বিবিধ

অভিমুখ (পর্ব : সাত)

অভি চক্রবর্তী Oct 20, 2021 at 8:09 am বিবিধ

অন্তরপ্রকাশ

........................... 

নামের মধ্যে দিয়েই বুঝে নেওয়া যায় যে, 'সূচনা বগুলা' নির্মিত এই নাট্যবাসাটি মূলত ঘনিষ্ঠ তথা আন্তরিক অভিনয়ের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে। স্পেসটির নামকরণ করেছেন বিশিষ্ট নাটককার তীর্থঙ্কর চন্দ। 'সূচনা' নাট্যদলের এই উদ্যোগ নিয়ে প্রথমেই একটি কথা জানিয়ে রাখা উচিত যে এই নাট্যদল কেন্দ্রীয় সরকারের স্যালারি গ্রান্টের আওতায় নেই। ইতোপূর্বে আমাদের আলোচিত স্পেসগুলির নিয়ন্ত্রণকারী দলেরা প্রায় সকলেই এই অনুদানের অধীনস্থ। কেউ কেউ এর বাইরেও নানা সরকারি অনুদান পেয়েছেন। যাঁরা অনুদান পেয়েছেন বা পেয়ে থাকেন তাঁদের প্রতি এই প্রতিবেদকের যাবতীয় শ্রদ্ধা আছে। তবে একেবারে কোনওরকম সরকারি সহায়তা না পেয়ে থিয়েটার-সংক্রান্ত কাজের জন্য নিজের বাড়ির একটা অংশকে সাজিয়ে তোলাকে আজ কী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হবে জানি না, কিন্তু আমার কাছে তা মহৎ এক প্রয়াস। শিল্পী-জীবনের অনিবার্য প্রয়োজনেই হয়তো গেরস্থালি কেটে নাট্যস্থলী বানাবার এই উদ্যোগ নিয়েছেন 'সূচনা'-র কর্ণধার সৃজন মণ্ডল। 

১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই এই দলের কাজ শুরু হয়। এখনও অবধি আস্তিনে প্রযোজনার সংখ্যা ৪০ ছুঁই ছুঁই। তার মধ্যে ২০০০ সালে সৃজনের নির্মাণে 'কারিগরনামা' নাটক জনমানসে গভীর ও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। আমাদের বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে তখন থেকেই। অশোকনগরে একটি জনপ্রিয় প্রতিযোগিতায় হৈচৈ ফেলে দিয়ে প্রথম হয় 'কারিগরনামা'। তারপর একে একে 'মাইকমাস্টার' থেকে 'পুঁটি রামায়ণ' - সবেতেই এক নিজস্ব প্রয়োগভাষা বজায় রেখেছেন সৃজন। কথায় কথায় তাঁর থেকে জানতে পারি, এই বগুলা ভৌগলিক ঐতিহাসিক বা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রেও তেমন সমৃদ্ধশালী প্রাচীন কোনো ভূখণ্ড নয়। আধুনিক নাট্যচর্চায় এই জনপদের বয়েস মাত্র চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ, জানান সৃজন। 


তখন আসন্ন অভিনয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে 'অন্তরপ্রকাশ'। তার পাশাপাশিই চলেছে সৃজনের সঙ্গে আমার কথোপকথন। জনা বারোর একটি দল এই নাট্যস্পেসের প্রস্তুতি ও দেখভালের কাজ করেন। কেউ কেউ দেখেন বাগান, সাজান বাইরেটা; কেউ প্রদর্শনের আগের দিন ঝুল ঝেড়ে পরিচ্ছন্ন করেন প্রেক্ষাগৃহটিকে, মুছে রাখেন সাফল্যের স্মারকচিহ্নগুলিকে; কেউ বা ব্যস্ত থাকেন আগত নাট্যদলগুলির পরিচর্যায় অর্থাৎ চা খাবার জল দেবার মতো কেজো ব্যাপারে। ঠোঁটের কোণায় হাসি ঝিলিক দেয় সৃজনের। যেমন শেষ বিকেলের অস্তগামী কমলা-রোদ ঝিলিক দেয় নদীতে, এ হাসি তেমনই। হয়তো এখনই ডুবে যাবে, কিন্তু কাল প্রকাশিত হবেই - এ সংকল্প নিয়েই সে ডোবে। পঁয়ত্রিশ বছর একটানা নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত সৃজন আত্মবিশ্বাসী,দৃপ্ত কন্ঠে বলেন, "সকলেই সবকিছুর দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন বলেই চলছে। টাকাপয়সা নেই বলেই হয়তো ডাইনোসর যুগের গ্রুপ থিয়েটার-চর্চায় রত রয়েছি আমরা। তথাকথিত পেশাদার, বানিজ্যিক, কর্পোরেট হতে পারিনি।'


এই স্পেসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল- এখানে অভিনয়ের জন্য কোনও ভাড়া নেওয়া হয় না। সূচনার উদ্যোগে মাসে ২ থেকে ৩ দিন অভিনয়ের আয়োজন হয় এখানে। টোটাল স্পেসটির মাপ ২৩ ফুট বাই ১৩ ফুট। অভিনয়ের জন্য নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ১৮ বাই ৯ ফুট। ডিমার সহ ১২টি আলোর সোর্স রয়েছে এখানে। আছে নিজস্ব মিউজিক সিস্টেমও। দলগুলোর জন্য সাধারণ টিফিনের ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে। প্রতি অভিনয়ে ২০ জন দর্শক থাকেন। স্টেশন থেকে নাট্যগৃহ হেঁটে মাত্র ৪ মিনিট। বাসষ্ট্যান্ড থেকে হেঁটে মাত্র ১ মিনিট। ওপেনিং থেকে আজ অবধি  এক বছরে ৩০ টি দল এখানে কাজ করেছেন। প্রায় ৯০০ দর্শক থিয়েটার দেখেছেন। আজ অবধি যতগুলি অভিনয়ের আয়োজন করা হয়েছে প্রতিটি হাউসফুল হয়েছে। এসব শুকনো তথ্য হলেও এটুকু আন্দাজ করাই যায় যে, স্পেস আয়তনে ছোট হলেও তাকে ঘিরে এক গভীর অভিনিবেশ, নিয়ত পর্যবেক্ষণ এবং আধুনিক থিয়েটার-উপযোগী সবরকম ব্যবস্থা করে তুলতে সর্বদাই সচেষ্ট থাকে এই নাট্যদল। 


সম্পূর্ণ অব্যবসায়িক এই উদ্যোগে একমাত্র নাট্যবন্ধুদের থেকে প্রাপ্ত তিরিশ হাজার টাকা ব্যাতীত এখনও পর্যন্ত আর কোনও সহায়তা পাননি তারা। ফলত দুশ্চিন্তার মেঘ প্রশ্ন হয়ে ভিড় করে মনে। কীভাবে দর্শক আসেন এখানে? কীভাবে তৈরি হচ্ছে অন্তরপ্রকাশের দর্শক? জানতে চাই সৃজনের কাছে। অন্ধকার হয়ে আসা পথের দিকে অগ্রসরমান সৃজনকে যেন জোনাকি বলে মনে হয়। বলতে বলতে এগোন তিনি - "অন্তরপ্রকাশ-এ দর্শক দুরকমভাবে থিয়েটার দেখেন। এক, স্বেচ্ছাদান বা নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে। কোনও কমপ্লিমেন্টারি দেওয়া হয় না অন্তরপ্রকাশে। অনেকরকম পদ্ধতিতে এই দর্শক জোগাড় করি আমরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়, যে প্রচার দেখে মানুষজন আসেন বা এসেছেন অন্তরপ্রকাশে। দ্বিতীয় পদ্ধতি, আমাদের দলের মেম্বাররাও ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ করে দর্শক আনেন। প্রায় ১৫ বছর আমরা প্রসেনিয়াম বা নন-প্রসেনিয়াম নাট্য উৎসব আয়োজন করছি। যারা বিগত দিনে একাধিকবার আমাদের উৎসবে নাটক নিয়ে এসেছেন তারা দেখে গেছেন প্রায় শ-চারেক মানুষকে নিয়মিত থিয়েটার দেখতে। এই দর্শকদের আমরা সারাবছর আনবার চেষ্টা করি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আমাদের নাট্যগৃহ যেহেতু স্টেশনের খুব কাছেই তাই দূরের বন্ধুরাও স্বচ্ছন্দে আসছেন থিয়েটার দেখতে। নাট্যদল এবং বাইরের দর্শকের কথা ভেবেই আমরা বিকেল ৫ টায় নাটক শুরু করি। বিগত এক বছরে যাদের যে ট্রেন ধরার কথা ছিল, সেখান থেকে সামান্য বিচ্যুতি ঘটেনি।" এখানেই চরম পেশাদার লাগে সূচনার কর্ণধারকে। জোনাকিরা এখন যেন সব আকাশে গিয়ে তারা হয়ে জ্বলে থাকছে। জ্বলে থাকছে আকাশ জুড়ে। সেই প্রেক্ষাপটে অপার্থিব লাগে সৃজনের কণ্ঠস্বর - "একটা ছোট্ট স্পেস তার সাধ্যের মধ্যেই স্বপ্ন দেখে। আমরা চাই আরও নাট্যদল,আরও মানুষজন আসুন অন্তরপ্রকাশে। উন্মোচিত হোক এই ক্ষেত্র। নানাভাবে। এই ভয়ংকর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে আমাদের মত অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল দলগুলি যাতে অন্তত থিয়েটারের মতো প্রান্তিক একটি চর্চা অব্যাহত রাখতে পারেন পারেন, সেটাই চাই। সেই লক্ষ্যে অবিচল ও নিষ্ঠ থাকুক অন্তরপ্রকাশ।" 

........................... 

লেখকের এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলি পড়ুন : 

১) অভিমুখ (পর্ব: এক) - অমল আলো থেকে বিদ্যাধরী হয়ে ক্যাফে থিয়েটার 

২) অভিমুখ (পর্ব : দুই) - ইফটার থিয়েএপেক্স 

৩) অভিমুখ (পর্ব : তিন) - ইউনিটি মালঞ্চের বিনোদিনী মঞ্চ 

৪) অভিমুখ (পর্ব : চার) - 'অমল আলো' স্পেসকে কেন্দ্র করে নির্মিত নতুন নাট্য 'মারের সাগর পাড়ি দেব' 

৫) অভিমুখ (পর্ব - পাঁচ) - সাতকহানিয়ার 'তেপান্তর নাট্যগ্রাম'  

৬) অভিমুখ (পর্ব : ছয়) - গোবরডাঙার শিল্পায়ন নাট্যবিদ্যালয় ও স্টুডিও থিয়েটার 


[লেখক 'অশোকনগর নাট্যমুখ' দলের পরিচালক ও কর্ণধার]

….……………………………………….. 


[পোস্টার : অর্পণ দাস] 

[পোস্টারের মূল ছবি ও অন্যান্য ছবিগুলি লেখকের সূত্রে প্রাপ্ত] 

#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Web Portal #থিয়েটার #নাটক #Theatre #অভিমুখ #অভি চক্রবর্তী #সূচনা বগুলা

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

41

Unique Visitors

215816