উপন্যাস

টেরাকোটা টালমাটাল (চতুর্থ পর্ব)

প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় May 22, 2022 at 3:10 am উপন্যাস

চতুর্থ পর্ব

....................................

‘বলেন কী ফেলুবাবু, শ্রীরামপুরেও রাজা আছেন?’ জটায়ুর হাঁ-মুখটা দেখার মতন হয়েছে।

‘আছেন নয় মশাই, ছিলেন। শুধু শ্রীরামপুর কেন, শেওড়াফুলি, বাঁশবেড়িয়া সর্বত্রই রাজারা ছিলেন।’

জটায়ু প্রায় খাবি খাচ্ছিলেন, ‘কী খবর দিলেন প্রদোষবাবু! আচ্ছা, বদ্যিবাটিতেও কি রাজবাড়ি আছে?’

এবার ফেলুদা হেসে ফেলল, ‘বদ্যিবাটির খবর আমার কাছে নেই। আসলে নামে রাজা হলেও এঁরা প্রায় সবাই ছিলেন বড়ো ভূস্বামী। তাই শ্রীরামপুরের রাজা আর শশাঙ্কর মধ্যে কিছু তফাত তো আছেই। তবে বলে রাখি, শ্রীরামপুরের রাজার কথা আমিও জেনেছি সদ্য। সৌজন্যে সেই কিপলিং সাহেব!’

‘কী কাণ্ড! বাংলার মন্দির নিয়ে তো দেখছি বাঙালিদের থেকে সাহেবরা বেশি খবর রেখেছেন।’

ফেলুদা মাথা নাড়ল, ‘কথাটা হয়তো খুব ভুল বলেননি আপনি। বিশেষত ডেভিডকে দেখার পর এ কথা বলাই যায়। তবে কিপলিং-এর লেখায় এ মন্দিরের উল্লেখ নেই, শুধু বলা আছে গিরিডিতে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি গড়ে উঠেছিল শ্রীরামপুরের রাজার এস্টেট ভাড়া করে। গিরিডিতে টেরাকোটার মন্দির দেখে আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল, হিতেন সান্যালকে জিজ্ঞেস করলাম দুয়ে দুয়ে চার করতে। ভদ্রলোক সম্ভবত পুরো মিথ্যা কথা বলেননি, লিখতে লিখতে কিছু গবেষণা এই হিতেন সান্যালও করেছেন।’

আমার মনে একটা প্রশ্ন খচখচ করছিল অনেকক্ষণ ধরে। এবার করেই ফেললাম, ‘কিন্তু ফেলুদা, যেসব জার্নালের কথা বললে সেসব জার্নাল গিরিডিতে বসে হিতেনবাবু পেতেন কী করে?’ 

‘ভেরি গুড তোপসে’, ফেলুদা একটা পিঠে চাপড় মেরে বলল, ‘এই কথাটা আমাকেও ভাবাচ্ছিল। গিরিডি খুব ছোটো শহরও নয়, কলেজ-লাইব্রেরি সবই আছে। তা হলেও, যেসব জার্নালে কলকাতার হিতেন্দ্রনাথ লেখা বার করতেন সেসব পাওয়া এখানে সহজ হত না। কিন্তু তাও গিরিডির হিতেন সান্যাল কী করে সেইসব লেখা পাচ্ছিলেন? এর উত্তর পেতে আমারও কালঘাম ছুটে যেত, কিন্তু ভাগ্যক্রমে সে উত্তর কাল লালমোহনবাবু দিয়ে দিয়েছেন।’

লালমোহনবাবু সামান্য ঘাবড়ে গেলেন, ‘আমি? কোন উত্তর দিলাম মশাই? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’

আমার ধাঁ করে গতরাতের আলোচনাটা মনে পড়ে গেল, ‘সুধাংশুবাবু?’

‘এক্সেলেন্ট তোপসে! তুই আর নেহাত স্যাটেলাইট নোস দেখছি, টিমটিম করে হলেও এ জ্যোতিষ্কেরও তেজ বাড়ছে। হ্যাঁ, সুধাংশুবাবুর লাইব্রেরিতেই এইসব জার্নালের সন্ধান পেয়েছিলেন হিতেন সান্যাল। কিন্তু একটা প্রশ্ন এখনও ভাবাচ্ছে রে…’

আমরা দুজনেই ফেলুদার দিকে তাকিয়ে।

‘সুধাংশুবাবু শান্তিনিকেতনের চাকরি ছেড়ে গিরিডিতে কেন ফিরে এসেছেন? এবং সত্যি কথাটা গোপনই বা করছেন কেন?’ 

‘চিঠির কথাটাও ভুলে যাবেন না ফেলুবাবু’, বলে উঠলেন জটায়ু।

ফেলুদা লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে উনি বললেন, ‘ব্ল্যাকমেল রহস্যের তো এখনও সমাধান হয়নি মশাই। ডেভিড যদি ব্ল্যাকমেল নাই করে থাকে, অন্য কেউ তো করেছে।’ 

‘না লালমোহনবাবু, মনে আছে। রহস্য তো এক নয়, একাধিক। জট ছাড়ানো তো পরের কথা, কোথায় কোথায় যে জট বেঁধে আছে সেটাও পরিষ্কার হচ্ছে না।’ 

‘ছাড়বে মশাই, ছাড়বে। এই যে একটা জোড়বাংলা শব্দ থেকে প্রথম রহস্যের সমাধান করে ফেললেন, এটাই বা কজন করতে পারে বলুন?’

ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছিল। লালমোহনবাবুর কথা শুনে বলল, ‘সেটার কৃতিত্ব অবশ্য অনেকটাই ডেভিডের। হিতেন সান্যালের মুখে জোড়বাংলা শব্দটা শুনে আমার একটা প্রাথমিক খটকা লেগেছিল, কারণ এটুকু জানতাম যে টেরাকোটা মন্দিরগুলোর মধ্যে আটচালা যতটা জনপ্রিয়, জোড়বাংলা অতটাও নয়। তাই শুনে মনে হয়েছিল যে বেশ খানিকটা চর্চা বা পড়াশোনা না থাকলে এটা সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু জোড়বাংলা মন্দিরের গঠনশৈলী যে ঠিক কীরকম, সেটা ডেভিড না বোঝালে ওই সুড়ঙ্গের অস্তিত্ব আন্দাজ করা সম্ভব হত না।’ 

‘ডেভিডের কথায় মনে পড়ল ফেলুবাবু, অত সকালে উনি মন্দিরে কেন গেছিলেন?’

‘সেটা জানবার জন্যই তো সাতসকালে উশ্রী যাওয়া। ডেভিড বলেছিলেন উনি আমাকে মন্দিরের ব্যাপারে কিছু জানাতে চান, কী সেটা খুলে বলেননি। খালি বলেছিলেন আর্জেন্ট। তারপরেই তো ফিল্ম কিনতে…’

ফেলুদা থেমে গেছে, ‘আরে তাই তো! ফিল্ম যখন, ক্যামেরাটাও নিশ্চয় ছিল।’

ডেভিড ম্যাককালাম তাহলে ক্যামেরার ফিল্ম কিনতে মোহনপুর গেছিলেন!

ফেলুদা বলল, ‘আমি একবার চট করে থানায় ঘুরে আসি। খোলা থাকা উচিত, আর যদি বন্ধ নেহাত হয়ে যায় চুনিলালকে ফোন করব। পুলিশ কোনও ক্যামেরা পেয়েছে কি না জানতে হবে।’

ফেলুদা বেরোতে যাচ্ছে, আমাদের ঘরে সুধাংশুবাবু ঢুকলেন।

‘বেরোচ্ছেন নাকি প্রদোষবাবু? কাল সন্ধ্যা থেকে যা ঝঞ্ঝাট গেল, আমি এসেছিলাম আপনাদের সঙ্গে একটু সময় কাটাতে। মনটা বড়ো বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।’

‘আপনি বসুন। তপেশ আর লালমোহনবাবু রইলেন, আমার ফিরতে একটু দেরি হবে যদিও।' 

'কিন্তু এত তড়িঘড়ি চললেন কোথায়?’

ফেলুদা দেখলাম সত্যি কথাটাই বলল, ‘ডেভিড ম্যাককালাম যখন মারা যান তখন সম্ভবত একটা ক্যামেরা ছিল ওঁর সঙ্গে। খোঁজ করা দরকার ক্যামেরাটা পুলিশের হস্তগত হয়েছে কি না।’

সুধাংশুবাবু অস্ফুটে কিছু একটা বললেন। মনে হল বললেন, ‘দুয়ো।’

ফেলুদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বললেন?’

সুধাংশুবাবু তাড়াতাড়ি সামলে নিলেন নিজেকে, ‘না, এদের এই গা-ছাড়া ব্যাপারগুলো একদম পোষায় না, বুঝলেন! আপনার সঙ্গে এত কথা হল, আর ক্যামেরার মতন এত গুরুত্বপূর্ণ একটা এভিডেন্স নিয়ে কিছু বললই না। আচ্ছা, আপনি ঠিক জানেন উনি ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলেন?’

‘না, একটা স্পেকুলেশন মাত্র।’

ফেলুদা বেরিয়ে গেল। সুধাংশুবাবুকে যেন একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। 

লালমোহনবাবু সামান্য উশখুশ করেছিলেন। এবারে বলে বসলেন, ‘আপনি কি এককালে নাটক-টাটক করতেন?’

এবার সুধাংশুবাবুর অবাক হওয়ার পালা, ‘নাটক? কই না তো, কেন বলুন তো?’

লালমোহনবাবু একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আসলে গত পরশু থেকে মনে হচ্ছে আপনাকে আগে যেন কোথাও দেখেছি। আমার আবার নাটক-টাটক দেখার ইয়ে, একটু শখ আছে কিনা। কেন জানি মনে হচ্ছিল স্টেজেই দেখেছি আপনাকে।’

‘না মশাই। ওই স্কুল-কলেজে থাকতে যা হয় আর কি, কখনও-সখনও স্টেজে উঠেছি। কিন্তু তার বাইরে নৈব নৈব চ।’

‘ওহ, আমারই ভুল। আসলে আপনার চেহারাটা হেঁ হেঁ, মানে বেশ দাগ কেটে যায় তো।’

সুধাংশুবাবুর মুখে এবারে একটু হাসি ফুটল, ‘তা চেহারার কথা যদি বলেন, এটা বংশগত। আমার বাবা আর দুই জ্যাঠাকে অবশ্য শুধু দেখতেই ভালো ছিল না, টুগেদার দে ওয়র অ্যান ইনডমিটেবল ফোর্স। লোকে ওনাদের বেশ সমঝে চলত।’

‘কী বলছেন মশাই, ব্যক্তিত্ব কি আপনারই কম নাকি? কাল ব্ল্যাকমেলের কথা যে মুহূর্তে শুনেছি তখন থেকেই…’ 

সর্বনাশ করেছে! 

লালমোহনবাবু জিভ কেটে চুপ করে গেলেও যা ঘটার ছিল তাই ঘটল। সুধাংশুবাবুর মুখ অন্ধকার হয়ে এসেছে, ‘ব্ল্যাকমেলের কথা কী বলছিলেন?’ 

লালমোহনবাবুর ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা! মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মাফ করবেন। আমি আসলে ভুল করে…’

সুধাংশুবাবুর মুখের অন্ধকার ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছিল। লালমোহনবাবুকে থামিয়ে বললেন, ‘আপনার লজ্জিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কাল রায়বাড়ির বাগানে পাতার ওপর পায়ের আওয়াজ পেয়েছিলাম বটে। কিন্তু আপনারাই যে সেখানে ছিলেন সে কথা বুঝতে পারিনি। আসলে একটা সামান্য কথায় রণবীর যে অত উত্তেজিত হয়ে যাবে তাও বুঝতে পারিনি।’

লালমোহনবাবু আর আমার চোখাচোখি হল। আমি ইশারায় ভদ্রলোককে বললাম আর কোনও কথা না বলতে। সুধাংশুবাবু যে ভুল করে গতকালের ঘটনার কথা ভেবে নিয়েছেন, সেটা এক হিসাবে শাপে বর হতে পারে। 

‘আসলে জানেন তো ওর ফ্যামিলি হিস্ট্রির অনেকটাই আমার জানা, যে কারণে রণবীরের আমাকে নিয়ে একটা ইনসিকিউরিটি চিরকালই ছিল।’

‘ইনসিকিউরিটি?’ লালমোহনবাবুর জড়তা কেটে গেছে।

‘সে তো বটেই। অক্সফোর্ডে গিয়ে বেলেল্লাপনা করার জন্য যে পড়াশোনাটাই শেষ হল না, সে কথা কি লোকসমাজে বলা যায়? বা ধরুন, পারিবারিক ব্যবসা যে ওর হাতে পড়ে ক্রমেই লাটে উঠে গেল, সেটাই বা জানে কজন?’ 

লালমোহনবাবুর মুখচোখ দেখে সুধাংশুবাবু বললেন, ‘আপনি হয়তো ভাবছেন এসব খবর আমার কাছেই বা এল কী করে! এসে যায় লালমোহনবাবু, ছোটো শহর। কতরকমের যে কথা উড়তে থাকে। আমি শুনি সবই, চট করে মুখ খুলি না। রণবীর রগচটা মানুষ, কবে একটা তর্কাতর্কির সময় মুখ ফসকে কিছু কথা বলে ফেলেছিলাম, সে রাগ আজও ওর যায়নি। আমি অবশ্য মাইন্ড করি না।’ 

সুধাংশুবাবু আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে বিদায় নিলেন। ফেলুদার ফিরতে ফিরতে ভালোই রাত হল। জটায়ুর চোখমুখ উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে দেখে বলল, ‘দাঁড়ান। একটু ফ্রেশ হয়ে আসতে দিন অন্তত।’

ফেলুদা চান করে এসে আরামকেদারায় বসা মাত্র লালমোহনবাবু আপডেট দিতে বসলেন। সব শুনে-টুনে ফেলুদা বেশ নির্বিকার চিত্তে একটা সিগারেট বার করে চারমিনারের প্যাকেটটার ওপর ঠুকতে লাগল।

জটায়ু অধৈর্য হয়ে পড়লেন, ‘কী মশাই? কিছু তো বলুন?’

‘গিরিডি যে রহস্যের খাসমহল, আপাতত এটুকুই যা বলার। কিপলিং-এর ভূতেদের দেখা না পেলেও কম রহস্যজনক ব্যাপার ঘটছে না!’

‘কিন্তু সুধাংশুবাবু…’

ফেলুদা বসা অবস্থাতেই সামনের দিকে ঝুঁকে এল, ‘সুধাংশবাবু কোনটা সত্যি বলছেন আর কোনটা মিথ্যা, সেটা চট করে ধরা যাবে না লালমোহনবাবু। তবে কিছু তথ্য, সে দরকারি হোক বা অদরকারি, আমাদের এখনও বলেননি।’

‘তুমি কি সেই খোঁজেই এত রাত অবধি ঘুরছিলে?’

ফেলুদা আবার আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিল, ‘তা বলতে পারিস। তবে এত দেরি হওয়ার একটা কারণ হল আমাকে মোহনপুর যেতে হয়েছিল।’

‘মোহনপুর? গতকাল যেখানে ডেভিড গেছিলেন?’

‘ঠিক ধরেছিস। কাল আমাকে যখন ডেভিড বলল ও ক্যামেরার ফিল্ম কিনতে মোহনপুর যাচ্ছে, আমি সামান্য অবাকই হয়েছিলাম। এই তো কাছেই মকৎপুর বাজার। সেটা বাদ দিয়েও আরও খান দু-এক বাজার আছে গিরিডি শহরের মধ্যে। তাহলে উজিয়ে মোহনপুর কেন, যেখানে যেতে আসতে সময় লেগে যাবে দেড় ঘণ্টার বেশি? আজ থানায় চুনিলাল তেওয়ারির কাছে ক্যামেরা দেখামাত্র বুঝতে পারলাম কেন।’

‘কেন ফেলুদা?’ 

‘কারণ ডেভিডের ক্যামেরাটি ভিন্টেজ, মোহনপুরের দোকানটার মতন স্পেশ্যালিস্ট না হলে এ ক্যামেরার ফিল্ম সাধারণ দোকানে পাওয়া যাবে না।’ 

‘কতটা ভিন্টেজ মশাই?’ শুধোলেন জটায়ু।

‘দোকানদার তো বলল এ ক্যামেরা চলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। পঞ্চাশের দশক থেকেই এর ব্যবহার কমে এসেছে, এখন তো বোধহয় পাওয়াই যায় না।’ 

আমার জানতে ইচ্ছে করছিল ক্যামেরার দোকান ছাড়া আর কোথায় গেছিল ফেলুদা। ওকে বলাতে একটা হাই তুলে বলল, ‘বৈষ্ণবসমাজ মন্দিরে। কিন্তু সেখানে উত্তর না এসে বরং প্রশ্ন বেড়ে গেল। কাল অগতির গতি সিধুজ্যাঠাকে ফোন না করে আর উপায় নেই। এবার আর না বকিয়ে ঘুমোতে যা।’

আর্কিটেকচার নিয়ে মাথা না ঘামালে মন্দিরে যে ফেলুদা ঢুঁ মারে না সে কথা বিলক্ষণ জানি। কিন্তু এই সন্ধ্যাবেলা, তাও আবার বৈষ্ণবসমাজ মন্দিরে? মাথামুন্ডু কিছুই বুঝছি না। 

আমি শুতে যাওয়ার তোড়জোড় করছি, ফেলুদা আর-একটা হাই তুলে বলল, ‘ভালো কথা, তোর চেনা একজন লোককে দেখলাম।’ 

‘আমার চেনা! গিরিডিতে?’

‘হুঁ, কালকের সেই মক্কেল আজও পাকুড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল।’

শুনে হার্টবিট বেড়ে গেল। কিন্তু ফেলুদা ওর নোটবুক টেনে নিয়েছে। অর্থাৎ, এখন আর ওকে বিরক্ত করা যাবে না। 


সকালে উঠে ফেলুদাকে দেখতে পেলাম না। সিধুজ্যাঠাকে ফোন করতে গেল, নাকি থানায়? বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেও ওর টিকির দেখা পাওয়া গেল না। লালমোহনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবলে পৌঁছে দেখি সুধাংশুবাবু বসে আছেন। আমাদের দেখে একটা শুকনো হাসি হেসে গুড মর্নিং জানালেন। 

‘তপেশ, তোমার দাদা কখন ফিরবেন?’

সুধাংশুবাবুকে বাধ্য হয়ে বলতে হল ফেলুদা কোথায় গেছে আমি জানি না। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একবার গলা খাঁকরে বললেন, ‘আসলে ওনাকে একটা কথা বলার ছিল। একটু জরুরি বলতে পারেন।’

লালমোহনবাবু একবার আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার নিতান্ত অসুবিধা না থাকলে আমাদের বলতে পারেন।’

‘না, অসুবিধা আর কী। আসলে জানেন, এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল, এমনিতেও গত কয়েকদিন মনমেজাজটা ভালো যাচ্ছে না…’

ভদ্রলোক কি ওঁর সঙ্গে রণবীর রায়ের কথা কাটাকাটির দিকে ইঙ্গিত করছেন?

‘তাই ভাবছিলাম আজ সন্ধ্যার ট্রেনে কলকাতা যাব, কয়েকটা দিনের জন্য চেঞ্জ অফ প্লেস দরকার। কিন্তু আপনারা আমার অতিথি হয়ে এসেছেন, তাই বুঝে উঠতে পারছি না কী করা উচিত।’

লালমোহনবাবু সামান্য হালকা মেজাজে বললেন, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন সুধাংশুবাবু, এরকম পরিস্থিতিতে আমাদেরও আর ঘোরার ইচ্ছা সেরকম নেই। কী বলো তপেশ?’

ভদ্রলোক কথাটা ঠিকই বলেছেন, কিন্তু ফেলুদার সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে পারলে ভালো হত।

সুধাংশুবাবু অবশ্য মনে হল খানিক হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, ‘আপনি বাঁচালেন। কথাটা পাড়তেও বড় অস্বস্তি হচ্ছিল। তবে আপনারা চাইলে স্বচ্ছন্দে পুরো ছুটি কাটিয়ে যেতে পারেন। কাজের লোকেরাও সবাই রইল, হিতেনও থাকবে, কোনোই অসুবিধা হবে না আপনাদের।’     

লালমোহনবাবুও কথাটা ঘোরাতে চাইছিলেন। এবার ফুরসত পেয়ে বললেন, ‘আপনাকে কিন্তু দেখলে চট করে মৈত্রবাড়ির লোক বলে মনে হয় না।’ 

সুধাংশুবাবু একটূ ঘাবড়ে গেছেন, ‘তাই নাকি! কেন বলুন তো?’

লালমোহনবাবু এবার বৈঠকখানার দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সেই প্রথম দিন থেকে দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখছি তো। আপনাকে কিন্তু মশাই আপনার পূর্বপুরুষদের মতন একেবারেই দেখতে নয়। আমি অবশ্য ভরদ্বাজবাবুকে দেখিনি…’

‘আরে না মশাই’, সুধাংশুবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘এঁরা কেউই আমার পূর্বপুরুষ নন।’

এবার জটায়ুর ঘাবড়ানোর পালা, ‘বলেন কী! এনারা কে তাহলে?’

‘এঁরা সবাই গিরিডির কৃতী আবাসিক লালমোহনবাবু। ওপরের বাঁদিকে দেখুন, উনি হলেন সুধীররঞ্জন খাস্তগীর, দুন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন একসময়। তার পাশে তো বোধহয় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে চিনতে পারছেন। প্রশান্তচন্দ্রের পাশে ওনারই শ্বশুর, আরেক বিখ্যাত অধ্যাপক হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। আর মৈত্রমশাই-এর নিচে হলেন হেমেন বোস।’

“কার কথা বলছেন? সেই ‘কেশে মাখো কুন্তলীন, অঙ্গবাসে দেলখোস’?” ফেলুদা ফিরে এসেছে!

‘আরে আসুন আসুন প্রদোষবাবু’, সুধাংশুবাবু উঠে দাঁড়িয়েছেন, ‘হ্যাঁ, সেই হেমেন বোসের কথাই হচ্ছে। ওনার বিশাল বাংলো এই কাছেই, পি-ডব্লিউ-ডির মাঠ পেরোলেই দেখতে পাবেন।’ 

সুধাংশুবাবু সন্ধ্যার ট্রেনে কলকাতা যাবেন শুনে ফেলুদা অবাক, ‘সে কী! এদিকে আমি যে একবার রায়বাড়িতে যাব ভাবছিলাম সন্ধ্যাবেলায়।’ 

রায়বাড়িতে যেতে হবে শুনে সুধাংশুবাবু একটু চমকেই গেলেন, ‘রায়বাড়ি? কোনও বিশেষ দরকার ছিল কি?’  

ফেলুদা শান্তস্বরে বলল, ‘তদন্তের কাজেই রণবীরবাবুকে কিছু প্রশ্ন করার ছিল।’ 

‘তদন্ত!’ সুধাংশুবাবু হাঁ হয়ে গেছেন।

ফেলুদা মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, কোনও মক্কেল অবশ্য এ তদন্তের ভার আমাকে দেয়নি। কিন্তু ডেভিডের মৃত্যু আমাকে এতটাই ভাবিয়ে তুলেছে যে কয়েকটা জিনিস জানার আশু দরকার।’ 

সুধাংশুবাবুর গলা গম্ভীর, ‘ডেভিডের মৃত্যুরহস্যের সমাধান হলে আমিও যারপরনাই খুশি হব প্রদোষবাবু। গিরিডিতে এরকম খুনখারাপি আগে ঘটেছে বলে তো খেয়ালও পড়ে না। তবে আপনি হয়তো আপনার বন্ধুর মুখে শুনে থাকবেন যে রণবীরের সঙ্গে কয়েকদিন আগে আমার বেশ একটু কথা কাটাকাটি হয়। এরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে আমার হয়তো রায়বাড়িতে না যাওয়াই সমীচীন। তা ছাড়া কলকাতায় যাব বলে মনস্থির যখন করেই ফেলেছি, তখন আর প্ল্যান বদলানোর মানে হয় না।’  

ফেলুদা একটা আরামকেদারায় বসে পড়ে মাথা নাড়ল, ‘আপনাকে অবশ্যই আমি জোর করব না। তবে সুধাংশুবাবু, আপনার কাছেও কয়েকটা প্রশ্ন ছিল যে!’ 

সুধাংশুবাবু অবাক হয়ে ফেলুদার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। 

‘ওহ! আমিও তাহলে আপনার সন্দেহভাজনের তালিকায় আছি?’ সুধাংশুবাবুর গলায় একটা অস্থিরতা টের পাচ্ছি।  

ফেলুদার বিশেষ কোনও তাপউত্তাপ না দেখিয়ে একটা চারমিনার ধরিয়েছে, ‘বসুন সুধাংশুবাবু। সন্দেহ নয়, শুধু কয়েকটা জট ছাড়াতে চাই। তাই আপনার সাহায্য দরকার।’ 

‘সাহায্য?’ ফ্যাকাশে হাসলেন সুধাংশুবাবু, ‘বেশ! বলুন কী জানার আছে আপনার?’

ফেলুদা একদৃষ্টিতে লক্ষ করছে সুধাংশুবাবু্কে, ‘আপনার লাইব্রেরি আমি বেশ ভালো করে দেখেছি সুধাংশুবাবু। আর্ট-হিস্ট্রি নিয়ে আপনার কালেকশন ঈর্ষণীয়। আর্ট-হিস্ট্রি নিয়ে আপনার এই উৎসাহের কোনও কারণ আছে কি?’

‘থ্যা-থ্যাঙ্কস’, ভদ্রলোক কপালের ঘাম মুছছেন, ‘আর্ট-হিস্ট্রি আমার নেশা বলতে পারেন।’

‘নেশা, নাকি পেশা?’ ফেলুদার গলার স্বর ধারালো হয়ে উঠেছে।

সুধাংশুবাবু চুপ। 

‘আপনি যদি না বলেন তাহলে আমিই বলি। শান্তিনিকেতনে আপনি ডেভিড ম্যাককালামের সহকর্মী ছিলেন, তাই নয় কি? আমার বন্ধু শ্রী লালমোহন গাঙ্গুলি কাকতালীয়ভাবে আপনাকে আগেই চিনেছিলেন। গতকাল চুনিলালবাবু শান্তিনিকেতন থানায় খোঁজ নিয়ে আমার বন্ধুর ধারণাটি কনফার্ম করেছেন। কিন্তু শান্তিনিকেতনের সে চাকরি আপনার থাকেনি। কেন সুধাংশুবাবু?’ 

সুধাংশুবাবু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন, ‘সবই কপালের ফের প্রদোষবাবু। আবার ইন্ট্রিগ্রিটি রাখার খেসারতও বলতে পারেন। শান্তিনিকেতনে ডেভিডের শত্রু কম ছিল না! একজন সাহেব কী করে বাংলার শিল্পইতিহাস পড়াতে পারেন সে নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠছিল। একমাত্র আমি ওর পাশে দাঁড়িয়েছিলাম সেসময়। তারই খেসারত দিতে হয়েছে আমাকে। কলকাতায় ডেভিডের বহু গুণমুগ্ধ ছিলেন, তাঁদের জন্য ডেভিডের চাকরি যায়নি। মাঝখান থেকে কাজে গাফিলতির অভিযোগ দেখিয়ে আমাকে বরখাস্ত করা হয়।’   

ফেলুদার ভাব দেখে বুঝলাম ও সুধাংশুবাবুর কথাটা অস্বীকার করছে না। কিন্তু ওর প্রশ্ন এখনও শেষ হয়নি, ‘ডেভিড ম্যাককালামকে নিয়ে আমি যতটা জেনেছি তাতে তাঁকে অকৃতজ্ঞ বলে মনে হওয়ার কোনও কারণ নেই। অথচ সেই ডেভিড এখানে এসে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আপনিও এমন ভান করছিলেন যেন ডেভিডকে আপনি চেনেন না। ব্যাপারটা রহস্যজনক নয় কি?’

সুধাংশুবাবুর মুখে মৃদু একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল, ‘যোগাযোগ করেনি এ কথা কে আপনাকে বলল প্রদোষবাবু? এখানে এসে যোগাযোগ করেনি ঠিকই, কিন্তু যোগাযোগ করেই এসেছিল যে।’

ফেলুদার ভুরু কুঁচকে উঠেছে।

‘তার মানে হিতেন সান্যালের জালিয়াতির ব্যাপারে আপনি জানতেন?’

সুধাংশুবাবুকে কিছুটা বিমর্ষ দেখাল, ‘অবশ্যই! ডেভিডই খবর দিয়েছিল, এবং সে-ই বারণ করেছিল এ ব্যাপারে কোনও কথা আগে থেকে না বলতে। যে কারণে আমরা দুজনে মিলে ঠিক করি আমাদের পূর্বপরিচিতির ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে। হিতেন যে এরকম কিছু করতে পারে এ আমার ধারণার অতীত ছিল প্রদোষবাবু।’  

ফেলুদা কথা বন্ধ করে কিছু একটা ভাবছে।

‘আমি কি উঠতে পারি? যাওয়ার আগে কিছু কাজকর্ম শেষ করার দরকার ছিল। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু মাস্টার তপেশ আর লালমোহনবাবুকে বলে রেখেছি– গিরিডির ছুটিটা আপনাদের মাঠে মারা যাওয়ার কোনও কারণ নেই। আপনারা যতদিন ইচ্ছে এখানে থেকে যান।’

ফেলুদা হাসল, ‘ডেভিডের খুনিকে না ধরতে পারা অবধি আর ছুটি নেই সুধাংশুবাবু।’

সুধাংশুবাবু উঠতে যাচ্ছিলেন, ফেলুদা বলল, ‘একটা শেষ প্রশ্ন। আপনাকে কি সম্প্রতি কেউ ব্ল্যাকমেল করছিল?’

সুধাংশুবাবু উঠতে গিয়েও বসে পড়লেন। মুখে সামান্য অসহিষ্ণুতার ছাপ, ‘সেই কথাই তো হচ্ছিল মিত্তিরমশাই। রণবীর রায়…’

ফেলুদা হাত তুলে বাধা দিল, ‘রণবীরবাবুর প্রসঙ্গ টানছি না। আপনি কি কোনও হুমকি দেওয়া চিঠি পেয়েছিলেন?’ 

সুধাংশুবাবু অবাক, ‘আপনাকে সে কথা কে বলল! হ্যাঁ, ট্যারাব্যাঁকা হাতের লেখায় একটা চিঠি এসেছিল বটে। তার মাথামুন্ডু আমি বুঝিনি। পড়া মাত্রই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। আপনি জানেন কে সে চিঠি পাঠিয়েছিল?’ 

ফেলুদা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল দুদিকে।

এই সময় সুধাংশুবাবুর কাজের লোক ঘরে ঢুকল, হাতে একটা মস্ত বড় খাম, ‘বাবু, ইন্সপিক্টর সাহিব নে ভেজা হ্যায়।’  

ফেলুদা খামটা নিয়ে উঠে পড়ল, ‘তোপসে-লালমোহনবাবু, একটা পাজল সলভ করতে হবে। ঘরে চল।’ 

সুধাংশুবাবুও উঠে দাঁড়ালেন, ‘আমিও এবারে আসি প্রদোষবাবু। আপনারা যদি ফিরেই যান তাহলে সম্ভবত কলকাতাতেই দেখা হবে আবার।’  


১০

আমাদের বিছানায় এখন ছবির ছড়াছড়ি। ডেভিড ম্যাককালামের ক্যামেরার ফিল্ম নেগেটিভগুলো ছেপে আসার সঙ্গে সঙ্গেই চুনিলাল তেওয়ারি ফেলুদার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। 

‘কী ঢাউস সব ছবি মশাই। ভাবা যায়, ওইটুকু ছোটো ক্যামেরা থেকে এত বড় বড় প্রিন্ট বেরোচ্ছে!’ 

ফেলুদা ছবিগুলো সাজাচ্ছিল, লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ডেভিডের ক্যামেরার বিশেষত্বই যে সেটা। কোডাক-ডুয়ো ক্যামেরা বানানোই হয়েছিল বড় প্রিন্ট বার করার জন্য, এতটাই বড় যে খুঁটিয়ে দেখার জন্য ম্যাগনিফাইং গ্লাস না হলেও চলবে। বুঝতেই পারছেন ডেভিডের মতন আর্ট-হিস্টোরিয়ানদের জন্য কী কাজের একটা জিনিস।’

ক্যামেরার নামটা শোনামাত্র ধাঁ করে একটা কথা মাথায় এল। বলব কি বলব না করতে করতে ফেলুদাকে বলেই ফেললাম।

‘সুধাংশুবাবু মনে হয় ডেভিডের এই ক্যামেরাটাকে চিনতেন।’

ফেলুদা ছবিগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আমার কথা শুনে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘সেটা হতেই পারে, দুজনে এতদিন ধরে একে অপরকে চিনত। কিন্তু তুই বুঝলি কী করে?’

“তোমার মনে আছে, গতরাতে তুমি যখন ক্যামেরার কথাটা তুলেছিলে উনি চমকে গিয়ে কিছু একটা বলেছিলেন। আমি শুনেছিলাম ‘দুয়ো’, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে…”

ফেলুদা এবার সটান আমার দিকে তাকিয়েছে ‘সাব্বাশ তোপসে! এটা মোক্ষম ধরেছিস। হ্যাঁ, উনি নির্ঘাত এই ক্যামেরাটার কথাই বলছিলেন– ডুয়ো।’

আমার মনের মধ্যে তাও একটু খচখচ করছিল। ভদ্রলোক কি কিছুটা চমকেও উঠেছিলেন ক্যামেরার কথা শুনে? কে জানে! 

‘কিন্তু পাজলটা কী ফেলুবাবু?’ 

‘আপনার মনে আছে লালমোহনবাবু, মন্দির দেখতে গিয়ে আপনাদের টেরাকোটার কাজগুলো দেখাচ্ছিলাম।’

‘হ্যাঁ মশাই! মনে আবার থাকবে না? সেই পোড়ামাটি?’

‘ঠিক। তাহলে এটাও নিশ্চয় মনে আছে যে পোড়ামাটির টাইলসগুলো সব জ্যামিতিক প্যাটার্নে বসানো। আমাদের কাজ হচ্ছে সেই নকশাগুলো এইসব ছবি থেকে খুঁজে বার করা। আমার ধারণা ডেভিড ম্যাককালাম নিজেও সেই কাজটা করতে চেয়েছিলেন এত ছবি তুলে রেখে।’

‘কিন্তু কেন বলুন তো?’ লালমোহনবাবু এবার কিছুটা অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। সেটা ছবির সংখ্যা দেখে না রহস্যের উত্তর মিলছে না বলে, সেটা অবশ্য ঠিক বোঝা গেল না।

‘সাজাতে শুরু করুন। ঠিক বুঝতে পারবেন।’

একশোর কাছাকাছি প্রায় ছবি, ঠিকমতন সাজিয়ে উঠতেই বেশ কয়েক ঘণ্টা চলে গেল। অবশ্য ফেলুদা না থাকলে আমরা হয়তো নকশাগুলো বুঝেই উঠতে পারতাম না। 

‘কী বুঝছিস তোপসে?’ ফেলুদার স্বর গম্ভীর।

ও ঠিকই বলেছিল, ছবিগুলো সাজানোর পরপরই রহস্যটা ঠিক চোখের সামনে ভেসে উঠল।

জ্যামিতিক নকশাগুলো মোটের ওপর টিকে থাকলেও একাধিক জায়গা স্রেফ ফাঁকা। কেউ সেই ইটগুলো তুলে নিয়েছে।

লালমোহনবাবুও দেখতে পেয়েছেন, ‘কিন্তু ফেলুবাবু, মন্দিরের বাইরে তো কিছু নজর পড়ল না সেদিন।’

‘কারণ অধিকাংশ ছবিগুলো মন্দিরের ভেতরের’, ফেলুদা ঝুঁকে পড়ে ছবিগুলো দেখছে, ‘ছবিগুলোয় আলোর ব্যবহারটা দেখুন। স্পষ্টতই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ছাড়া এ ছবি ওঠে না।’

‘কিন্তু এই ইটগুলোয় কী ছিল ফেলুদা?’

ফেলুদা পায়চারি করতে শুরু করেছে, ‘আমার ধারণা যে ইটগুলো তোলা হয়েছে তার প্রত্যেকটিতেই খোদাই করা আছে হয় পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক কোনও কাহিনিচিত্র। শিবের মন্দির যখন, শিবের ছবি খোদাই থাকাও অসম্ভব নয়। জ্যামিতিক নকশা তুলতে গেলে অনেক কটা ইট তুলতে হত, ফলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু মন্দিরের ভেতরের দেওয়াল থেকে খুবলে খুবলে নির্দিষ্ট কয়েকটি ইট তুললে কে আর দেখতে যাবে? ওই যে কিপলিং লিখেছিলেন না, গোটা অঞ্চল জুড়েই ভূতের গল্প শোনা যায়, আমার ধারণা ওই ভৌতিক পরিবেশের পূর্ণ ফায়দা তুলেছে এই অপরাধী।’ 

আমার আর লালমোহনবাবুর মাথায় যে একই প্রশ্ন ঘুরছে সেটা ফেলুদা আন্দাজ করতে পারছিল।

‘এবার প্রশ্ন থাকে একটাই। কে এই দুষ্কৃতী? কোনও সন্দেহ নেই যে ডেভিডের খুনটিও সম্ভবত সেই লোকটিই ঘটিয়েছে।’

বলতে বলতেই দেখলাম ফেলুদা ঝটিতি ছবিগুলো খামের মধ্যে ঢোকাতে শুরু করেছে, ‘চ তোপসে, চলুন লালমোহনবাবু। অপরাধীর সুলুকসন্ধান এখন একজন লোকই দিতে পারে।’

[আগামী পর্বে সমাপ্য]

............................................

ধারাবাহিকের পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ুন :

টেরাকোটা টালমাটাল (তৃতীয় পর্ব) 

 টেরাকোটা টালমাটাল (দ্বিতীয় পর্ব) 

 টেরাকোটা টালমাটাল (প্রথম পর্ব)

...............................................................................................

অলংকরণ: অভীক কুমার মৈত্র


#ফেলুদা #সত্যজিৎ #সিলি পয়েন্ট #বাংলা পোর্টাল #প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় #টেরাকোটা টালমাটাল #উপন্যাস #ধারাবাহিক #Feluda # Satyajit Ray #Prabirendra Chatterjee #pastiche #silly point # webportal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

57

Unique Visitors

215025