অভিমুখ (পর্ব : দশ)
শিল্পকৃতি স্টুডিও থিয়েটার *****************************************************
এই পর্ব যখন লিখতে বসছি তখন মনে মনে এক চোরা বিষাদের সুর মিশে যাচ্ছে। যেভাবে নবমী নিশির জনজোয়ারে লুকিয়ে অশ্রুজল মিশে যায় আগত দশমী দিনের। সেসব মনের কোণে রেখেই, যতটা সম্ভব ব্যক্তিগত আবেগকে দূরে রেখে এই 'অভিমুখ' নামাঙ্কিত সিরিজের শেষ পর্বের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ব। গত নটি পর্বে, অর্থাৎ প্রায় তিনমাস জুড়ে প্রতি সোমবার থেকে নিজেরই মধ্যে যেন জেগে উঠত 'সিলি পয়েন্ট' ওয়েব পোর্টালের সম্পাদক। নিজেই নিজেকে তাড়া দিতাম। বলে রাখা দলগুলিকে বারংবার তাড়া দিতাম, যাতে দ্রুত তারা তথ্য পাঠান, মেল করেন ছবি। আমি অপেক্ষায় থাকতাম তাদের হোয়াটস আপ খুলে রেখে। হতাশ হতাম। অনেকেই পাঠিয়েছেন সময়মতো। কেউ কেউ দেরি করেছেন। নিজেদের কাজ, শারীরিক অবস্থা বা নানান ঘটনাপ্রবাহের মাঝে এই দেরির কবলে পড়া এক মানুষের নাম সুরজিৎ সিনহা। যিনি আমাদের বন্ধুমহলে 'রাজা' নামে সুপরিচিত। তার সুদর্শন চেহারা, কাজের আদব কায়দা, বড় করে ভাবতে পারবার প্রবণতাই তাকে এ নামে খ্যাত করেছে এ কথা লেখাই বাহুল্য।
কাজের কথায় চলে আসি সরাসরি এবার। এই রাজার সাম্রাজ্য তথা নাট্যদলের নাম 'মহিষাদল শিল্পকৃতি'। সুরজিতের সঙ্গে আমার আলাপ বছর আটেক আগে, তাদের বিদ্যালয়-ভিত্তিক নাট্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। এই প্রতিযোগিতা চলছে গত দশ বছর টানা। ২০১৭ থেকে শুরু হয়েছে শিল্পকৃতির নিজস্ব ছোটদের বিভাগ। একটি নাট্যদলকে দূর থেকে যদি আপনার রেলগাড়ি মনে হয়, তবে মহিষাদল শিল্পকৃতি সেক্ষেত্রে রাজধানী এক্সপ্রেস। প্রতি কামরায় আলাদা মানুষ, আলাদা তাপমাত্রা, আলাদা চরিত্র - কিন্তু দিশা এক। সেভাবেই আমরা দেখতে পারি শিল্পকৃতিতে যেমন ছোটোদের নাটক, বড়োদের নাটক নিয়ে কাজ চলছে লাগাতার তেমনই ২০১৯ এ ভারতখ্যাত প্রথিতযশা অভিনেত্রী বিনোদিনীর নামে তৈরি হয়েছে 'বিনোদিনী গ্রন্থাগার'। এলাকায় নানানভাবে অফলাইন ও অনলাইন প্রচারের মধ্যে দিয়ে, নতুন পুরনো বই মিলিয়ে, প্রায় তিন হাজার বইয়ের সমাহার করে তোলা গেছে এই পাঠাগারে।
আমি প্রথমবার গিয়েই আন্দাজ করেছিলাম ছোটদের নিয়ে কী নিবিড় ধারাবাহিক কাজে লিপ্ত এই দল! বড়োদের কাজে বা উৎসব সংগঠনেও কতো আন্তরিক! অতিথিদের জন্য সর্বদা মনোযোগী এই দলে নিজস্ব থিয়েটার স্পেস তৈরি করবে, এ তো একরকম নিয়তিই বলা চলে।
শিল্পকৃতি স্টুডিও থিয়েটারের ভাবনা সেই ১৯৯৪ সাল থেকেই। নিজের পায়ের নিচে মাটি চাইবার সহজাত প্রবণতা একটা নাট্যদলের তৈরি হয় মূলত প্রত্যাখান পেতে পেতে। আজ এই ক্লাব, কাল ঐ দালান, পরশু স্কুল ঘরে পরিযায়ীর মতো মহলা করতে করতে খুব দ্রুতই শ্বাস ফুরাবার অবস্থা হয়। একটি দল স্বাভাবিকভাবেই বাসা খোঁজে, নিজস্ব বাসা। মহিষাদলের মত ঐতিহাসিক ও প্রাচীন জনপদের একটি দলের যে এই আত্মসম্মানের ঠাঁই লাগতই, তা সুরজিৎ বুঝেছিলেন অনেক আগেই। লকডাউন এ কাজকে তরান্বিত করেছে। এই অবধি অন্যান্য অনেক স্পেসের মতোই প্রায় একই চেনা গল্প এই স্টুডিওর। আলাদা কোথায় সে কথায় আসি। বিদ্যাসাগর, অজয় মুখার্জী, সুশীল ধারা, ক্ষুদিরাম, কুমদিনী ডাকুয়া,মাতঙ্গিনী হাজরার মতো খ্যাতনামা মনীষীদের জন্মস্থান মেদিনীপুরের অন্তর্গত এই জনপদটি বেড়ানোর জায়গা হিসেবে বেশ উত্তম। মহিষাদলের রাজবাড়ি, ফুলবাগ প্যালেস, গোপাল জিউর মন্দির, হলদি- হুগলী-রূপনারায়ন নদী এবং অবশ্যই সামান্য দূরেই দিঘা। ফলত এই স্টুডিও থিয়েটারকে কেন্দ্র করে মহলা, অভিনয়, কর্মশালা যেমন চলে, তেমনই যারা এখানে আসেন তাঁরা বেড়াবার একটা ছোট প্যাকেজ করেই আসেন। ভবিষ্যতে এর সম্ভাবনা আরো বাড়বে এবং করোনা বিদায় নিলে এখানের কাজের পরিমণ্ডল বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে বলে জানান সুরজিৎ। সত্যিই এই মহান কর্মব্যাপ্তিকে টিকিয়ে রাখতে গেলে অন্য কোনো আদান প্রদান ভীষণ জরুরি হয়ে ওঠে। বিশেষত আজকের সমাজে থিয়েটারকে যখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে মনেই করা হয়না সেখানে মহিষাদলের মতো একটা নগর-দুরবর্তী জনপদে নাট্যজন হিসেবে সুরজিত যে অক্লান্ত প্রাত্যহিক কাজের মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন তা সত্যিই অভাবনীয়।
এই স্টুডিও থিয়েটার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এখনো কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো অনুদান পাননি তারা। দল থেকেই টাকা জমিয়ে, বহু কষ্টে, বহু ঋণে এই জমি তারা কিনেছিলেন। পরবর্তীকালে রাজ্য সরকারের কাছে লাগাতার দরবার ও সুপারিশের ফলে মেলে কুড়ি লক্ষ টাকা। স্বাভাবিকভাবেই যাঁরা এই হলে গেছেন তারা জানেন, এই অর্থে কোনভাবেই সম্পূর্ণ হয়নি এই স্পেস। প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকার অধিক খরচ করে ঋণে জর্জরিত হয়েও, ঢেউয়ের মতো অবিরাম কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সুরজিৎ। তিনি জানালেন, "প্রায় পঞ্চাশটি আলোর সোর্স, চব্বিশ চ্যানেলের কন্সোল, পাওয়ার প্যাক, একশো পঁচিশ সিটের অডিটোরিয়াম, সেটের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, একশো জনের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা গেছে। অর্থাৎ কেউ বা কোনও দল শুধু এসে পড়লেই হল, বাকি সমস্ত দায়িত্বই আমাদের।"
আবার ঢেউ এল। সমুদ্র পাড় এখন ফাঁকা হয়ে আসছে। সুরজিতের কথার মধ্যে কিন্তু কোনও ফাঁক নেই। এখানে কোটাল কখনও মরে না। এই ঢেউয়ে আছে ক্ষুদিরামের অকুতোভয় মনোভাব, মাতঙ্গিনীর আত্মত্যাগ, বিদ্যাসাগরের সংস্কার ভাঙার লড়াই, রাজবাড়ির রাজকীয় মেজাজের ঔদার্য এবং দক্ষ হাতে প্রশাসন চালাবার ক্ষমতা এবং অবশ্যই সবই মিলেমিশে গেছে এক অবিরাম ঢেউয়ে - এক নিরন্তর এগিয়ে চলায়।
সে চলার নাম 'শিল্পকৃতি'। সে ঢেউয়ের নাম সুরজিৎ। যার সিনায় দম আছে। আমরা ফিরে আসছিলাম সমুদ্রকে একলা ফেলে। সমুদ্র তখন একলা আলোচনায় বসে তার ঢেউয়েদের সঙ্গে। আমরা ফিরে আসবার পর সুরজিৎ-ও হয়তো আলোচনায় বসবেন পরবর্তী 'অদেখা অন্ধকার' বা 'ত্যাগ' অভিনয়ের জন্য।
..............................
লেখকের এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলি পড়ুন :
১) অভিমুখ (পর্ব: এক) - অমল আলো থেকে বিদ্যাধরী হয়ে ক্যাফে থিয়েটার
২) অভিমুখ (পর্ব : দুই) - ইফটার থিয়েএপেক্স
৩) অভিমুখ (পর্ব : তিন) - ইউনিটি মালঞ্চের বিনোদিনী মঞ্চ
৪) অভিমুখ (পর্ব : চার) - 'অমল আলো' স্পেসকে কেন্দ্র করে নির্মিত নতুন নাট্য 'মারের সাগর পাড়ি দেব'
৫) অভিমুখ (পর্ব : পাঁচ) - সাতকহানিয়ার 'তেপান্তর নাট্যগ্রাম'অভিমুখ
৬) অভিমুখ (পর্ব : ছয়) - গোবরডাঙার শিল্পায়ন নাট্যবিদ্যালয় ও স্টুডিও থিয়েটার
৭) অভিমুখ (পর্ব : সাত) - সূচনা বগুলার নাট্যস্পেস 'অন্তরপ্রকাশ'
৯) অভিমুখ (পর্ব : নয়) - 'চাকদহ নাট্যজন'-এর 'আঙিনা' ও 'থিয়েক্যাফে'
[লেখক 'অশোকনগর নাট্যমুখ' দলের পরিচালক ও কর্ণধার]
….………………………………………..
[পোস্টার : অর্পণ দাস]
[পোস্টারের মূল ছবি ও অন্যান্য ছবিগুলি লেখকের সূত্রে প্রাপ্ত]