অভিমুখ (পর্ব : নয়)
আকস্মিক ও বিপজ্জনক স্বপ্নে 'চাকদহ নাট্যজন' *****************************************************
উত্তর চব্বিশ পরগনার চাকদহ সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধশালী জনপদ। যদিও ব্রিটিশ প্রসেনিয়াম-চর্চার অনুকরণে কলকাতা থেকে জেলায় জেলায় যেভাবে প্রসেনিয়াম মঞ্চ ও চর্চা বিস্তার লাভ করেছিল, চাকদহেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ফলত এখানে কখনোই অন্তরঙ্গ নাট্যচর্চার কোনো বাতাবরণ ছিলনা। শ্যামাপ্রসাদ ময়দান বলে একটি মুক্তমঞ্চ ছিল। তাকে ঘিরেই নাট্যচর্চা ডালপালা মেলত। কিন্তু বর্তমানে এই শ্যামাপ্রসাদ মুক্তমঞ্চ পৌরসভার তত্ত্বাবধানে সরকারি বিল্ডিং-এ পরিবর্তিত হচ্ছে। অবশ্য দু দশক আগে 'সম্প্রীতি মঞ্চ' নামে একটি বড় কমিউনিটি হল চাকদহে হয়েছে। তাকে কেন্দ্র করেই ইদানিং এখানের নাট্যদলগুলি নাট্যচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।
এসব কথা শুনছিলাম চাকদহ নাট্যজনের কর্ণধার সুমন পালের কাছ থেকে। রাত তখন প্রায় নিশুতি। আশপাশের বাড়িঘরের জানলা দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা ভুল করে দেরি হয়ে গিয়ে আমরা বেশ রাত করেই ঢুকলাম 'আঙিনা'-য়। এ-ও এক ব্ল্যাক বক্স। বানিয়েছে 'চাকদহ নাট্যজন'। আমরা যারা তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে গেছি তারা দেখলে বুঝতে পারব যে, প্রায় এক রেপ্লিকা বানিয়েছেন 'চাকদহ নাট্যজন'; কিন্তু প্রাইভেট স্পেস বলেই হয়তো এখানে আলোর ব্যবস্থা প্রতুল, গ্রীনরুম পরিচ্ছন্ন ও প্রসারিত। পাশে দুটি টয়লেট। কুয়াশা তখন পাশের পুকুর ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা 'আঙিনা' জুড়ে। প্রসঙ্গত বলা জরুরি এই 'আঙিনা'-র নামকরণ করেছেন বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যের প্রণিধানযোগ্য নট দেবশংকর হালদার। 'আঙিনা'-য় বসতে পারেন জনা চল্লিশেক লোক, জানালেন সুমন। এই 'আঙিনা' শুরুর আগেই এক শেষ হয়ে আসা বিকেলে, আকস্মিক টেলিফোনে যোগাযোগ করে সুমন চলে এসেছিলেন 'অমল আলো'-য়। দেখে গেছিলেন 'অমল আলো'-র আলো,শব্দ,পর্দার যাবতীয় ব্যবস্থা। বারবার সে কথা উচ্চকন্ঠে স্বীকার করেন তিনি।
তিনি সুমন পাল। দলের বয়েস পাঁচ হতে না হতেই বারোটি নাট্য প্রযোজনা করে হৈচৈ বাঁধিয়ে দিয়েছেন বাংলা থিয়েটারে। 'কর্মদানব' আখ্যা পেয়েছেন তিনি। একের পর এক নাট্য মঞ্চস্থ করা কিংবা নতুন বিষয়, আঙ্গিক বা অভিনয়ের পথ খোঁজার নিবিড় যাত্রাপথকে তাও একরকমভাবে শিল্পীর নিজস্ব অস্থিরতা অথবা উৎকর্ষের অভিমুখে সংসৃতি হিসেবে মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু এই সুমনই যখন 'চাকদহ নাট্যজন'-এর ব্যানারে আবারও একটি মুক্তমঞ্চ ‘থিয়েক্যাফে’ তৈরি করে ফেলেন তখন সত্যিই এক ঈর্ষা পেঁচিয়ে ধরে আমাদের। সুমনের এই ক্রমাগত কাজ করবার বাসনাকে স্যালুট জানিয়েও ভিতরে ভিতরে এক আলস্যের মনকেমন আমাদের তাড়িয়ে মারতে থাকে।
"আঙিনায় এখনও মঞ্চ ভাড়া করে খুব নিয়মিত কাজ হচ্ছে, এমন নয়। অনেকেই আসছেন, নিজেরা অভিনয়ের ইচ্ছে জানাচ্ছেন। আমরা মানুষজনকে জানাচ্ছি। অভিনয় চলছে। তবে একটা ভাড়া রাখা হয়েছে। এসি সহ ১৮০০ আর এসি ছাড়া ১৫০০," জানান সুমন। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করি, এখানে পর্যটনের কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা। প্রথমে পত্রপাঠ 'না' বলে দিলেও, 'না'-কে যিনি নিজস্ব কর্মের অভিধানে জায়গাই দেননি কোনওদিন, সেই সুমন ভাবলেন আরেকটু। তাঁর চোখ চলে গেল সুদূরে। দু চোখে তারার আলো জ্বলে উঠল যেন। যেভাবে 'সাক্ষী'-তে জ্বলে ওঠে তাঁর চোখ বারবার। অসহায় মানুষের জ্বলে ওঠা তো থিয়েটারের লোকই ভাল বুঝতে পারে। আমিও তেমন আঁচ করেই সুমনের সঙ্গে এগোলাম। সামান্য দূরে চাকদহ রাজবাড়ি, গঙ্গার পাড়ের দিকে। ইদানিং তার সৌন্দর্যায়ন হয়েছে। সারাদিন মানুষজন ভিড় করছে। দেখলাম সব। সুমন যেন একটা পিঙ্ক স্পটে বলে যাচ্ছেন, বর্ণনা করছেন ব্লু ওয়াশের গঙ্গার বা সেপিয়া টোনের রাজবাড়ির। আমি যেন বুঝতে পারছিলাম, আগামীদিনে সুমন এখানে নাট্যের সঙ্গে পর্যটনকে মেলাবেনই মেলাবেন। তিনি এসব কাজে একাই একশো। কোভিডের সময় থিয়েক্যাফে থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় একশো লোককে খাবার দিয়েছেন তাঁরা। থিয়েক্যাফেতে হয়েছে পিঠেপুলি উৎসব। ফলত সুমন ধীরে ধীরে একটা অঞ্চলের সংস্কৃতিকে আপামর বদলে ফেলছেন, নিঃশব্দে।
আমরা যখন 'আঙিনা' দেখেছিলাম, সুমন জানিয়েছিলেন এই মঞ্চ ২৪ ফুট লম্বা, ১৬ ফুট চওড়া। ওই ২৪ ফুটের মধ্যেই দর্শক বসেন। কখনো চাটাইয়ে, কখনো ছোট টুলে। আর তাকে কেন্দ্র করে সুমন রাহুল দেব ঘোষকে দিয়ে এক অনবদ্য কাজ করেছেন 'সাক্ষী' নাট্যে। চারিদিকে যখন থিয়েটারের 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল'রা উঠে-পড়ে লেগেছেন অন্তরঙ্গ নাট্যের ভাষা কী হবে তাই নিয়ে পান্ডিত্য ফলাতে, সুমনের 'সাক্ষী' তখন হাতেগরম বাস্তবিক উদাহরণ। ঘনিষ্ঠ স্পেসগুলোয় 'সাক্ষী' নজর কাড়বেই। এক অসহায় কনস্টেবলের জন্য আপনার নজর ঝাপসা হবেই।
'আঙিনা'-র পাশাপাশি 'থিয়েক্যাফে' জুড়েও চলছে নানারকম কাজ। সুমনের হিট প্রযোজনা 'ভানুসুন্দরী'-র আঙ্গিক একেবারেই এই ক্যাফের উপযুক্ত। সঙ্গে তৈরি হয়েছে 'কমলি কথা' এবং 'নিশিনটের গীত'। থিয়েক্যাফের ওপেনিং ৩০ ফুট, ডেপথ ২০ফুট। সাউন্ড নিজস্ব। আলোর প্রায় পঁচিশটা সোর্স আছে। স্কাই উইংস আছে। আছে থাকার ব্যবস্থাও। এখন অব্দি 'আঙিনা' আর 'থিয়েক্যাফে' দুটো জায়গা মিলিয়ে প্রায় তিরিশটা দল অভিনয় করেছেন। এই যাবতীয় ঘটনা সুমন চালিয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো টাকা ছাড়া। এখন অব্দি খরচ হয়েছে প্রায় চুরাশি লক্ষ টাকা। বাজারে লোন চুয়ান্ন লক্ষ, সঙ্গে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন, ব্যক্তিগত সোনা বিক্রি - এসব করেই চলছে। 'মিনিস্ট্রি অফ কালচার' সুমনদের অ্যাপ্লিকেশানে লিখেছেন 'নট স্যাটিসফেক্টারি'। কুয়াশা যেন এবারে আঙিনা ছাড়িয়ে ঘিরে ধরতে থাকে সুমনকে। ২০১৭-র ২৬ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে 'চাকদহ নাট্যজন' রেজিস্ট্রেশান পায় ২০২১-এর আগস্টে। অর্থাৎ মাত্র চার বছরেই এই মহামানবীয় উত্থান। সত্যিই অভাবনীয়। স্টুডিও থিয়েটার চালু হয়েছিল ৩০ নভেম্বর ২০২০। আর থিয়েক্যাফে চালু হয় ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০তে। সত্যিই এখনো পর্যন্ত এ ঘটনা আমাদের বাংলা থিয়েটারে বেশ আকস্মিক - আর বিপজ্জনকও।
........................
লেখকের এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলি পড়ুন :
১) অভিমুখ (পর্ব: এক) - অমল আলো থেকে বিদ্যাধরী হয়ে ক্যাফে থিয়েটার
২) অভিমুখ (পর্ব : দুই) - ইফটার থিয়েএপেক্স
৩) অভিমুখ (পর্ব : তিন) - ইউনিটি মালঞ্চের বিনোদিনী মঞ্চ
৪) অভিমুখ (পর্ব : চার) - 'অমল আলো' স্পেসকে কেন্দ্র করে নির্মিত নতুন নাট্য 'মারের সাগর পাড়ি দেব'
৫) অভিমুখ (পর্ব : পাঁচ) - সাতকহানিয়ার 'তেপান্তর নাট্যগ্রাম'অভিমুখ (পর্ব - পাঁচ)
৬) অভিমুখ (পর্ব : ছয়) - গোবরডাঙার শিল্পায়ন নাট্যবিদ্যালয় ও স্টুডিও থিয়েটার
[লেখক 'অশোকনগর নাট্যমুখ' দলের পরিচালক ও কর্ণধার]
….………………………………………..
[পোস্টার : অর্পণ দাস]
[পোস্টারের মূল ছবি ও অন্যান্য ছবিগুলি লেখকের সূত্রে প্রাপ্ত]