উপন্যাস

সোনার বাড়ি জমি (তৃতীয় পর্ব)

সরোজ দরবার Aug 7, 2021 at 8:05 pm উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস

******************************

আগের কথা: সোনাপুর গাঁয়ে আছে এক জাদুবুড়ো, হরেক কিসসা তার ঝুলিতে। এবার গাঁয়ে হাজির দুই যুবক যুবতি। সে মেয়ে তার মনের মানুষের গাঁয়ে এসেছে এ দেশের মাটিকে চিনতে। মাটির ধুলো থেকে সে কুড়িয়ে নিতে চায় নুড়িপাথরের মতো যত গল্পগাথা। কিন্তু মেয়ে যে বিধর্মী! তাই ভয় পায় তার ভালোবাসার জন। কেউ কিছু বলে বসে যদি! কিন্তু তাকে দেখেই জাদুবুড়োর গলায় উঠে আসে মহুয়া পালার গান। নিজের সঙ্গী পেল বুঝি জাদুবুড়ো?

******************************

তৃতীয় পর্ব

.............................


[পাঁচ]


ভোটের মরশুম এখন সোনাপুরে। হাওয়ার গায়ে লেগেছে পালটা টান। সবকিছু বদলে যায় যায়। মাঝে মাঝেই এমন হাওয়া ওঠে। একটু তোলপাড় হয় বটে। কিন্তু কিছু বদলায় না। যা কিছু এদিক ওদিক হয়, তাতে যেন খানিক খানিক বদলের মতো লাগে। বদলের এই যে একখানা ছদ্মবেশ আছে, তা নিয়েই চোরপুলিশ খেলা। নেতারা ভাবে, মানুষ এসব বোঝে না। মানুষ ভাবে, নেতারা বুঝি-বা বোঝে না, যে, তারা সবকিছুই জানে-বোঝে। এ ভারী মজার লুকোচুরি। এ ওকে লুকোচ্ছে, সে তাকে চোখ ঠার দিচ্ছে। 

সত্যি বলতে মানুষ কী না জানে! এ তো কেষ্টযাত্রার দেশ। যে কেষ্ট সাজে, সে যে কেষ্ট নয়, এ-কথা কে না জানে! সকল মানুষই জানে। তবু পালা দেখে লোকে কেঁদে ভাসায়। আবার মূর্তির সামনেও মানুষ মাথা নোয়ায় বইকি। সে কি আর মাটি বা পাথরের মূর্তির সম্মানে কেবল! নাকি মূর্তিকে সামনে রেখে যে অচিন্ত্যকে কল্পনায় আনা সম্ভব তাঁর সামনেই মাথা ঝুঁকে আসে! এ-ও মানুষ বোঝে। জেনেবুঝেই মাথা ঠেকায়। কেউ কেউ এ নিয়ে তাকে নিন্দেমন্দ করে। বলে, বোকামো। ভারী ভারী কথায় বলে পৌত্তলিকতা। কিন্তু মানুষের তাতে কিছু যায় আসে না। সে জানে, সে কী করছে। সবকিছুর ভিতরই এমন দোলাচল যে আছে, জোয়ার-ভাটা যে থাকে- সে জানে। আসলে-নকলে এমনধারা মেলামেশা তার গা-সওয়া। সেই লোকের সামনে এই ছা-পোষা নেতারা আর কত কিছুই-বা লুকাবে! মানুষ তো জানেই, কখন কীসে কতদিন বিভোর হতে হবে, আর কবে আঁধার কেটে ভোর হবে। 

আজ ভোর ভোর উঠে পড়েছে সেমিমা। নতুন জায়গা, অপরিচিত বিছানায় শোয়ার কারণেই হয়তো ঘুমটা তেমন করে হল না। কিন্তু তেমন ক্লান্তি নেই শরীরে, চোখ জ্বালা নেই, বিরক্তির ভাবও নেই। বরং নতুন একটা জায়গায় চিরকেলে ভোরের আলোটাকেই যেন নতুন ঠেকল বেশ। ভেবেছিল, এই কাঁচা আলোয় একা একা পল্লির আশপাশ ঘুরে দেখবে। কাল বরুণের সঙ্গে যতটা দেখেছে তাতে পিপাসা বেড়ে গেছে দশগুণ। তার মন বলে, এই মাটি গল্প বলতে জানে। হাতে নিলেই তার ভিতর ইতিহাসের অক্ষরমালা ঠিক ধুলো ধুলো হয়ে উড়ে এসে পড়বে। শুধু সেসব চিনে নিতে হবে। ধুলো বলে হেলা করে সরিয়ে রাখলে চলবে না। মাটিকে না-জানলে মাটিতে থাকা যায় না। না-জেনে থাকা একরকমের উদ্বাস্তু হয়ে থাকা। যেন টবে লাগানো গাছটি। শিকড়ের সঙ্গে মাটির আলাপ শৌখিন, তাতে পৃথিবীর যোগ নেই। সেমিমা টবের গাছ হয়ে বাঁচতে চায় না। তার দেশের মাটি, বাংলার মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকে। দ্যাখে সবকিছু।

ঘরের লাগসই বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বাইরে বেরোতে গিয়েও বেরোল না সেমিমা। হঠাৎ তার মনে হল, অপরিচিত জায়গায় একা একা ঘোরা ঠিক হবে না। বরুণ থাকলে খুব ভালো হত। এত ভোর ভোর বরুণকে ডাকাডাকি করার কথা ভেবে একটু লজ্জাই পেল সে। যদিও এ বাড়িতে সবাই বেশ যাকে বলে মনেপ্রাণে উদার। বরুণের মা নেই। এক পিসি তাকে মায়ের মতো করে মানুষ করেছে। সেই পিসি তো পারলে এখনই সেমিমাকে বউমা বলে ডাকাডাকি শুরু করে। 

সেমিমা এই ভেবে অবাক হয়, কতদিন আগের মানুষ এই পিসিমা, অথচ তার ভিতরে সেমিমার ধর্ম নিয়ে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই। আদর করে খাওয়াচ্ছে, বসাচ্ছে, কিছু অসুবিধা হচ্ছে কি না বারেবারে জানতে চাইছে। বোঝা যায়, গৃহিণীহীন দাদার ঘরের রাশটি ধরে পিসি বেশ যত্ন করেই সামলেছে। এখনও তাই তার কথাই যেন এ বাড়িতে শেষ কথা। বিধবা হয়ে সংসার হারানোর শোকের উপর সেই কবে প্রলেপ হয়ে নেমেছিল এই ঘরের অলিখিত কর্ত্রীপদ। তারপর থেকে সেইটেই অভ্যেস হয়ে গেছে। পিসিমার বাবা-বাছা দেখে সেমিমার ভারী অস্বস্তি হয়। সে বলে, তুমি কি আমায় বাচ্চা ভাবো পিসিমা?

- না, তুমি একেবারে পাক্কা গিন্নি হয়ে গেছ। দুই ছেলের মা।

- ধ্যাত! কী যে বলো না। কিন্তু আমায় এমন আতুপুতু কোরো না, ভারী অস্বস্তি হয়। জানোই তো, আমি মাঠেঘাটে ঘোরা মেয়ে। 

- সে যখন মাঠেঘাটে ঘুরবে, তখন সেরকম থাকবে। এখন আমার কাছে এসেছ যখন, আমার মতো করে থাকতে হবে। 

- আচ্ছা পিসিমা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

- বলো না... এত কিন্তু কিন্তু করো কেন?

- না, যদি কিছু মনে করো...

- তাহলে তো আরোই বলো। দেখি, কী কথা মনে জমেছে?

- এই যে আমি মুসলমান, এই নিয়ে তোমার আলাদা কিছু মনে হচ্ছে না?

এবার পিসিমা হাসে। সেমিমা অবাক হয়। বলে, হাসছ যে? পিসিমা বলে, এইসব হিন্দু-মুসলমান ভাগ কারা করে জানো, কিছু দামড়া অকম্মা লোক। তাদের নেই কাজ তো খই ভাজ, থেকে থেকেই হিন্দু-মুসলমান করে লাগিয়ে দেয়। কিন্তু তুমি তো মেয়ে এখানে ওখানে অনেক ঘোরো। তুমি মায়েদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস কোরো; প্রসবের বেদ্‌না উঠলে কি হিন্দু-মুসলমান ফারাক থাকে? বুকের যে দুধ, তাতে কি হিন্দু-মুসলমান লেখা থাকে? ওসব ফালতু কথা মা, মন থেকে ফেলে দাও। মায়েদের কাছে কোনোদিন কোনও কিছুর ভাগ কি ছিল? না, আছে? 

কথাগুলো খাঁটি সত্যি। একটু যেন পুরোনো গোছের শুনতে লাগে। যেন পুরোনো কোনও নভেলে পড়া সংলাপ। সেমিমা ভাবে, তাদের বয়সি আর কেউ শুনলে এক্ষুনি এসব মেলোড্রামাটিক বলে নাক কুঁচকোবে। যেখানে ঋত্বিক ঘটককেই দু-চার কথা শুনতে হয়, সেখানে পিসিমা তো কোন ছার! কিন্তু পিসিমা যে আবেগ থেকে কথাগুলো বলছে, সেমিমা জানে, বহু আয়াসেও তা আয়ত্ত করা যায় না। মানুষের মনের গভীর গোপন এক দেশ থেকে উঠে আসে এই সত্যি ইতিহাস। পিসিমা যা বলছে, সবই তো সত্যি কথা। কালে কালে তার গায়ে এত বিষ জমেছে, সেই নিপাট সরল ভালোবাসার কথাটুকুও আজ তাই নভেলের মতো লাগে। আমাদের দেশের অবস্থা আজ এমন হয়ে গেছে যে, এই সহজ সরল কথাগুলোকে আর আজ ঠিক সহজ বলে মনে হয় না। মনে হয় যেন কেউ বাড়িয়ে বলছে। আরোপিত। অতিরেক। কিন্তু এ তো সত্যিই একজন মায়ের মনের কথা। গ্রামের সন্ধেয় বরুণদের রান্নাঘরে বসে থাকা পিসিমাকে হঠাৎ যেন দেশ বলে মনে হয় সেমিমার। দেশ-ও তো মা। দেশ কাউকে ভাগ করেনি। দেশ-কে ভাগ করা হয়েছে। 

ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্গত এই যে বাংলাটায় এখন সে বসে আছে, সেই রাজ্যটাই তো জন্ম নিয়েছে দেশভাগের ফলে। যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, সাম্প্রদায়িকতার বিষ তারও শিরায় শিরায় লুকিয়ে আছে। তার কৃষি অর্থনীতি বদলে গেছে। শিল্পকে কাঁচামালের অভাবে শুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তার যে অবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির ভাণ্ডার, তা-ও কেটে দু-অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছে। আর-এক বাংলা এখন অন্য রাষ্ট্র। তার চলনবলন সবই আলাদা। তার সঙ্গে এখন এই বাংলার মেলেও না, আবার নাড়ির টান স্বীকার না করেও উপায় নেই। যেন এক ডানা কাটা পাখির মতো ছটফট করছে এই রাজ্যটা। আজও। সেই ক্ষতে কেউ আর হাত রাখে না। শুধু নিরাময়ের নামে থেকে থেকে ক্ষত খুঁচিয়ে দেয়। আর-একটু পেকে ওঠে ক্ষত। আর-একটু বিষ জমে। 

সেই বিষবাষ্পের ভিতর শুশ্রূষা হয়ে বসে আছেন কেউ কেউ। যেমন এই পিসিমা। সেমিমার চোখ পলকে ভিজে যায়। আর সে আবিষ্কার করে, পিসিমারও চোখে জল।   

- পিসিমা, তুমি কাঁদছ?

চোখের জল মুছে পিসিমা বলে, মা হওয়া কাকে বলে, কোনোদিন জানতে পারিনি, মা। তখন তো এত ডাক্তার বদ্যি ছিল না। একটা সন্তানের জন্য গাজিবাবার কাছে, দেওয়ান ফকিরের কাছে কত মানত করেছি। শীতলতলায় পুজো দিয়েছি। বলেছি, মা গো কোল ভরিয়ে দাও। কিন্তু কপালে নেই সুখ, আর কী হবে? মানুষটাই আচমকা চলে গেলেন। নিজের সংসারেও আর টেকা হল না। 

সেমিমা পিসিমার হাতে আলতো করে হাত রাখে। শিরা জেগে আছে কতদিনের। হাত বুলোয় সে আদর করে। বলে, থাক না, ওসব পুরোনো কথা। পিসিমা অবশ্য থামে না। বলে, এই সংসারে এসে বরুণকে পেলুম। ওই-ই আমার ছেলে। ... তারপর সামলে নিয়ে পুরোনো প্রসঙ্গ সরিয়ে রেখে বলে, এখন আমাদের যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। তুমি ওকে দেখবে। 

- কী যে বলো না পিসিমা! কোথাও যাওয়ার দিন-ফিন ঘনিয়ে আসছে না। তুমি থামো তো।

- রোজ সকালে, সন্ধেয় মা সারদার ছবির সামনে বসি জানো তো। মা না হয়েও যে মা হওয়া যায় এই একটা মানুষ আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। আমি রোজ প্রণাম করে বলি, আমাকে শক্তি দাও, আমিও যেন তোমার বলতে পারি, আমি সকলের মা। আজ তুমি এলে বলে বুঝলুম, আমার ইচ্ছে তিনি পূরণ করেছেন। 

পিসিমাকে এখন খুব চেনা চেনা লাগে এখন সেমিমার। সে এই পরিমণ্ডলে বড়ো হয়নি ঠিকই, কিন্তু রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ যেভাবে হিন্দু ধর্মের সাধারণ গৃহস্থের রোজকার যাপনের একটা পথ নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন, যা সে জেনেছে, জানতেই হয়েছে, আজ পিসিমাকে দেখেই এক লহমায় সে তা চিনতে পারে। এই ধরনের ধর্মাচরণের মধ্যে একরকমের খোলামেলা ভাব আছে। ধর্মে মতি রেখেও যে মনটাকে খানিক খুলে রাখা যায়, এই পিসিমারা প্রতিদিন তার প্রমাণ দিয়ে চলেছেন। এঁদের কাছে, পরধর্ম নিন্দা পাপ। কিন্তু ধর্মের কারবারিরা সে-কথা শুনলে তো! হায় রে পোড়া দেশের মা, পিসিমারা! তাঁদের কথা আর কবে শোনা হল তেমন করে! সেমিমার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অজান্তেই। 

পিসিমা আবার চোখ মুছে বলে, আজকাল তো শুনি খুব হিন্দু-মুসলমান করা বেড়েছে চাদ্দিকে।

- তা বেড়েছে। বাড়ার কারণও আছে। 

- কিচ্ছু কারণ নেই। সব বদমায়েশি। 

- না গো পিসিমা। আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমাদেরই কীর্তিকলাপ। কম হিংসা তো হয়নি। ইতিহাস যত করুণই হোক, সে তো আমাদেরই অতীত। তা অস্বীকার করে তুমি যাবে কোথায়?

- আমি অত লেখাপড়ার কথা বুঝি না, মা। শুধু এইটুকু তোমায় বলছি, মানুষ অমন ভাগ ভাগ করে থাকতে চায় না। আমাদের ছোটোবেলায় এমন বদমায়েশি দেখতাম। তারপর এই ভাগাভাগি বেশ খানিকটা কমেছিল। এখন আবার কোন বদমায়েশ লেজে আগুন দিয়ে ঘর পোড়াচ্ছে কে জানে!

পিসিমার বলার ধরনে হেসে ফেলেছিল সেমিমা। এই সকালে কথাটা মনে হতে তার আরও একবার হাসি পেল।  



[ছয়]


বরুণকে এখন আর সে ডাকল না। হয়তো কেউই কিছু বলবে না, ভাববে না, তবু একটা স্বাভাবিক সংকোচ তাকে পেয়ে বসে। মনে মনে সে নিজের প্রস্তাব নিজেই নাকচ করে দেয়। প্রথমে ভেবে পায় না কী করবে। তারপর জানলার ধারে গিয়ে বসে। আলো ফুটছে একটু একটু করে। পাখিরা জাগছে। গাছগাছালিও। সবকিছু জেগে ওঠার অল্প অল্প আওয়াজ মিশছে বাতাসে। ঝাপসা স্লেটের মতো এই ভোরটাকে তার ভারী ভালো লাগে। একটা ভোর দেখবে বলে লোকে কত খরচ করে কত আয়াস করে দূরদূরান্তে যায়। তবু এই বাংলার এক গ্রামের ভোরের ভিতর যে সারল্য আর সহজ ভাবখানা আছে, সেটাকে আলতো ওড়নার মতো গায়ে তুলে নিয়ে সেমিমা জানলায় মুখ রেখে চুপটি করে বসে থাকে। সূর্যদেবের যেন একটা নতুন যাত্রা শুরু হচ্ছে। প্রাণভরে দেখতে থাকে সে।   

এককালে গ্রহ, নক্ষত্রের যাতায়াতকে সকলে বলত যাত্রা। উত্তরায়ণ, দক্ষিণায়ন। সেই উপলক্ষ্যে বেশ উৎসবও জমত। বর্ষার সময় এ-মুলুকে হত রথযাত্রা। যেমন ও-মুলুকে বড়োদিনের সময় শুরু হত উৎসব। যে দুনিয়ার জলহাওয়া যেমন, তারা সূর্যি ঠাকুরকে নিয়ে তেমন করে উৎসব বানিয়েছে। এ বড়ো প্রাচীন রেওয়াজ। তারপর কবে থেকে যেন, আমাদের এখানে যাতায়াত-টা আর ততটা ধর্তব্য থাকল না। উৎসবটাই হল যাত্রা। এর মধ্যে নদের ঠাকুর প্রেমে ভাসিয়ে দিলেন সবকিছু। তখন যত উৎসবে এসে বসলেন যমুনাপারের কেষ্টঠাকুর। শুরু হল কেষ্টযাত্রা। তিনদিনের কেষ্টযাত্রা। তাতে এক-একটা পালা। নৌকাবিলাস কি নিমাই সন্ন্যাস। 

আলগোছেই এইসব ভাবনা সেমিমার মনে ঘোরাফেরা করছিল। মাঝেমধ্যে এমনটা হয়। ঠিক নির্দিষ্ট করে সে যে কিছু ভাবছে বা ভাবতে চাইছে তা নয়। তবু কোনও এক সূত্রে সুতোয় সুতো মিলিয়ে ভাবনারা গড়িয়ে যায়। আজও সেইরকম হচ্ছে। নানা জিনিস মনে পড়ে যাচ্ছে এমনি এমনিই। প্রথম যখন সে ঠিক করেছিল, লোককথা নিয়ে গবেষণা করবে, তখন অনেকে একটু অবাক হয়েছিল। বাংলার ছাত্রী, আর যে-কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারে। লোকনাথ ভট্টাচার্যের উপন্যাস কিংবা নবজাগরণকালে হিন্দুত্ববাদের পুনরুত্থান নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন কেউ। দুটো বিষয়েই তার আগ্রহ ছিল। নিজের গরজে পড়াশোনাও করেছিল খানিকটা। এরকম বিষয় নিয়ে কাজ করলে, বইপত্র ঘেঁটে, লাইব্রেরি ওয়ার্ক করেই কাজ মিটতে পারত। দৌড়াদৌড়ি মোটের উপর। কিন্তু বেখাপ্পা সেমিমা বেছেছিল এমন একটা বিষয়, যেখানে মাঠে-ঘাটে ঘুরতে হবে। প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে, এলাকায় এলাকায় ঘুরে ফিরতে হবে। জোগাড় করতে হবে নতুন কিছু। তাতে খাটনি আছে। সেই খাটনির নেশাতেই যেন পেয়ে বসেছিল সেমিমাকে। সে জোর করে এই বিষয় নিয়েই কাজ করতে শুরু করে। অপ্রত্যাশিতকে পাওয়ার আনন্দ এক জীবনে কম নাকি!

তবে কেন কে জানে, সেমিমার চিরকাল মনে হয়েছে, সে নিজে ঠিক এই সিদ্ধান্তটা নেয়নি। নিয়েছে তার ঠাকুমা। বরুণের পিসিমাকে দেখতে দেখতে তার নিজের ঠাকুমার কথাই বারবার মনে পড়ছিল। 

ঠাকুমাকে সে যে খুব বেশি দেখেছে তা নয়। সেই কোন ছোটোবেলায় একটা মেয়ে নিজের ঘরবসত ছেড়ে চলে গিয়েছিল অচেনা একটা মুলুকে; সে-কথা যতদিন আয়ু ছিল, একদিনও ভুলতে পারেনি সেমিমার ঠাকুমা। দেশ যে কারা কেন ভাগ করেছিল, সে তো জানত না। তারপর থেকে এপার আর ওপার কেবল উচ্ছিন্ন মানুষের ঢল। সে বড়ো কষ্টের দিন। মন খানখান হওয়ার দিন। সেই ছোটোবেলায় সেমিমার ঠাকুমার এক খেলার সাথি ছিল। পিঠোপিঠি ঘর তাদের। উঠি বলতে একসঙ্গে, বসি বলতে একসঙ্গে। কত দুষ্টুমি, হাসাহাসি, কান্নাকাটি সব ভাগ করে করে দুই বালিকা তরতরিয়ে বড়ো হচ্ছিল। হঠাৎ একদিন পড়ে রইল খেলনাবাটি। এমন দিন এল যে, একজনকে চলে যেতে হয়েছিল তাদের ঘর ছেড়ে। সেমিমার ঠাকুমারা থেকে গেল এখানেই, যা হবে এই দেশের মাটিতে হবে, এই ভেবে। তার সাথির বাবা তখন ভাবছিল, নতুন দেশে তারা অনেক ভালো থাকবে। অনেক সম্মান নিয়ে থাকবে। প্রতিপত্তিও হবে। তার মনে হয়েছিল, যেভাবে দেশটাকে ভাঙা হচ্ছে, তাতে তাদের প্রাপ্য সম্মান এখানে ভবিষ্যতেও দেবে না কেউ। এখানে দ্বিতীয় হয়ে থাকার চেয়ে কোথাও প্রথম হয়ে থাকা ভালো, হোক সে অচেনা কোনও ভূমি। 

একই মাটিতে দাঁড়িয়ে, একই শস্য, হাওয়ার ভিতর থেকে জীবন খুঁটে পাওয়া দুটো মানুষ ভাবল একেবারে দুরকম ভাবনা। তাদের পথ গেল বেঁকে। একেবারে নিয়তি। যেন তা খণ্ডানো যায় না কিছুতেই। 

সেদিন কেউ ছোটো দুটো মেয়েকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেনি যে, তাদের আলাদা হয়ে থাকতে কেমন লাগবে। আর বাচ্চা মেয়ে তো কোন ছার! দেশটা যখন ভাগ হয়েছিল, তখন কি আর কেউ সকল মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিল যে, ভাঙা দেশে আলাদা হয়ে থাকতে তাদের কেমন লাগবে! যার হাতে ছুরি, সে ছুরি চালায় এলোপাতাড়ি। রক্ত বেরোয় অন্যের বুকে।

সেমিমার ঠাকুমার সঙ্গে তার সইয়ের আর কোনোদিন দেখা হয়নি। সেই না-দেখা হওয়ার অভাব অভাবনীয় কায়দায় পূরণ করেছিলেন ভদ্রমহিলা। 

সেমিমার মনে পড়ে, ছোটোবেলায় যখন সে কোনও বিষয়ে বায়না করে মায়ের কাছে বকা খেয়ে কান্নাকাটি করত, তখন তার ঠাকুমা গল্প শোনাতে বসত তাকে। আর সেইসব গল্পে আর যে-ই থাকুক না কেন, অবধারিত থেকে যেত তার সেই ছোটোবেলার হারানো সাথি। গল্পের ভিতরও সেই সাথিকে হারিয়ে ফেলত ঠাকুমা। তারপর কত ঘটনা ঘটত। কত দত্যি দানো, যুদ্ধ হত। শেষমেশ আবার দুজনের দেখা হত। আর তারা একটা পুকুরঘাটে বসে জলের দিকে তাকিয়ে গল্প করত। আর একটা দুটো করে মুড়ি ছুড়ে দিত। আর ছোটো ছোটো মাছ এসে সেই মুড়ি খেয়ে গেলে তারা কী আনন্দ যে পেত! এসবই ঠাকুমার মনগড়া গল্প, কিংবা সত্যি। যাই হোক না কেন, ঠাকুমার কাছে যেন গল্প মানে ছিল তার সেই হারানো সাথিটিকেই খোঁজা। এর বাইরে মহিলা আর কিছু জানতেন না। সম্ভবত দেশের ধারণাও তাঁর কাছে এর বেশি কিছু ছিল না। ছিল কেবল, যা হারিয়ে ফেলেছে তাকে খুঁজে পাওয়া। দূরত্ব মুছে আবার সব এক হওয়া। কিন্তু তা তো হবার নয়। সেমিমার আজ মনে হয়, ঠাকুমা নিজেই যেন অবিভক্ত একখানা দেশ।

একদিন ঠাকুমাও চলে গেল আচমকা, সেমিমা তখন মোটে ইস্কুলে পড়ে। দাদুকে সে চোখেও দেখেনি। ছোটোবেলার একটা পট আচমকা তার জীবন থেকে খসে গেল। 

অনেকদিন পর যখন গবেষণার কথা উঠল, তখন সেই হারানোকে খোঁজার কথাই মনে হল সেমিমার। মনে হল, ঘুরে ঘুরে এই দেশটাকে, এই বাংলাকে, এই বাংলার গল্পের ভিতর জমে থাকা সত্যিকে, ইতিহাসকে সে চাক্ষুষ করবে। সেই নেমে পড়েছিল। ভাগ্যিস পড়েছিল। নইলে বরুণের সঙ্গেই বা তার আলাপ হত কীভাবে! সে তো আর বাংলার ছাত্র ছিল না কোনোকালে, লোককথা নিয়ে তার তেমন আগ্রহও ছিল না। বরুণদের একটা দল আছে। তারা থেকে থেকেই ঘুরতে বেরোয় এদিক ওদিক। একবার পুরুলিয়ায় সেই করেই দেখা গিয়েছিল ওদের সঙ্গে। সেও আবার বেশ ক-বছর হয়ে গেল। বরুণের সঙ্গে তার যে এমন নিবিড় একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, আজ ফিরে দেখলে মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনা। এই সেদিন দেখা হল। বরুণের বাড়িতে একা একা বসে আছে বলেই বুঝি এত কথা আজ মনে পড়ছে সেমিমার। মনে পড়ছে সেই প্রথম দেখার দিনটার কথা। ভারী মিষ্টি এই এরকম একটা দুটো মুহূর্ত থেকে যায় জীবনে। আজীবন টাটকা। কখনও শুকোয় না। 

দেখতে দেখতে সকাল অনেকটা চোখা হয়ে এসেছে। তবু নিজের চিন্তাতেই এতক্ষণ মশগুল ছিল সেমিমা। রাস্তা দিয়ে লোকজনের যাওয়া-আসা দেখছে। রাত কাটিয়ে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার নিয়মেই আবার সব সচল হয়েছে। সেই শান্তি ভাঙল ভোটের বাদ্যিতে। একটা শান্ত বাতাসের উপর দিয়ে যেন একটা হইহই বয়ে গেল। ভোটটাকে আজকালকার কেষ্টযাত্রা মনে হয়। মনে হয়, নতুন করে যাত্রাপালা শুরু হয়েছে। বরুণদের দোতলা বাড়ির উপরতলার ঘরটাতে বসে বসে সেমিমা দেখল, একদল ছেলেপিলে বাইকে পতাকা লাগিয়ে এগোচ্ছে। স্পিকারে বাজছে স্লোগান। তালে তালে জমজমাট বিট জুড়ে দেওয়া হয়েছে স্লোগানে। যেন ডিস্কো থেক-এ নাচার গান। তা সবই তো নাচার আর নাচানোর খেলা। ওরা বলছে সেই কথাই, খেলা দেখাবে। সবাই যখন নাচছে, তখন ভোটারই বা আর নাচবে না কেন! 

সেমিমার আপশোশ হয়। ভোটের স্লোগান ধরে ধরেই একটা সময়ের ভিতরকার কত-না কিস্‌সা বেরিয়ে আসে। হয়তো সেমিমার-ই মতো কেউ যদি কোনোদিন তা খুঁজতে বেরোয় তো এই খেলা-টেলা মার্কা স্লোগান নিয়ে অকূল পাথারে পড়বে। এই সময়টাকে এই ‘খেলা দেখাবে’ উদ্দাম নেত্যর ভিতর বেচারি কেমন করে চিনবে! কীই-বা তাতে বোঝা যাবে! অথচ বোঝার জিনিস কি এখন কম আছে! তা তো নয়ই। বরং একটু বেশিই আছে। এত আছে যে তাতে দেশটাই বদলে যেতে চলেছে। সেই বদলখানা ধাতে সয় না বলেই আর সইবে না জেনেও কেউ চেয়ে চেয়ে বসে দেখছে বলে সমস্তটাই যেন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই রাজনীতিতে রাজনীতি নেই। ডিস্কো থেক-এর গান বাজছে আর বলছে, ‘খেলা দেখাবে’। তার পালটা প্যারডি লেখা চলছে। প্যারডির জবাবে ফের প্যারডি। এ-হেন দৈন্যের ভিতর আমোদ ছাড়া খুঁজে পাওয়ার মতো আর কিছু নেই। ছেলেগুলোকে দেখতে দেখতে সেমিমার মনে পড়ছিল ভোটকে নাকি গণতন্ত্রের সবথেকে বড়ো উৎসব বলে মনে হয়। এ-ও তবে এক যাত্রা। আর তার আলাদা আলাদা পালা চলছে বিক্ষিপ্তভাবে। এক পালার নাম হিন্দু-মুসলমান, আর-একের নাম দলবদল, অন্যটির নাম দুর্নীতি। সেই সব পালায় নামছে সাধারণ মানুষ, তাও আবার পালাবদল করবে বলে। 


সেমিমার হাসি পায়। কিন্তু সে হাসতে পারে না। যতবার এইসব ভাবনাচিন্তা কিংবা প্রহসনের সামনে এসে সে দাঁড়ায় ততবার শিউরে ওঠে। 


[চলবে]


আগের পর্বগুলি পড়ুন: সোনার বাড়ি জমি - প্রথম পর্ব 

                               সোনার বাড়ি জমি - দ্বিতীয় পর্ব 

.........................................................................

অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র

সজ্জা : বিবস্বান দত্ত 


#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #ধারাবাহিক উপন্যাস #সোনার বাড়ি জমি #সরোজ দরবার

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

42

Unique Visitors

177618