বিবিধ

অভিমুখ (পর্ব : ছয়)

অভি চক্রবর্তী Oct 6, 2021 at 9:28 am বিবিধ

গোবরডাঙার শিল্পায়ন নাট্যবিদ্যালয় ও স্টুডিও থিয়েটার

.............................. 

অধুনা বাংলাদেশের স্থানিক নৈকট্যে অবস্থিত এই বঙ্গের প্রাচীন জনপদ গোবরডাঙা। আজকে আমাদের আলোচ্য নাট্য-স্পেস 'শিল্পায়ন স্টুডিও থিয়েটার' গোবরডাঙার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বৃদ্ধি করেছে একথা অনস্বীকার্য। যদিও নাট্যচর্চায় চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিল্পায়নের ধারাবাহিক স্বীকৃতি গোবরডাঙাকে বিশ্বের দরবারে 'নাটকের শহর' নামে ধীরে ধীরে সুপরিচিত করে তুলছে। ফলত এই নাট্যদল যখন ক্রমাগত প্রসেনিয়াম চর্চার পরে একটি আন্তরিক স্টুডিও নির্মাণ করেন, যেখানে মূলত ইন্টিমেট থিয়েটারের একমুখী (দর্শক সামনে বসে আছে) চর্চা হবার ব্যবস্থা আছে, তখন বিষয়টা নতুন করে ভেবে দেখতে হয়। ভেবে দেখতে হয় যে, করোনার এই দীর্ঘস্থায়ী অবিশ্বাস্য প্রকোপের কথা আশিস চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর দলবল আগেই টের পেয়েছিলেন কিনা! নাকি ভর্তুকির নগরমুখী নাট্যের সঙ্গে যুঝতে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় উত্তাপ খরচ করতে চাইছিলেন না আর! এদিকে গ্রামগঞ্জের নাট্যের বাজার ক্রমাগত নিম্নমুখী। তাই কি এই স্থায়ী স্পেসের ভাবনা? শিল্পায়নের সদস্যদের সঙ্গে এই নিয়ে কথাবার্তার আগে মাথার মধ্যে বিজবিজ করছিল এমন নানান প্রশ্ন।  


যদিও তার আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন এই স্থানের ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যের কথা। আমরা অনেকেই জানি, উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার নিজস্ব ঐতিহাসিক জৌলুস এবং প্রাচীন গৌরব আছে। প্রাচীন জনপদ, সুপ্রাচীন পৌরসভা, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের একাধিক নামী বিদ্যালয় গোবরডাঙাকে প্রভূত ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কৌলিন্য দিয়েছে। সঙ্গে স্পর্ধা বাড়িয়েছে কলেজ, বি এড কলেজ, দুটি বৃহৎ বাজার, থানা, প্রাচীন রাজবাড়ি, মন্দির, পার্ক, অদুরে কঙ্কনা বাঁওর, যমুনা নদীর মতো আরও অনেক কিছু। একদা এই প্রান্তিক-প্রাচীন জনপদ মনীষীদের অধিষ্ঠানক্ষেত্র ছিল। প্রাচীন ব্রাহ্মসমাজের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় এখানে। টাটা কোম্পানির অন্যতম স্রষ্টা বিখ্যাত জিওলোজিস্ট প্রমথনাথ বসুর ভদ্রাসন এই গোবরডাঙায়। তাঁর নামেই প্রতিষ্ঠিত প্রমথনাথ বসু মেমোরিয়াল পৌর টাউন হল, গোবরডাঙাবাসীর কাছে যা বড়ই শ্লাঘা ও গর্বের বিষয়। আমরা যারা শূন্য দশকের শুরুতে থিয়েটারচর্চা শুরু করেছি তারাও দেখেছি এই তৎকালীন জীর্ণ হলকে কেন্দ্র করে এলাকার মানুষদের ভিড়, আবেগ, উত্তাপ এবং সর্বোপরি নাট্যচর্চাকে কেন্দ্র করে তুমুল হৈচৈ। ধীরে ধীরে এই হল ভেঙে পড়ে। তবে বর্তমানে তাকে পুনরুজ্জীবন দিয়েছেন গোবরডাঙা পৌরসভা। এটুকু ভূমিকা অনেকেরই অবান্তর মনে হতে পারে, তবে আমার মনে হয় স্থানমাহাত্ম্য বা এলাকার নাট্যচর্চার কৌলিন্য বোঝাতে এটুকু উল্লেখ করা একান্ত প্রয়োজনীয়। 

তাহলে কি এই স্থানমাহাত্ম্য বা আঞ্চলিক কৌলিন্যকে কেন্দ্র করে এই শিল্পায়ন স্টুডিও থিয়েটারের সঙ্গে পর্যটনকে জুড়ে দেবার কোনও চেষ্টা আছে? শিল্পায়নের কর্ণধার আশিস চট্টোপাধ্যায়কে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই। 

আমার উল্টোদিকে বসে আশিস মুচকি হাসেন। নিজের স্টুডিওর অফিসে বসে তখন তাকে বেশ উজ্জ্বল আলোকিত লাগছিল। তিনি বলেন, "এই স্থানমাহাত্ম্যের সঙ্গে আমাদের স্টুডিও থিয়েটার প্রতিষ্ঠার সরাসরি কোনও সম্পর্ক বা যোগ  নেই। একটি নাট্যবিদ্যালয় স্থাপনার স্বপ্ন নিয়ে এই শিল্পায়ন স্টুডিও থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গত ২৬ জানুয়ারি, ২০২০ সালে - আমাদের থিয়েটারের অগ্রজ প্রধানতম নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীর হাত ধরে। গোবরডাঙা কিন্তু আয়তনের দিক থেকে একটি ছোটো জায়গা। মাত্র পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হাজার মানুষের বাস এখানে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি বাদ দিয়ে প্রাচীন দ্রষ্টব্যের বেশিরভাগই এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। ফলত কলকাতা বা অন্যান্য জায়গা থেকে যাতায়াতের পথ সুগম হলেও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে অদূর ভবিষ্যতে যদি সেরকম কিছু গড়ে তোলাও হয়, আমাদের স্টুডিও থিয়েটার বা নাট্যবিদ্যালয়কে কোনো পর্যটন প্যাকেজ হিসেবে তার সঙ্গে সামিল করতে আমি অন্তত রাজি নই। ডুয়ার্স বা অন্যান্য কোথাও ঘুরতে গিয়ে দেখেছি সেখানে ঘোরা-পর্ব শেষ হলে একটি এরিনা ধরনের মঞ্চে চা-কফি পান আর আদিবাসী নাচ-গান ইত্যাদি হরেক কিসিমের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা রাখা থাকে। ওই 'একটা কিনলে একটা ফ্রি'-এর মতো ব্যাপার আর কি! ইদানিং কিছু নাট্যদলও দর্শকদের নাটক দেখানোর সঙ্গে এরকম সব প্যাকেজের ব্যবস্থা করছেন বলে জেনেছি। এটা বোধহয় কালচারাল ট্যুরিজমের সবচেয়ে আধুনিক রূপ। প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর জন্য এটা একটা অভিপ্রায় হতে পারে। এর ভালো-মন্দ বা 'নাটক বাঁচাও আন্দোলন'-এর সম্ভাবনা নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে রাজি নই বা আমার সে যোগ্যতাও নেই। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, এসব ভেবে আমি থিয়েটার করতে আসিনি। আমি চাই এই লকডাউন নামক ভূতুড়ে কাণ্ড ও যন্ত্রণা শেষ হোক আর এই প্রতিষ্ঠানটি বারবার বন্ধ না হয়ে যেভাবে চলছে সেইটুকু চলুক।" কথাগুলো বলতে পেরে একটু যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন আশিস। সেই স্বস্তি যেন বিকেলের জমে ওঠা মেঘ কাটিয়ে দেয়। আলো জ্বলে উঠছে তখন স্টুডিওতে, আর বাইরে ভিড় করছে দর্শক। 

এতদিনে প্রায় একশোর বেশি নাট্য অভিনয় করেছেন নানান দল। ভাড়া নিয়েই। জানালেন আশিস। কিন্তু টিকিটবিহীন দর্শকের এই ভিড়? একটু খটকা লাগল।  ফলত পরের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম এই জিজ্ঞাসা নিয়েই যে অবাধ প্রবেশের এই বিষয়টায় আশিসের ঠিক কী মত? এই ফ্রি থিয়েটারই কি চালিয়ে যাবেন তিনি? 

আশিস নির্লিপ্তভাবে সামলালেন এই বাউন্সার, "আমি কোনোদিন ফ্রি থিয়েটারে বিশ্বাস করিনি। তবে বারবার এই লকডাউনে যাতায়াত ব্যবস্থা এখনো ঠিক না হওয়ায় দলগুলোকে অনুরোধ করেছি আপাতত প্রবেশমূল্য না রাখতে। সবাই সম্মত হওয়ায় এভাবেই চলছে। তবে সবকিছু স্বাভাবিক হলে টিকিট কেটে মানুষ নাটক দেখবেন। এই নিয়ে কোনও অসুবিধা হবে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস।" 


যদিও 'শিল্পায়ন' গোবরডাঙা পৌরসভার সৌজন্যে জমির পাশাপাশি পেয়েছে মিনিস্ট্রি অফ কালচারের থেকে বিল্ডিং গ্রান্ট বাবদ চব্বিশ লক্ষ টাকা। কিছু শুভানুধ্যায়ীদের সহায়তাও পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন শিল্পায়নের অন্যতম অভিনেত্রী দীপা ব্রহ্ম। আশিস জানালেন, খরচের পরিমাণ এক কোটিরও বেশি। সঙ্গে জানালেন এক অত্যন্ত আনন্দের কথা যে, দলের ছেলেমেয়েরাও তাদের সর্বস্ব দিয়েছেন এই স্টুডিও থিয়েটারে। আজকের দিনে এ ঘটনা বিরল। যেখানে দল থেকে আমি কতটা পেলাম এই হিসেব-নিকেষে সদা ব্যস্ত থাকতে দেখি অনেককেই, সেখানে শিল্পায়নের এই সদর্থক দল- ফিলিং প্রেরণা দেয়।

আশিস এরপর অডিটোরিয়ামে নিয়ে গেলেন আমাদের। ঝকঝকে অডিটোরিয়াম দেখলে সর্বার্থেই মনে আসে ব্রডওয়ের নানান ইমেজের কথা। ঢুকতেই দুই অনবদ্য গথিক পিলার আমাদের আবার প্রাচীন রাজবাড়ির গঠনশৈলীর কথা মনে করায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই মিলনে আশিস সত্যিই এই স্টুডিও থিয়েটারের পরিকাঠামোকে এক মহাকাব্যিক বিস্তারের দিকে নিয়ে গেছেন। অনর্গল এই সাফল্যের মধ্যে পরিব্রাজকের মত হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, "দ্যাখ, এটা আদ্যন্ত একটা নাট্যগবেষণাগার হিসেবে গড়ে উঠেছে। বারোশো স্কোয়ারফুটের বেশি জুড়ে প্রদর্শন ক্ষেত্র ও দর্শকদের বসবার জায়গা। পুরোটাই কাঠের ফ্লোর। নাট্যবিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যেকোনো দিকে মুখ করে কর্মশালা সেমিনার বক্তব্য ইত্যাদি রাখা সম্ভব। দিনের বেলায় প্রাকৃতিক আলো ব্যাবহার করে কাজ করা সম্ভব। তার জন্য পুরো হলের একটা পাশ জুড়ে বিশাল মাপের কাঁচের জানালার ব্যবস্থা আছে। অভিনয়ক্ষেত্রের মাপ ২৮'(উইং টু উইং)/১৮'। আগে এখানে উইং বা কার্টেনের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দলগুলি প্রসেনিয়মের আদলে নাটক মঞ্চস্থ করছে বলে আমরা ওরকম অস্থায়ী ব্যাবস্থা রেখেছি। প্রয়োজনে খুব অল্প সময়ে ওগুলো খুলে ফেলা যায়। এতে যাঁরা প্রসেনিয়ম ধাঁচার বাইরে কাজ করতে চান তাঁদেরও কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না। প্রেজেন্টেশন এরিয়া জুড়ে প্রচুর আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। একসঙ্গে পঁচিশ কিলো লোড দেওয়া সম্ভব। সম্পূর্ণ আধুনিক কন্ট্রোল রুম, আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম, পাওয়ার জেনারেটর। আলাদা প্রজেকসন রুমে আধুনিক প্রজেক্টরের ব্যবস্থা করা আছে। এরকম প্রয়োজনীয় অনেক ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটি সুবৃহৎ ডরমিটারি আছে যেখানে পঁচিশ জনের বেশি মানুষ রাত্রিযাপন করতে পারবেন। এছাড়াও দুটি ডাবল বেডরুম তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন উৎসব ধরলে এ পর্যন্ত শতাধিক দল এখানে থিয়েটার করেছেন" 


তখন রাত বেড়েছে বেশ খানিক। পরের নাট্য শুরুর ঘন্টা বেজে গ্যাছে। আমাদের অডিটোরিয়াম ছাড়তে হল। 

আশিসদাকে বললাম, "সবই তো করে ফেলেছ। আগামীর স্বপ্ন কী? এই সুবিশাল পরিকাঠামোর ভবিষ্যৎই বা কী?" 

চল্লিশ বছর নাট্যের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলা আশিস চট্টোপাধ্যায় রাতের তারাদের দিকে চাইলেন। বললেন, "এই পরিকাঠামোর ভবিষ্যৎ কী তা এই মুহূর্তে আমি বলতে পারবো না রে! বারবার বন্ধ হওয়ায় আমি এখনও একটা পুরো বছরও পাইনি সার্বিক পর্যবেক্ষণের। তবে আমার এই স্টুডিও থিয়েটার যখন তৈরি করা শুরু হয় তখন গোটা বিশ্বেই করোনার কোনও নাম-গন্ধ ছিল না। পরে অবশ্য করোনাকালে নানান স্পেস থিয়েটার ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। তাদের সম্পর্কে আমার কোনও বিরোধভাব নেই,  প্রতিযোগিতাও নেই। আমাদের স্টুডিও থিয়েটারের ভালো-মন্দ আমাদের পরিকাঠামোতেই বিচার করা ভালো। কারো সাথে কোনো প্রতিতুলনা অর্থহীন। সবার মঙ্গল হোক।"

বাইরে মহালয়ার গান বাজছে, "বাজল তোমার আলোর বেনু।" এরপরে আর প্রশ্নোত্তর চালানো অনর্থক মনে হল। শুধু এই প্রত্যাশা নিয়ে ট্রেনে উঠলাম যে নাট্যশিল্প মরে যাবার জন্য জন্মায়নি।


........................... 

লেখকের এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলি পড়ুন : 

১) অভিমুখ (পর্ব: এক) - অমল আলো থেকে বিদ্যাধরী হয়ে ক্যাফে থিয়েটার   

২) অভিমুখ (পর্ব : দুই) - ইফটার থিয়েএপেক্স 

৩) অভিমুখ (পর্ব : তিন) - ইউনিটি মালঞ্চের বিনোদিনী মঞ্চ  

৪) অভিমুখ (পর্ব : চার) - 'অমল আলো' স্পেসকে কেন্দ্র করে নির্মিত নতুন নাট্য 'মারের সাগর পাড়ি দেব' 

৫) অভিমুখ (পর্ব - পাঁচ) - সাতকহানিয়ার 'তেপান্তর নাট্যগ্রাম' 


[লেখক 'অশোকনগর নাট্যমুখ' দলের পরিচালক ও কর্ণধার]

….……………………………………….. 


[পোস্টার : অর্পণ দাস] 

[পোস্টারের মূল ছবি ও অন্যান্য ছবিগুলি লেখকের সূত্রে প্রাপ্ত] 

#অভিমুখ #অভি চক্রবর্তী #থিয়েটার #নাটক #Theatre #সিরিজ #ফ্লেক্সিবল থিয়েটার #গোবরডাঙা শিল্পায়ন #শিল্পায়ন স্টুডিও থিয়েটার #অর্পণ দাস #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #পোর্টাল #Web Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

60

Unique Visitors

215845