নিবন্ধ

‘কোরক সাহিত্য পত্রিকা’: প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও আগামী

বিশ্বজিত্ ঘোষাল Oct 29, 2021 at 7:35 pm নিবন্ধ

লিটিল ম্যাগাজিন বাংলা সাহিত্যের এক অপরিহার্য অঙ্গ। নামে ‘লিটিল’ হলেও তার চরিত্র কখনোই ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে না। লিটিল ম্যাগাজিন যেমন ভবিষ্যতের দিশা দেখায়, খুলে দেয় বহু গবেষণার অজানা দিগন্ত; আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিজেই হয়ে ওঠে গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু।

লিটিল ম্যাগাজিন কী, তার পরিসর কতদূর তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও তর্ক হয়েছে। কিন্তু লিটিল ম্যাগাজিন-এর বেঁচে থাকার লড়াই, তার আদর্শ বজায় রেখে অন্যান্য পত্রিকার সাথে নিজেকে জিইয়ে রাখা এবং বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে নিজেকে টিকিয়ে রাখা কতটা কষ্টসাধ্য তা কেবল এই জগতের সাথে যাঁরা যুক্ত তাঁরাই জানেন। সহৃদয় পাঠক উপলব্ধি কিছুটা করতে পারেন বটে, কিন্তু  এই লড়াইয়ের জগৎ সম্পর্কে তাঁরা পুরোপুরি অবগত নন। 

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগের একটি প্রকল্পের সূত্রে ‘কোরক সাহিত্য পত্রিকা’ ও তার সম্পাদক তাপস ভৌমিকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ গড়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে পত্রিকার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। সেই জায়গা থেকেই এই পত্রিকার হয়ে ওঠার কাহিনি ভিতর থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। ১৯৭৭ সালের মে-জুন মাসে একদল তরুণের হাত ধরে কোরক পত্রিকা প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৩২। প্রথম পর্যায়ে সূচীপত্রবিহীন সাধারণ সংখ্যাই প্রকাশিত হত। এই তরুণদল তখনও বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করেনি। তখনও তারা স্কুলের ছাত্র। পত্রিকার সম্পাদক শ্রী তাপস ভৌমিক তখন বাগুইআটি হিন্দু বিদ্যাপীঠের ছাত্র। বয়স সবে ১৫ বছর। মাধ্যমিক পরীক্ষার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শেষ হয়েছে। তারপরেই সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার দরুণ বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। অন্যান্য বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাঞ্জন ঘোষ, রুপু ঘোষ, বাপী পাল, কল্যাণ সাহা, পার্থসারথি দত্ত, নীলকণ্ঠ ওঝা এবং আরও অনেকে। তখনকার দিনে আজকের মত অভিভাবকরা সরাসরি টাকা-পয়সা ছাত্রদের হাতে তুলে দিতেন না, দিলেও তার জন্য কৈফিয়ত দাবি করতেন। তাই সবাই মিলে চাঁদা তুলে পত্রিকার খরচ বহন করতে হত। ফলে সহজেই অনুমেয় যে পত্রিকা প্রকাশ করা কতটা কষ্টসাধ্য ছিল। ১৯৭৮-৮১ সাল পর্যন্ত পত্রিকা অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সময়ের অভাব এবং অর্থের অপ্রতুলতাই ছিল এর কারণ। ১৯৮২ সালে তাপস ভৌমিক মতিঝিল কলেজ থেকে বাংলা অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেন। সে বছরই পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন পর্ব সম্পন্ন হয়। পত্রিকার নাম হয় ‘কোরক সাহিত্য পত্রিকা’। এই সময়পর্বেও ‘কোরক’ নিয়মিত প্রকাশিত হয়নি। অবশ্য নানান বাধা-বিপত্তি থাকলেও পত্রিকার গতিপথ একেবারে থেমে থাকেনি - কিছুটা শ্লথ হয়েছে মাত্র। প্রথমদিকে ‘কোরক’ পত্রিকা বিশ্বাস প্রিণ্টিং হাউস (১৩০, কেশব সেন স্ট্রীট) থেকে প্রকাশিত হত, পরবর্তী সময়ে ‘একুশ শতক’-এর প্রেস থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। প্রথমদিকে আর্থিক সমস্যাই পত্রিকা প্রকাশের প্রধান অন্তরায় ছিল। তখন বিশ্বাস প্রিণ্টিং হাউস-এর কর্ণধার সাহেবদা সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। অনেক সময় টাকা বাকি থাকলেও তিনি আমাদের পত্রিকার কাজ করা বন্ধ করেননি; সবসময় পাশে থেকে আমাদের উৎসাহ দিয়ে গেছেন। এমনও দিন এসেছিল যে পত্রিকার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা না থাকায় তাপসবাবুকে নিজের পিতৃদত্ত ঘড়ি বন্ধক পর্যন্ত রাখতে হয়েছিল; কিন্তু তা সত্ত্বেও পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হয়নি।

উদ্যমের দিক থেকে কোনওদিনই ‘কোরক’ পিছিয়ে থাকেনি। কখনও ২৫ বৈশাখের সময় রবীন্দ্র সদনে একদল তরুণের হাত ধরে পাঠকদের হাতে পৌঁছে দিয়েছে ‘বিশেষ কবিতা সংখ্যা’, আবার কখনও কলকাতা বইমেলায় লিটিল ম্যাগাজিন স্টলে বসে ‘এশিয়ার গল্প’, ‘ইউরোপের গল্প’, ‘লাতিন আমেরিকার গল্প’, ‘আফ্রিকার গল্প’ ইত্যাদি নানাবিধ অনুবাদ গল্পের সংকলন জোগান দিয়েছে উৎসাহী পাঠককে।

১৯৯০ সালের পর থেকে আর ‘কোরক’-কে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। প্রথম ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংখ্যা প্রকাশ পায় এই সময়েই - শিবরাম চক্রবর্তী সংখ্যা (১৯৯০ বইমেলা সংখ্যা), যা পরবর্তী সময়ে বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম বিষয়ভিত্তিক রামায়ণ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৯৫-৯৬ সাল নাগাদ, যা পাঠককুলের কাছে বহু সমাদৃত হয়; পরবর্তী সময়ে বই আকারেও প্রকাশ পায়। এর পরে একে একে ‘বাংলা ভাষা’, ‘অভিধান সংখ্যা’, ‘আকাশবাণী সংখ্যা’, ‘ত্রিপুরা সংখ্যা’, ‘সুন্দরবন চর্চা’ সংখ্যা ইত্যাদি বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা প্রকাশ পেতে শুরু করে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংখ্যাগুলির মধ্যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায় ইত্যাদি বহু সংখ্যাই পাঠকবর্গের হৃদয় জয় করেছিল। এর মধ্যে বহু সংখ্যাই আজ অপ্রতুল। 

‘কোরক’ তার পাঠকদের নানা বৈচিত্র্যময় বিষয়সম্ভার যেমন উপহার দিয়েছে, তেমনই নানা সময় এই পত্রিকা পেয়েছে বহু গুণী মানুষের সাহচর্য। অভিভাবকের মত পাশে থেকেছেন অধ্যাপক অলোক রায়, অরুণ সেন, নির্মল দাস, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য প্রমুখ জ্ঞানী-গুণী মানুষজন; লেখকদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, দেবেশ রায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ বিদগ্ধজনেরা নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করেছেন। ‘ভারতে বহির্ভারতে রবীন্দ্রচর্চা’ সংখ্যার প্রুফ শঙ্খ ঘোষ নিজের হাতে সংশোধন করে দিয়েছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের পত্রিকার পক্ষ থেকে বহু পণ্ডিত মানুষদের চিঠি লিখে দিতেন যাতে আমাদের পত্রিকায় তাঁরা লেখা দেন। তাঁরই সুবাদে ক্লিণ্টন বি. সিলি-র মত পণ্ডিতের লেখা আমরা ছাপতে পেরেছি। 

পত্রিকার প্রচ্ছদের ক্ষেত্রেও বহু গুণী শিল্পীর আনুকুল্য পাওয়া গেছে। বিষয় অনুযায়ী প্রচ্ছদ নির্মাণ একটা পৃথক শিল্পকর্ম। সেই শিল্পের ধারা বহুকাল ধরে ‘কোরক’ বজায় রেখেছে এবং আগামী দিনেও রাখবার চেষ্টা করবে। প্রচ্ছদশিল্পী রূপে আমরা পেয়েছি পূর্ণেন্দু পত্রী, চারু খান, নির্মলেন্দু মণ্ডলের মতো ব্যক্তিত্বদের। বর্তমান সময়ে সঞ্জয়গোপাল সরকার, অনুপ রায়, শ্যামল জানা, অজয় গুপ্তের মতো শিল্পীরা আমাদের পত্রিকার প্রচ্ছদ ও অলংকরণের সাথে যুক্ত আছেন। এটি আমাদের কাছে গৌরবের বিষয়।

আরও পড়ুন : ‘নতুন দিনের আলো’- বাজেয়াপ্ত বই / শ্রুতি গোস্বামী 

পাঠকদের চাহিদার নিরিখে কিছু কিছু সংখ্যা জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যায়। ১৯৯৭ সালে ‘কাজী নজরুল ইসলাম সংখ্যা’-র জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি-র তরফ থেকে ‘কোরক’-কে ‘লিটিল ম্যাগাজিন পুরস্কার’ দেওয়া হয়। ২০১২ সালে কলকাতা বইমেলায় ‘লিটিল ম্যাগাজিন পুরস্কার’ প্রদান করা শুরু হয়। প্রথম বছরই ‘কোরক’ সেই দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হই। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই পুরস্কার তুলে দেন পত্রিকার প্রাণপুরুষ তাপস ভৌমিক-এর হাতে। এছাড়াও আমাদের প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত রবিশঙ্কর বল-এর লেখা ‘মধ্যরাতের জীবনী’ (২০০৩) এবং তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়-এর লেখা ‘হাতের মুঠোয় পৃথিবী’ (২০০৪) পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কর্তৃক পুরস্কৃত হয়।

আরও পড়ুন : একটি হিমশীতল স্বীকারোক্তি : শামশের আনোয়ারের কবিতা / আহ্নিক বসু 

১৯৭৭ সালে যাত্রা শুরু করা সেই ছোট্ট পত্রিকা আজ বহু পাঠকের মননের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে। এই কাজ সম্ভব হয়েছে সম্পাদক তাপস ভৌমিক-এর নিরন্তর প্রচেষ্টা, দায়বদ্ধতা ও পরিশ্রমের ফলে। কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার নয়, সাহিত্যের মান অক্ষুণ্ণ রেখে তাকে সহজ-সরল ভাবে পরিবেশন করাই ‘কোরক সাহিত্য পত্রিকা’-র বরাবরের উদ্দেশ্য। সাহিত্যের প্রতি যাতে পাঠকের অনুরাগ বজায় থাকে, সেই চেষ্টায় একনিষ্ঠ থাকাটাই পত্রিকার প্রাণশক্তি। 


কৃতজ্ঞতা স্বীকার : 

১) কোরক সাহিত্য পত্রিকা-র সম্পাদক তাপস ভৌমিক, যিনি বহু তথ্য দিয়ে আমাকে এই প্রবন্ধটি লিখতে সাহায্য করেছেন, ওঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

২) ‘লিটল প্রচার লিটল প্রসার’ ফেসবুক গ্রুপ থেকে বহু দুষ্প্রাপ্য ছবি আমি গ্রহণ করেছি। ‘শ্রীময়ী পত্রিকা’-র সম্পাদক সুশোভন রায়চৌধুরীকে এর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

........................ 


#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #silly পয়েন্ট #Web Portal #কোরক #লিটল ম্যাগাজিন #Little Mgazine #বিশ্বজিত্ ঘোষাল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

20

Unique Visitors

219132