বিবিধ

অভিমুখ (পর্ব : তিন)

অভি চক্রবর্তী Sep 15, 2021 at 6:19 am বিবিধ

জেলায় উজ্জ্বল বিনোদিনী মঞ্চ, বা একটি অতিলৌকিক মনোলগ


****************************************


"...আমি কখনও হল-মালিক হতে চাইনি। নিজের হলের জন্য ফেসবুকীয় আত্মপ্রচারেও দিনরাত মগ্ন থাকিনি কোনওকালেই। লকডাউনকালে আমার অনেক বন্ধু, বন্ধুদলকেই দেখেছি স্পেস তৈরি করতে এবং তা নিয়ে প্রভূত বিজ্ঞাপন করে, নাট্যদল, লোকজন, দর্শক ইত্যাদি টানবার জন্য বিবিধ চেষ্টা করতে। বিষয়টা ভালো। একটা করে স্পেস হয়তো সকলের তৈরি হয়ে গেল; কিন্তু বিনিপয়সার তেরো-পঁচিশজন দর্শককে নিয়ে সগর্বে হাউসফুল ঘোষণা করবার মধ্যে টিকে থাকবার যে প্রয়াস আছে, আনন্দ আছে বা একরকমের আত্মগরিমার উল্লাস আছে তাতে কিন্তু আমার বিশ্বাস কম। লকডাউনে সমস্ত সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য সব বিপর্যস্ত। সেখানে থিয়েটার টিকে আছে, আমরা টিকে আছি - এটা দেখানোর জন্য এই উদগ্র বিজ্ঞাপনসর্বস্বতা আমাকে ক্লান্ত করছিল। 

কারণ আমরা মনের আনন্দে থিয়েটার করতে শুরু করেছিলাম এবং ১৯৮৪ তে গোপাল দাস লিখিত ও নির্দেশিত 'হনুয়া কা বেটা' হবার পর থেকেই আমরা রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে যথেষ্ট পরিচিত নাম। প্রচুর পুরস্কার পেয়েছি। আমন্ত্রিত অভিনয়ের ডাক পেয়েছি প্রচুর। কিন্তু তা ক' টাকা? আনন্দ কীসে ছিল? আনন্দ ছিল এখানেই যে, 'হনুয়া কা বেটা'র জন্য প্যান্ডেল খুলে চেয়ার বাড়াতে হয়েছে। রঞ্জন ক্লাব থেকে বেথুয়াডহরি সর্বত্রই এমন ঘটেছে। তবুও কিন্তু  ২০০০ সালে নিজস্ব মঞ্চ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম। কারণ এই যে একত্রিশ দিনে ছত্রিশটা অভিনয় করবার মনোবাঞ্ছা, তা তো আমাদের ভিতরে গেড়ে বসেছিল। আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম, বয়েসকালে এই শারীরিক উদ্যমে অনটন আসতে বাধ্য। তখন কী হবে? মনখারাপ হবে। ফলত নিজেদের মধ্যে আড্ডা-কর্মশালা এবং অবশ্যই নিয়মিত অভিনয় করে যাবার ভাবনা থেকেই এই মঞ্চভাবনার বীজ ভিতরে ভিতরে মুকুলিত হতে শুরু করে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এই মঞ্চ এবং তাকে ঘিরে টানা ধারাবাহিক কর্মকাণ্ড কখনোই প্রচারের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠেনি। এগুলো ইউনিটি মালঞ্চ-র ইস্তেহারের একমাত্র সম্বল হয়ে ওঠেনি। এখানে ইছাপুর আলেয়া, বেলঘড়িয়া অঙ্গন, বেলঘড়িয়া রূপতাপস, জৌগ্রাম অন্যভাবনা, রাধানগর দর্পন, ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরী, হাওড়া শপথ সহ বহু আরো দল আরো অফিস ক্লাব নিয়মিত কাজ করে গেছে। কিন্তু আমি তাকে প্রচারে আনিনি। দ্যাখো, অনেকেই নিজের মতো করে একটা স্পেস করেছেন বা করতে চাইছেন। তা খারাপ নয়, কিন্তু কোভিড মুছে গেলে এগুলি ধীরে ধীরে ফাঁকা পড়ে থাকবে বলেই আমার মনে হয়। এতো অল্প দর্শকের জন্য কে বারবার গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে গিয়ে শো করবে বলো তো?” 

               -  (দেবাশিস সরকার, পরিচালক, ইউনিটি মালঞ্চ)

একটু খটকা লাগল! চারিদিকে সদ্য তৈরি নাট্যক্ষেত্র ও স্পেস নিয়ে যখন উৎসাহের জোয়ারে ভাসছি আমরা, আন্দোলনের উত্তাপে ইতিহাস-রচনায় মগ্ন প্রায় সব্বাই, আসছেন নতুন দর্শক, উদ্বেলিত হচ্ছি আমরা, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন দলের নতুন নতুন নাট্য - তখন নিজেই একটি নাট্যক্ষেত্রের প্রধান হয়ে এমন অভিমানমাখা হতাশার কথা কেন বলছেন তিনি?  লক্ষ্যণীয়, যাঁরা বাংলা জুড়ে থিয়েটারের স্পেস করেছেন, অনেকেই তাঁর পরিচিত, বন্ধু বা আত্মীয়; ফলত এসব কথা বলতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সাহসী হয়ে উঠতে হচ্ছে তাঁকে। হয়তো বিরাগভাজনও হচ্ছেন কারোর কারোর। তবু তিনি বলছেন। 




বিবরণীর মতো তাঁর কথাবার্তা। সমস্ত স্বগত উক্তি বা আত্মউচ্চারণের ঢেউই সত্যের দিকে বেঁকে যাচ্ছে। তাই ভাবনাটা আমার মাথাতেও ঘুরপাক খায়, ড্রিল করে ঢুকে যেতে থাকে অনেক ভিতরে। খুঁড়ে তোলে বহু প্রশ্নবাণ। বাংলা থিয়েটারের স্বনামখ্যাত পরিচালক দেবাশিস সরকার কেন বলছেন এমন সব টুকরোটাকরা বিপজ্জনক কথা? তাও আবার কোন দেবাশিস সরকার? যিনি পাঁচ বন্ধুকে নিয়ে ১৯৮২ সালে তৈরি করেছিলেন ইউনিটি মালঞ্চ এবং তারপর একের পর এক উল্লেখ্য নাট্যপ্রযোজনার মধ্যে দিয়ে, গ্রামথিয়েটারে প্রতিযোগিতা-মঞ্চে নিজেকে প্রায় একছত্রাধিপতি প্রমাণ করেছেন। এখনও বিবিধ কাজের অবিশ্রাম প্রবাহের মধ্যে দিয়ে ভাবনায়, লক্ষে, কর্মে সদা অবিচল ও অগ্রণী রয়েছেন তিনি এবং তার প্রধান সহকারী, বন্ধু বাবলু সরকার। এমন উদাহরণ বাংলা নাট্যজগৎ তো বটেই, বাংলা সংস্কৃতিচর্চার জগতেই বিরল বলা চলে। তাই বাংলা জুড়ে বিভিন্ন নাট্যস্পেসের প্রসারের সম্ভাবনা ও উজ্জীবনের এই আবহে তাঁর কন্ঠে বিসর্জনের এমন করুণ বিষাদ খানিক চিন্তান্বিত তো করেই। আনন্দের স্রোতের মাঝেও তৈরি হয় কিছু ঘূর্ণিঝড়ের অচেনা সংকেত। পোড়-খাওয়া নাট্যজীবী দেবাশিসবাবুর চল্লিশ বছরের নাট্যজীবনের নানা ঘটনার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ্য তাঁর বিনোদিনী নাট্যমঞ্চ। ২০০৪ সালে শুরু হয়েছিল যার কাজ। তৎকালীন সাংসদ তড়িৎ বরণ তোপদারের দশলক্ষ টাকা আর্থিক আনুকূল্যে শুরু হয় এই নাট্যকলাকেন্দ্র গঠনের কাজ। সঙ্গে তৎকালীন বিধায়কও দিয়েছিলেন এক লক্ষ টাকা। ইউনিটি মালঞ্চের মঞ্চ সহ গোটা পরিকল্পনার একটা অংশ তৈরি হয়েছিল এই অর্থে। যদিও তিনি নিজে হাতে পাননি এই অর্থ। ডি এম অফিসের তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছিল এই অংশ। সঙ্গে ছিল দলটির তিলতিল করে জমানো নিজস্ব অর্থ এবং কিছু নাট্যবন্ধুর  সহায়তা। নাট্যসম্রাজ্ঞী বিনোদিনীর নামাঙ্কিত এই মঞ্চের উদ্বোধন করেছিলেন আরেক স্বনামধন্য অভিনেত্রী শ্রীমতী শোভা সেন। ১৮ এপ্রিল, ২০০৭ সালে। সঙ্গে ছিলেন বাংলা মঞ্চের অন্যান্য উজ্জ্বল অভিনেত্রীরা। সেদিন মঞ্চ আলোকিত করেছিলেন ঊষা গাঙ্গুলী, চিত্রা সেন, খেয়ালি দস্তিদার, সীমা মুখোপাধ্যায়, সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত প্রমুখ।



মঞ্চটি উচ্চতায় বারো ফুট, চওড়ায় বত্রিশ ফুট এবং গভীরতায় ছাব্বিশ ফুট। সামনে, পিছনে পর্দা, উইং, সাইক্লোরামা, পঞ্চাশের কাছাকাছি আলো, শব্দপ্রক্ষেপণের ব্যবস্থা সহ সব আধুনিক ব্যবস্থাই মজুত এই মঞ্চে। সঙ্গে লাগোয়া দুটি গেস্ট রুম, খাবার জায়গা। একের পর এক নিজস্ব প্রযোজনা থেকে অন্যান্য বিভিন্ন দলের প্রযোজনা এই বন্ধ শাটারের অভ্যন্তরে নীরবে তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, আজকে ইন্টিমেট বা অন্তরঙ্গ স্পেস-নাট্য নিয়ে যে হৈচৈ তার বেশ আগেই 'ঘনিষ্ঠ নাট্যপ্রকল্প' নাম দিয়ে ইউনিটি মালঞ্চ এই বিনোদিনী মঞ্চকে একটা স্পেস হিসেবে ব্যবহার করে কাজ করেছেন। তীর্থঙ্কর চন্দ, কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের মতো নাট্যনির্মাতা, থেকে হালিসহর মাটির মতো দল এখানে কাজ করেছেন এবং ইউনিটির নিজস্ব একাধিক প্রযোজনা জোকার, সংক্রান্তি, অপেক্ষার রং ইত্যাদি অভিনীত হয়েছে। আবার এই মঞ্চে প্যান্ডেল করে বড় উৎসবও করেছেন তাঁরা। কিন্তু অনেকসময় প্যান্ডেল চেয়ার ইত্যাদির ভাড়া এমন জায়গায় পৌঁছায় তখন বাধ্য হয়ে নৈহাটি ঐকতানে যেতে হয় তাঁদের। কলকাতার কিছু বড় নাট্যের ক্ষেত্রেও এ ঘটনা ঘটেছে, অভিনয় অনুযায়ী স্পেসের কারণেই। আর নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক ঐকতান এমন আধুনিকভাবে সাজিয়েছেন, সেখানে কাজ করাও অত্যন্ত জরুরি কাজ বলে মনে করেন এই নাট্যদল।



এখানে দেবাশিস সরকারের কিছু বক্তব্য আবার উদ্ধার করি। "...আসলে একজন ডিরেক্টার তার স্পেসে হওয়া নাটক নিয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, পরের দিনই আবার লোকসমাগমের ছবি আবার শুনছি কেউ কেউ রিভিউর গ্যারান্টিও দিচ্ছেন - আবার কেউ বলছেন, সব্বাই ভাড়া নিচ্ছে, আমি নিচ্ছি না। কেউ কেউ উৎসব করিয়ে নিচ্ছেন নাট্যদলগুলিকে কোনো টাকা না দিয়েই, এই স্পেসের দোহাই দিয়ে। ফলত কেমন যেন একটা স্থূল বাজারি ব্যাপার তৈরি হচ্ছে সর্বত্র। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠলে প্রেক্ষাগৃহগুলির এই পপুলারিটি থাকবেনা। শিশির মঞ্চ থেকে যদি গোবরডাঙায় গিয়ে শোয়ের খরচ বেশি হয় তবে আমি কেন যাব? তাও ফ্রিতে দর্শক আসছে। একটা টিকিট বিক্রির প্রচলন চালু করা উচিত। দলগুলোকে তাই নিয়ে ভাবতেই হবে। স্পেস মালিকরাই বা ক'বার দর্শক জোগাড় করবেন? এটা কি তাদের দায়িত্ব? আবার কেউ কেউ গিয়ে আটজন দর্শক পেয়ে ফেসবুকে বিরাট উষ্মা প্রকাশ  করছেন, বিপ্রতীপে মালিক বলছেন জঘন্য নাটক। দর্শক হয়না। একটা রেষারেষির জায়গায় চলে যাচ্ছে বিষয়টা। আমি মনে করি প্রত্যেকের তাঁর নিজস্ব সেন্টারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাকে কেন্দ্র করে নিরীক্ষামূলক নির্মাণের দিকে যাওয়া উচিত। তাহলে হয়তো একটা দিশা পাওয়া যেতে পারে।"



সত্যি কিছু ভাবার মতো প্রশ্ন তুললেন দেবাশিসবাবু। আবার এরই মধ্যে কিছু আশার কথাও শোনালেন। জানালেন, এবারে বিনোদিনী মঞ্চ একটা সর্বাংশে আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অডিটোরিয়াম হয়ে উঠবে। এলাকার বিধায়ক পার্থ ভৌমিক কথা দিয়েছেন সহায়তা করবেন। এর পাশাপাশি তাঁরা হাত পাতবেন বন্ধুবান্ধব ও স্থানীয় মানুষজনের কাছে। ২০৪ সিটের হবে এই প্রেক্ষাগৃহ। কথা দেওয়া সত্ত্বেও একদিন বিনোদিনী দাসীর নামে থিয়েটারবাড়ি হয়নি। তা নিয়ে ইতিহাস খুঁড়লে চোখের জলের নোনতা স্বাদ আর ভারী বাষ্পে আবহাওয়া বিষণ্ণ হয়ে ওঠে আজও। পুরুষতন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার জোড়া ফলায় বিদ্ধ সেই ঐতিহাসিক অধ্যায়কে হয়তো সামান্য শুশ্রূষা এনে দিতে পারবে ইউনিটি মালঞ্চের এই বিনোদিনী মঞ্চ। এইটুকুই তো অনেক... 


আরও পড়ুন : অভিমুখ (পর্ব: এক)   

                   অভিমুখ (পর্ব : দুই)


[লেখক 'অশোকনগর নাট্যমুখ' দলের পরিচালক ও কর্ণধার]

….……………………………………….. 


[পোস্টার : অর্পণ দাস] 

[পোস্টারের মূল ছবি ও অন্যান্য ছবিগুলি লেখকের সূত্রে প্রাপ্ত] 

#অভিমুখ #অভি চক্রবর্তী #ইন্টিমেট থিয়েটার #ফ্লেক্সিবল থিয়েটার স্পেস #অর্পণ দাস #বাংলা পোর্টাল #ওয়েবজিন #বিনোদিনী মঞ্চ #গোপাল দাস # 'হনুয়া কা বেটা' #দেবাশিস সরকার #ইউনিটি মালঞ্চ #শোভা সেন #খেয়ালি দস্তিদার

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

60

Unique Visitors

215845