভারতবর্ষে উপযুক্ত সারোগেট মায়ের খোঁজে আসে নিঃসন্তান দম্পতি জন এবং সামার, জয়পুরের হোটেলে মিমিকে নাচতে দেখে তার গর্ভ ভাড়া নেবার ইচ্ছে প্রকাশ করে তারা। মোটা টাকার বিনিময়ে মিমিকে রাজি করাবার দায়িত্ব নেয় ট্যাক্সি ড্রাইভার ভানুপ্রতাপ পাণ্ডে। মিমির স্বপ্ন বলিউড তারকা হবার, মুম্বই যাবার টাকা জোগাড় করতে মার্কিন দম্পতির প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় সে। মাসকয়েক সব ঠিকঠাক চলবার পর আচমকা বাধে গণ্ডগোল। ডাক্তারের কাছে জন ও সামার জানতে পারে, মিমির গর্ভে তাদের যে সন্তান বেড়ে উঠছে, সে নাকি ডাউন সিন্ড্রোম আক্রান্ত। ভয় পেয়ে সন্তানের দায়িত্ব অস্বীকার করে জন এবং সামার, মিমিকে গর্ভপাত করাবার পরামর্শ দিয়ে ভারত ছেড়ে চলে যায় তারা। তারপর শুরু হয় সন্তান নিয়ে মিমির লড়াই, যা এ ছবির মূল উপজীব্য।
সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজমের প্রবক্তাদের কথা অনুযায়ী, ‘সেক্স’ এবং ‘জেন্ডার’ হল দুটি পৃথক ধারণা। সেক্সের সম্পর্ক জীববিজ্ঞানের সাথে, বিভিন্ন লিঙ্গের প্রাণীদের দৈহিক ও জৈবিক পার্থক্য হল তার ফলশ্রুতি। কিন্তু জেন্ডার ঘটিত পৃথকীকরণ সমাজের চাপিয়ে দেওয়া, যার ফলে শিশু অবস্থাকেই ছেলের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ক্রিকেট ব্যাট এবং মেয়ের হাতে পুতুল, ছেলে সন্তানকে বাইরে যাবার এবং মেয়ে সন্তানকে ঘরে বসে সংসার সামলানোর তালিম দেওয়া হয়। ঠিক সেভাবেই, নারী সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম এটি একটি জৈবিক সত্য, কিন্তু সন্তান জন্ম দিয়ে তার লালন পালনই হচ্ছে একটি নারীর স্বাভাবিক কর্তব্য, এমন চরমপন্থী ভাবনা আসে জেন্ডারের চলতি ধারণা থেকে। মাতৃত্ব এবং সারোগেসি, কোনটাই বিষয় হিসেবে হিন্দি ছবিতে নতুন নয়। মা এবং সন্তানের সম্পর্ক নিয়ে তৈরি হয়েছে মাদার ইন্ডিয়া, দিওয়ার থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের হেলিকপ্টার ইলা বা নিল বাটটে সান্নাটা, সারোগেসির প্রসঙ্গ এসেছে দুসরি দুলহন বা চোরি চোরি চুপকে চুপকে ছবিতে। কিন্তু মিমি ছবি হিসেবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এ ছবিতে একবারের জন্যও মিমির মাতৃত্বকে ‘এটাই তো একজন নারীর স্বাভাবিক জীবন’ বলে গ্যাদগেদে সেন্টিমেন্তে মুড়ে দেওয়া হয়নি, বা ‘মাতৃত্ব তোমার অহঙ্কার’ জাতীয় ধুয়ো তুলে মিমির ভোগান্তির প্রসঙ্গটাকে ঘেঁটে দেওয়া হয়নি। সন্তান পালনের দায়িত্ব একা মিমির ঘাড়ে ছেড়ে না দিয়ে আগাগোড়া তার পাশে থেকেছে ভানুপ্রতাপ, বাচ্চা সামলানো খালি তার মায়েরই কাজ, এমন ধারণাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় এ ছবি। রাজের সঙ্গে কথা বলার মুহূর্তে যখন মিমি বলে, তোর জন্য আমি পুরো কেরিয়ার শেষ করে দিলাম, কোথাও যেন তার কণ্ঠে শোনা যায় আফসোসের সুর। যে মেয়ে কয়েকদিন আগেও ঘর ভরতি সিনেমার নায়িকাদের পোস্টার সেঁটে রাখত, তার পক্ষে এটাই তো স্বাভাবিক। মিমি কোনও অসম্ভব রকম মহানুভবতার পরাকাষ্ঠা নয়, সাধারণ দোষে গুণে ভরা একজন মানুষ, টাকার লোভে পেট ভাড়া দেবার পরে একটা নতুন প্রাণের প্রতি মানবিকতার খাতিরে যাকে বাধ্য হয়েই মায়ের ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়েছে। মহান মায়ের ইমেজ লোভনীয় হলেও সত্যিই বিপজ্জনক, কারণ তা প্রায়শই কায়দা করে নারীদের চরিত্রের যাবতীয় আশা আকাঙ্ক্ষাকে পিষে দিয়ে তাকে পাকাপাকিভাবে শহীদ বানিয়ে দিতে চায়।
নতুন প্রাণের প্রতি দায়িত্ববোধকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এ ছবিতে। বারবার বোঝানো হয়েছে, শিশু অসহায়, সুস্থ জীবন পেতে হলে তার পরিণত মানুষের আশ্রয় প্রয়োজন। চাই শুধু সহৃদয় কিছু মানুষ। ছবির শেষে তাই জন এবং সামার এক ভারতীয় অনাথ শিশুকন্যাকে দত্তক নিয়ে দেশে ফিরে যায়, রাজ রয়ে যায় মিমির কাছে। শ্বেতাঙ্গ রাজ থেকে যায় ভারতে ও কৃষ্ণাঙ্গী তারা পাড়ি দেয় আমেরিকা- সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের বার্তাটিও সুন্দর এ ছবিতে। মজার ব্যাপার, রাজ কিন্তু মিমিকে মা বলে না, অন্যান্যদের মত তাকে নাম ধরেই ডাকে। আগেকার দিনে যেখানে মহিলাদের ব্যাক্তিগত নাম বেমালুম অগ্রাহ্য করে তাদের গোবিন্দর মা বা কার্তিকের মা বানিয়ে দেওয়া হত, সেখানে গোটা ছবি জুড়ে মিমি নামের এই প্রাধান্য অবশ্যই আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখে।
মিমি চরিত্রে সুন্দর অভিনয় করেছেন কৃতি শ্যানন, ভালো স্ক্রিপ্ট পেলে তিনি যে নিজেকে মেলে ধরতে পারেন তা বরেলি কি বরফি ছবির পর আবার প্রমাণিত, যদিও তার সংলাপের রাজস্থানি টানে দক্ষিণ দিল্লির আকসেন্ট ঢুকে গিয়ে কিঞ্চিৎ জগাখিচুড়ি হয়ে গেছে। পঙ্কজ ত্রিপাঠী অপূর্ব, সংবেদনশীল ভানুপ্রতাপের ভূমিকায় তাঁর অভিনয়ের জবাব নেই। সাই তমহনকর পার্শ্বচরিত্রে আবার চোখে পড়লেন হান্টার ছবির পর। মনোজ পাওয়া যথাযথ, তবে সুপ্রিয়া পাঠককে যথেষ্ট ব্যবহারই করা হয়নি। লক্ষণ উতেকার এবং রোহণ শঙ্করের চিত্রনাট্য বেশ পোক্ত, দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হবার পরেও ছবির গতি ঝুলে যায়নি। নতুন করে কিছু পাওয়া যায়নি এ আর রহমানের সঙ্গীতে, বিশেষ করে ‘ফুলঝরিয়ো’ গানটিকে হাইওয়ে ছবির ‘জুগনি’ গানের অপভ্রংশ বলে মনে হয়। তবে রহমানের নিজের গলায় ‘রিহাই দে’ শুনতে মন্দ লাগেনি। হিন্দি সিনেমার এই পোড়া সময়ে যেখানে অধিকাংশ ছবিই নারীদেহ বা দেশপ্রেমের তাস খেলে বাজিমাত করতে চায়, সেখানে মিমি দর্শককে একটি সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। প্রাপ্তি হিসেবে এটুকুই বা কম কি?