'আয়াপ্পানাম কোশিয়াম' - অহং ও প্রতিপত্তির সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি
ছায়াছবি : আয়াপ্পানাম কোশিয়াম পরিচালনা/গল্প : কে. আর. সচ্চিদানন্দন চিত্রগ্রহণ : সুদীপ এলামন সঙ্গীত : জেকাস বিজয় মাধ্যম : অ্যামাজন প্রাইম
কেরালার সবুজঘেরা স্বপ্নদুনিয়ার এক ছোট্ট জনপদ আট্টাপ্পাড়ি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বিস্তৃত সংরক্ষিত অরণ্যের বুক চিরে যান চলাচলের রাস্তা, মানুষের থেকে হাতির আনাগোনাই বেশি সেখানে। গভীর রাতের নিকষ কালো আস্তরণ ভেদ করে গাড়ির হেডলাইট ছুটে চলে সেই রাস্তা ধরে। মাঝপথে পুলিশ আর আবগারি দপ্তরের নাকাবন্দিতে থামতে বাধ্য হয় বৃদ্ধ ড্রাইভার কুমারন। রুটিন খানাতল্লাশি মুহূর্তে ভোল পালটে ফেলে যখন গাড়ির আরোহী, অবসরপ্রাপ্ত সেনা হাবিলদার কোশি কুরিয়েন, মদ্যপ অবস্থায় পুলিশের গায়ে হাত তুলে বসে। সাব ইন্সপেক্টর আয়াপ্পান নায়ারের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে হাজতে চালান হয় কোশি। বাবার প্রতিপত্তির জোর খাটিয়ে সে প্রতিহিংসার ছক কষে, নায়ারের ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে তাকে মিডিয়ার চোখে খলনায়ক সাব্যস্ত করে। নায়ারের সাতাশ বছরের চাকরির সম্মান, সরকারি মেডেল – সবকিছু এক লহমায় তছনছ হয়ে যায়। দুই পুরুষের অহং আর প্রতিপত্তির এক আশ্চর্য লড়াই শুরু হয়।
এই সিনেমা আসলে এক অদ্ভুত দড়ি-টানাটানির নাটকীয় আখ্যান, যার একদিকে রয়েছে কোশির মিলিটারি অহং, বাবার দাপুটে ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেকে জাহির করার তাগিদ, আর অন্যদিকে আয়াপ্পানের একরোখা পুরুষকার, নীতিবোধের দর্শন। সংঘাত যত তীব্র হতে থাকে, কোশি বুঝতে পারে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তির বাইরেও আরেকটা জগত আছে – ব্যক্তিত্বের জগত। আয়াপ্পানের সৎ ও আপোষহীন ব্যক্তিত্ব তাকে ওই অঞ্চলের অবিসংবাদী নেতা বানিয়ে তুলেছে। তার অধস্তন সহকর্মী থেকে বাজারের লজ-মালিক, ছিঁচকে চোর থেকে দিন-আনি-দিন-খাই আদিবাসী – সবাই তার অপমানকে নিজের অপমান বলে ভাবতে শুরু করে। এ এক অদ্ভুত প্রতিপত্তির খেলা, যা কোশি এবং তার বাবার কাছে একেবারেই অচেনা। খেলার সুতো কোশির হাত থেকে যত আলগা হতে শুরু করে, সে ততই খ্যাপা ষাঁড়ের মতো নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যায়। উল্টোদিকে অন্যায় প্রভাব খাটানোর অভ্যাসকে ঠান্ডা করতে আয়াপ্পানের একগুঁয়ে আগ্রাসন, তাকে তার অতীতের হিংস্রতায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে।
একে অপরকে এক ইঞ্চিও জমি না-ছাড়ার এই গল্পে পরিচালক সাচি খুব সুচারু ভাবে একাধিক সমান্তরাল পরত বুনে চলেন। সিনেমা শুরু হয় কেরালার অতি প্রাচীন মুন্দুর কুম্মাট্টি উৎসবের মাঝে এক খুনের দৃশ্য দিয়ে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে হরিজন সম্প্রদায়ের উপর জমিদারদের অত্যাচারের কুখ্যাত ইতিহাস থেকেই জন্ম নেয় এক ভয়াবহ মিথ। আয়াপ্পানের স্ত্রী, আদিবাসী কন্যা কান্নাম্মা, তার একরত্তি ছেলেকে কোলে নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায়। কান্নাম্মা-আয়াপ্পানের সাংসারিক সমীকরণ, কোশি ও তার স্ত্রী রুবির সম্পর্ককে এক বিপ্রতীপ বিন্দুতে দাঁড় করিয়ে দেয়। কোশির পুরুষত্ব যেখানে ভালবাসায় রুবির গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা বোধ করে না, আয়াপ্পান সেখানে চাকরি-সম্মান-আশ্রয় সবকিছু হারিয়েও কান্নাম্মাকে যোগ্য সম্মান দেওয়ার দায়িত্ববোধ থেকে বিচ্যুত হয় না। আয়াপ্পানের সঙ্গে লড়াই, কোশির জন্য আস্তে আস্তে বহুমুখী হয়ে পড়ে। বাবার এই ক্ষমতার অপব্যবহারের অভ্যাসকে, নিজের অন্যায় আচরণকে বারবার প্রশ্ন করতে থাকে সে। অথচ আয়াপ্পানের একমুখী লড়াইয়ের সামনে তার অহং মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তার প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টাকে প্রতিহত করতে থাকে “মুন্দুরের ভ্যাম্পায়ার” মিথের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার চেষ্টা। সিনেমার শেষ অবধি এই সংঘাতের ছন্দকে পরিচালক এক মুহূর্তের জন্যও স্তিমিত হতে দেননি।
নিঃসন্দেহে এই সিনেমার মূল কারিগর এর অভিনেতারা। আয়াপ্পানের চরিত্রে অনবদ্য বিজু মেননের পাশাপাশি কোশির ধূসর চরিত্রে পৃথ্বীরাজ অতুলনীয়। তাকে এখানে দেখলে বোঝা যায়, কিছু ফালতু বলিউডি সিনেমায় নিজের অভিনয় প্রতিভার সঙ্গে কী অবিচারটাই না তিনি করেছেন! এই দু’জনের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে গেছেন বাকি পুলিশকর্মীরা। কান্নাম্মার চরিত্রে গৌরী নান্ধা নিজেকে উজাড় করে দেন, তার নির্বাক অভিব্যক্তি হাজার ডায়লগের থেকেও বেশি শক্তিশালী। গোটা সিনেমা জুড়ে গল্পের ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে আবহসঙ্গীতের লয় পরিবর্তন, ছবির মুড ধরে রাখে। আট্টাপ্পাড়ি রিজার্ভ ফরেস্টের রূপ-রসকে অনন্য দক্ষতায় ক্যামেরাবন্দি করে থ্রিলারের আবহে জঙ্গলের নৈর্ব্যক্তি মিশিয়ে দেন চিত্রগ্রাহক সুদীপ। আয়াপ্পান ও কোশির আখ্যান, ধীরে ধীরে আমাদের ক্ষুদ্র অহং আর ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের গল্প বুনে যায়।
#ayyappanum koshiyum #film #review #Ayyappan and Koshi #Malayalam #action thriller # Sachy #Prithviraj Sukumaran #Biju Menon #Gold Coin Motion Picture Company. # Anna Rajan #K. R. Sachidanandan #সায়নদীপ গুপ্ত #ফিল্ম রিভিউ