সোনার বাড়ি জমি (ষষ্ঠ পর্ব)
ধারাবাহিক উপন্যাস
**********************************
আগের কথা: কিসসার ভেতর কিসসা বুনে দেওয়া গল্পবলিয়েদের স্বভাব। আমাদের গল্প যে পালার সুর ধরে চলেছে, সেই ময়মনসিংহ গীতিকার কথাই ধরা যাক না! হয়-কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে কত-না নয়-কথা, খুঁজে নেওয়ার ওয়াস্তা কেবল। এই গল্পও এবার বাঁক নিচ্ছে সেদিকেই। যা বলছে, তার মোড়কে লুকিয়ে রাখছে অন্যরকম না-বলা। এই যে এক অন্যের কাছে ধরা দেওয়ার, একে অন্যের ভিতরে হারিয়ে যাওয়ার বাসনা নিয়ে সীমাহীন প্রান্তরে হারিয়ে গেল কন্যে আর তার মনের মানুষ, মোড়কের ঠিক কোনখানে টান লাগল তাতে?
*****************************
ষষ্ঠ পর্ব
*****************************
[দশ]
কাজটা যে ভালো হয়নি, এমনকি অচিন্ত্য চক্কোত্তিও সে-কথা মানছে।
প্রগতিশীল চক্কোত্তিকে সোনাপুরে সক্কলে মাস্টারমশাই বলে জানে। যদিও মাস্টারি সে কোনও কালেই করেনি। তবে বেশভূষা সব মাস্টারদের মতোই। এককালে উঠেপড়ে বিপ্লব করতে নেমেছিল। একটা পতাকা হাতে ধরেই দেশ, সমাজ সব বদলে দেবে বলে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিল। তারপর আগুন বাতাসে কী যে সোহাগ হল, ক্রমে ক্রমে মাস যায় বছর যায় বিপ্লবের আঁচ নিবে আসে। কোথাও কিছুই বদলায় না প্রায়। লোকে সেই আগের মতোই শিবতলায় হত্যে দেয়। মনসার থানে পুজো চড়ায়। তাদের দীর্ঘশ্বাসের দিন আর ফুরোয় না।
তা সময় তো আর বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে না রে বাবা। তার পেটে আগুন। সে সবকিছুকে খাবে। মানুষকে খায়, মানুষের আদর্শ খায়। সময় এক আজব চিজ। যা কিছু ডাঁটো, তাকে ছিবড়ে করে ছেড়ে দেয়। কেউ কেউ সময়টাকে কামড়ে ধরতে জানে। বেয়াড়া সময়কে শাসন করতে জানে। সময়ের ঘাড়ের উপর দাঁত বসিয়ে তারা তখন বেরিয়ে যায় সময়ের থেকে আগে। তখন যেন ভোজবাজির মতো কত কিছু হতে থাকে। মনে হয় যেন, সময়ের আশ্চর্যের খেলার ভিতর বাস করছে মানুষ। তারপর সব ঝিমিয়ে যায়। সময়-শিকারি এক-একজন করে বিদায় নিলে মানুষ কেবল সময়ের হাতের পুতুল হয়ে জন্ম আর মৃত্যুর ভিতর চরকি পাক খায়।
অচিন্ত্যকেও খেয়েছে সময়ের ওই বাঘে। নইলে একটা সময় ছিল যখন তাকে দেখলে মনে হত টাটকা একটা কিছু। যেন একটা জ্যান্ত সম্ভাবনা হয়ে-ওঠার জন্যে ছটফট করছে। শরতের ঝলমলে রোদ দেখলে যেমন মনে হয় উৎসব আসন্ন। অচিন্ত্যকে দেখলেও মনে হত, মানুষের জীবনের একটা সার্থক উৎসব যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছে। একা অচিন্ত্য তো নয়, সেই উৎসবের আশায়, অপেক্ষায় স্বপ্ন বুকে নিয়ে ছিল অনেকেই। সেই অনেকেই এখন আর নেই। থেকে গেছে অচিন্ত্যের মতো জনাকয়। থেকে গেছে তারা আধখাওয়া আপেলের মতো। দিশাহীন মাছি এদিক ওদিক তার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। তবু মানুষ তো। যত পচনই ধরুক না কেন, তাকে মানুষের মতোই দেখতে লাগে।
অচিন্ত্য এখন বুড়ো হয়েছে। তার চুলে পাক ধরেছে। লম্বা ঝাঁকড়া চুলে তাকে একটা জ্ঞানবৃক্ষের মতো দেখতে লাগে। আজও পরনে সেই ধুতি-পাঞ্জাবি। সে যেন বেশ নেই-বৃক্ষ মাঝে ভেরেন্ডা হয়ে ওঠে। বেশ একটা প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ভাব আসে চেহারায়। একসময় তাকেই অতীত দিনের মতো মোড়ল ঠাওরে বসে তল্লাটের লোক। সেও যেন এই মোড়লের ভূমিকাটা পেয়েই বর্তে যায়। যেন এইটেই তার সারাজীবনের চেষ্টা ছিল। কী যে সে চেয়েছিল, আর কী হয়ে থাকতে হচ্ছে, সেসবের আর হিসেবনিকেশ করে না অচিন্ত্য। খুঁতখুঁতে বুড়োর মতো সে সবার ভুল ধরে শুধু। পান থেকে চুন খসলে খিঁচিয়ে ওঠে। বকে, ঝকে। শাস্তি দেয়। সে আর জমির কথা বলে না, ভাতের কথা বলে না। অচিন্ত্য জানে, ওসব কথা আজ আর বলা যায় না। বলে কোনও লাভ নেই। কেউ শোনেও না। সে তাই এখন জাতের কথা বলে, ধর্মের কথা বলে। ন্যায় অন্যায়ের দোহাই দিয়ে কত কিছু যে বলে! অর্ধেক কথার মানে সে নিজেও জানে না। তবু মোড়লের মুখোশ খুলতে পারে না। একটা মরা হাতির মতো লাখ টাকার গরিমা নিয়ে সে কেবল পড়ে থাকে। পড়েই থাকে।
এমনিতে সে কথায় কথায় ইংরেজি বলে। তার উপর কিছু কিছু বইপত্তরও সে পড়েছে বইকি! যদিও সেইসব বইয়ে পড়া কথাবার্তা আজ তার মুখে বেশ বেমানান ঠেকে। মনে হয়, পুরোনো পিতলের বাসন যেন। গায়ে তার জন্মের কলঙ্ক। তেঁতুল দিয়ে সংস্কার না করলে সে আর ঝকঝকে হয়ে উঠবে না। একই কথা শুধু বলে বলে গেলে কিছু হয় না। সেই যে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা আছে না, যে, সিদ্ধি সিদ্ধি মুখে বললে কি আর নেশা হয়! সিদ্ধি খেতে হয়। চক্কোত্তিদের হালও তেমনই। মুখে যা বলে যায়, ভাবে, বললেই সবটুকু হয়ে গেল। কাজেও যে করতে হবে, সে যেন তাদের ভাবনাতে থাকে না। তাই একই কথা ক্রমাগত বছরের পর বছর বলে চলে।
যুক্তিকে সময়ের নিক্তিতে মেপে নতুন পথ বের করতে হয়। দেশ বদলায়, সমাজ বদলায়, মানুষ বদলায়, মানুষকে ঠকানোর উপায়ও বদলায়,- সেইসব বদলের বিশ্লেষণ করে তবে তো দিনবদলের পথ চিনতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে সূর্যোদয়। কিন্তু এত কষ্ট অচিন্ত্য চক্কোত্তি কেন স্বীকার করবে! সে তত্ত্বকথা আউড়ে মাস্টারটি সেজে দিব্যি দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। যেন গুরুঠাকুর কোনও। একই মন্ত্র শিখে এসেছেন পূর্বপুরুষের কাছ থেকে। কেবল তাই-ই কপচিয়ে চলেছেন আর যজমানের থেকে কলাটা মুলোটা আদায় করছেন। এই করে করেই বাকি কটা দিন কাটিয়ে ঘাটে উঠবে। অচিন্ত্যর-ও তাই দশা। তফাত কিছু নেই। ছেলে তার বিদেশ চলে গেছে কবেই। একবারও আসার ফুরসত পায় না, এমন কত্তগুলো বছর যে চোখের সামনে কেটে গেল। লোকটা ক্রমে খিটখিটে আর কেমনধারা যেন হয়ে উঠল।
এই তো সেমিমাকে নিয়ে বরুণ যখন সেদিন সন্ধেয় আটচালা, মন্দির সব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে, তখন অচিন্ত্যর সঙ্গে দেখা। বরুণও তাকে সেই ছোট থেকেই মাস্টারমশাই বলেই জানে। সে কুশল প্রশ্ন করে। দু-চার কথা হয়। কথা নয় ঠিক, কথার পিঠে কথা। মাস্টারই প্রথম বেপথু হয়েছিল। সেমিমাকে পাশে দেখে বিরক্তিভরে বলেছিল, তা তোমাদের মতো ইয়ং ব্লাড সব প্রেমে মজে গেলে, দেশ আর কী করে বদলাবে? আমাদের সময়ে যুবসমাজ এই বয়সে বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ত।
এইরকম যাত্রাপালার সংলাপের মতো বলার ঢং শুনে বরুণের হাসি পেয়ে গিয়েছিল। সে কিছুতেই হাসি গোপন করতে পারল না। সেমিমা যদিও আঁচ করতে পারছিল, কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
মাস্টার ভারি বিরক্ত হয়ে বলল, অমন করে হাসছ যে বড়ো? বরুণ একটু বাঁকা সুরে বলেছিল, কিছু মনে করবেন না। আপনি কথা তুললেন বলে তাই বলছি। বলছি, আগুনে ঝাঁপ তো দিয়েছিল সব। তাতে হল কি কিছু?
মাস্টার এবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, এই তোমাদের ইরেস্পন্সিবিলিটি। নিজেরা কিছু করবেও না, নিজেদের অতীত জানবে না। আবার তা নিয়ে মক্ করতেও ছাড়বে না।
বরুণ বলেছিল, না না মাস্টারমশাই, আমি কাউকে তাচ্ছিল্য করতে চাইনি। করছিও না। কিন্তু যারা আগুনে ঝাঁপ দিল তাদেরকে কতটা সম্মান দেওয়া হল, সেটাও তো ভাবতে হবে। কারা তাদের স্বপ্ন বিফল করে দিল? কারা আগুনে জল ঢেলে ভেজা ছাই লেপে দিল চারিদিকে, তাদের চিনতে হবে না? সেসবের দায় দায়িত্ব কেউ নেবে না!
অচিন্ত্য মাস্টার স্তম্ভিত। এই সোনাপুরে তার মুখের উপর কেউ এমন কথা বলতে পারে, সে কল্পনাও করেনি। মনে মনে তার ছেলের মুখটা ভেসে উঠল। ঠিক এমনধারাই বেয়াড়া সে। কিছুতেই অচিন্ত্যর কোনও কথা শুনল না। মুখটা মনে পড়তেই মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল অচিন্ত্যর।
বরুণ তখনও বলে চলেছে, আর আপনি যে প্রেমকে অপরাধ সাব্যস্ত করলেন বিনা দোষে, তার কি কোনও মানে হয়! আপনি তো পড়াশোনা করা মানুষ! আর বিপ্লবের ভিতরও কি প্রেম নেই? প্রেম না থাকলে কেউ আগুনে ঝাঁপ দেয়!
মাস্টার সেই গরম তেলে পুড়ে কালো বার্তাকুর মতো মেজাজেই বলল, এই তোমরা, তোমরা হলে আল্টিমেট অপরচুনিস্ট। দুটো কি এক জিনিস হল? ফুর্তি করতে চাও তো করো, সেটাকে আবার জাস্টিফাই করতে হবে কেন? নিজে যেটা চাইবে, সেটা ঠিক করেই ছাড়বে, আবার তার পিছনে যুক্তি খাড়া করবে। আজ অব্দি কিচ্ছুটি ত্যাগ শিখলে না তোমরা। হোপলেস।
বরুণ বুঝতেই পারল না, কেন তাকে হাতের সামনে পেয়ে চার কথা শোনাচ্ছে মাস্টার। তার অপরাধটাই বা কী! আসলে সে তো এখানে থাকে না। থাকলে অবশ্য জানত, অচিন্ত্যর ছেলেটা যেদিন থেকে কাজের দোহাই দিয়ে বাপের ছায়া মাড়ানো বন্ধ করেছে, সেদিন থেকে গোটা পৃথিবীটাকেই সুবিধেবাদী ঠাওরায় অচিন্ত্য চক্কোত্তি। এ তার একরকম রোগে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ মশকরা করে বলে মাস্টারের পেটে বিদ্যের বদহজম হয়েছে। তত্ত্বের ফড়িং ঢুকে সব তিড়িং-বিড়িং করে ঘুরে বেড়ায়। আর মাস্টার তেলেবেগুনে নেচে বেড়ায়। একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝত, কার দোষে আল ভাঙল আর কার খেতের জল কোথায় গড়িয়ে গেল। কিন্তু সেসবে মাস্টারের মন নেই। বিশ্বসুদ্ধ সবার দিকে আঙুল তোলাই যেন তার একমাত্র কর্তব্য। যেখানে পারছে ছিদ্র খুঁজছে।
অথচ বরুণ এসবের আর কী জানে! সে তো এসেছে অনেকদিন পরে। পরন্তু প্রেমিকার সামনে অকারণে অপমানিতও হয়েছে। এবার তারও মেজাজ গেল গরম হয়ে। সে পালটা মুখের উপর বলে দিয়েছিল, ত্যাগের কথা আবার আপনি কী বলেন? জীবনে কী-ই বা ছাড়লেন? এত বিপ্লবের কথা বললেন সারা জীবন, অথচ পইতেটা অবধি ছাড়লেন না। ধর্ম ভেঙে বেরোনোর কথা বললেন, কই নিজে পারলেন ব্রাহ্মণ হওয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখতে?
আর যায় কোথায়! দু-দিনের ছোকরা, করে কিনা পইতে ধরে টানাটানি। চক্কোত্তি রেগে ফায়ার। কথায় কথায় বাতাস গরম হয়ে গেল। আরও কী কী হতে পারত কে জানে! হাতের উপর সেমিমার চাপে সংবিৎ ফেরে বরুণের। কথা না বাড়িয়ে সে তাই বলে, আচ্ছা এগোই আপাতত। এমনিই কথায় কথা বাড়ল, কিছু মনে করবেন না যেন মাস্টারমশাই।
অচিন্ত্য চক্কোত্তি গোপনে দাঁত কিড়মিড় করে, উত্তর করেনি কিছুই।
জাদুবুড়ো বরুণকে বলে, রাগরে অমন মাথায় উঠতে দাও কেন? বরুণ কিছু বলে না। চুপ করে আছে। তখনও রাগে তার মাথার দুপাশের শিরা দপদপ করছে। সেমিমাকে দেখিয়ে জাদুবুড়ো আবার বলে, পাশে যার এমন সুন্দরী কইন্যা আছে, তার পৃথিবীতে রাগের ঠাঁই নেই। ওরে তাড়াও। ও সবকিছুকে ঘুলিয়ে দেয়।
বরুণ তখনও বেশ বিরক্ত। সে পালটা বলে, মাস্টারের কথাগুলো শুনলে তুমি, বুড়ো? নিজের বেলায় আঁটিশুটি, অন্যের বেলা দাঁত কপাটি। পায়ে পা তুলে ঝগড়া করতে আসেই বা কেন! বিপ্লব করে কী যে হয়েছে সে তো দেখতেই পাচ্ছি! বিপ্লব যেন পাওয়ারের পা ধুয়ে জল খাওয়া; এইসব ফাঁকা আওয়াজ আমায় শোনাতে আসে কেন?
জাদুবুড়ো বলে, আরে শান্তি শান্তি। ও বাবা বাতাস, একটু জোরে ব’ দিকি। ঠাকুরের মাথা গেছে গরম হয়ে। তারপর একটু থেমে বলে, চক্কোত্তির কথা ছাড়ান দাও। লোক সুবিদের না। ওরে কি আমি চিনি নাই! ও নামেই মাস্টার, রক্তে একেবারে হুমরা বেদে। বরুণ অবাক হয়ে বলে, সে আবার কে? জাদুবুড়োও একটু হেসে বলে, আর-একটু বাড়ো বয়সে, হুমরাদের ঠিক একদিন নিজেই চিনতেই পারবে। দেখবেখন, কেমনে এরা পরের মেয়ে চুরি করে আনে। তারপর নিজের দল গড়ে। মেয়েকে খেলা শেখায়। মেয়ের রূপ দেখে খেলা দেখতে লোকের ভিড় বাড়ে, দলের কদর বাড়ে। আর এরা সেই দলের কেষ্টবিষ্টু হয়ে মাথায় চড়ে বসে। এদের কাছে দল আর কছরতের বাইরে আর দুনিয়া নাই। প্রেম, পিরিতের দাম নাই। মানুষের মূল্য নাই। ওই দল আর দল। দল রাখতে গিয়ে চাইলে এরা নিজের মেয়েকেও মরণে ঠেলে দিতে পারে।
বরুণ এবার ধন্ধে পড়ে যায়। বলে, কেন জাদুবুড়ো, দল থাকা তো ভালো কথা। দলের বাঁধন থাকাও ভালো কথা। নইলে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাবে না? জাদুবুড়ো এবার খলখলিয়ে হাসে। বলে, বুঝবে গো বুঝবে। দল যে ভালো, এ আর বড়ো কথা কী! কিন্তু দলই যে একমাত্র বড়ো, সে বড়ো ছোটো একখানা কথা। এতবড়ো পৃথিবী। তাতে এত মানুষ। মানুষই বড়ো। মানুষের জন্য দল। দলের জন্য তো মানুষ নয়। শুধু দলে আটকে থাকা কি ভালো! সে তো জালে ঝুলে থাকা মাকড়সার স্বভাব। ওর বাইরে বেরোবে না। কিন্তু এক-একটা লগন আসে, যখন দল ভেঙে বেরোতেও হয়। দলের উপরে উঠতে হয়। সবার উপরে মানুষ সত্য, এই কথাটায় মাথা হেঁট করতে হয়। হুমরা বেদে তা আর পারে কই! সে গুয়োর ব্যাটা মেয়ের হাতে ছুরি ধরিয়ে দেয় অতিথ মারতে; মেয়ে আর কোথায় যায়, যা মোর ভালোবাসার ধন তারে আর হারায় কী করে, সে তখন নিজের বুকেই ছুরি বসায়। সব শেষ হয়ে যায়। বিচ্ছেদের লহরি বাজে গো। প্রাণ কেঁপে ওঠে। হুমরারা তবু শুধরোয় না। দল দল করে থাকতে গেলে যে মানুষকেই তার মূল্য না দিয়ে ফিরিয়ে দিতে হয়, বুঝবে, তুমি একদিন ঠিকই বুঝবে।
জাদুবুড়োর কথা সেদিন কিছু বোঝেনি বরুণ। সেমিমাও যে বুঝেছিল তা নয়। আজ যখন ঘটনাটা ঘটেই গেল, আর সালিশি সভার মতো একটা জমায়েত হল বরুণদের বাড়ির উঠোনে, আর অচিন্ত্য চক্কোত্তি, মাস্টারমশাই মাথা নেড়ে নেড়ে বলল, ‘নাহ্, কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি’, বরুণের মনে পড়ে গেল, জাদুবুড়োর বলা সেই হুমরা বেদের কথা।
ঘটনা আর কী! অপরাধই বা কোথায় তাতে! সেই যে প্রান্তরের মধ্যে মিলিয়ে গেল বরুণ, সেমিমা, তারপর অনেক দূর হাঁটতে হাঁটতে যখন তাদের মনে হল আকাশ ঝুঁকে এসেছে মাটির কাছাকাছি, তখন সেই বিরাট বিস্ময়ের ভিতর দাঁড়িয়ে তারা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছিল। দুটো শরীর এক নিমেষের জন্য এক হয়ে গেল। বরুণ টের পেল সেমিমার ঠোঁটের ভিতর নদী; নদী চলেছে সমুখপানে, গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে, আর তার কূল নাই, কিনার নাই। সে এক অথৈ। সেই এক লহমার জন্য ডুবে যাওয়া। লীন হয়ে যাওয়া।
মুহূর্তটুকু ফিরে যেতে হঠাৎ তারা খেয়াল করে, এই এত নির্জনের ভিতরও তারা তো একা নয়। আশপাশ থেকে যেন ক-টা মাথা উঠে এসে তাদের দেখছে! গোপন ক্যামেরার মতো কোথা থেকে এল এরা? এরা কি এখানেই ছিল? নাকি অনেকক্ষণ থেকেই পিছু নিয়েছিল বরুণ-সেমিমার। পিছু যদি নিয়েই থাকে, তবে কেন নিয়েছিল? কিছুই ভেবে পায় না বরুণ। এই এখান থেকে ডাকহাঁক করেও কাউকে মিলবে না। পাড়া থেকে বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছে তারা। যদি কিছু বিপদ ঘটে! সেমিমাও খুব ভয় পাচ্ছে। যেভাবে শক্ত করে ধরে আছে বরুণকে, সেই চাপের জোরেই সেমিমার মন পড়তে পারছে বরুণ। সে এবার শক্ত করে নিজেকে। তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ভয় পাস না সেমিমা। ... তারপর জুলজুলে চোখওলা মাথাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, এই তোমরা কারা? কেন এভাবে আমাদের ঘিরে রেখেছ? জানো, আমি কে? উত্তরের অপেক্ষা অবশ্য সে করে না আর। সেমিমার হাত ধরে হনহনিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। আর সেই উটকো মাথাগুলো মন্ত্রের মতো জপতে থাকে- সেমিমা সেমিমা।
তারপর যেন দাবানল। গোটা পাড়া রটে গেল তাদের কথা। বাড়ির লোক খানিকটা শঙ্কায় ছিল। সেমিমা তো ভয়ে কাঁটা। সংকোচে, লজ্জায় মুখ অব্দি তোলে না। তার খালি মনে হচ্ছিল, বরুণের আবদার না মানলেই হত। এই বিরাট প্রকৃতির উদারতা তাকেও যেন কেমন এলেমেলো করে দিয়েছিল। নইলে বরুণের এমন আবদার তো সে কপট রাগ দেখিয়ে ফিরিয়েই দেয়। কেন যেন তার মনে হয়েছিল শহরের মতো ঝুটঝামেলা এখানে অন্তত থাকবে না।
সন্ধের দিকে চক্কোত্তি উজিয়ে চলে এল বরুণদের ঘরে। বলে, আমি আগেই বলেছিলাম, এই জেনারেশনটা ইরেসপনসিবল। এমন করে কেউ বাড়ির সম্মান ধুলোয় মেশায়! না না, নাহ্ কাজটা মোটেও ভালো হয়নি।
দশ জন লোক সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। তারা ধুয়ো ধরে বলে, আবার মোসলমান! চক্কোত্তি সায় দিয়ে বলে, সেই তো! তা এমন একটা কাণ্ড হচ্ছে, তোমরা একটিবার জানাবে না!
বরুণের বাড়ির সাত পুরুষের দেওয়ালের ভিতর থেকে প্রাচীন ইট-কাঠ এখনও যারা আছে তারা ধমকে ওঠে চক্কোত্তিকে। বলে, তা নিয়ে তো তোমার মাথা ঘামানোর কথা নয়! তুমি না প্রগতিশীল! তোমার না এইসব বেড়া ভেঙে এগোবার কথা। তুমি এখন জল-অচল করার খেলায় নেমেছ কেন?
চক্কোত্তি ঘাগু লোক। সে জানে, দেওয়ালেরও কান আছে। তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেওয়ালকেই যেন শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, আমার কিছু যায় আসে না। আমার কী! এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু বাকি সকলের একটা সেন্টিমেন্ট আছে। ডেমক্রেসিতে কাউকে ফেলে দেওয়ার নয়। কারও সেন্টিমেন্টকে ছোটো করার অধিকার কারও নেই। যাকে একদিন ছোটো করবে, দশদিন বাদে বাড় বেড়ে সেই-ই তোমার টুঁটি চেপে ধরবে। এই মেয়েকে নিয়ে শিবের ঘর, বিশালাক্ষির থান ঘুরে এল ছেলে। এখন লোকে যদি খেপে যায়, সামলাতে পারবে তো! এমনিতেই হাওয়া ভালো নয় দেশের! দেশলাইয়ের আগুনেও দাঙ্গা বেধে যেতে পারে।
চক্কোত্তির মুখের উপর আর কেউ কিছু বলে না। আগত লোকগুলোকেও শান্ত করা হয়। বলা হয়, আপাতত থাক। ভুল যদি কিছু হয়েই থাকে, নিশ্চতই তার একটা প্রতিকার হবে। আজ দিন ফুরোল, কাল নাহয় এইসব নিয়ে বসা যাবে।
সেই সন্ধেয় বাতাস বইল খুব। মাঠ পেরিয়ে শোঁ শোঁ বাতাস ছুটে ছুটে এল। সকলেই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করল, বাতাস যেন আগুনের দেখা না পায়। সব যেন শান্ত হয়ে যায়।
অনেক রাতের বেলা মাঠের পারে কঙ্কালেরা সব ধরল জাদুবুড়োকে। বলল, কেমন বুড়ো হে তুমি! ছেলেমেয়ে দুটোকে মন্ত্র দিয়ে, বিপদের পথে এগিয়ে দিলে। মাথার কিরা এখন ওদের রক্ষে করো, নয়তো গলায় কলসি-দড়ি দিয়ে ডুবে মরো। জাদুবুড়ো মাথায় চুলকোয়। যেন সোনালি চাঁদের রাতে নেমে এসেছে অলুক্ষুনে মেঘ। পৃথিবীর নৌকা টলমলো। কিছু একটা না করলেই নয়। এই হুমরা বেদের মতো লোককে সে বেশ ভালোই চেনে। এরা তো কাউকে শান্তিতে বাঁচতে দেবে না। কেউ যে দু-দণ্ড মুখোমুখি বসবে তাতেও এরা নিয়মের ছক কেটে রাখবে। বলবে, এই নিয়মমতো হল, নয় হল না। এদের জ্বালায় সেই কবে থেকে দুনিয়া জ্বলছে। কিন্তু কী আর করা যাবে! তাকে তো এসব সইতেই হবে। তার তো শিকড় গেড়ে গেছে মাটিতে। পালাবার জো নেই। সে বরং উড়িয়ে দেয় কবুতরদের। কঙ্কালদের আশ্বস্ত করে সে। তারপর বলে, যা, বনের পাখি, বনে উড়ে যা তোরা।
রাইক্ষসের হাতে পড়ি না দেখি উপায়
মনে মনে চিনতে কন্যা কিমতে পালায়।।
এক দিন যুক্তি করে নদের চান্দে লইয়া।
কিরূপে যাবে কন্যা দূরে পলাইয়া।।
[এগারো]
মরা তারার কি আলাদা করে কোনও গল্প হয়? সে তো ছাই কেবল আর ভস্ম কেবল। তা-ই নয় কি! মৃত নক্ষত্রের তবু আলো হয়। যে আলো বেরিয়ে পড়ে সেই আলো অনেক দূর থেকে পৃথিবীতে আসে। তাই মনে হয়, তারা যেন বেঁচেই আছে। কিন্তু খসে যাওয়া তারা তো একেবারেই নিঃশেষ। তার আবার গল্প কী!
অথচ সেই তারা ধরে আর তারা পেটের গল্প বের করেই দিন কাটে জাদুবুড়োর। কত না ভেলকি তার জানা। এতদিন সেসব হালকা চালেই নিত সবাই। কিন্তু এবার ব্যাপারটা বেশ ঘোরতর হয়ে উঠেছে।
সাতসকালে লোকজন খেপে গেছে জাদুবুড়োর উপর। অবশ্য খেপবার কারণ ছিল। যা নিয়ে আজ সকলে খেপে উঠবে ঠিক করেছিল, অন্তত মনে মনে সেই কামনাই ছিল, সেই কারণটিই সকাল সকাল অন্তর্হিত হয়েছে। সেমিমা ও বরুণকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা রাতারাতি যেন উবে গেছে।
কিন্তু দুটো মানুষ কি এমন করে ‘নেই’ হয়ে যেতে পারে! বেশ কিছু মানুষের সন্দেহ গিয়ে পড়েছে জাদুবুড়োর উপর। তারা-ধরা বুড়ো নিশ্চয়ই কিছু জাদু করে ছেলেমেয়ে দুটোকে লুকিয়ে রেখেছে। বুড়োর তো যত অনাসৃষ্টিতে সায়। সেই থেকেই কথায় কথা ওঠে। দু-চারজন দুচ্ছাই করে বলে, ধুত্তোরি, বুড়ো ভেলকি জানলে তবে তো! ও মুখেই বলে তারা ধরে, কেউ কোনোদিন দেখেছে নাকি সেইসব মরা তারাদের? আর মরা তারা নিয়ে কী কাজটা হবে শুনি। বুড়ো বলে, মরা তারার পেটেও নাকি গল্প বেঁচে থাকে। হ্যাঁ বুড়ো, এরম সত্যি হয় নাকি! আর কত বুজরুকি দেবে বলো দিকি! মরা তারার আবার গল্প কীসের!
বুড়ো খানিক দাড়িতে হাত বুলোয়। হাসেও একটু। তারপর বলে, তেমন তেমন তারা ধরলে তবেই গল্প পাওয়া যায়। নইলে সব ভস্ম আর ছাই। তারা দেখে তোমায় বুঝতে হবে তো বাপু, কার পেটে গপ্পো আছে, আর কার পেটে নাই।
বুড়োর হেঁয়ালিতে পাড়া জুড়ে আবার গুজগুজ, ফুসফুস। বুড়ো এই করে। যখনই কেউ কিছু জানতে চায়, তখনই তাকে এমন ভুলভুলাইয়া ধরিয়ে দেয় যে, কোনটা যে রাস্তা আর কোথায় যে যাওয়ার- সেইটেই ঘুলিয়ে যায়। কিন্তু অচিন্ত্য চক্কোত্তি তেমনধারার লোক নয়। সে বুড়োকে পাকড়াও করে বলে, এই তুমি, তুমি ওদের লুকিয়ে রেখেছ তো? তোমাদের জন্যই সমাজে কোনও নিয়ম থাকবে না? বুড়ো দুহাত তুলে হাসে। বলে, আমি কারে লুকোই? কোথায় বা লুকোই? লুকনোর যদি ক্ষমতা থাকত আমার তো দানার ভিতর আস্ত একখান গাছ লুকিয়ে ভেলকি দেখাতুম। সে কছরত জানা নাই।
চক্কোত্তি এতে শান্ত হয় না। মধ্যে মধ্যে ইংরেজি বলে গজগজ করে। বলে, সমাজের একটা ডিসিপ্লিন আছে, ডেকোরাম আছে। অনুসাশন না মানলে সমাজ একদিন ভেঙে পড়বে।
দু-চারটে কঙ্কাল বুড়োর আশেপাশেই ঘুরছিল। তারা এই শুনে বলল, তা এত হাজার হাজার বছর ধরে যে সমাজ, জীবন সবকিছু চলছে, কই ভেঙেভুঙে তো পড়েনি। ঝড়ে, দাপটে, জলে, শীতে দিব্যি সমাজ টিকে আছে। আজ শুধু তোমাদের এত মাথাব্যথা হল কেন? তোমরা কোন জ্যাঠামশাই হলে যে, সব ঠিক করে দিতে এসেছ? চক্কোত্তি সে-কথা শুনতে পেল কি না কে জানে! নিজের মনেই সাফাই দিয়ে বলে, সবকিছু নিজের জন্যে ভাবলে চলবে কেমন করে? সবার আগে, দেশের কথাটা, সমাজের কথাটা, দশের কথাটা তো ভাবতে হবে।
কঙ্কালরা আবার বলে, কোনটায় দেশের ভালো, দশের ভালো, সেসব কিছুই যে দেশের মানুষ বোঝে না, এমন কথাটা তোমরাই বা ভাবলে কী করে! এক তোমরা যা চাও তাতেই দেশের ভালো হবে, নইলে দেশ সমুদ্রের ভিতর সেঁধিয়ে যাবে, এমন সৃষ্টিছাড়া ভাবনা তোমাদের মগজে এল কী করে! ঘিলু কি আর বাকি নেই মগজে নাকি সেখেনে সব ছাতা পড়েছে! মাস্টার এবারও সে-কথা শুনতে পেল না। কিন্তু বুড়োর কানে তো সবই যাচ্ছে। এ কথা শুনে সে আর হাসি চেপে রাখতে পারে না। দাঁত বের করে হ্যা হ্যা করে হেসে ফ্যালে। তাতে চক্কোত্তির মাথার তেলো রোদে রাখা ঝামা ইটের মতো তেতে ওঠে। সে বলে, বুড়ো শোনো, এই তোমায় হুঁশিয়ারি দিয়ে গেলুম, ভালো কথায় বলছি, অনাসৃষ্টি যদি বন্ধ না করো, তবে আইন করে সব বন্ধ করব। কী বলতে হবে, কী করতে হবে, কোন প্রেম ধর্মে সইবে, কোন প্রেম গিলে ফেলতে হবে- সব আইন করে দিয়ে যাব। আর আইন না মানলে কী হয় জানো তো! কঙ্কালরা বলে, কাঁচকলা। চক্কোত্তি শুনতে পায় না, হনহনিয়ে হাঁটা দেয়। বুড়ো শুধু একা একা হাসে।
তারপর কঙ্কালদের ডেকে বলে, এদের খালি সবটাতেই গেল গেল! যেন আমাদের কখনও কিছু ছিলই নাকো!
কঙ্কালেরা বলে, কী ছিল!
জাদুবুড়ো বলে, গল্পের ভিতর আলো ছিল। আলোখানা ধরতে পারলেই বুঝবে, কতখানি খোলামেলা ছিল আমাদের ঘরদুয়ার। কতখানি খোলামেলা হওয়ার কথা ছিল আমাদের বসতখানা।
কঙ্কালেরা সকলেই এবার বিরক্ত হয়। বলে, একটু খোলসা করে বলবে কি কথাটা?
জাদুবুড়ো বলে, তবে শোনো, একবার দেখি কি, তারার পেটে একখানা গপ্পো হাঁকুপাকু করছে। যেন এই তারার পেট ফাটে আর কি! বেরোতে চায়, কিন্তু কিছুতেই বেরোতে পারছে না। বলি, তোমার এমন হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় দশা কেন বাছা! সে বলে কী, আমারে তো বেরোতেই দেয় না। তারার পেটের ভিতরে গহ্বরের ভিতর গহ্বর, তার ভিতরের আর-এক গহ্বর- এই করে করে সেই কোন ভিতরের পুরীতে যে আমাকে সেঁধিয়ে রাখে তার ঠিক নেই। অনেক কষ্টে আজ সামনে এসেছি। বলি, এ তো ভারি আশ্চয্যির কথা। কেন, আছেটা কী এমন তোমার ভিতরে? নাও এবার হাত-পা ছড়িয়ে একটু বসো দিকিনি। শুনি তোমার সব কথা। সে তখন নিজেকেই বলে বলে শোনায়। এই হল গিয়ে এক কন্যে। এই তার পুত্রের জন্ম হচ্ছে। কিন্তু কোনও রাজপুরীতে নয়, গেরস্থের ঘরে নয়। ঘন অরণ্যের ভিতর। এবার সেই শিশুপুত্রকে সেই রাজ্যের কোটাল করলে চুরি। তাহলে সে হল গিয়ে এখন কোটালপুত্র। আর তার মা, সেই কন্যে হল গিয়ে দুঃখিনী মা। তার ঠাঁই হয় এক বামুনের ঘরে। যেমন সীতার ঠাঁই হয়েছিল বাল্মীকির কুটিরে। এইবার কোটালপুত্র তো বড়ো হয়, যুবক হয়ে ওঠে। একদিন বামুনের ঘরে সেই কন্যেকে দেখে, যুবক কোটালপুত্র তো তার রূপে মুগ্ধ। এমন মোহিত যে একেবারে বিয়ে করতে চায়। গল্পের এই অব্দি যেতেই জাদুবুড়ো বলে, তোওবা তোওবা হরি হরি। এ তো সত্যিই বিনা মেঘে বাজ ফেলবে গো। এরকমটা আবার হয় নাকি! বলি, সম্বন্ধখানার কথা একবার ভেবে দেখলে না, অমনি গল্প হয়ে গেলে? গল্প বলে, সেইটেই তো কথা। এই সম্বন্ধখানার জেরেই তো এত ঢাকঢাকি। কিন্তু এই যে আমি গল্প, এর পিছনের যে মানুষজন, তাদের ভিতর যদি ইশারাখানা থেকেই থাকে, তবে আমার আর দোষ কীসে! জাদুবুড়ো বলে, হক কথা! গল্প তখন বলে, এত ঢেকে চেপে রাখাই বা কেন? যা সত্যি, যা ছিল, তারে সামনে আনলেই হয়। তাতে তো খোলসা হয় যে, এই ছিল, এমনটা না হলেই ভালো হয়। নইলে যত ঢাকবে, তত উঁকিঝুঁকি বাড়বে। মরা তারার পেটের ভিতরকার সেই জ্যান্ত গল্প জাদুবুড়োকে যেন অতীতের সেই খোলা ঘরখানার কথা বোঝাতে থাকে। তারপর বলে, এই তোমার কাছে এসে একটু নিশ্বেস নিতে পারলাম। নইলে সব ভেঙেচুরে যাবে বলে, আমার গায়ে পেরেক মেরে সবাই ভিতরেই ঢুকিয়ে রেখেছে।
কঙ্কালেরা বলে, বুঝলুম। সেই গেল গেল... তাই তো?
জাদুবুড়ো বলে, নয়তো আর বলছি কী! চিরটাকাল এদের এই গেল গেল, আর সবকিছুকে কচুপাতায় মুড়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছে স্বভাব। যা ওদের মজ্জিমাফিক নয়, তারে কিছুতেই ঘুরে বেড়িয়ে থাকতে দেবে না।
সেমিমা শুনে বলে, আরে এটা তো শ্বেত-বসন্তের গল্প। রেভারেন্ড লালবিহারী দে যখন বাংলার উপকথা জোগাড় করছিলেন, তখন এ গল্প পেয়েছিলেন। উইলিয়াম কেরি সাহেব তো খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে বাংলার আলাদা একটা পৃথিবীই খুলে দিয়েছিলেন। তিনি শোনালেন ইতিহাসমালা-র গল্প, সেখানে এমন কত কাহিনি-ই না আছে। এখন শুনলে মনে হবে যেন সেসব অশ্লীল। মনে হবে যেন এই বুঝি ভেঙে গেল নৈতিকতার সীমা। এ এক ভারি মজার ব্যাপার। সময়ই বদলে দেয় সময়কে। আর তার ভিতর দাঁড়িয়ে মানুষ শ্লীল-অশ্লীল, নীতি-নৈতিকতার জালে পড়ে খাবি খায়। যে সময়কার ইতিহাস, সেই সময়কার চোখ দিয়ে দেখলে, এর ভিতর অবশ্য দেখার মতো অনেক কিছুই থাকে। তখন আর অশ্লীল মনে হয় না। লালচোখা নীতির জ্যাঠামশাই তখনও তো ছিল। কিন্তু তাদের বেঁধে দেওয়া কানুন যে ভাঙতও, তা-ও তো সত্যি। এইরকমের গল্পগুলিই তো আজও স্পষ্ট করেই যেন বলে দিচ্ছে, সেদিনের সমাজে কত বৈচিত্র্য ছিল। কত কিছু জায়গা পেয়েছে। সব কি আর শাস্ত্রে লেখা থাকে! মানুষের জীবন লেখা হয়ে আছে মানুষের মুখে মুখে ফেরা গল্পে। শাস্ত্র তাকে মানুক বা না-মানুক, যা ছিল, যা সত্যি তাকে অস্বীকার করা যায় না। ক্ষমতাবলে চেপে রাখা যায় শুধু। মূলধারা বলে অন্য সবকিছুকে পায়ে ঠেলে রাখা যায়, তবু, ক্ষীণ হলেও সব ধারাই বইতে থাকে একই ভূমিতে। সময়ে সময়ে মানুষের ঠিক চোখে পড়ে যায় তাতে। যত দিন যাচ্ছে, এই কথাটা খুব জোরের সঙ্গেই উপলব্ধি করছে সেমিমা।
আরও কত কথাই হয়তো বলত সেমিমা। জাদুবুড়ো মুখে আঙুল দিয়ে স্স্স্ করে তাকে থামায়। বলে, জননী, তুমি আবার এত কথা বোলোনি। বনেরও তো কান আছে, কে জানে কোত্থেকে কে আবার তোমার গলা চিনে ফ্যালে!
সেমিমা চুপ করে যায়। সত্যিই সব ঝামেলা থেকে তাদের আত্মগোপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে জাদুবুড়ো। তার ভেলকির খেলায় রাতারাতি সে মাঠের ধারে একটা বন বানিয়ে তার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে তাদের। আসলে বন বানানোর কিছু নেই। অরণ্য এমনিতেই ছিল। জাদুবুড়োর ভেলকি-টা একটু অন্যরকম। অরণ্যকে সে ঘন করে তুলতে জানে। এমন করে গাছেরা মাথায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়াল, মনে হল যেন এ অরণ্য দুর্ভেদ্য। গাছেরা নাকি এমন কাজ করতে জানে। যখন নতুন চারা জন্মায়, তখন বনস্পতিরা মাথায় মাথা ঠেকিয়া চাঁদোয়া তৈরি করে, চারা বেড়ে ওঠে ছায়ায় ছায়ায়। দেখে মনে হবে, এই দুই যুবক-যুবতির জন্যও বনস্পতিরা অপত্যস্নেহে ঘন হয়েছে।
বরুণ অবাক হয়ে বলে, এসব কী করলে বুড়ো? বুড়ো হাসে আর বলে, আছে না আমার রাউচণ্ডালের হাড়! যা করার ওরাই করবে। তখন দেখতে দেখতে জনাকয় কঙ্কাল হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে গেল। বলে, বুড়ো, ভেলকি করে আমাদের গাছের রূপ দিয়ে দাও দেখি। এই আমরা গাছের বেশ ধরে হাতে হাত বেঁধে শেকল বানিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লুম। দেখি ওদের কে ছুঁতে পারে!
ছোঁয়া তো দূর অস্ত, ওরা যে কোথায় লুকিয়ে আছে, তাই-ই কেউ জানে না। এইভাবে ঘন হল অরণ্য। জাদুবুড়ো তখন ওদের বলে, চলি গো বনের পক্ষী। তোমরা আনন্দে থাকো কটাদিন। বরুণ বলে, তোমায় যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব জাদুবুড়ো, আমার ভাষা জানা নেই। বুড়ো খলখলিয়ে হাসে। বলে, হতুম তো দেওয়ান সাহেব, চাইতুম এখন নজর মরেচা। বরুণ বলে, সে আবার কী জিনিস বুড়ো? বুড়ো বলে, বে করবে আর দেওয়ানরে খাজনা দেবে না, এ কেমন কথা! বরুণের চোখ ওঠে কপালে। বলে, বাপরে, তুমি খাজনা চাইলে আমরা আর দিই কী করে! বুলবুলিতে ধান খেয়েছে। বুড়ো এবার হেসে ফ্যালে, বলে, আর ছাড়ান দাও। সেই দিন তো নাই, সেই বালাইও নাই। তোমরা এখন এত কথা বোলোনি, দুটিতে দুটো মনের কথা কও গিয়ে। পিরিতের কথা বলতে আড়াই অক্ষরই সই। এই বনই তোমাদের রঙ্গিনা বলো বাসর বলো, যা ভাবো তাই। আমি এখন যাই গিয়ে।
[চলবে]
আগের পর্বগুলি পড়ুন : সোনার বাড়ি জমি (প্রথম পর্ব)
..........................................................................
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র
সজ্জা : বিবস্বান দত্ত
#ধারাবাহিক উপন্যাস #সরোজ দরবার #বাংলা পোর্টাল #সোনার বাড়ি জমি #সিলি পয়েন্ট #web portal #ওয়েবজিন