উপন্যাস

সোনার বাড়ি জমি (ত্রয়োদশ পর্ব)

সরোজ দরবার Sep 3, 2021 at 3:09 am উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস
*************************************

আগের কথা: গল্পটা এবার যেন কেমন হাতের নাগালে এসে পড়েছে। তারা খসা, তারা ধরা, সেইসব তারাদের মধ্যে থেকে ঝিকমিক করে যেন বার হয়ে আসছে আসল কথাটি। আসলে কিসসা তো অমনই। যা বলতে চেয়েও বলে ওঠা যায় না, যা করতে চাইলেও করে ওঠার মতো সাহসটুকু জোগাড় হয় না, কিসসা সেই সব করিয়ে নেয়। এই আমাদের কথাখানাই ধরুন না! কারা যেন এসে চোখ রাঙাচ্ছে, এর সঙ্গে মেশা চলবে না, তার সঙ্গে বসা চলবে না, তা বাবুমশাইরা, এমন কাঁটাতারের চৌহদ্দিখানার মধ্যে থাকতে থাকতে রাগের আগুন ধুঁইয়ে ওঠে কি না বলুন দেখি! সোনাপুর গ্রামেও ঠিক তাই হল, জানেন! ছোট্ট একটা গ্রাম, সুখ ছিল, দুঃখ ছিল, শান্তি ছিল, অশান্তি ছিল, কিন্তু যা ছিল সে তো নিজেদের ছিল। আজ কেউ ওঠ বললে উঠতে হবে আর বস বললে বসতে, এ আবার কেমন আবদার বলুন দেখি বাবুমশাই! হাওয়াকে তার মতো বইতে দিচ্ছিল বটে গাঁয়ের মানুষ, কিন্তু ভেতরে জমছিল ক্ষোভ। আর সেই সময়েই, টুপ করে আসল কথাটি বলে ফেলল পূর্ণিমা।

*************************************

[একুশ]


ভোরের বেলা হনহনিয়ে ফিরছিল পূর্ণিমা। পিসিমার সঙ্গে দেখা করে তার মনটা বেশ ভালো। কিন্তু কেন এই ভালো লাগা সে ঠিক বুঝতে পারে না। একটা কিছু এমন কাজ করছে, যাতে ছেলেমেয়ে দুটোর ভালো হয়, সেইজন্যেই কি এই ভালো লাগছে! নাকি, বিধবা হওয়ার পর সংসার ঠেলার বাইরে তার যে আলাদা কোনও ভূমিকা আছে, সেইটে আবিষ্কার করে তার ভালো লাগছে। পূর্ণিমা জানে না ঠিক। শুধু তার বুকে পুলক লাগে। আর হঠাৎ যেন রক্ত ছলকে উঠে আর-একখানা মনে করিয়ে দেয়। এত এতদিন পর সে আর সোমু খুব স্বাভাবিক স্বাধীন ভাবে পাশাপাশি থাকতে পারছে বলেই কি, এই ভালো লাগা!

কথাটা মনের ভিতর প্রবল হয়ে উঠতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে। সারা শরীরে তার ঘাম ফুটেছে বিনবিনিয়ে। সে খোলা বাতাসে শ্বাস নেয়। শরীরের ভিতর যে এই অস্বস্তিকর আনন্দের একটা মুহূর্ত হনিয়ে উঠেছে, সেটিকে যেন প্রাণভরে শুষে নেয়। ফাঁকা মাঠের দিকে তাকিয়ে পূর্ণিমা যেন অনুভব করে, পৃথিবীটা কী ব্যাপক বড়ো। যেন সমুদ্র। তার খুব ইচ্ছে করে, সেমিমা বরুণের মতো ওই সমুদ্রের ভিতর মিলিয়ে যেতে।

কতক্ষণ যে সে মগ্ন হয়ে ছিল খেয়াল নেই পূর্ণিমার। আচমকা সে খেয়াল করল সেই মাঠের ভিতর থেকে দুজন মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছে। পূর্ণিমা বিস্মিত হয়। কই একটু আগেও তো সে এদের দেখেনি। এতবড় মাঠের কোন দিক থেকে হেঁটে এসে কখন তারা এত কাছে চলে এল, বুঝে উঠতে পারে না পূর্ণিমা। তা ছাড়া এ গাঁয়ের সবাইকে সে চেনে। এরা তো চেনা লোক নয়। সেই সাতসকালে ফাঁকা মাঠের ধারে খুব ভয় পেয়ে যায় পূর্ণিমা। সে মনে মনে ভাবে, দৌড়ে পালাবে কি না।

ততক্ষণে দুজনেই কাছে চলে এসেছে আরও খানিকটা। আর পূর্ণিমাকেই হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সম্মোহিতের মতো পূর্ণিমা তাদের দিকে এগিয়ে যায়। বলে, তোমরা কারা গা? ভূতের মতো এমন করে মাঠের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলে কী করে?

তার কথা বলার ধরনে দুজনেই হেসে ওঠে। পূর্ণিমা খেয়াল করে দেখে, দুজনের মধ্যে একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ। আর একজন খানিকটা বয়স্ক। দুজনেই যেন কোন অচিনপুরী থেকে তাদের গাঁয়ে চলে এসেছে। 

বৃদ্ধই প্রথম কথা বলে। বলে, ভয় পেয়ো না। আমরা তোমার পাড়ার লোক নই ঠিকই। কিন্তু যে যেখানে লড়ে যায়, সে তো আমাদেরই লড়া। আমরা তাই সেখানে গিয়ে হাজির হই। 

পূর্ণিমা অবাক হয়ে বলে, মানে? তোমাদের বয়েস কত করে তাহলে?

বৃদ্ধ আবার বলে, সে ছাড়ান দাও। কে তার হিসেব করে বলো? তোমার বয়েস কত তুমি কি জানো?

পূর্ণিমা এমন আজব প্রশ্ন জীবনে শোনেনি। সে তার বয়স জানবে না কেন? সবে বলতে যাবে, এমন সময় তাকে থামিয়ে দিয়েই বৃদ্ধ আবার বলে ওঠেন, সেই রংপুরে যখন আগুন জ্বলল, তখন কি তুমি ছিলে না?   

রংপুর নামে কোনও গ্রামের কথা শোনেনি পূর্ণিমা। সে অনেক ভাবার চেষ্টা করল, কোন গাঁয়ের কথা এরা বলছে, আর কোন গাঁ থেকে এরা এসেছে। 

বৃদ্ধ তার মুখ দেখেই যেন অন্তরখানা বুঝে ফেলল। তারপর বলল, আজ তোমার মনে নেই তেমন করে। আজ নিজেকেও চেনা শক্ত। বিশ্বাস করো, একদিন কিন্তু এমনটা ছিল। 

বলতে বলতে বৃদ্ধ বসে পড়ে। যে রাস্তার উপর পূর্ণিমা দাঁড়িয়ে, সেই রাস্তার দুপাশে পেতে রাখা ঘাসে আসনের উপর বসে পা দুটি টানটান করে। তারপর গায়ের উপর ফেলা সাদা কাপড়খানা তুলে নিয়ে মুখের ঘাড়ের ঘাম মোছে। পাতলা কাপড়টা ছিল বলে, এতক্ষণ দেখতে পায়নি পূর্ণিমা, সেটুকু সরতেই দেখল, বৃদ্ধের সারা গায়ে লম্বা লম্বা ক্ষতচিহ্ন। যেন কেউ কাস্তে দিয়ে কুপিয়েছে। যেন কেউ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ফুটো করেছে শরীরে। 

পূর্ণিমা দেখে শিউরে উঠে বলে, বাবা গো! কে তোমায় এমন করে মেরেছে গা!

বৃদ্ধ বলে, সে তো তুমিও ভালো জানো মা। এই দাগ-টাগগুলো গায়ে না থাকলে আর মনে পড়বে কেমন করে। একবার ছুঁয়েই দেখো, দেখো সব মনে পড়ে কি না। 

পূর্ণিমা খেয়াল করে, দাঁড়িয়ে থাকা তরুণের মুখে তখন হাসি। যেন দুজনে মিলে ষড়যন্ত্র করে পূর্ণিমাকে নিতে এসেছে তারা। আর তাই কত না ছলনায় মন ভোলাচ্ছে। কী মনে পড়বে তার! এখন কী মনে পড়ার আছে! পূর্ণিমা বুঝে উঠতে পারে না কিছুই। শুধু তার মনে হতে থাকা, এই সাতসকালে সে যেন কোন মায়ার ফাঁদে পড়ে গেছে। তার আশপাশ থেকে হারিয়ে গিয়েছে তার সাধের সোনাপুর। চেনা লোক একটাও নেই এই তল্লাটে যে নাম ধরে ডাকে। যেন নিজের ঘরের ভিতর ঘরের ভিতর হারিয়ে গিয়েছে সে। আর এই মায়াঘরে কেবল তার সঙ্গী দুজন অচেনা মানুষ। 

বৃদ্ধ এবার যেন আপন মনেই কথা বলতে শুরু করে। মৃদু সেই স্বর কানে গিয়ে পৌঁছয় পূর্ণিমার। বৃদ্ধ বলতে থাকে, সেবার মন্বন্তর হল। এমন সবুজে সবুজ, এমন ফসলে গোলা ভরা দেশটাকে ওরা ছারখার করে দিল। মানুষ খেতে পায় না, শুধু মার খায়। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না, শুধু উন্মাদ হয়ে যায়। আমি গিয়ে ওদের বললাম, তোমরা একজোট হও। হাত দেখিয়ে বললাম, এই হাতে কী না কী করো তোমরা। হাতে কি বল-শক্তি কম হয়েছে? একার শক্তিতে না কুলোলে পাঁচজনে মিলে দাঁড়াও, দেখবে পাঁচের শক্তির সামনে ওরা আর দাঁত ফুটোতে পারবে না। 

ওদের চোখেমুখের ভয় তবু কাটে না। এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে সে তো ওরা কখনও জানে না। ওদের সৃষ্টির হাত। বুঝলে তো মা, মানুষ চাষার হাত বলে অবজ্ঞা করে। কিন্তু এ কি খেলো জিনিস! এই হাতে ঈশ্বর বলো আল্লা বলো আর যাই বলো সেই তিনি নেমে আসেন। মাটির বুকে দানা ফেলে নতুন গাছ বানাতে জানে যে, সে হাত ভগবানের হাত গো মা। মানুষ সেটা নিজেই বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু আমি ওদের বোঝালাম, প্রয়োজন এলে হাতের কাজ পালটে ফেলতে হয় গো ভালোমানুষের পো। যে হাত দিয়ে ফসল ফলাও, সেই হাতে যদি চিরকাল ফসলের সবুজ ছুঁয়ে থাকতে চাও তো, একদিন হাত মুঠো করো। প্রতিবাদ করো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও। 

পূর্ণিমা শুনতে শুনতে যেন শিহরিত হয়। যেন আদিকাল্যের বুড়ো এক তাকে রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলে ওঠে, তারপর...

বৃদ্ধ বলতে থাকে, গোরাদের ধারণা ছিল না মা, সামান্য চাষা, ফকির, সন্ন্যাসীরা অমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে তুলতে পারে। বেশ রোয়াবেই তারা চলছিল। একদিন ঠিক জায়গায় গিয়ে ঘা-টা লাগল। তখন রাত নেমেছে। আমরা সবাই একজোট হয়ে ঘিরে ফেললাম ঢাকার ইংরেজ কুঠি। ওরা যে কিছু করবে, তার আগে বুঝে উঠতে হবে তো ছাই যে কী হচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারেনি। কুঠি দখল করে নিলাম আমরা। শুনেছিলাম, ক্লাইভ নাকি এই ঘটনায় খুব চটেছিল। খাইয়ে দাইয়ে সৈন্য রেখে যদি কুঠি হাতছাড়া হয়ে যায়, কার না রাগ হবে! ওদিকে তখন আর-এক যুদ্ধ চালাচ্ছেন রামানন্দ গোঁসাই। ইংরেজ লেফট্যানান্ট মরিসনকে তখন ঘোল খাওয়াচ্ছে সন্ন্যাসীরা। একটা আগুনের শিখা চারিদিকে জ্বলে উঠছিল মা, মনে হচ্ছিল, এই অপশাসন, এই অন্যায়, মানুষকে নিয়ে এই ছেলেখেলার দিন আমরা ফুরিয়ে দিতে পারব। আমি তো চেয়েছিলাম, জমিদাররাও আসুন আমাদের সঙ্গে। যে ফকিররা একা একা ভিক্ষে করে বেড়াত তারা যদি একজোট হতে পারে, সন্ন্যাসীরা একজোট হয়ে এতবড় জিনিসটা ঘটিয়ে তুলতে পারে, সেখানে জমিদার শ্রেণির সহায়তা থাকবে না কেন! তারা তো এই দেশেরই মানুষ। আমি নাটোরের জমিদার রানি ভবানীকে চিঠি লিখেছিলাম। সাহায্য প্রার্থনা করেছিলাম। 

তরুণ এবার অনেকক্ষণ পর কথা বলে। বলে, আপনারা যখন হারতে শুরু করলেন সেই সময়ের কথাও ওঁকে বলুন। 

বৃদ্ধের যেন ক্লান্তি নেই। দারুণ উৎসাহে আবার বলতে শুরু করে, একসময় ইংরেজরা আমাদের পাল্টা মার দিতে শুরু করল। তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল সবাই। এটাই সবথেকে বড় সময়, মা। মনে রাখবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যখন নামছ, তখন সর্বদা জিত হবে না। হার-ও হবে। হারটা স্বীকার করে নিয়েও অস্বীকার করতে হয়। ওই হারের জ্বালাটাকে চারিয়ে দিয়ে আরও বড় করে প্রত্যাঘ্যাত আনতে হয়। ইংরেজরা যখন আমাদের কোমর ভেঙে দিল, আমরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু হাল ছাড়িনি। পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ ঘুরে ঘুরে অস্ত্র জোগাড় করি। অর্থ জোগাড় করি। গোপনে গোপনে সংগঠন মজবুত করতে থাকি। আমি বুঝতে পারছিলাম, একটা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে না তুললে এই অন্যায়ের শিকড় উপড়ে ফেলা যাবে না। তারপর কালেশ্বরে একদিন মুখোমুখি লড়াই বেধে গেল ইংরেজদের সঙ্গে। সামনে থেকে লড়াই করছিলাম সেই যুদ্ধে। জখম সেবার এমন হল যে, পালিয়েও শেষ অব্দি...

বলতে বলতে বুড়ো হঠাৎ থেমে যায়। কী যেন ভাবে এক দু-পল। তারপর যেন এই মনে পড়ল, এমন করে বলে ওঠে, তুমি তো শুধু আমার কথাই শুনলে। এর কথাও কিছু শোনো। বলো হে, তোমার কথা বলো। 

তরুণ্টি বলে, আপনি গুরু। আমি আমার কথা আর কী বলতে পারি। আপনি নতুন সূর্যের মতো উজ্জ্বল। আমি আপনার আলোতেই দিন দেখেছি। 

বৃদ্ধ বলে, থাক থাক, হয়েছে। এখন ওসব কথায় কাজ নেই। শোনো মা, আমিই তোমায় বলছি, এই ছেলে একদিন কী কাণ্ডই না বাধিয়েছিল। নানা ঘাটের জল খেয়ে খেয়ে একদিন ও বুঝতে পেরেছিল, জমিদার বলো আর ইংরেজ, ওই উপরতলার মৌচাকে ঢিল না মারলে চলবে না! কতদিন আর মুখ বুজে সহ্য করা যায়! দেখতে দেখতে একদিন রুখে দাঁড়াতেই হয়! এই ছেলেও একদিন হিন্দু-মুসলমান গরিব কৃষকদের নিয়ে বড়লোকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ও যখন একজোট হওয়ার ডাক দিত, এমন অসাধারণ করে কথা বলত যে, শয়ে শয়ে লোক এসে ওর কথা শুনত। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করত যে, জমিদার হোক বা ইংরেজ, এই অন্যায় শাসনের গোড়ায় কুড়ুল মারতেই হবে। 

আর, ও তো আমার যুদ্ধ দেখেছিল। তাই একটা শিক্ষে নিয়েছিল বেশ ভালো। লড়াই করতে গেলে যেমন একজোট হতে হয়, তেমনই অস্ত্র দরকার, অস্ত্রচালনা শেখা দরকার, আর মুখোমুখি লড়াই বাধলে একটা দুর্গ-ও দরকার। ও সবই করেছিল। যদিও অন্যায় কি আর একদিনে শেষ হয়!

তরুণটি কিছু বলে না। শুধু বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে একবার প্রণাম করে। 

বৃদ্ধ এবার বলে, তুমি হয়তো ভাববে মা, যখন তুমি একটা যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছ, তখন আমরা তোমায় শুধু হেরে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছি কেন? 

পূর্ণিমা চমকে ওঠে। সত্যিই তো সে মনে মনে এমনটাই ভাবছিল। বুড়ো কী করে টের পেয়ে গেল। তার সন্দেহ হয়, জাদুবুড়ো কি এমন করে রূপ বদলে তার সামনে এসেছে! জাদুবুড়োর তো ভেলকির শেষ নেই। কিন্তু আজ এতকাল ধরে বুড়োকে দেখছে সে। কখনও চেহারা বদলাতে দেখেনি! তাহলে এ বুড়োও কি আর এক জাদুবুড়ো! মনের কথা তার মনেই থাকল। বুড়ো নিজের প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলতে থাকে, আসলে কেউ কোথাও হেরে যায় না, জানো তো মা। এই কথাটাই আমরা দুজনে মিলে আজ তোমাকে বলতে এলাম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, জুলুম না সয়ে যে যেখানে যতটুকু কথা বলতে পারে, যতটুকু ঘাম ঝরাতে পারে, ততটুকুই মানুষের উপকারে লাগে। 

বলে, এই এতক্ষণ পরে বুড়ো যেন একটু দম নেয়। তারপর ওঠবার চেষ্টা করে। তরুণ তার হাতখানা বাড়িয়ে দিলে বুড়ো উঠে পড়ে। তারপর বলে, তোমার কাছে এসে অনেক বকবক করলুম, মা। না করে যে থাকতেও পারি না। যেদিন যেখানে তোমরা উঠে দাঁড়াও, ঘুরে দাঁড়াও, সেদিন সেখানে নতুন সূর্য করে ওঠে। আর সেই দেখে আমাদের ভারী আনন্দ হয়। তাই দু-কথা বলতে চলে আসি। তুমি মনে মনে যা সংকল্প করেছ, তা কাজে করে দেখাও। কোনও কিছুতেই নিজের সংকল্প থেকে সরে যেও না, কেমন! 

বলে দুজনেই যাবার উদ্যোগ করল। পূর্ণিমার মুখ থেকে তখনও কোনও কথা সরছে না। সে কথা বলতে চাইছে, কিন্তু দুই ঠোঁটে যেন আঠা লেগে আছে। তার চিরচেনা এই সোনাপুরে সে যে সকাল সকাল এমন একখানা কাণ্ড দেখবে, তা কি সে কখনও ভেবেছিল! আপ্রাণ চেষ্টা করে সে তার মুখখানা খোলে আর একটিমাত্রই প্রশ্ন করতে পারে, তোমরা কারা গো বাবা? আমাকে পরিচয় দিলে না যে বড়!

বৃদ্ধ আর তরুণ তখন উলটোদিকে মুখ ফিরিয়েছে। পূর্ণিমা দেখছে যেমন হাওয়ার ভিতর থেকে আচমকা তাদের উদয় হয়েছিল, তেমনই হাওয়ার ভিতর মিলিয়ে যাচ্ছে তারা। সেই হাওয়ার ভিতর থেকেই শুধু ভেসে আসে দুটো নাম, ফকির মজনু শাহ, তিতুমির। 

পূর্ণিমা নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে সেই দুজন মানুষের হাওয়া হয়ে যাওয়া। অনেকক্ষণ পর সম্মোহিতের মতো সে শুধু তার হাত দুখানা জোড় করে কপালে ঠেকায়। 


[বাইশ]                   

পূর্ণিমার এলেম আছে বলতে হবে। এতদিন তার এই গুণটার দিকে কেউ নজর করেনি। বাপের সংসার ঠেলে দিন কেটেছে তার। আজ হাতে একটা কাজ পেয়ে সে দেখিয়ে দিয়েছে, পূর্ণিমা নামে ব্যক্তিটার স্বাতন্ত্র্য কতটা, হিম্মত কতখানি। যে ঘরকন্না গুছিয়ে করে, সে যে এমন তুখোড় সংগঠক, এটা যেন কারও কল্পনাতেই আসেনি। অথচ তাই তো হওয়া স্বাভাবিক ছিল।

বিশালাক্ষিতলার মাঠে বউ-ঝির জমায়েতই বেশি। কৌতূহলে বেশ কিছু পুরুষও জুটেছে। কৌতূহলটা একটু অন্যরকম। এক তো বিষয়টা নিয়ে ক-দিন ধরেই গ্রামে একটা হেলদোল চলছে। তার উপর মেয়েরা যে এমন একটা কিছু ঘটিয়ে তুলেছে, তাই নিয়ে বেশ একটা টান আছে সবার মনে। পক্ষ নেওয়ার কথা ভাবছিল সকলেই। কিন্তু সকলেই যে মেয়েটার ডাকে শেষ পর্যন্ত একজোট হয়ে উঠতে পারবে, এটা ভেবে ওঠা যায়নি। একটা চোরা ভয় মনের মধ্যে ছিলই যে, হয়তো বলছে আসবে, কিন্তু কাজের দিনে আসবে না। কিন্তু না, সত্যিই সকলে এসেছে। 

পূর্ণিমা তো ঘরে ঘরে গিয়ে বলে এসেছে। বলেছে, আজ একটা মেয়েকে হেনস্তা করেছে। নাহয় সে মুসলিম। কাল আমাদের ঘরের মেয়েকেও হেনস্তা করবে। বলবে, কেন হাত ধরে ঘুরতে বেরিয়েছে? কেন প্রেম করবে? এসব কী! ভোটে জিততে হয় তো রাস্তা করো, আলো আনো। পুকুর কাটাও। রেশনের ব্যবস্থা করো। নর্দমা কাটো। ভোট দেওয়া তো মানুষের অধিকারের জন্য। কে প্রেম করবে, কোন জাতের ছেলে কোন জাতের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবে, এইসব ফালতু কথা মাথায় তুলে ভোটে জিতবে কেন? 

কথাখানা সবারই বেশ মনে ধরেছে। হিন্দু-মুসলমান করে দিনকয় হাওয়া গরম বটে, কিন্তু জাত-ধর্ম বাঁচাতে গিয়ে পেটে হেলা দিলে তো আর হয় না। জলটা যে কোনদিকে গড়ায় সেদিকেই সবার লক্ষ্য। 

প্রচারের জন্য বেদম খাটলেও, পূর্ণিমার মনে সন্দ ছিল। সকলে আসবে তো! সন্দেহ ছিল সমুর মনেও। শুধু দেবীপ্রসাদ বলেছিলেন, ধৈর্য ধরো। সব হবে। হাজার রকম কথার ভিতর একমাত্র কাজের কথাটি বলেছ তুমি, দেখো সবাই ঠিক তা শুনবে, বুঝবে আর আসবে। সত্যিই আজ সকলে এসেছে। একটা ফালতু বিষয়কে নস্যাৎ করে দিতে একজোট হয়েছে। 

চিত্রকরদের দিয়ে গান গাওয়ানোর আইডিয়াটা দেবীপ্রসাদেরই। চিত্রকররা না হিন্দু, না মুসলমান, তাঁরা দুই ধর্মেরই। দুই ধর্ম তাঁদের ভিতর দিব্যি মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। তাঁদের গান গাওয়ার, গানের কথার তাই আলাদা গুরুত্ব আছে। 

পূর্ণিমা বরং একটু খটকা নিয়ে বলেছিল, কিন্তু ওসব গান তো আজকাল আর কেউ শুনতে চায় না। ওই মাত্র শোনার কারণে কি লোক আসবে? বাইরে থেকে কোনও গাইয়ে ধরে আনলে হয় না! তা ছাড়া...

দেবীপ্রসাদ পূর্ণিমার দিকে তাকান। বলেন, তা ছাড়া কী?

- সমু এতদিন পর মিটিং করছে, যদি দেখে লোক না হয়... 

দেবীপ্রসাদ হাসেন। পূর্ণিমার উৎকণ্ঠা বোঝেন তিনি। বোঝেন আরও অনেক কিছুই। মনে মনে অপার এক শান্তি পান মানুষটা। তারপর মেয়েটাকে শান্ত করে বলেন, শুধু লোক টানার কারণেই যে ওঁরা গাইবেন, তা তো নয়। বরং যাঁরা আসবেন, যত কম মানুষই আসুন না কেন, তাঁদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা শোনানোর জন্যই ওঁরা গাইবেন। যদি একজন আসেন, তাও গাইবেন। ওঁরা তো শুধু পারফর্মার নন। আর এইসব গান, এই ধরন... ফর্ম, যদি বলি এসব আমাদের সবার মনের ভিতর, যাকে বলে যৌথমানস, সেখানে তো আছেই। হ্যাঁ, চাপা পড়ে গেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রয়োজনে তাকে সামনে আনতে তো ক্ষতি নেই। 

কথা বলার ফাঁকে তিনি দেখে নেন, পূর্ণিমা তাঁর কথা প্রায় ক্লাস ফোরের ছাত্রীর মতোই মন দিয়ে শুনছে। তিনি বলতে থাকেন, তোমার উলটোদিকটা যদি খেয়াল করে দেখো তো দেখবে, পুরাণ-শাস্ত্রের নাম করেই যারা বিভাজন চায় তারা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। তারা যা চাইছে, সেইটাকেই দেখাচ্ছে, আর কায়দা করে বলে বেড়াচ্ছে সেইটেই লেখা আছে সনাতন ভারতের সব প্রাচীন পুথিতে। এমনকি রবি ঠাকুরকেও রাস্তায় নামিয়েছে। যে লোকটা আজীবন হিঁদুয়ানি, গোঁড়ামির বিরোধিতা করে গেলেন, তাঁর এক লাইন কি দু-লাইন তুলে এনে এঁরা প্রমাণ করতে চাইছেন রবি ঠাকুরও সহি হিন্দু। কী যে মজার দুনিয়া হয়েছে এ এক! যাই হোক, কিন্তু ভেবে দেখো, দেশের কি সম্পদ কম! তুমিও দেখিয়ে দাও না কেন, তোমার অঞ্চলে কী সম্পদ লুকিয়ে আছে, আর তা ঠিকঠাক ব্যবহার করে কেমন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ করানো যায়, দেখিয়ে দাও।  প্রতিবাদ বাইরে থেকে লোক এনে কেন হবে! বাইরের লোকের কথায়, গানেই বা হবে কেন! তোমার সোনাপুরের অন্যায় হচ্ছে। তুমি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছ। তোমার পাশের চিত্রকর গানে গানে তার প্রতিবাদ করবেন। এইটেই তো হওয়া উচিত। চাপিয়ে দেওয়া প্রতিবাদে কী হয় আর না হয়, সে আজ সকলেই জানে। এখন নিজের ভিতর থেকেই নিজে রুখে দাঁড়াবার মাটি খুঁজে নিতে হবে। 

দেবীপ্রসাদকে এমন তন্ময় আর দৃঢ় হয়ে কথা বলতে পূর্ণিমা আগে তেমন করে শোনেনি। এও তার এক নতুন অভিজ্ঞতা। গত কয়েকদিনে তার সঙ্গে যেন আজব সব ঘটনা ঘটছে। আর পূর্ণিমা বারবার শিহরিত হচ্ছে। ভাবছে, কীসে যেন ভর করেছে তার উপর। নইলে এত জিনিস ঘটছে কী করে! সেই-ই বা এতকিছু করে উঠছে কীভাবে!

দেবীপ্রসাদ তাঁর কথার রেশ ধরেই এবার বলেন, তোমার প্রতিরোধ তোমাকেই গড়ে তুলতে হবে। আর কিছু না হোক বাঁশ থাকে তো তাই দিয়েই কেল্লা বানাও। তিতুমিরের গল্প শুনেছ তো? 

ওইখানে দাঁড়িয়েই পূর্ণিমার আশরীর রোমাঞ্চ হয়। কী করে যে সব কথার বিন্দুগুলো এক এক করে মিলে যায় সে যেন বুঝে উঠতে পারছে না। তবু মিলে তো কোথাও ঠিক যায়ই যায়। 

পূর্ণিমা আর না করেনি। গঙ্গা চিত্রকরের কাছে গিয়ে সব বুঝিয়ে বলে, সে তো এক কথায় রাজি। বলে, পুন্নিমাদিদি, আমিও তো সবই খেয়াল করেছি। হিন্দু মুসলমান নিয়ে একটা লাগানি-ভাঙানি চলছে। কতবার ভেবেছি, গান বাঁধব। কিন্তু ভয়ে আর বাঁধা হয় না। তা ছাড়া আজকাল আমাদের আর গাইতে কে ডাকে বলো! এখন তুমি অভয় দিচ্ছ, যখন আমরা সবাই গাইব। আজই আমি গান বাঁধব।

প্রস্তুতির সময় অল্প ছিল, কিন্তু কোথাও কোনও খামতি রাখেনি পূর্ণিমা। 

[চলবে] 


আগের পর্বগুলি পড়ুন : সোনার বাড়ি জমি (প্রথম পর্ব)

                               সোনার বাড়ি জমি (দ্বিতীয় পর্ব)

                               সোনার বাড়ি জমি (তৃতীয় পর্ব)

                               সোনার বাড়ি জমি (চতুর্থ পর্ব)

                               সোনার বাড়ি জমি (পঞ্চম পর্ব)

                               সোনার বাড়ি জমি (ষষ্ঠ পর্ব)

                               সোনার বাড়ি জমি (সপ্তম পর্ব) 

                               সোনার বাড়ি জমি (অষ্টম পর্ব)

                               সোনার বাড়ি জমি (নবম পর্ব)

                               সোনার বাড়ি জমি (দশম পর্ব)

                               সোনার বাড়ি জমি (একাদশ পর্ব) 

                              সোনার বাড়ি জমি (দ্বাদশ পর্ব) 


..............................................................................

অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র

সজ্জা : বিবস্বান দত্ত 

#সোনার বাড়ি জমি #সরোজ দরবার #উপন্যাস #ধারাবাহিক #বিবস্বান দত্ত #ঐন্দ্রিলা চন্দ্র #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #বাংলা পোর্টাল #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

43

Unique Visitors

215010