অভিমুখ (পর্ব : দুই)
ইফটার থিয়েএপেক্স
*****************************************************************
বাসে ভিড় পাতলা হয়ে এসেছে। আমাদের গন্তব্য অজয়নগর। এয়ারপোর্ট থেকে দুজন বাসে চেপেছি। বাস এখন সবে সায়েন্স সিটি। আমার মনে হল এই সুযোগে স্বল্পভাষী, স্মিতহাসির দেবাশিসের সঙ্গে ওঁর থিয়েএপেক্স নিয়ে কিছু কথাবার্তা এগিয়ে রাখি। বয়েসে সামান্য বড় হলেও, বন্ধুত্বের কারণে এবং বেশ কিছু যৌথ কাজে জড়িত থাকার সুবাদে আমি আর অনুমতি নেবার পোশাকি চেষ্টার মধ্যে না গিয়ে সটান প্রশ্ন করলাম - "থিয়েএপেক্সের ভাবনা, বা ধরো এই স্পেসের ভাবনা ঠিক কবে থেকে?"
কোনও ভূমিকায় না গিয়ে সটান উত্তর দিলেন দেবাশিসও - "পনেরো বছর আগে থেকে। তবে এই প্যাটার্নে, এই অবয়বে হবে বুঝতে পারিনি। চোখের সামনে প্রথমেই এইরকম ছাদেই স্পেস করবার ভাবনা ছিল না। তখন ভেবেছিলাম একতলার পুরো জায়গাটা নিয়ে করব।"
"এখন যেখান থেকে গাড়ি ঢোকে? মানে গ্যারেজের দিকটা? বাড়ির সামনের দিকটা?”
হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়েন দেবাশিস। তাঁর চশমায় দেখি, বাইরের আকাশ মধ্যাহ্নকে সম্মতি দিয়েছে অপরাহ্ণের শরীরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে মিশে ফেড আউট হয়ে যাবার জন্য। এক নরম কমলা রং এখন বাসের থেকেও দ্রুত গতিতে ছুটে যাবে বিকেলের দিকে।
দেবাশিস বলে চলেন, '"আসলে ভেবেছি যখন তখন তো টাকা জোগাড় নেই, বাড়ি করতে হয়েছে। থিয়েটার থেকেই সবটুকু করবার চেষ্টা। আবার খানিক টাকা যখন হাতে এলো তখন সময়ের অভাব। সারাবছর নানান কাণ্ডে জড়িয়ে থাকে ইফটা...।"
"লকডাউন স্কোপ দিল বলছ?"
"তা তো বটেই, তবে তোমার আগের প্রশ্নের বাকি উত্তরটুকু দি আগে?" হেসে বলেন দেবাশিস।
"শিওর।"
"বাড়ি করতে গিয়ে নীচে পিলার দিতে হল, অভিনয়ের জায়গা নীচে তৈরি করা আর সম্ভব হল না।"
"এত আগে থেকে এসব মাথায় এল কী করে?” আমি কথোপকথনটাকে খানিক তরল করে আড্ডার কালভার্টে নিয়ে ফেলি, “রাজ্যের বাইরে কাজের অভিজ্ঞতা? নানান ডিরেক্টরদের স্পেস দেখার সুযোগ?"
স্বল্প কথায় আর মৃদু হাসিতে প্রায় সিদ্ধি অর্জন করেছেন দেবাশিস। এবারের সম্মতিতে শুধু ঠোঁটের কোণে চেনা হাসির ঝলকটুকুই ভেসে উঠে মুহূর্তে মিলিয়েও গেল।
প্রসঙ্গত বলে নেওয়া যাক, দেবাশিস দত্ত দিল্লির সংগীত নাটক আকাদেমির একটি ট্রেনিং প্রসেসের মধ্যে দিয়ে নাট্য তৈরির পাঠ নিয়েছেন, প্রায় দু দশক আগে । ২০০৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত - চারটে ফেজের মধ্যে দিয়ে। রতন থিয়াম, কে. এন পানিক্কর, নিসার আলানা, সত্যব্রত রাউত, সতীশ আনন্দ থেকে মহেশ আনন্দ হয়ে ভারতখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বরা ছিলেন সেই কোর্সের ফ্যাকাল্টি।
"অবশ্যই, তবে শুধু তাই নয়," বলতে থাকেন দেবাশিস, "আমি চেয়েছিলাম স্পেসকে কেন্দ্র করে কিছু নতুন রকম পারফরমেন্স তৈরি হোক। ঘুরে ঘুরে থিয়েটার করবার সঙ্গে সঙ্গে এই নিরীক্ষার প্রতি ঝোঁকও ছিল একটা। নিজস্ব স্পেস থাকলে নানান পরীক্ষা করা সম্ভব। তুমিও তো স্পেস করেছ, আশাকরি সহমত হবে। (আমি সামান্য ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিই) বিদেশে মানে পশ্চিমে তো ব্রডওয়ের সঙ্গে অফ ব্রডওয়ে বা অফ অফ ব্রডওয়েও আছে। ফলত অন্যান্য টেকনিক্যাল সাপোর্ট অক্ষুণ্ণ রেখে একটা স্পেস করা জরুরি বলে মনে হয়েছে আমার। অনেক ছোটোকাল থেকেই সে মনে হওয়াকে বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি। তুমি বলতে পারো সেই মনে হওয়াকে বাস্তবে বেশ খানিকটা তরান্বিত করল লকডাউন। সময় পেলাম। প্রায় ছ মাস ধরে স্পেসটা রেডি হয়েছে। শুনশান লকডাউনের মধ্যেও, কোভিড-ভীতির মধ্যেও চালিয়ে গেছি কাজ। অবশেষে গত ৫ অক্টোবর ২০২০ তে তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।" থামলেন দেবাশিস। তাঁর এক দমে কথা বলবার মধ্যেই বোঝা যাচ্ছিল কাজ শেষ করবার তৃপ্তি ও উত্তেজনা তাঁকে এক কঠিন পরীক্ষা পাশের অনুভূতি দিচ্ছে। আমি তাঁর এই ভাবনার সহচর। তাই ভালো লাগছিল।
কন্ডাক্টারের চিৎকার অজয়নগর নামিয়ে দিল আমাদের। খানিক ছিঁড়ে গেল চিন্তা ও কথার সুতোও। দেখলাম বিকেল নিজের সমস্ত উপাদান নিয়ে ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসছে চারপাশে। আমাদের পাশ কাটিয়ে পরস্পর সংলগ্ন হেঁটে গেল প্রেমিকযুগল। বিকেলের অভিজ্ঞান কি নতুন প্রেম, প্রথম চুমু বা লাল গোলাপ? নাকি সদ্য প্রেমের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকেই আভাসিত করে বিকেলের বিছিয়ে যাওয়া, যেভাবে শরৎ-ভোরে বিছিয়ে থাকে শিউলি বা ফুলসজ্জার খাটে ছড়িয়ে থাকে রজনীগন্ধা? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই আচমকা মনে পড়ল দেবাশিসের স্পেসে, মানে থিয়েএপেক্সেই সদ্য দেখা ইফটার নতুন নাট্য 'ভাঙা সম্পর্কের জাদুঘর'-এর কথা।
মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে গেল সামনের সমস্ত ইমেজ। বিকেল তার যাবতীয় লোকেল ও ক্যারেক্টারসহ প্রায় ডিজলভ করে থিয়েএপেক্সের ঠান্ডায় নিয়ে বসাল আমাকে। পাশে কম লোকজন, ছিটিয়ে ছড়িয়ে আছেন। মুখে মাস্ক। কোভিডের ভয়। উপরে টাঙানো নানান প্রপস। টেরিবিয়ার থেকে চাবুক - কী নেই সেখানে? এসবই কি তবে সম্পর্ক ভাঙার নানান খতিয়ানের চিহ্নরাশি? বিচ্ছেদের বয়ানের একলা স্মারক? নাটকের শুরুর খানিক অংশ পড়া যাক। বা নাট্যই বলা ভালো। কারণ এটি পারফরমেন্স টেক্সট।
'ভাঙা সম্পর্কের জাদুঘর...
মিউজিয়াম অব ব্রোকেন রিলেশনশিপস..
( গান, বন্ধু তোমার চোখের মাঝে...)
সূত্রধর- ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কির এক ভ্যলেনটাইনস ডে পার্টিতে আলাপ, আর প্রথম দেখাতেই প্রেম। ছেলেটির অবস্থা তখন ভালো নয়, নিজের ব্যাবসা বন্ধ হয়ে গেছে, গলা অবধি ধার দেনা। সকাল বিকেল দুটো আলাদা চাকরি করতে হচ্ছে দেনা শোধ করতে। মেয়েটির তাতে কিছু এসে যায় না। সে চলে এল ছেলেটির সঙ্গে থাকতে। একদিন একসঙ্গে রাতের মেট্রোয় ফিরছে, অচেনা এক ভদ্রলোক এক টুকরো কাগজ বাড়িয়ে দিলেন। ওদের দুজনের একটা স্কেচ করেছেন তিনি। পরের স্টেশনে নেমে গেলেন। ভদ্রলোকের নামটাও জানা হয়নি যুগলের। মেয়েটি অসম্ভব ভালোবাসত ছেলেটিকে, তার জন্য সবকিছু ছাড়তে প্রস্তুত সে। আর গোল বাধল সেখানেই। মেয়েটি বিদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বৃত্তি পেলো, স্কলারশিপ। অনেকগুলো টাকা, ভালো সুযোগ। কিন্তু প্রেমিককে ছেড়ে সে যাবে না।
মেয়েটি - না, আমি যাব না, যাব না তোকে ছেড়ে, নেভার নেভার নেভার!
ছেলেটি - তুই বোঝার চেষ্টা কর, এতো ভালো সুযোগ, নষ্ট করিস না, সময় তো আছে, আবার আমরা একসঙ্গে থাকব, তুই দেখিস...
মেয়েটি - না, আমি যাব না.....
ছেলেটি অনেক বোঝালো, কিন্তু কোনও লাভ হলো না। শেষমেশ ভয়ংকর কঠিন একটা রাস্তা নিলো ছেলেটি। তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে জানিয়ে দিলো যে তাদের সম্পর্ক শেষ - ব্রেকআপ। চোখের জল মুছে সেই মেয়ে চলে গেল বিদেশে। এর চার মাস পরে ছেলেটি তার কারখানায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হল। প্রাণে বাঁচল বটে, কিন্তু মারাত্মক জখম হলো। বুঝতে পারল প্রিয় মানুষকে পাশে না পাওয়ার যন্ত্রণা। সে মেয়েটিকে জানাল, সেরে উঠলেই আমি তোর কাছে যাবে, ওখানেই কাজ করব, এক সঙ্গে থাকবে আমরা...
মেয়েটির উত্তর এলো - অনেক দেরি হয়ে গেছে, অন্য এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি আমি, তোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কোনও ইচ্ছে আমার আর নেই...
নাহ্, ছেলেটিও আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। হয়তো খুঁজে চলেছে সেই মেয়েটিরই মতো অন্য কাউকে। আর মেট্রোরেলে সেই আগন্তুকের আঁকা তাদের দুজনের সেই স্কেচ জমা আছে এই জাদুঘরে।
ভাঙা সম্পর্কের জাদুঘর। মিউজিয়াম অব ব্রোকেন রিলেশনশিপস।
চলচ্চিত্র প্রযোজক ওলিঙ্কা ভিসটিকা ও ভাষ্কর দ্রাজেন গ্রুবিসিক-এর চার বছরের সম্পর্ক ভেঙে যায় ২০০৩ সালে। বিচ্ছেদের বেদনার মধ্যেই তাঁরা মজা করে বলেছিলেন, তাঁদের সম্পর্কের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা জিনিসপত্র নিয়ে একটা সংগ্রহশালা করলে কেমন হয়! গোড়ায় সেটা ছিল নেহাতই কথার কথা, কিন্তু বছর তিনেক পরে সত্যিই নড়েচড়ে বসেন দুজনেই। বন্ধুদের কাছে চাইতে থাকেন এমন কোনও জিনিস যার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বেশ কিছু জিনিস জুটেও গেল, আর তা প্রদর্শিত হল জাগ্রেবের এক আর্ট গ্যালারিতে। এরপর এই সংগ্রহ চললো বিশ্বভ্রমণে। জার্মানি, বসনিয়া, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, আমেরিকা - আরও বহু দেশ গেল। সমব্যথী মানুষের দানে বাড়তে লাগলো সংগ্রহ সম্ভার। এক বার্লিনেই পাওয়া গেল তিরিশটি নতুন জিনিস। সবই বিচ্ছেদের বেদনা মাখা।
(গান, এক আকেলা ইস শহর মে...)
ওলিঙ্কা ও দ্রাজেন ক্রোয়েশিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রকে বেশ কয়েকবার আবেদনও করেছিলেন এই সংগ্রহের একটা স্থায়ী ঠিকানার জন্য। প্রতিবার ব্যর্থ হতে হতে রোখ চেপে গেল তাঁদের। নিজেরাই ভাড়া করলেন জাগ্রেব শহরের ৩২০০ বর্গফুট জায়গা। ২০১০ এর অক্টোবরে সেখানেই তৈরি হয় ক্রোয়েশিয়ার প্রথম ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জাদুঘর।
কী আছে এই জাদুঘরে? মেয়েদের এক পাটি স্টিলেটো জুতো, একপাতা গ্যাস্ট্রাইটিসের ট্যাবলেট, একটা ভাঙা হাতঘড়ি, কফিমেকার, মেট্রোয় আঁকা কোনও দম্পত্তির স্কেচ, বটল ওপেনার, ঘরে বানানো বর-বৌ পুতুল, মা আর ছানা ব্যাঙ পুতুল, ছেঁড়া দস্তানা, আরও অসংখ্য জিনিস। বলা বাহুল্য, প্রতিটি জিনিসের সঙ্গেই জোড়া আছে এক-একটি গল্প। ভাঙা সম্পর্কের গল্প।
এমনই আরও পাঁচটা গল্পের মধ্যে দিয়ে, বিচ্ছেদের নোনাজলের অনুচ্চার কাব্যের মধ্যে দিয়ে, কার্যত ক্লাইম্যাক্স ছাড়াই, প্রথাগত নাট্যশর্তের ধার না ঘেঁষে শেষ হয় এ নাট্য। ডকু-ড্রামার প্রভাব থাকলেও তাকে বেশি প্রগাঢ় হতে দেন না দেবাশিস। বরং আশ্চর্য এক আন্ডারটোনে বাঁধা গোটা নাটকটি দর্শকের হৃদয়ে প্রবেশ করে অনায়াসেই - এক বহমান পেইন্টিং এর মতো করেই। তৈরি হয় এমন এক নাট্যভাষা, যা বিচ্ছেদের কুয়োতলা থেকে উদ্গত। কবি রাইনার মারিয়ান রিলকে ক্লারাকে বিয়ে করেন এবং একবছরের মধ্যে সে বিয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় কাঁচের পাত্রের মত। তখন তিনি সন্তানের জনক। তবুও তাঁর এই বেদনা প্রয়োজন ছিল, ব্যথার কাছে পৌঁছনোর দরকার ছিল - তাই তিনি ক্লারাকে এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন, "...এই ভাঙার, চুরমারের ব্যথা না পেলে তোমাকে, ক্লারা, এই ভাষায় এই চিঠিতে এত স্পষ্ট করে জানাতে পারতাম না...আমাকে ভাঙতে হবে বারবার।" ব্যক্তিজীবনের ভাঙচুরই কি দেবাশিসকে এই নাট্যভাষা খোঁজার জন্য ব্যাকুল করে তুলল? অস্বস্তিকর এই প্রশ্ন তাঁকে না করলেও দর্শক হিসেবে আমিও স্মৃতিখনন করতে শুরু করি অভিনয় চলতে চলতেই। নিজের মনেও গড়ে ওঠে ভাঙাচোরা সম্পর্কের জাদুঘর। এই ঘটনাই এই নাট্যের সদর্থক এবং প্রবহমান অভিঘাত। প্রত্যেকে অভিনয় করেছেন একেবারে ন্যাচারালিস্টিক ভঙ্গিতে। আড়ষ্টতার বিন্দুমাত্র চিহ্ন ছিল না কারোর মধ্যে। দেবাশিসের অভিনয়ে আরও তলিয়ে যাওয়া, আরও গভীরে যাওয়া দরকারি বলে মনে হয়েছে। তিনি একাধারে সূত্রধার এবং প্রতিটি গল্পেরই প্রধান চরিত্র। সেগুলিকে আরও সতর্ক থেকে প্রভিন্ন করতে পারলে, এ নাট্যের প্রয়োগ আরও প্রাঞ্জল হতে পারে। যদিও নাট্যসমালোচনা লেখা নয়, আমি এই নির্মাণকাজ ফিরে দেখতে চাইছি এই স্পেসকে কেন্দ্র করে এটি নির্মিত হয়েছে বলেই। থিয়েএপেক্সের মাঝের একটি অংশ ঘুরত বলে জানতাম। কিন্তু এই নাট্যের ছটি গল্পের দুনিয়াজোড়া পরিভ্রমণকালে কেন দেবাশিস তা ব্যবহার করলেন না, জানতে চেয়েছিলাম।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম দেবাশিসের উত্তরে। আমরা জানি ইতিমধ্যে বাংলা জুড়ে স্থাপিত নানান স্পেসের মধ্যে থিয়েএপেক্সেই সবথেকে বেশি অভিনয় হয়েছে। ২০২০-র অক্টোবর থেকে এই আগস্ট অবধি প্রায় শ-দেড়েক অভিনয় হয়েছে। মাঝে প্রায় চারমাস বন্ধ থাকা সত্ত্বেও। এই স্পেস ভৌগোলিকভাবে মহানগরের মধ্যে এবং মেট্রোর কাছেই। ফলত নানা লোকজন আসেন। স্থানিক যোগাযোগের সুবিধে আছে। কিন্তু এই ঘূর্ণয়মান অংশটিতে চার কুইন্টাল ওজনের বেশি, অর্থাৎ পাঁচজনের বেশি দাঁড়ানো সম্ভব নয়। অথচ প্রথম প্রথম আট-দশজন উঠে খেলার মতো ঝাঁপাঝাঁপি করা, সেল্ফি তোলা ইত্যাদি নানান ঘটনা ঘটিয়েছেন ফলত এটি বর্তমানে টেকনিক্যালি অকেজো হয়ে আছে।
দীর্ঘশ্বাসের মেঘ উড়ে যায় দেবাশিসের পাশ থেকে। আমিও তাজ্জব, চুপ। নাট্য দেখার পরের স্তব্ধতার সঙ্গে এই ঘটনা মিলেমিশে এক মনকেমন ঘিরে ধরে। মনে আসতে থাকে, অনেকেই অনেক সমস্যার কথা জানিয়েছেন স্পেস নিয়ে। আবহটাকে একটু চাঙ্গা করতে দেবাশিসকে বলি, "এসো একটা র্যাপিড ফায়ার খেলি।"
দেবাশিস নির্বিবাদী সজ্জন। ফলে সম্মতির অপেক্ষা না করেই শুরু করি আমি। পাঠকের সুবিধার জন্য কথোপকথনের আকারেই সাজিয়ে দিচ্ছি সংলাপগুলোকে।
অভি - পেছনে জায়গা নেই।
দেবাশিস - আছে। কম।
অভি - সাইক্লোরামা নেই।
দেবাশিস - না। আছে তো।
অভি - জায়গা অত্যন্ত ছোটো।
দেবাশিস - ওইটুকুই স্পেস। ছশো স্কোয়ার ফিট মোট। কিছু করবার নেই।
অভি- দর্শক বসবার জায়গায় প্রচন্ড অসুবিধে হয়।
দেবাশিস- সহমত। কিন্তু চল্লিশটা সিট বার করতেই হত। একটু ম্যানেজ করতে হয় তাই দর্শকদের। তারা করছেনও।
অভি- দেওয়ালের কাঁচ অত্যন্ত পাতলা, বাইরের শব্দ ও আলো ঢুকে পরে।
দেবাশিস- সেকেন্ড লেয়ারের চেষ্টায় আছি। দেখা যাক।
অভি- আলো প্রপারলি কমানো বাড়ানো যায় না। ছড়িয়ে যায়।
দেবাশিস- এটা র্যাপিড ফায়ারে হবেনা, সময় দাও বলছি। (দুজনের উচ্চকিত হাসি)।
অভি - বলো, বলো!
দেবাশিস - আসলে স্পেসটা ডোমেস্টিক। তাই বারবারই চেষ্টা করছিলাম যে কীভাবে পাওয়ার কনজামশান কমানো যায়! সেখান থেকেই এলিডির ভাবনা মাথায় আসে 220 ভোল্টকে 12এম্পিয়ারে নিয়ে আসবার জন্য সার্কিট নিয়ে নানান ভাবনা চিন্তা, নীরিক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছিল, এখনো হচ্ছে। ফলে পাওয়ার কমজানশান কমলেও আলোর অপারেশান সত্যিই এখনো সম্পূর্ণ স্মুদ নয়। চেষ্টা চলছে। আবার খেয়াল করে দেখো নতুন দুটো আলো ভাঙা সম্পর্কে ব্যবহার হয়েছে, সেগুলো কিন্তু ছোট জায়গায় কনসেন্ট্রেড করা যাচ্ছে।
অভি - আচ্ছা বেশ। ক্যাফে বা বইঘর?
দেবাশিস - বইঘর আপাতত বন্ধ। ওদিক থেকে জল আসে। আমি এখনো সেভাবে গুছিয়ে উঠতে পারিনি।
অভি- ক্যাফেতে লাভ হচ্ছে?
দেবাশিস- ধুস।(হেসে ওঠে) ওই চলে যাচ্ছে আর কি! মূলত চা-টা বিক্রি হয়।
র্যাপিড ফায়ার শেষ করি। আপাতত চা পান জরুরি হয়ে পড়েছে। চায়ের ধোঁয়ার গন্ধে বাকি আলোচনা, মানে কাকে বলে নাট্যকলা নিয়ে এগোনো যাবে...
আকাশে তখন স্টারি নাইট আঁকছেন গখ। আমরা হেঁটে যেতে থাকি সেই উন্মাদনাময় ছবির দিকে।
আরও পড়ুন : অভিমুখ (পর্ব: এক) / অভি চক্রবর্তী
[লেখক 'অশোকনগর নাট্যমুখ' দলের পরিচালক ও কর্ণধার]
….………………………………………..
[পোস্টার : অর্পণ দাস]
[পোস্টারের মূল ছবি ও অন্যান্য ছবিগুলি লেখকের সূত্রে প্রাপ্ত]