নাট্যজগৎ ও পিকাসো
প্রথম পর্ব : থিয়েটার ডিজাইনার পিকাসো
....................................................................
ছেলেবেলায় পিকাসোকে তাঁর বাবা প্রায়শই বুল ফাইট দেখাতে নিয়ে যেতেন। সেই বুল ফাইটের দৃশ্যই বছর আট-নয়ের পিকাসোর আঁকা প্রথম ছবি। ছবিটিতে তিনি একটি পারফর্ম্যান্সের সমস্ত অংশের সুনিপুণ বর্ণনা দিয়েছেন – এরিনা, পারফর্মার এবং দর্শক। সহজেই বোঝা যায় যে ঐ অল্পবয়সেই তিনি মঞ্চ, নাটক ও অভিনেতার-দর্শকের আন্তর্নির্ভরতার সমীকরণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। এই বুল ফাইটের থিম ও তার নাটকের ন্যায় রীতিনীতি-সাজসজ্জা – এসবই চিত্রশিল্পী পিকাসোর শিল্পীজীবনের প্রিয় বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল।
পাবলো পিকাসো, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর নাম জানেন না এহেন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে চিত্রশিল্পী রূপে তাঁর বিশ্বজুড়ে খ্যাতি হলেও তাঁর শিল্প দক্ষতার ব্যাপ্তি শুধু ওই পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল না, নিজের সমকালীন নাট্যজগতেও তিনি তাঁর শৈল্পিক গুণের বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছেন কখনও মঞ্চসজ্জায়, কখনও বা নাট্যকাররূপে। গবেষক, জীবনীকারদের অগণিত লেখাপত্রে তাঁর জীবনযাপন, চিত্রকর্ম স্থান পেলেও প্রায়শই ব্রাত্য থেকে গেছে তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক - তাঁর থিয়েটার জীবন।
আট বছর বয়সে পিকাসোর আঁকা ‘ল্য প্যতি পিকাদোর জওন’ (১৮৮৯)
বিশ শতকের গোড়ার দিকে পিকাসো প্যারি ও বার্সেলোনায় থাকতে শুরু করেন, মূলত এইসময় থেকেই থিয়েটারের বিষয়বস্তু নিয়ে পিকাসো আঁকার শুরু। তিনি তাঁর এইসময়ের নানা চিত্রকর্মে দেগা, তুলুস-লওত্রেক প্রমুখের ইম্প্রেশনিস্ট স্টাইলে দর্শকের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে ক্যাবারে, মিউজিক হলের পারফর্ম্যান্সের আনন্দোচ্ছল দৃশ্য তুলে ধরেছেন। বহু বছর পর তাঁর তৈরি ‘কোয়াদ্রো ফ্লামেঙ্কো’ ব্যালে-র যবনিকাতেও এই পর্বের চিত্রশিল্পের প্রভাব স্পষ্ট।
১৯০৪ থেকে প্যারিস শহরের মঁমার্ত-তে পাকাপাকিভাবে বাস করতে শুরু করেন পিকাসো। ফার্নান্দে ওলিভিয়ের, পিকাসোর সেইসময়ের বন্ধু তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন যে পিকাসো এবং তাঁর বন্ধু ম্যাক্স জাকব ও আঁদ্রে সালমঁ হপ্তায় তিন-চারদিন বাত্যু লাভুয়া-এ সার্কাস দেখতে যেতেন। পারফর্মিং আর্টসের প্রতি পিকাসোর এই তীব্র ঝোঁক ও এইসময়ে সার্কাসজীবন নিয়ে তাঁর চিত্রকর্মগুলি যেমন তাঁকে পরবর্তীতে থিয়েটার ডিজাইনার হতে প্রভাবিত করেছিল তেমনই আপোলিন্যার-এর “আঁ ফাঁতম দ্য ন্যুই” ও রিল্কের “ফিফথ্ দুইনো এলিজি” রচনাতেও প্রভাব ফেলেছিল।
১৯০৫-এ পিকাসোর সাথে পরিচয় হয় গিওম আপোলিন্যার-এর, যিনি পরবর্তীতে পিকাসোর কিউবিস্ট ঘরানার চিত্রশিল্প নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি শুরু করলে পিকাসো-সৃষ্ট এই নতুন ধরনের চিত্রশিল্প পরিচিতি পেতে থাকে। আপোলিন্যার-এর সূত্রেই পিকাসোর পরিচয় হয় আলফ্রেড জারি, জাঁ কোক্তু ও সের্গেই দিয়াঘিলেভ-এর সঙ্গে। এইসময় পল ফো ও ল্যুন্যে-পো প্রমুখের ‘সিম্বলিস্ট থিয়েটার’-এ প্রযোজনার কাজে চিত্রকরদের নিয়োগ করা শুরু হলে ফরাসী নাট্যজগতে এক বিপুল পরিবর্তন আসে। পিকাসোর প্রত্যক্ষভাবে থিয়েটারের কাজে নিয়োজিত হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়।
‘পারাড’ (১৯১৭) ব্যালের পোশাকের মাধ্যমে গগনচুম্বী অট্টালিকা ও প্রশস্ত পথ দেখিয়েছিলেন পিকাসো
নতুন ধারার সঙ্গে তালমিলিয়ে সের্গেই দিয়াঘিলেভ-এর ‘লে ব্যালে রুস্’ প্রযোজিত অনেকগুলি ব্যালে-তে মঞ্চসজ্জা, পোশাক, যবনিকা – সবকিছুর পূর্ণ দায়িত্ব পড়েছিল পিকাসোর ওপর। ১৯১৭-এ ‘পারাড’ ব্যালের জন্য পিকাসোর তৈরি মঞ্চসজ্জা ও যবনিকা-পর্দায় দুই বিপরীতধর্মী থিমের প্রয়োগ দেখা যায়। ‘রোজ্’ পর্বের চিত্রকর্মের ন্যায় এগুলিতেও হালকা রঙের প্রয়োগ রয়েছে যা ব্যাকড্রপের গাঢ় রঙের সঙ্গে মিলে অদ্ভুত এক দৃশ্য তৈরি করে। মঞ্চসজ্জায় বিভিন্ন আকৃতি ও অছায়াবৃত রঙের প্রয়োগ পিকাসোর ‘কিউবিজম্’-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পাশাপাশি যবনিকাটি বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে যেমন তুলে ধরে সার্কাস জীবনের দুই বিপরীতধর্মী দিক, তেমনই প্রতিভাত হয় ‘ট্র্যাডিশনাল রিয়ালিজম্’ ও ‘কিউবিজম্’ ঘরানার চিত্রবৈশিষ্ট্যের তফাৎও – ফলে দ্বিগুণ হয় ‘ড্রামাটিক এফেক্ট’। ‘পারাড’-এর পোশাক ডিজাইনের ক্ষেত্রেও এই বিপরীতধর্মীতার ধারাকে বজায় রেখেছেন পিকাসো। মঞ্চসজ্জা ও পোশাক-এর ক্ষেত্রে পিকাসোর এই অভিনব চিত্রকলার প্রয়োগ ‘পারাড’-এর প্রথম মঞ্চস্থাপনা থেকেই দর্শকদের মধ্যে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল।
পিকাসো নির্মিত ‘ল্য ত্রিকর্ন’ ব্যালের যবনিকা (১৯১৯)
১৯১৯-এ ‘ব্যালে রুস্’ পেদ্রো দে আলার্কন্ রচিত উপন্যাস ‘এল সোম্ব্রেরো দে ত্রেস পিকোস’ বা ‘থ্রি কর্নার্ড হ্যাট’ অবলম্বনে ‘ল্য ত্রিকর্ন’ নামের একটি ব্যালে প্রযোজিত করে, এতে মানুয়েল দে ফায়া-র সঙ্গীত নির্দেশনা ও লিওনাইদ মাস্সিন-এর ফ্লামেঙ্কো নৃত্যের প্রয়োগের সঙ্গে পোশাক ও মঞ্চসজ্জা করেছিলেন পিকাসো। একে পিকাসো নিজে আন্দালুসিয় তার ওপরে মূল কাহিনিটি স্পেনীয় হওয়ায় এই কাজটি তাঁর জন্য ছিল একেবারে ‘মেড-টু-অর্ডার’, ফলত, মাত্র একটি সন্ধ্যায় সমস্ত ডিজাইনের কাজ শেষ করেছিলেন তিনি। যবনিকা ও মঞ্চ – দুয়ের সজ্জাতেই পিকাসো প্রয়োগ করেন টেরাকোটা ও বেইজ রঙের, পোশাকে ব্যবহার করেন সাদা ও লাল রঙ যা আদ্যোপান্ত স্পেনীয়। মঞ্চ ও পোশাক ডিজাইনের ক্ষেত্রে কিউবিজমের ছোঁয়া ও তার সাথে ফায়া ও মাস্সিনের নির্দেশনার এরূপ সরল প্রয়োগ আঁদ্রে রিগু, আদোলফে বোশু, অঁরি বিদু, লুই লালুয়া-র মত সমালোচকদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা পায়।
পিকাসোর ডিজাইন করা ‘পুলচিনেল্লা’ ব্যালের পোশাক (১৯২০)
১৯২০ সালে ‘পুলচিনেল্লা’ ব্যালের মঞ্চসজ্জায় ইতালীয় কমেডিয়া দেলার্তে-র নানা বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়েছিলেন পিকাসো। ব্যাকড্রপে দুপাশে সারি সারি বাড়ির মাঝে সরু রাস্তা, চন্দ্রালোকিত সমুদ্র, মাছশিকারের নৌকা, ভিসুভিয়াসের ছবির মাধ্যমে নেপলস্ শহরকে তুলে ধরেছিলেন পিকাসো। ধূসর ও নীল রঙের চন্দ্রালোকিত ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে ফোরগ্রাউন্ডে পারফর্মারদের শ্বেতবর্ণের পোশাক সমগ্র দৃশ্যটিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিল। মঞ্চের ডিজাইনের ক্ষেত্রে পিকাসো তিন-প্যানেলের স্ক্রিন ব্যবহার করেন, যার মাঝেরটি ছিল একেবারে সামনে ও দুপাশের প্যানেলদুটি ছিল সামান্য হেলানো। পিকাসো একটি ছোটো দৃষ্টিভঙ্গিগত কৌশলের প্রয়োগ করেছিলেন যাতে দর্শকদের কাছে প্রতিভাত হয়েছিল যে মাঝের প্যানেলটি সবথেকে দূরে অবস্থিত ও পাশের প্যানেলদ্বয় ক্রমাগত তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
পিকাসোর করা ‘কোয়াদ্রো ফ্লামেঙ্কো’র মঞ্চসজ্জা (১৯২১)
১৯২১-এ ‘কোয়াদ্রো ফ্লামেঙ্কো’ ব্যালের জন্য পিকাসো যে মঞ্চ ও পোশাক ডিজাইন করেছিলেন তা তাঁর থিয়েটার ডিজাইনার হিসেবে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। একমাস সময়ে শেষ করা এই ডিজাইনে তিনি অধিকাংশ দৃশ্য নিজে এঁকেছিলেন, ইল্যুশনের প্রয়োগে দর্শক-পারফর্মার সমীকরণকে অন্য আঙ্গিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। মঞ্চসজ্জায় ট্র্যাডিশনাল স্পেনীয় রঙ, লাল, সোনালী ও কালো রঙের ব্যবহারে চিত্রাঙ্কিত ‘ত্রোম্পলোই’ বা ‘স্টেজের মধ্যে স্টেজ’ ইল্যুশনের প্রয়োগ এবং পোশাকের ক্ষেত্রে ব্যাকড্রপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চিরাচরিত ফ্লামেঙ্কো-পোশাকের প্রয়োগ পিকাসোর চিত্রশিল্পের পাশাপাশি থিয়েটার দক্ষতারও পরিচায়ক।
পিকাসো নির্মিত ‘ল্য ত্রাঁ ব্ল’ ব্যালের যবনিকা (১৯২৪)
ব্যালেগুলির নাট্য-প্রযোজনার সঙ্গে তাঁর শিল্পকার্যের অভাবনীয় মেলবন্ধনের কারণে শিল্পীমহলে পিকাসোর জনপ্রিয়তা অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ডিজাইন-বিষয়ক সমস্যার সমাধানে বা অন্যশিল্পীর করা ডিজাইনের সম্পূর্ণ করার জন্যও অনেকসময় প্রায় শেষমূহূর্তে অন্য নাট্য-প্রযোজকদের কাছে তাঁর প্রায়শই ডাক পড়ত। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত থিয়েটার-বিষয়ক ডিজাইনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পিকাসো ১৯২৪-এর পর কখনই মঞ্চ, পোশাক ও যবনিকা – সবকিছু একসঙ্গে ডিজাইনের পূর্ণ দায়িত্ব নেননি। ১৯২২-এ জাঁ কোক্তু সফোক্লিসের ‘আন্তিগোনে’-র অ্যাডাপ্টেশনে পিকাসো মঞ্চসজ্জা করেছিলেন। ১৯২৪-এ দারিয়ুস মিউও-র অপেরা ‘ল্য ত্রাঁ ব্ল’-এর জন্য পিকাসো শুধুমাত্র যবনিকার ডিজাইন করেছিলেন, এটিই দিয়াঘিলেভ-এর ‘ব্যালে রুস্’-এর সঙ্গে তাঁর শেষ কাজ। রঁমা রঁলা-র ‘ল্য ১৪ জুইয়ে’-তেও যবনিকার ডিজাইন করেছিলেন পিকাসো, এই যবনিকার শিল্পকর্মের সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘গের্নিকা’-র বেশকিছু মিল রয়েছে। ১৯৪৪-এ জাঁ রাসিন-র নাটক ‘আঁদ্রোমাক’-এ অভিনেতা জাঁ মারে-র ব্যবহৃত একটি ঝাঁটার হাতলের ওপর চিত্রকার্য করেছিলেন পিকাসো, এতটাই আকর্ষণীয় ও সুন্দর ছিল সেই কাজ যে অভিনেতার সজ্জাঘর থেকে সেটি চুরি যায়। এছাড়াও তিনি পরবর্তীতে পিয়ের ব্লঁশা-র অ্যাডাপ্টেশন ‘আদিপে রোয়া’-এ মঞ্চসজ্জা ও সার্জে লিফা-র অপেরা ‘ইকা’-র ও ব্যালে ‘লা’প্রে-মিদি দাওঁ ফন’-এর জন্য যবনিকার ডিজাইন করেছিলেন।
****************************
তথ্যসূত্র:
(১) Rubin, William. Pablo Picasso: A Perspective.
(২) Olivier, Fernande. Picasso and His Friends. Translation J. Miller.
(৩) Gilot, Françoise. My Life with Picasso.
(৪) Brassai. Picasso & Co.
(৫) Cooper, Douglas. Picasso Theatre.
চিত্রঋণ: ইন্টারনেট
প্রচ্ছদ: পিকাসো চিত্রিত হারলেকুইন পরিচ্ছদ পরিকল্পনা
******************************
#পাবলো পিকাসো #কিউবিজম #নাট্যজগত #চিত্রশিল্প #নাট্যশিল্প #নাট্যসজ্জা #নাটক #সিরিজ #অলর্ক বড়াল #সিলি পয়েন্ট #বাংলা পোর্টাল #ওয়েবজিন #web portal