সোনার বাড়ি জমি (দ্বিতীয় পর্ব)
ধারাবাহিক উপন্যাস
******************************
আগের কথা : এই কাহিনিটা এক জাদুকর বুড়োর। কিংবা যুবক-যুবতির। অথবা দুটো ফুলের। সে কথা বিচারের ভার পাঠকের। কারণ, এসব কথা যত না কাহিনি, তার চেয়ে বেশি আলাপ। আপাতত কথক আর পাঠক দুজনেই হাজির এক গাঁয়ে। নাম তার সোনাপুর। জাদুবুড়োর দেখা মিলেছে প্রথমেই। তারা ধরে ঝুলি ভরাচ্ছে সে। দেখা যাক, চলতে চলতে দেখা হয়ে যায় আর কার কার সঙ্গে। আর কার দেখা পেলে কিসসা শোনায় জাদুবুড়ো!
***************************
দ্বিতীয় পর্ব
...............
[তিন]
সোনাপুর গ্রামটা ঘুরে দেখলে আশ্চর্য হবেন। এখানে মানুষ কাঁদে না। আপনি চুপিচুপি জিজ্ঞেস করবেন, হ্যাঁ গো তোমাদের দুঃখ-কষ্ট নেই?
উত্তর আসবে, হ্যাঁ আছে তো।
-তবে তোমরা কাঁদো না কেন?
-কেঁদে কী হবে?
-মনের ভার কমবে।
-মনে আমাদের জন্মের ভার। সে কমাতে গেলে কাঁদতে কাঁদতে নদী হয়ে যাবে। দেখছ না, আমাদের বসত ঘিরে তাই কত নদী! কতকালের দুঃখ আমাদের শতেক নদী হয়ে আমাদেরই পাশে পাশে বয়ে যাচ্ছে।
এইরকম উত্তর পেলে আপনি চুপ করে যেতে বাধ্য। কী আর বলবেন, বলুন! এই যে কেমন চমৎকার সবুজ, ধানগাছ মাথা দোলাচ্ছে; বড় বড় গাছেরা থেকে থেকেই ঘিরে রেখেছে গ্রামের রাস্তার দুপাশ। এক-একটা ঘরের চালে ফনফনিয়ে উঠে গেছে লাউ কি কুমড়োর লতা। গোরুরা ঘুরছে নিশ্চিন্তে। পুকুরে নেমেছে হাঁস। দু-একটা তরুণী বউ ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে, হ্যাঁ, এখনও আপনি এ-দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন। এইসব কী চমৎকার না! এই বাতাসে শ্বাস নিলেই আপনি টের পাবেন, টাটকা বাতাস কাকে বলে।
তারপর দেখবেন, বাতাস কেমন ঘুরছে। পাক খাচ্ছে। তখন বুঝবেন, বাতাস নয় কেবল, ও আসলে মানুষের দীর্ঘশ্বাস। পাক খেয়ে খেয়ে এই গ্রামের বাতাসের সঙ্গেই তা মিশে আছে। এখন আর আপনি কোনোটার থেকে কোনোটাকে আলাদা করতে পারবেন না। ফলে, গ্রামের বাতাস ফুসসুসে নিয়ে এরপর থেকে যখন আপনার আহ্লাদ হবে, খেয়াল রাখবেন, কারও কারও দীর্ঘশ্বাসেও আপনার অজান্তেই আহ্লাদ হচ্ছে। এই কথাটা কেমন নীতিকথার মতো হয়ে গেল না! আমার কানেই খচ্ করে বাজল। বুধমণ্ডলী, আমায় মার্জনা করবেন, কিন্তু আমাদের এই আহ্লাদের স্বভাব নিয়ে আমার একটু আপত্তি আছে। দেখুন না কেন, কতকিছু নিয়ে আমরা আহ্লাদ করে বসি। বড় গাড়ি, বড় রাস্তা, বড় কারখানা, বড় দোকান ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের চোখের সামনে উন্নতির যেসব চিহ্ন ছড়িয়ে দেওয়া হয়, সেইসব দেখে আমরা বলি, সাবাস! কিন্তু সেটাই যদি চিহ্ন হয়, তবে সকলের ঘরেই তো একই চিহ্ন থাকার কথা ছিল। মানুষ সামান্য পিটুলি গোলা জলে কী চমৎকার আলপনা এঁকে নিজেদের ঘর সাজাতে পারে। এত বড় বড় দেশ, এত পুঁজি, এত এত কিছু সাধারণ কটা জিনিস দিয়ে মানুষের ঘর সাজাতে পারে না! হয়তো পারে। ইচ্ছে করেই করে না। এখন, আপনারাও জানেন, যতই বলি সবার ঘরে এক চিহ্ন থাকার কথা, তা তো থাকে না, তা থাকার নয়। যুগ যুগ ধরে এই-ই চলছে। যে-গরিব সে-গরিব, যে-শোষিত সে-শোষিত, এটা মেনে নিয়েই আমরা আহ্লাদ করি। এটাকে আমার মুদ্রাদোষ বলে মনে হয়। ধরুন, দেশে একটা ভালোমানুষের পেল্লায় মূর্তি বসল আর আমার আপনার ছাতি গর্বে একেবারে ছিয়াশি ইঞ্চি হয়ে গেল। সে তো বেশ ভালো কথা। কিন্তু তাতে হল যেটা, যে কটা গ্রাম উচ্ছেদ হল, যে কয়েকশো মানুষ রাতারাতি ঠিকানাহীন হলেন, এই পৃথিবীতে পরগাছা সমান হয়ে গেলেন, তাঁদের এই অভিশপ্ত জীবনকেও আমরা আমাদের আহ্লাদের ভিতর ঢুকিয়ে ফেললাম। এরপর যখন আমরা একবার কি দুবার দরবার করি যে, ‘চলছে না চলবে না’, তখন আসলে তার তলায় তলায় একটা সুর বাজতেই থাকে, চলছে যখন বেশ চলবে। আমি এইটে শুনতে পাই। পাই বলেই আপনাদের বলছি গ্রামের বাতাস বুক ভরে নেওয়ার সময় ওই দীর্ঘশ্বাসগুলোও খেয়াল রাখবেন।
সোনাপুরের হালখানাই দেখুন না কেন। এখানে চাষ আছে, ফসলের দাম নেই। দেখেননি কি, কুইন্টাল কুইন্টাল ফসল কেমন রাগে নষ্ট করে ফেলেন কৃষক। নিশ্চয়ই আপনি সংবাদে এরকম জেনেছেন, কিন্তু আয়রনি দেখুন, সেই গ্রামের নামটা আপনি এখন কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। যেখান থেকে আপনার মুখের গ্রাস আসে, সেখানকার নামটাই আপনার স্মরণ নেই। কিন্তু তাই বলে কি আপনার এটিএম পিন বা মেলের পাসওয়ার্ড বা কোন দোকানে কখন কত শতাংশ ছাড় দেয়, এসব মনে নেই! নিশ্চিত মনে আছে। আমাদের ভুলে যাওয়ার ভিতর আসলে এরকম একটা বেখাপ্পাপনা আছে। মানুষ মানুষকে ভুলে যায়। অথচ সকলেই পাশাপাশি থাকে। এর থেকে আশ্চর্য আর কী আছে বলুন!
যাই হোক ধরে নিন, ওই যেসব গ্রামের নাম আপনি মনে রাখতে পারেন না, তারই একখানা হল এই সোনাপুর। যেখানে, কাজ-জানা লোক আছে, কাজ নেই। কাজের কদর নেই। গ্রামখানা যেন আধা শহরের মুখোশ পরে আছে। অথবা, একটা শহর যেন হতে হতেও হতে না-পেরে কোনও গল্পের অভিশপ্ত রাজপুত্রর মতো এই একখানা গ্রাম হয়ে বেঁচে আছে। তার একদিকে ইলেক্ট্রিক আছে, মোবাইল আছে, নাচ আছে, গান আছে, সিনেমা হল আছে। আবার নেই-ও অনেক কিছু। গ্রামে তেমন কাজ নেই। যুবক মানুষ নেই। লেখাপড়া শেখা ছেলেপিলেরা দলে দলে গ্রাম ছেড়েছে। বাইরে থাকে। সোনাপুরে তারা ঘুরতে আসে মাঝে মধ্যে। থাকার মধ্যে আছে কয়েকজন পুরোনোদিনের মানুষ। আর তাদের স্মৃতি। মাঝে মধ্যে ওদের দেখে মনে হবে, যেন ওরা ঠায় বসে আছে। কিন্তু আসলে ওরা বহুদূর স্মৃতি ধরে হেঁটে আসছে।
মানুষ হওয়া ছাড়া মানুষের কী আর হওয়ার থাকতে পারে? কিছুই না। কিন্তু মানুষ কিছুতেই মানুষ হতে পারে না। বহুযুগ ধরে সেই এই একটা চেষ্টাই ক্রমাগত করে চলেছে। তেল মাখানো বাঁশে বাঁদরের ওঠার মতো এক-পা এগোচ্ছে তো দু-পা পিছোচ্ছে। মাঝে মাঝে আঁধার গাঢ় হয়। অন্ধকার সেরঘুট্টি, চোরের মায়ের কুরখুট্টি। নিবিড় মেঘে কালো হয়ে এলেই তো তস্করের আহ্লাদ। তখন চারিদিকে তছনছ। সমাজে এ ওর মাথায় চড়ে বসে। সে তার জল-অচল করে। যার হাতে দুটো পয়সা আসে, সেই-ই অন্যের মাথায় উঠে কর্তাগিরি ফলাতে চায়। এক-একটা সময় এমন আসে, কে যে সাধু আর কে চোর বোঝা যায় না। সত্যি আর মিথ্যের ভেদ স্পষ্ট হয় না, সবই যেন ভেক নিয়েছে। সবরকমের বাঁধুনি আলগা হয়ে আসে। অনাচারের মেঘ জমে। অত্যাচার বেড়ে চলে পাল্লা দিয়ে। মানুষ কাঁদে, কিন্তু ভয়ে শব্দ করে না। গোটা সমাজ গুমরে গুমরে কাঁদে আর মুক্তি চায়। সোনাপুরের লোকেরা বুঝতে পারে, একটা অদ্ভুত সময়ের ভিতরই তারা ঢুকে পড়েছে। সময়টা ভালো নয় মোটেও।
গ্রামের মানুষের বিশ্বাস, এইরকম খারাপ সময় এলে নাকি আকাশের সাতমহলা থেকে এক একজন সত্যিকার মানুষ নেমে আসেন মাটির দুনিয়ায়। তাঁরা অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে বলে যান, এইসব নালা-খন্দে মুখ গুঁজে পড়ে থেকে হবেটা কী! মনে যদি কাদা জমে তো শতজন্ম গঙ্গাস্নানেও তা ধুয়েমুছে যাবে না। ভিতর থেকে কর্তার ভূতখানাকে সরাও দিকি! মানুষ হও রে, মানুষ।
কিন্তু বললেই যে লোকে চাঁদমুখ করে শুনবে, তার আর কী মানে? এতই সহজ নাকি সবকিছু! এই যে নদী, তারও কি বইতে গিয়ে মাটির বাধা সইতে হয় না! সুতরাং, যতই তুমি বড়ো মানুষ হও না বাপু, এক কথায় সব মানছি না। অনড় পাথর যেন কথা বলে ওঠে। তুমি এসে বললে, আর পুরুষানুক্রমে কর্তা সেজে থাকার সব সুবিধা ঝেড়ে ফেলে অমনি লোকে মানুষের সঙ্গে মিশে মানুষ হওয়ার সাধনা শুরু করলে, এমন যাত্রাপালা আবার হয় নাকি! তখন তাই সংঘাত গুরুতর হয়। মানুষের সাধনার কথা যারা বলতে এসেছে, তাদেরকে তাই বিপ্লবী হয়ে উঠতে হয়। কষ্টও সইতে হয় বিস্তর। কিন্তু অমনি কাছা এঁটে বিপ্লবী কিছু হয়ে-ওঠা যায় না সহজে।
প্রথমে তাঁরা নিজেরা সবকিছু ভেদের ঊর্ধ্বে ওঠেন। জাত ধর্ম অনাচারের চার আঙুল উপর দিয়ে হাঁটেন। তাঁদের কারও রথ মাটি ছোঁয় না। লোকে বলে অ-লৌকিক। সক্কলে তো আর অতখানি উপরে উঠতে পারে না। তাই অলৌকিক মনে হয়। তারপর শুরু হয় দোরে দোরে ঘোরা। সে বুদ্ধই বলো, আর শ্রীচৈতন্য- জনসংযোগ না করলে চেতনা জাগবে না, সক্কলেই দেখিয়েছেন। দ্যাখো না আমাদের ঠাকুর রামকৃষ্ণকে। কোন ভাষায় কথা বলেন তিনি? মানুষের ভাষায়। সেই মানুষ কারা? বহু, বহু মানুষ। সমষ্টির মানুষ। এই ভাষা, এই ঘোরা, এই সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে এসে বড়ো একজন মানুষ হয়ে ওঠার ভিতরেই সেই বহু মানুষ নাড়ির টান খুঁজে পান। রক্তে তখন বদলের দোলা লাগে। মানুষ ভিতরে ভিতরে অনেকখানি বদলায়। তখন কিছুদিন শান্তিকল্যাণ। প্রথম প্রথম মনে হয়, এবার পৃথিবীতে মানুষ কেবল প্রকৃত মানুষই হবে।
তারপর মানুষ আবার লোভী হতে থাকে, নেতা হতে থাকে, মন্ত্রী হতে থাকে, কমিটির মেম্বার হয়ে ওঠে। বাণিজ্য করে, নয় লোক ঠকিয়ে, নয় গোলামি করে বেজায় টাকা-পয়সা করে। তখন তার মনে হয়, সবই তো হল। কিন্তু সুখ কই? সুখের খোঁজে দিক ঘোরে আর ওদিক ফেরে। তারপর একদিন মনে হতে থাকে মনোহারি রকমারি জিনিসপত্র খরিদ করলেই সুখ মিলবে। যেই না এই কথা ভাবা, বেশ ক-টা মানুষ চাট্টি রঙিন সুখখেলনা নিয়ে হাজির হয়ে যায় ওদের সামনে। তখন আর-এক প্রস্থ বড়ো করে লোক ঠকানোর খেলা শুরু হয়। খেলনায় কি আর সুখ হয়! ও তো ছেলেভুলানো জিনিস। কোনও বস্তুই মানুষকে সুখ দিতে পারে না। তবু খরিদপত্তর চলতেই থাকে।
মানুষ জেনেবুঝেই ঠকতে থাকে। যত কিনছে, তত ঠকছে। ঠকছে, তবু কিনছে। লক্ষ্মীর ভাঁড় ভাঙে, ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙে, ঘটিবাটি বাঁধা পড়ে তবু কেনা আর থামে না। যেন ভিখিরি হওয়ার সাধ জেগেছে মনে। কিন্তু ভিখিরি হওয়াই বা কী আর এমন সহজ! মানে যে বেজায় বাধে। তখন সেই ক-জন লোক বলে, আরে এভাবে দেখতে নেই। বলো, ভিখিরি আবার কি! এই তোমায় দিয়ে দিলাম ভিকারি হওয়ার কার্ড। তোমার যা লাগবে তুমি এখন কিনে নাও! পরে সময় সুযোগ বুঝে তোমার মাংস কেটে কেটে শোধ দিও। মানুষ দু-মুহূর্তের সুখ পেতে সেই শর্তে রাজিও হয়ে যায়।
একদিন তার দেহ থেকে মাংস নিয়ে চলে যায় ওই ক-টা তস্কর। রক্ত আর হাড় নিয়ে সে পড়ে থাকে। তার যন্ত্রণা হয়। সে চায় একজন মানুষ এসে তার এই কষ্ট লাঘব করুক। আর, চকিতে তার মনে পড়ে যায় মানুষ হওয়াই তার প্রথমত উদ্দেশ্য ছিল। সে মানুষ হতে পারেনি। তাই মানুষও তার সঙ্গে নেই। কঙ্কালের দেহ নিয়ে সে তখন কঁকিয়ে ওঠে।
এইরকম একটা দুটো দশটা বিশটা করে শয়ে শয়ে কঙ্কাল সব পাশাপাশি আসে একদিন। প্রথমে এ-হেন নিয়তিতে তারা পরস্পরের দুঃখ ভাগ করে নেয়। তারপর রেগে ওঠে। বলে, আসলে তো গোড়ায় গলদ। শব্দের অসহায়তা। মানুষ যখন হওয়ামাত্র মানুষ, তখন আর-একটা শব্দ কি থাকতে পারত না, যা উন্নত সেই মানুষকে বোঝায়! থাকলে গন্তব্যটা অনেক স্থির-নিশ্চিত হত। তোমাকে এই ঘাট থেকে ওই ঘাটে যেতে হবে, এই বললে পালখানা তোলা সহজ। কিন্তু ঘাটের ভিতরেই অন্যতর ঘাট খুঁজে পেতে হবে, এ বড়ো রহস্যকথা। এর তো কূলকিনারা নেই।
[চার]
জাদুবুড়ো এইসব শোনে আর হাসে। বলে, রহস্য তো এই কারণেই মধুর ভারি। দ্যাখো না কেন, শূন্য থেকে শূন্য নিলেও শূন্য। পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলেও পূর্ণ। মানুষ থেকে মানুষ নিলেও মানুষই থাকে। মানুষকে মেরে ফেলা সহজ নয়। জাদুবুড়ো বলে, মানব। মহামানব। মানুষ থেকে মানবে। আছে তো সেই পারে যাওয়া। তোমরা চোখ চেয়ে দেখো নাই কেন!
কঙ্কালদের কাছে এ-কথার জবাব নেই। তারা পূর্বাশ্রমের কথা মনে করে। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। স্মৃতিরা এসে তাদের ক্ষতের উপর আদর রাখে। তাদের যন্ত্রণা একটু কমে। তখন তারা বোঝে এটুকুই সম্বল। এই রক্ত-মাংসলোভী শেয়ালের দুনিয়া শরীর থেকে সব মাংস-মজ্জা খুবলে নিয়ে চলে যায়। শুধু স্মৃতিটুকু কেউ কেড়ে নিয়ে যেতে পারে না। স্মৃতিতে থেকে যাওয়া সেইসব দিনের কথাগুলোই তারা বলতে চায় সবার কাছে। যখন গেরস্থ ঘরে দু-মুঠো অন্ন ছিল। একটু আলো ছিল। গান ছিল। মেলা ছিল। এমন মাথা ঢাকতে পাছা বেরিয়ে পড়ার দিন তো ছিল না। এত ভাইয়ে ভাইয়ে কাটাকাটির দিনও ছিল না। কী সোনার দিনই না ছিল এককালে সোনাপুরে!
সেইসব সুন্দর দিনের কথা বলতে তাদের কঙ্কালের ভিতরও আনচান জাগে। কিন্তু বলবে কী করে! তারা তো কঙ্কাল। লোকে এই কঙ্কালকে সামনে দেখলে দাঁতকপাটি খাবে না! কঙ্কালেরা তখন জাদুবুড়োর কাছেই হত্যে দেয়। বলে, বুড়ো তোমার রহস্য রাখো। আমাদের কথাগুলোকে মুক্তি দাও দেখি। বুড়ো মিচমিচ করে হাসে। তারপর চুপিচুপি বলে, আয়রে আমার রাউ চণ্ডালের হাড়। আয় তোরা সব, আমার কাছে থাক। তোরা আমার পাশে থাকলে তবে না জাদুর খেলা দেখাতে পারব। আসছে সেই সময়; কোথায় খেলা দেখাবে বুড়ো? কঙ্কালেরা জিজ্ঞেস করে। জাদুবুড়ো বলে, চলো তবে বড়োপুকুরের ধারে। বড়োবাড়ির ছেলে এসেছে শহর থেকে। সঙ্গে এসেছে এক কন্যে।
কঙ্কালেরা বলে, ও মা! ওরা এসে গেছে। তবে তো শুভ মহরৎ বুড়ো। তা ছেলেটাকে তো আমরা চিনি। সে তো এই মাটিরই ছেলে। কিন্তু কন্যেকে তো চিনি না। তার কথা বলো আগে।
জাদুবুড়ো বলে, সেই তো বলি। কেমন সে কন্যে জানো?
পরমা এক সুন্দরী কইন্যা সঙ্গেতে তাহার।
জন্মিয়া ভন্মিয়া এমুন দেখি নাইকো আর।।
কঙ্কালেরা খানিক উশখুশ। তারা আরও কিছু শুনবে আশায় ছিল। মন ভরল না। কিন্তু একটা মজার ব্যাপার হল। এই যে, জন্ম ইস্তক যেমনটি দেখি নাই, তারে কী ভাষায়-বা ব্যাখ্যান করা যায়! বরং তার কল্পনা করা যায়। সে ভারী নতুন তবে। এই ভেবে তারাও উল্লসিত হল। তাদের আনন্দের অবশ্য আর-এক কারণ আছে। জাদুবুড়োর মুখে বহুদিন পর বাদ্যানির পালা-র পঙ্ক্তি ভুসভুসিয়ে উঠছে দেখে ডগমগ কঙ্কালের দল। তারা একে অন্যকে বলে, বুড়োর খেলা এদ্দিনে শুরু হল বলে। এবার ঠিক কিছু একটা দেখা যাবে।
কিন্তু দেখা যাবে বললেই কি দেখা যায়! না, দেখা সমীচীন হবে! বিশেষত পুকুরপাড়ে বসে ওরা যখন একমনে গল্প করছে। করছে তো করছেই। যেন সাত জন্মের গল্প এই ক্ষণে সেরে নিচ্ছে। সে ধ্যান যেন ভাঙার নয়। বিকেলখানা ওদের জন্য এমন মধুর হয়েছে যে বলার নয়। একটা দুটো পাখি থেকে থেকে সাড়া দেয়। ফুলেরা তাদের পাপড়ি গোটাবে গোটাবে করেও গোটায়নি এখনও। একটু কুঁচকেছে যেন দুপুরের ঘুম সেরে আড়মোড়া ভাঙছে। ঠিক সেই সময়। বুড়ো পা টিপে টিপে ওদের পিছনখানিতে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করে কী বলছে সুন্দরী কইন্যা।
কন্যা তখন ভারী খুশি। সে দেখে ফেলেছে শিবতলা, বিশালাক্ষীতলা। মনসার থান। পিরের ঘর। এ সব যেন তার স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসে মাটিতে রূপ নিয়েছে। একই সঙ্গে পাশাপাশি কেমন এরা থাকতে পারে। পিরের ঘরখানা দোচালা, খড়ে ছাওয়া কুঁড়ে। সে জানে, একে বলে একবাংলা রীতির মন্দির। শুধু শুনেইছিল, আর ছবি দেখেছিল। এত ভালো করে দেখল এই প্রথম। কী চমৎকার নাম! একবাংলা। বাংলা তো একটাই। একধরনের স্থাপত্যের রীতির নামের ভিতরই কেমন ইতিহাসের বীভৎসতা নস্যাৎ হয়ে যায়। এই একবাংলারই সাহেবি কেতার নাম ডাকবাংলা। আজ যত দেখেছে ততই সে শিহরিত হয়েছে। তারপর দেখল আটচালা। অনেক লোক সেখানে একসঙ্গে বসতে পারে। শিবের গাজন, বিশালাক্ষীর পুজোর সময় এই আটচালা নইলে লোক ধরবে কেন! নাচগান, বাদ্যিবাজনা, পুথিপাঠ কোথায় হবে! এসব সে আগে কখনও দেখেনি। আজ দেখছে। দেখেছে আর আহ্লাদ পেয়েছে।
সে তাই তার মনের মানুষের আরও গা ঘেঁষে বসে বলছে, সে আরও ঘুরবে। এই দেশের গ্রামে গ্রামে। গঞ্জে গঞ্জে। সে সব জানবে। বুঝবে। নুড়ি, পাথর, ছড়া, কথা কুড়িয়ে তুলে রাখবে তার ডায়রিতে। কোনও ফোকলা দাঁত বুড়ির থেকে শুনবে কোনও রূপকথা। দক্ষিণারঞ্জনে যার হদিশ নেই। বা, একটু অন্যরকম করে আছে। এইসব খুঁজে বেড়াবে সে। প্রণয়ী এদিকে তাকে চোখে হারায়। বলে, সে তো ভালো কথা, কিন্তু আমার যে চিন্তা হয় খুব। কন্যা বলে, কেন? আমি মেয়ে বলে? নাকি মুসলমান বলে? ছেলে বলে, দুই-ই। দুই-ই চিন্তার কারণ।
খুব চুপিস্বরেই এইসব বলাবলি করছিল তারা। তবু তাদের কথা শুনে বুড়ো আর থাকতে পারে না। ফস করে বলে ফ্যালে,
যখন নাকি বাইদ্যার ছেড়ি বাঁশে মাইলো লাড়া
বইস্যা আছিল নদ্যার ঠাকুর উইঠ্যা ঐল খাড়া।।
দড়ি বাইয়া উঠ্যা যখন বাঁশে বাজী করে।
নইদ্যার ঠাকুর উঠ্যা কয় পইর্যা নাকি মরে!
সেমিমা চমকে ওঠে। শক্ত করে হাত চেপে ধরে বরুণের। বরুণও ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে। তারপর জাদুকর বুড়োকে দেখে কী খুশিই না হয়ে ওঠে। সেই ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছে এই তারা-ধরা বুড়োকে। বুড়োর কত গল্পই না শুনেছে সে। এক-একদিন ঝুঁঝকো আঁধার রাতে গাছের মাথায় অনেক জোনাকি একসঙ্গে জ্বলে উঠত। মনে হত যেন এক নরম আগুনের গোলা গাছের মাথায় এসে বসে পড়েছে। বরুণের মা বলত, কী ভাবিস! জোনাই বুঝি! উঁহুঁ, ও হল গিয়ে জাদুবুড়োর তারা নামানো। সে অবাক হয়ে বলত, অত উঁচু আকাশ থেকে তারা কি নামানো যায়? কিন্তু মা যখন বলেছে, তখন মিথ্যে হবে কেন! নিশ্চয়ই তারা নামে। তারপর একদিন তো সে নিজের চোখেই দেখল, আকাশের পথে এক তারা মেলা করেছে। দ্রুত বদলে যাছে তার অবস্থান। সরসর করে এগোতে এগোতে তারখানা টুপ্ করে পাতার মতো খসে পড়ল। মানে, ছিল থেকে নেই হয়ে গেল লহমায়। উঠোনে খেজুর চাটাই পেতে সেদিন বসেছিল বরুণ, একটা হ্যারিকেন জ্বলছে টিমটিম করে মাত্র, আর তার ভয় করেছিল, যে তারাটা ঠিক তার পাশেই পড়ল না তো! তারপর সে ভাবে, এ বাবা! তারা তার পাশে পড়বে কী করে! তাকে তো নামিয়েছে জাদুবুড়ো! আশ্চর্য সেই আঁধার রাতেও সে মাঠের মাঝখান থেকে জাদুবুড়োর হাসির আওয়াজ পেয়েছিল। তার মনে সেদিনই গেঁথে গেল যে জাদুবুড়ো আলবাত তারা ধরতে জানে। মা কি কখনও মিথ্যে বলে! তারপর কত বয়স বাড়ল। জোনাকি কেবল জোনাকি-ই হয়ে গেল পরে পরে। তবু তারা-ধরা বুড়োর রহস্য ভাঙতে কিছুতেই মন চাইল না তার। কত্তদিন দেখা হয়নি। আজও সে জানে আর মানে যে, বুড়ো এক অলৌকিক ক্ষমতাবলে তারা নামাতে জানে।
অকস্মাৎ আজ জাদুবুড়োর দেখা পেয়ে সে তাই ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে বলে, জাদুবুড়ো, তুমি এখন এখানে? তারা এসে পড়েছে নাকি আশেপাশে? এমন করে সে বলল, যেন ঘুড়ি কাটা পড়েছে। সেমিমা এবার চারচালার উপর আটচালা অবাক। একে তো বুড়ো তাদের ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে, তায় বরুণ তাতে একটুও না রেগে খুশিতে ডগমগ। সেমিমা অবাক হবে না! বুড়ো এবার হেসে বলে, তারা বলে তারা, জব্বর তারা তো এসে পড়েইছে। দেখছ না, কেমন আলো দিছে। বলে তাদের দুজনের দিকেই আঙুল দেখায়। বরুণ হাসে। সেমিমাও। বুড়ো শুধোয়, কি মা জননী, ঠিক বলিনি? দাদাঠাকুর কি আমার চাঁদ-সুরুজ নয়?
আমার বন্ধু চান্দ-সুরুজ কাঞ্চা সোনা জ্বলে।
তাহার কাছে সুজন বাদ্যা জ্যোনি যেমন জ্বলে।।
বলে হাসতে থাকে। সেমিমা এবার আর-এক দফা অবাক হয়। এই গাঁয়ের বুড়োর মুখে যে থেকে থেকেই ফুল ফুটছে। বেরিয়ে আসছে মহুয়া পালার গান। প্রথমবার শোনার পর, ঘটনার আকস্মিকতায়, সে ব্যাপারটা ঠাহর করতে পারেনি তেমন করে। বুড়ো ছড়া কাটছে ভেবেছিল। গাঁয়ে-গঞ্জের প্রাচীন পুরুষ কি রমণীরা আজও এমন ছড়া কেটে কেটে কথা বলে, সে শুনেছে। প্রথমটা সেরকমই ভেবেছিল। কিন্তু এবার তার স্মৃতি স্পষ্টই জানাল, এ তো ছেলেভুলানো ছড়া নয়। আশ্চর্য হয়ে সে তাই বলে, এইসব পঙ্ক্তি আপনি জানলেন কী করে? এবার বুড়োর ভারী আশ্চয্যি হবার পালা। বুড়ো একটু থেমে যায়, তারপর উত্তর করে, মা জননী, এ তো আমারই জিনিস। নিজের জিনিসকে নিজে কেমনে জানি এখন তা আর বলি কী করে!
সেমিমা এবার লজ্জা পায়। কী করে যেন সে ধরেই নিয়েছিল এইসব পঙ্ক্তি এই গ্রামের বুড়োর মুখে শোনা যাবে না। এসব এখানে মানায় না। কোথায় মানায়? না, কলকাতার কোনও সেমিনারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে। কিংবা নিদেন লিটল ম্যাগাজিনের কোনও প্রবন্ধে। গেঁয়ো এক বুড়ো যে তা জানবে, এমনটা সে ভাবতেই ভুলে গিয়েছিল।
পুরো ছকটাই এখান ঘুরে উলটো হয়ে গেছে। অথচ এ তো গাঁয়েরই জিনিস। এই মাটি-জল-হাওয়ারই সম্পত্তি। ভেজাল নয়, খাঁটি মধু। যে এর স্বাদ পেয়েছে সে খামখা ছাড়বে কেন। কত অনামা অখ্যাত বয়াতি এইসব পালা লিখেছে, গেয়েছে। গাইতে গাইতে রূপ গেছে পালটে। শব্দ জুড়েছে। শব্দ ভেঙেছে। মধুর স্বাদ তবু পালটায়নি। এককালে এমন করেই লোকে গাইত। আর লাঙলের উপর ভর দিয়ে কত মানুষ তন্ময় হয়ে শুনত সে গান। সেই পালার ভিতর জমে যেত। কাজ ফুরোনো অবসরে কেউ গুনগুন করত দু-চার কলি। আবার একেবারে রসিয়ে বসেও পালা গাওয়া হত। তার জন্য প্যালাও মিলত। স্মৃতিতেই তো ছিল এসব। যেমন আছে এই বুড়োর স্মৃতিতে।
এ সবই তো জানা কথা। পড়ে পড়ে জানা কথা। আজ একেবারে চোখের সামনে একটা মানুষকে পালার প্রসঙ্গ তুলতে দেখে সে যারপরনাই আশ্চর্য হয়েছে। আজ অব্দি এমন কোনও মানুষকে সে তার জীবনে দেখেনি। ক্লাসরুমের বাইরে এসব যে কেউ আবৃত্তি করবে, তা তার স্বপ্নের অতীত। কেমন করে যেন, জাদুবুড়োকে এরই মধ্যে খানিক সে তাই ভালোও বেসে ফেলেছে। তার মনে হচ্ছে, এই একটা মানুষ সে খুঁজে পেয়েছে যাকে খনন করা যায়। যাকে খুঁড়লে বেরিয়ে আসবে পুরোনো মাটি। তাতে লুপ্ত সভ্যতার গন্ধ। মাঠে ঘাটে ঘুরতে ঘুরতে, হারানো ঐতিহ্যের খোঁজ করতে করতে এটুকু নাড়িজ্ঞান তার হয়েছে এতদিনে। কোথায় কী পাওয়া যেতে পারে, সে টের পায়। যেমন সাপুড়ে এসে ধরে ফেলে কোন ভিটেয় সাপ আছে। এটুকু অভ্যেস আর চর্চা। এই লোকটাকে তার চাপা পড়া ঢিপি মনে হয়। যার ভিতর ঘুমিয়ে আছে কোনও সভ্যতার অনিমেষ আলো। বরুণকে অবাক করে সে তাই বলে ফ্যালে, আমাদের গল্প শোনাবেন বলেই তো আপনি এসেছেন, না জাদুবুড়ো?
তখন সন্ধে নামছে। তালগাছের পাতার কোলে বাসার ভিতর ঢুকে পড়েছে পাখি। অন্ধকারের পর্দাখানা একটু একটু করে মাথা মুখের উপর চাপা দিয়ে দিয়েছে কেউ। সেই রহস্যসন্ধ্যার ভিতর খলখলিয়ে হেসে ওঠে জাদুবুড়ো। বলে, এত্ত সহজে চিনে ফেললে! নইলে আর জননী হয়েছ কেন!
এই দেশে দরদী নাই রে কারে কইবাম কথা।
কোনজন বুঝিবে আমার পুরা মনের বেথা।।
[চলবে]
পূর্ববর্তী পর্ব : সোনার বাড়ি জমি (প্রথম পর্ব) / সরোজ দরবার
..............................
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র
সজ্জা : বিবস্বান দত্ত