'ভেঙে যায় অনন্ত বাদাম’ : স্মরণে বিজয়া মুখোপাধ্যায়
“অবিশ্রাম বুকের ভেতরে ঘণ্টা বাজছে। কোথাও যাবার কথা ছিল...।”
মানুষের অর্জিত নানাবিধ দুর্ভাগ্যের মধ্যে অন্যতম হল, সে মরে গেলেই আচমকা সামাজিক হয়ে যায়। যদিও কবিরা একেবারেই বিপন্ন প্রজাতি, তবু মরে গিয়ে অন্তত কিছুদিনের জন্য তো বই বিক্রি বেড়ে যায় কবিরও। বেঁচে থাকতে যেটুকু যা আদর, মরে গেলে বাণিজ্য তার চেয়ে অনেক অনেকটা বেশি। মরে গিয়েই না ‘দিল বেচারা’ নামের ছবিটির জন্য আইএমডিবির সর্বকালীন রেকর্ড রেটিং অর্জন করতে পারলেন সুশান্ত সিং রাজপুত। কিছুদিন আগের ‘সোনচিরিয়া’ ছবিতে অসাধারণ অভিনয় কতজনেরই বা নজরে এসেছে। কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায় আজ মারা গেলেন। তাঁর বইটই নিশ্চয়ই অনলাইনে অর্ডার দেবার কথা ভাববেন কেউ কেউ।
আমাদের মাটিতে পেড়ে ফেলে আমাদের ওপর দিয়ে আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে চলে যাচ্ছে ঘটনার স্রোত। ফেক ঘটনা, ম্যানুফ্যাকচার্ড ঘটনার মাঝে কয়েকটা সত্যি ঘটনাও ঢুকে পড়ছে মাঝেমধ্যে। একটা বুঝে উঠতে না উঠতে পরেরটা। অচল আধুলির মতো আমাদের ইন্দ্রিয়সকল খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না। অপমানিত রাজ্যপালের মতো তারা। আছে, কিন্তু কাজে লাগে না। বিরক্তই করে বরং। সেই ১৯৬৮ সালে মোক্ষম কথাটা বলে দিয়েছিলেন অ্যান্ডি ওয়ারহল। বলেছিলেন, সকলেই ১৫ মিনিটের জন্য বিখ্যাত হবে। বছর পাঁচেক আগে গুগলের সার্ভে দেখাল, মানুষের গড় মনোযোগের পরিমাণ এখন গোল্ডফিশের চেয়েও কম। মাত্র ৮ সেকেন্ড। মরে যাওয়া হচ্ছে মানুষের হাতের শ্রেষ্ঠ আয়ুধ, যা দিয়ে সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পাওয়া যেতে পারে। কবির মৃত্যুতে অবশ্য তেমন তাৎপর্য নেই। ভিড় নেই। হইহল্লা নেই। তত বিখ্যাত তো নয় এ হৃদয়পুর। বিজয়া মুখোপাধ্যায়ই তো আমাকে প্রথম স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন কবিকে সহজ কথায় কীভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে -
“প্রত্যেক কবির সঙ্গে একজন ভিন্ন লোক থাকে একটা ছুরি থাকেলোক ও ছুরির মধ্যে অতি দ্রুত কবি হেঁটে যায়।”
সেই বিজয়া মুখোপাধ্যায় আজ মারা গেলেন। ৮৩ বছর বয়সে। তিনি ছিলেন শেষ জীবিত ‘কৃত্তিবাসী’দের একজন (আদি অকৃত্রিম কৃত্তিবাস পত্রিকার কথা হচ্ছে, বলাই বাহুল্য)। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি যুগ, একটি লিগ্যাসি অবসানের দিকে আরও এক পা এগিয়ে গেল। আর এক বিখ্যাত কবি ও ‘কৃত্তিবাসী’ শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী ছিলেন তিনি। ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। প্রবন্ধকার হিসেবেও লব্ধপ্রতিষ্ঠ ছিলেন। অনুবাদও করেছেন অনেক। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় বই লিখেছেন। পাণ্ডিত্যের ছোঁয়া থেকে সবসময় সম্পূর্ণ মুক্ত নয় তাঁর কবিতা। কিন্তু অনুভবের আলোই বেশি করে আভাসিত হয়ে থাকে। ‘সঙ্গী’ কবিতা থেকে একটি স্তবক উদ্ধার করি, যেটা আমার পড়া একেবারে প্রথমদিকের ‘বিজয়া মুখোপাধ্যায়’। লেখার সময় এখনও আমাকে মিলিয়ে নিতে হয় না এর একটা শব্দও -
“আমরা যার সঙ্গে নিত্য বসবাস করিতার নাম প্রেম নয়, উদ্বেগ। প্রেম অতিথির মতোকখনও ঢুকে পড়ে অল্প হেসে, সমস্ত বাড়িতে স্মৃতিচিহ্ন ফেলে রেখে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়।”
খুব কম কবিই আছেন, যাঁরা নিজেরা নারী হলেও লিঙ্গপরিচয় তাঁদের কবিতায় মাথা উঁচিয়ে থাকে না। বিজয়া মুখোপাধ্যায় তেমন একজন কবি। নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে নিজের অঞ্চলের অধিকার তিনি বুঝে নিতে চান। তবু, তিনি নিজে নারীর চোখে না দেখতে চাইলেও, আমাদের সামাজিক বিন্যাসের কারণে নারীর একটা আলাদা সার্বভৌম জমিন চিহ্নিত হয়েই থাকে। সেদিক থেকে খুব তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে তাঁর ‘পুঁটিকে সাজে না’ (বিশ্বের সমস্যাপূরণের ভার তোকে দেওয়া হয়নি পুঁটি…), ‘ভেঙে যায় অনন্ত বাদাম’ (ফেটে যায় বাদামের খোলা/ নির্ভুল অঙ্গুষ্ঠ ওঠে নামে…), ‘তাঁতবস্ত্র’ (মেয়েরা ঢুকবে না তাঁতঘরে…) বা ‘ওরা’ (মা আর মেয়ে গান গাইছে, ‘আমারে কে নিবি ভাই, সঁপিতে চাই’…)-র মতো কবিতা।
উৎপলকুমার বসুর একটা চমৎকার মন্তব্য মনে পড়ছে। কবিতা তো আসলে নিছক কিছু শব্দের সমষ্টি নয়। কবিতায় আমরা শব্দ দিয়ে একটা স্পেসকে অর্ডার করি। কবিতা যতটা না শব্দ, তার চেয়ে বেশি করে বোধহয় ওই স্পেসটা। ওই ডায়মেনশন, ওই দিগন্ত। ওইটাই কবিতা। বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতা প্রসঙ্গে এই কথাটাই মনে হয়। সহজ শান্ত নিরুচ্চার কথনভঙ্গিতে তিনি ওই স্পেসটাকে নিয়ে চমৎকার খেলা করেছেন। আমার প্রভুর জন্য (১৯৬৭), যদি শর্তহীন (১৯৭১), ভেঙে যায় অনন্ত বাদাম (১৯৭৭), উড়ন্ত নামাবলি (১৯৭৯) থেকে দাঁড়াও তর্জনী (১৯৮৮), অশ্লেষা তিথির কন্যা (১৯৯৩), ভাষায় যেটুকু বলা যায় (২০০৫) বা আজন্ম হস্টেলে আছি (২০১৩) পর্যন্ত রাস্তায় তাঁর লেখা যেভাবেই বাঁক নিক না কেন, এই জিনিসটা বদলায়নি। স্বল্প পরিসরে সবটা আলোচনা সম্ভব না। আমি শুধু আলাদা করে উল্লেখ করতে চাইব আর একটি প্রসঙ্গ। তাঁর স্মরণ- কবিতাগুলি। বিনয় মজুমদারকে টানা গদ্যে নিয়ে লিখেছিলেন ‘বিনয় সমীপে’ - “বাস্তবিক, আপনি কাব্য ও গণিতকে যদি একটি বিন্দুতে এনে মেলাতে পারেন, তাহলে বাংলা কবিতার চারপাশ থেকে বহু ভুষিমাল ঝরে পড়ে যাবে এবং আধুনিক কবিতায় এর চেয়ে বড় কাজ এখন আর কিছু নেই - একথা কে না মানবে।” এছাড়া দেবব্রত বিশ্বাস বা সন্দীপনের স্মৃতি নিয়ে লেখা কবিতাগুলি ভুলে যাওয়া অসম্ভব। ভুলে যাওয়া অসম্ভব আরও অনেক অনেক কবিতা। সেগুলো নিয়ে বিস্তারে আলোচনা হবে নিশ্চয়ই। কারণ কবি মারা গেছেন। ভালো লাগবে কবি যদি দীর্ঘজীবী হন। এরকম সময়ে কি সেরকম আশা করা যায়? কিছুই কি এখন আশা করা যায়? কিছুই কি আঁকড়ে ধরা যায়? কে জানে।
আমরা শুধু জানি, কোথাও যাবার কথা ছিল। কোথাও একটা। অবিশ্রাম তাই বুকের ভেতরে ঘণ্টা বাজছে। এটুকুই।
#বিজয়া মুখোপাধ্যায় #স্মরণ