টেরাকোটা টালমাটাল (দ্বিতীয় পর্ব)
দ্বিতীয় পর্ব
..................................
৪
সুধাংশুবাবু ঠিকই বলেছিলেন, রায়বাড়ির গ্যারাজে শেভ্রোলে আর ব্যুইক দুই-ই দেখা গেল। সেই দুই গাড়ির মালিক এখন আমাদের সামনেই বসে। যে পাইপ কামড়ে ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে গল্প করছেন শুনলাম সেটা হাতির দাঁতের তৈরি। ডেভিড ম্যাককালামের বন্ধু যখন, রণবীর রায়ের বয়স মাঝ-চল্লিশের বেশি হওয়া উচিত নয়, তবে দেখলে মনে হয় ভদ্রলোক পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছেন। চুলে ভালোই পাক ধরেছে। হাত আর গলার কাছের চামড়াটাও বয়সের তুলনায় সামান্য কোঁচকানো লাগল, তবে ভদ্রলোক এত বেশি ফর্সা যে কুঁচকে যাওয়া চামড়া আরও বেশি করে চোখে পড়ে।
ফেলুদা বলল, ‘আপনার শেভ্রোলেটা তো বোধহয় ফিটন, তাই না?’
ফেলুদার প্রশ্ন শুনে রণবীর রায় খুবই ইমপ্রেসড হলেন, ‘বাহ! আপনার মতন ইয়ংম্যানের যে এসব আদ্যিকালের গাড়ি নিয়ে ইন্টারেস্ট থাকবে তা তো ভাবিনি। এই ফিটনের দেখভাল করতেই বছরে বেশ কয়েক হাজার টাকা যায় প্রদোষবাবু। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি, তবে বাপ-ঠাকুদ্দা এই গাড়ি চড়েছেন, প্রাণে ধরে আর বিক্রি কী করে করি বলুন! দুটো গাড়িই ঠাকুদ্দা তিরিশ সালে এক আমেরিকানের থেকে কিনেছিলেন।’
‘আপনাদের ব্যবসাটা কীসের?’
‘তামা। বরগণ্ডায় যত কপার মাইনস আছে তার মধ্যে সবথেকে বড়ো মাইন আমাদের। এককালে আমাদের কোম্পানি ব্রিটেনে এত তামা পাঠাত যে ইংল্যান্ডে তামা গলানোর একটা কারখানা অবধি খুলেছিলেন আমার বাবা। আমিও তখন অক্সফোর্ডে পড়তে যাই, আর সেই সুবাদেই ডেভিডের সঙ্গে আলাপ।’
ডেভিড মাথা নাড়লেন, ‘কারি খাওয়ায় আমার হাতেখড়ি রণবীরের হাত ধরেই। দেশে থাকার সময় ওকে হাত পুড়িয়ে রাঁধতে হয়নি বটে, কিন্তু অক্সফোর্ডে আর সে সুযোগ কোথায়?’
‘বিলেত ছাড়ার পরেও তাহলে যোগাযোগ ছিল আপনাদের মধ্যে?’
ডেভিড একবার রণবীরের দিকে তাকালেন, ‘অক্সফোর্ডের পর আমার বন্ধু একেবারে বেপাত্তা। সত্যি বলতে কি যোগাযোগ ছিলই না। যা হয় আর কী, প্রথম দিকে কিছু চিঠিচাপাটির আদানপ্রদান হত। পরে সেসবও বন্ধ হয়ে যায়। শেষ চিঠি আমরা লিখেছি বোধহয় বছর কুড়ি আগে, নয় কি?’
‘হ্যাঁ, বিশ বছর তো হবেই। সেই শেষ, তারপর এই মাসখানেক আগে ওর চিঠি পেয়ে আমি একেবারে অবাক! কী বিশেষ কাজে ও গিরিডি আসবে, আমি থাকব কি না জানতে চেয়েছে। আমিও পত্রপাঠ উত্তর দিয়ে দিলাম, থাকব তো বটেই এবং তুমিও এসে আমার কাছেই উঠবে।’
ডেভিড হেসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময়ে বৈঠকখানার জানলার বিশাল পাল্লা দুটো সশব্দে আছড়ে পড়ল। বাইরে যা শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে, বোঝাই যায় ভালোমতন ঝড় উঠেছে।
সুধাংশুবাবু বললেন, ‘ফাল্গুন মাসে এই ঝড় প্রায়ই হয় গিরিডিতে। রণবীর, তোমাদের ছাদে যাওয়া যাবে? মিত্তিরমশাইদের একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাক।’
‘সে কথা আর বলতে! এই ঘোরানো সিঁড়িটা দিয়ে আসুন আপনারা।’
আমরা এতক্ষণ বসেছিলাম একতলায়। দোতলার ওপর ছাদ। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে খেয়াল করলাম দোতলার সেই বিশাল ঘরে সত্যিই দুখানা ঝাড়বাতি, এবং এরকম রাজকীয় ঝাড়বাতি আমি এর আগে দেখিনি। ফেলুদাকে ঘুরে বলতে গিয়ে দেখি কয়েক ধাপ নিচে ডেভিডের সঙ্গে খুব মনোযোগ দিয়ে কী যেন আলোচনা করছে। কান পেতে বিশেষ সুবিধে হল না, শুধু ‘জোড়বাংলা’ শব্দটা শুনলাম। মনে হয় জঙ্গলের সেই মন্দিরটা নিয়েই আলোচনা চলছে।
ঝড় উঠেছে বলেই মনে হল সন্ধ্যাটা যেন আজকে আর-একটু তাড়াতাড়ি নেমে এসেছে। ছাদে উঠতেই লালমোহনবাবুর গলা পেলাম, ‘এদিকটায় এসো তপেশ। অপার্থিব ভাই, অপার্থিব দৃশ্য।’
লালমোহনবাবুর কথাটা নেহাত আবেগ বলে উড়িয়ে দেওয়া গেল না। সত্যিই অপরূপ দৃশ্য। দূরে উশ্রীর জলে চাঁদের আলো পড়ে রুপোর পাতের মতন দেখতে লাগছে, আর প্রবল হাওয়ায় উশ্রীর উলটো দিকে শালবনের মাথাগুলো সজোরে দুলছে।
সুধাংশুবাবুর সারপ্রাইজের জন্য অবশ্য আর-একটু অপেক্ষা করতে হল। হাওয়াটা কমে যাওয়ার পর পরেই অবাক হয়ে দেখলাম বারগণ্ডা জুড়ে জায়গায় জায়গায় জ্বলে উঠছে ছোটো ছোটো আগুন।
সুধাংশুবাবু মুচকি হাসলেন, ‘বনে ফায়ার বেশ বিপদজনক হয়ে যেতে পারে, তাই এই আমাদের বনফায়ার। ফাগুন মাসের এই ঝড় শুরু হলেই বারগণ্ডার ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়ে শুকনো শালপাতা জড়ো করে আগুন জ্বালাবে বলে। গেঁয়ো মজা বলতে পারেন, কিন্তু শহুরে মানুষরাও কম উপভোগ করেন না!’
সে অবশ্য লালমোহনবাবুকে দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। লালমোহনবাবু তন্ময় হয়ে সুধাংশুবাবুর কথা শুনছিলেন। ভদ্রলোক কী একটা কাজে ছাদের অন্য দিকে যেতে আমার দিকে ঘুরে বললেন, ‘মনে হয় না তপেশ, রবীন্দ্রনাথের মতন বলি– আহা কী দেখিলাম, জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলিব না?’ এই রে, ভদ্রলোক এবার সত্যিই বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন! ওঁকে বলাটা কি উচিত হবে যে কথাটা রবীন্দ্রনাথ নয়, বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন?
‘অবশ্য গড়পারের বৈকুণ্ঠ মল্লিকই বা কম যান কীসে? শুধু শালগাছ নিয়ে কবির ইমেজারিটা একবার দ্যাখো—
তরুবর তুমি মহাপ্রাংশু, তুলে যাও হিল্লোল,
রাঢ়বঙ্গের বিটপীশ্রেষ্ঠ, দাও দোদুল দোলায় দোল
ক্ষুৎপীড়িতের করেছ সেবা,
পাতা নাকি থালা বুঝিবে কে বা!
হরিৎহৃদয়, চর্ম তোমার হইবে না কভু লোল।’
ভদ্রতা করে বলতেই হল বৈকুণ্ঠবাবুর দেখার চোখ আছে, যদিও শালকে মহাপ্রাংশু বলা যায় কি! শেষ লাইনের গুরুচণ্ডালী দোষটা নিয়ে বলাতে জটায়ু ‘পোয়েটিক লাইসেন্স’ বলে হেসে উড়িয়ে দিলেন।
‘একবার ভাবো তো তপেশ, গাছের ছাল দেখে যার লোলচর্ম বৃদ্ধের কথা মনে পড়ে তিনি কত বড়ো কবি! আমার তো মনে হয় ইউক্যালিপটাস গাছ দেখেই বৈকুণ্ঠবাবুর এই ইমেজারিটা মাথায় এসেছিল।’
আমার যদিও সন্দেহ হচ্ছিল কচি ইউক্যালিপটাস গাছের চামড়ার রংই সাদা হয়। ফেলুদাকে বলতে গিয়ে খেয়াল হল সেই যে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ডেভিডের সঙ্গে কথা বলছিল তারপর আর ফেলুদাকে দেখিইনি।
বারগণ্ডা জুড়ে আগুনগুলো নিভে এসেছে। সুধাংশুবাবু বা রণবীর রায়কেও দেখতে পাচ্ছি না। লালমোহনবাবু যতক্ষণ আবৃত্তি করছিলেন তখনই বোধহয় সবাই নেমে গেছেন। লালমোহনবাবু কথা বলতে বলতে ছাদের অন্য প্রান্তে চলে গেছিলেন। ডাকতে গেলে বললেন, ‘দেখেছ কাণ্ড! এই দিক দিয়ে আর-একটা সিঁড়ি সোজা একতলায় নেমে গেছে।’
সুধাংশুবাবুদের বাড়ি্র পেছনেও এরকম সিঁড়ি দেখেছি, বাড়ির জমাদারদের জন্য বানানো। আমি ভেতরের সিঁড়ি দিয়েই নামব ভাবছিলাম, ফেলুদাকে ধরতে হবে। কিন্তু লালমোহনবাবুর নিচের বাগানে গিয়ে ঘোরার ইচ্ছে জেগেছে, খানিকটা বাধ্য হয়েই পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নামলাম।
‘ওরে বাবা, কত ফুলগাছ দেখেছ তপেশ! চাঁপাফুলের গন্ধ পাচ্ছ?’ লালমোহনবাবুর কথায় খেয়াল হল হাওয়ায় সত্যিই মিষ্টি, কাঁঠালমার্কা গন্ধ ভেসে আসছে। এই ফুলকেই কি কাঁঠালিচাপা বলে?
গাছটা খুঁজে বার করার জন্য এগোতেই একটা হিসহিসে শব্দ ভেসে এল। কারা কথা বলছে। ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর আড়ালে মুহূর্তের জন্য যেন দুটো সিল্যুয়েট নজরে এল।
লালমোহনবাবুও শুনেছেন। ফিসফিস করে বললেন, ‘কাছে গিয়ে একবার দেখবে নাকি?’
ভাগ্য ভালো এদিকটায় শুকনো পাতা বিশেষ পড়েনি, না হলে হাঁটাই মুশকিল হয়ে যেত। পা টিপে টিপে আর-একটু দূর যেতেই একটা গলার স্বর শোনা গেল। সে গলা গজরাচ্ছে।
‘সমস্ত ভালোমানুষি এবার ঘুচে যাবে। আমাকে ব্ল্যাকমেল করে পার পাওয়া যাবে না!’
অন্য গলাটা অস্পষ্ট, কী বলছে শোনা যাচ্ছে না।
প্রথম গলার স্বর আরও চড়ছে, ‘কী মতলবে এতদিন পরে আসা হয়েছে তা কি জানি না?’
দ্বিতীয় গলাটা যেন প্রথমজনকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। প্রথম গলার আওয়াজটা এবার কমে এল।
আমার কবজিতে চাপ পড়তে দেখি লালমোহনবাবুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ইশারায় জানতে চাইলেন এবার ফিরে যাওয়া উচিত হবে কি না।
আমার পুরো কথোপকথনটা শোনার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু লালমোহনবাবুর চোখমুখের অবস্থা দেখে ফিরে যাওয়াই মনস্থির করলাম। তা ছাড়া এরা যেই হোক না কেন, মুখোমুখি পড়ে গেলে একটা কেলেঙ্কারি হবে।
ফেলুদা একতলাতেই অপেক্ষা করছিল। লালমোহনবাবু হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকে প্রশ্ন করলেন, ‘সাহেবটি কোথায়?’
ফেলুদা সামান্য অবাক, ‘কেন বলুন তো? বাইরে বেরোল বলেই তো মনে হল।’
লালমোহনবাবু চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, ‘ব্ল্যাকমেল রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে ফেলুবাবু!’
শুনে ফেলুদার কয়েক সেকেন্ড বাক্যস্ফূর্তি হল না। জটায়ু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু রণবীরবাবু তখনই ঘরে এসে ঢুকলেন, সঙ্গে শরবত-এর ট্রে হাতে তাঁর কাজের লোক। ফেলুদা ইশারায় লালমোহনবাবুকে বলল রাতে কথা হবে।
‘বাকিরা কোথায় সব?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন রণবীর রায়, ‘এবার খাবারদাবারের ব্যবস্থাটাও তো করে ফেলতে হবে।’
সুধাংশুবাবু কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলেন, কিন্তু ডেভিডের দেখা নেই। সুধাংশুবাবুর মুখটা যদিও বেশ থমথম করছে। ফেলুদা জিজ্ঞেস করায় বললেন, ‘শরীরটা ভালো ঠেকছে না, আপনারা বরং রণবীরের এখানেই ডিনারটা সেরে নিন। আমি বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম নিই। আপনাদের ফেরার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেব কি? হরিপদবাবু তো বাড়িতেই আছেন।’
রায়বাড়ি থেকে সুধাংশুবাবুদের বাড়ি দিব্যি হেঁটে ফেরা যায়। ফেলুদা ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করতে উনি উঠে পড়লেন। ডেভিড কোথায় গেছেন কে জানে, আমরাও গুটিগুটি ডাইনিং রুমের দিকে এগোলাম।
৫
রায়বাড়ি থেকে একটু এগিয়েই বড়ো বাগানবাড়ি পড়ে যার নাম ‘শশীকান্ত কুটির’, আর বাগানবাড়ির পাশ দিয়ে যে গলি ঢুকে গেছে সেটা ধরলে সুধাংশুবাবুদের বাড়ি শর্টকাটে পৌঁছে যাওয়া যায়। আমরা সেই রাস্তাটাই ধরেছি। ফেলুদা আয়েশ করে একটা চারমিনার ধরিয়ে লালমোহনবাবুর দিকে তাকাল, ‘ব্ল্যাকমেলের কথা কী বলছিলেন?’
লালমোহনবাবু সন্ধ্যাবেলার ঘটনাটা ফেলুদাকে বললেন। ফেলুদা একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বলল, ‘তা আপনার থিয়োরিটা কী?’
‘ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো মশাই। ডেভিড ম্যাককালাম যে সুধাংশুবাবুকে ব্ল্যাকমেল করছেন সেটা তো বেশ বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু কেন সেটাই প্রশ্ন!’
‘ডেভিড! সুধাংশুবাবুকে? এত শিওর হচ্ছেন কী করে?’
আলো-অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পাচ্ছি লালমোহনবাবুর মুখটা উত্তেজনায় চকচক করছে, ‘আপনি কি জানেন সুধাংশুবাবু আর ডেভিড একে অপরকে আগে থেকেই চেনেন?’
আমার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। ফেলুদাও অবাক হয়ে লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে।
‘মনে আছে প্রথম দিন সুধাংশুবাবুকে দেখে আপনাদের বলেছিলাম টালিগঞ্জের কোনও অভিনেতার মতন ওনাকে দেখতে। তারপর গত দুদিন ধরে যতবার দেখছি, ভারী চেনা চেনা ঠেকছে অথচ ঠাহর করতে পারছিলাম না। আজকে রায়বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়েও মনে করবার চেষ্টা করছিলাম। তখন মনে এল না, কিন্তু বাগানে ওই ঝামেলার মধ্যে স্পষ্ট মনে পড়ে গেল! বছর তিনেক আগে সিমলে নাট্য উৎসবে শান্তিনিকেতন থেকে একটা দল এসেছিল, সব ওখানকারই ছাত্রছাত্রী আর অধ্যাপক। গড়পারে আমার প্রতিবেশী মৃগাঙ্ক ভড় আবার সেই উৎসব কমিটির সেক্রেটারি, আমাকে ভার দিয়েছিলেন ব্যাকস্টেজে গিয়ে প্রতিটি দলের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে আসতে।’
ফেলুদার ভুরু কুঁচকে উঠেছে, ‘আপনি বলছেন সেখানেই সুধাংশুবাবুকে দেখেছেন আপনি?’
‘তবে আর বলছি কী মশাই! শুধু দেখিনি, রীতিমতন হ্যান্ডশেকও করেছি। আসলে ওঁর হাইটটা তো অ্যাভারেজ বাঙালির থেকে বেশি, তা ছাড়া বনেদি ব্যাপারটাও আছে। চেহারাটা মনে রয়ে গেছিল।’
‘স্ট্রেঞ্জ, ভেরি স্ট্রেঞ্জ! আপনার কথা সত্যি হলে ডেভিডের সুধাংশুবাবুকে আগে থেকে না চেনার সত্যিই কোনও কারণ নেই। কিন্তু সে কথা দুজনেই লুকিয়ে গেলেন কেন?’
‘ওখানেই তো রহস্য মশাই। আমার ধারণা ডেভিড সুধাংশুবাবুর কোনও গোপন কথা জানেন। আর সেটা নিয়েই ওনাকে ব্ল্যাকমেল করতে গিরিডিতে এসেছেন।’
বারগণ্ডার এদিকটায় আলো একটু কম। আমাদের ডানদিকে একটা মন্দির চোখে পড়ল, সেটার ফলকে দেখি লেখা আছে ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণবসমাজ মন্দির’। বৈষ্ণবসমাজ তো বুঝলাম, কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবসমাজ মানে কী? ফেলুদাকে অবশ্য জিজ্ঞাসা করা গেল না, কারণ লালমোহনবাবু খানিকটা অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, ‘ফেলুবাবুর কি আমার থিয়োরিটা মনে ধরল না?’
‘না না, মনে না ধরার কোনও কারণ নেই। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ইনফরমেশন দিলেন আপনি। তবে ডেভিডের ব্ল্যাকমেল করার পয়েন্টটায় একটু গণ্ডগোল লাগছে।’
‘কেন বলুন তো? ওরকম ভালোমানুষ চেহারা দেখে?’
ফেলুদা একবার গলা খাঁকরিয়ে বলল, ‘উঁহু। চেহারা দিয়ে যে মনুষ্যচরিত্র বোঝা যায় না সেটুকু আমি জানি।’
লালমোহনবাবু বিস্তর লজ্জা পেয়ে, জিভ কেটে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।
ফেলুদা হাত তুলে বলল, ‘আমি জানি আপনি ওরকম কিছু ভেবে বলেননি। তাই ব্যতিব্যস্ত হবেন না। আপনার মনে আছে বোধহয়, হিতেন সান্যাল আমাদের বলেছিলেন সুধাংশুবাবুর ড্রয়ার থেকে উনি ব্ল্যাকমেলের কাগজটা পেয়েছিলেন মাসখানেক আগে। যে পাঠিয়েছিল সে হয়তো আরও কিছুদিন আগেই পাঠিয়ে থাকতে পারে। অথচ ডেভিড গিরিডিতে এসেছে দিন পাঁচেক।’
লো-ভোল্টেজ গলার স্বরে জটায়ু জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাই পোস্ট পাঠায়নি বলছেন?’
আমরা হাটতে হাঁটতে সুধাংশুবাবুদের বাড়ির প্রায় কাছেই চলে এসেছি। ফেলুদা মাথা নেড়ে বলল, ‘সে কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ডাকেও এসে থাকতে পারে।’
‘তাহলে?’
ফেলুদা দাঁড়িয়ে পড়েছে, ‘যদি সে চিঠি ডাকে এসেও থাকে, তাহলেও আজকে সন্ধ্যার সময় তো ডেভিডের রায়বাড়ির বাগানে থাকার কথা নয়।’
লালমোহনবাবু এবার যারপরনাই অবাক হয়েছেন, ‘আপনি এত শিওর হচ্ছেন কী করে ফেলুবাবু?’
‘কারণ লালমোহনবাবু, আপনারা যখন ছাদে ছিলেন ডেভিড তখনই বেরিয়ে গেছে মোহনপুরের দিকে। বারগণ্ডা থেকে মোহনপুর হেঁটে যেতে মিনিট চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ তো লাগবেই।’
‘মোহনপুরে কী আছে ফেলুদা? তোমাকে বলেই গেছে?’
ফেলুদা মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, বলেই গেছে। কিন্তু কেন গেছে সে কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।’
জটায়ু নিজের থিয়োরি খাটল না দেখে একটু মুষড়ে পড়েছিলেন। ফেলুদা সেটা বুঝতে পেরে বলল, ‘আপনার তো তাও একটা থিয়োরি ছিল। ফেলু মিত্তিরের এখন এমন অবস্থা যে থিয়োরিটুকুও নেই, রহস্যের গোলকধাঁধায় ঠোক্কর খেয়ে বেড়াচ্ছি।’
সুধাংশুবাবুর বাড়িতে ঢুকে কিছুটা এগিয়ে খেয়াল হল গেটটা বন্ধ করা হয়নি। ফিরে এসে গেটটা আটকাতে গিয়ে উলটোদিকের রাস্তায় বিশাল পাকুড় গাছে চোখ চলে গেল। এ গাছ রোজই দেখছি, কিন্তু গাছের নিচে প্রায় অন্ধকারে মিশে যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে আগে দেখিনি। ভালো করে দেখতে যাওয়ার আগেই লোকটা আরও অন্ধকারের দিকে সরে গেল।
সুধাংশুবাবু শুয়ে পড়েছিলেন। দোতলায় আমাদের ঘরে গিয়ে দেখি ফেলুদা বাংলার মন্দিরের স্থাপত্যকলা বিষয়ে একটা বই উলটেপালটে দেখছে। দেখে মনে হল সুধাংশুবাবুদের লাইব্রেরি থেকেই নিয়েছে বইটা। পাকুড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার কথা বললাম ফেলুদাকে, শুনল বটে কিন্তু বিশেষ উচ্চবাচ্য করল না।
আমি কলকাতা থেকে টিনটিনের ‘প্রিজনারস অফ দ্য সান’ বইটা নিয়ে এসেছিলাম। রাজদরবারে যখন টিনটিনদের বিচার চলছে তখনই ঘুমটা এসে গেল।
ঘুম ভাঙল ফেলুদার ডাকে, ‘তোপসে ওঠ, সাতটা বাজে। বেরোতে হবে এবার।’ এত সকালে বেরোতে হবে শুনে একটু অবাক হচ্ছিলাম। ফেলুদা দেখলাম অলরেডি পাজামা-পাঞ্জাবি পরে তৈরি। আমাকে বলল, ‘লালমোহনবাবুকে ডেকে তোল। ওনাকে না নিয়ে বেরোলে জেনুইনলি দুঃখ পাবেন।’
‘কিন্তু এত সকালে যাব কোথায়?’
‘উশ্রী নদীর ধারে। আর হ্যাঁ, সূর্যের আলো উঠেছে পাক্কা ছটার সময়। একঘণ্টা পরেও এত সকাল বললে একটা গাঁট্টা খাওয়ার কথা। কিন্তু গিরিডির এই চমৎকার সকালে ভায়োলেন্ট হতে মন চাইছে না।’
লালমোহনবাবু এত সকালে বেরোতে হবে শুনেও যাকে বলে এক পায়ে খাড়া। কালকের দুঃখটাও বেমালুম চলে গেছে দেখলাম, আমাকে বললেন, ‘তুমি মিলিয়ে নিয়ো তপেশ, ফেলুবাবু নির্ঘাত কোনও রহস্যের গন্ধ পেয়েছেন।’
রহস্যের গন্ধ পেলে ফেলুদা যেমন চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ে সেরকম অবশ্য কিছু দেখলাম না। বরং কী একটা গানের কলি গুনগুন করতে করতে হাঁটছে এখন। জিজ্ঞেস করাতে দু-কলি গেয়েও শুনিয়ে দিল– ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে, মোদের ততই বাঁধন টুটবে/ ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে, ততই মোদের আঁখি ফুটবে।’
রবীন্দ্রনাথ গানটা লিখেছিলেন বঙ্গভঙ্গের সময়ে, আর সে গান নাকি লেখা হয়েছিল গিরিডিতেই।
রাতে বোধহয় কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বারগণ্ডার কয়েক জায়গায় জল জমেছে দেখলাম, এদিকে উশ্রীর পাড়টাও ভেজা ভেজা। আমরা তাই না বসে নদীর ধার ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। সময় কাটানোর জন্য ফেলুদা বলল অ্যাক্রস্টিক খেলা যাক।
‘সেটা আবার কী খেলা মশাই? এই প্রথম নাম শুনলাম।’
লালমোহনবাবুর মতন আমিও অ্যাক্রস্টিকের নাম এর আগে শুনিনি। ফেলুদা সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল, ‘জমবে কেমন মজা/ টাটকা হবে ভাজা/ উচ্ছে তাজা তাজা।’
‘এ আবার কী হেঁয়ালি মশাই! তাও আবার উচ্ছে নিয়ে! তুমি কিছু বুঝলে তপেশ?’
আমি বুঝেছি। বার দু-এক লাইন তিনটে আওড়াতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল।
‘প্রত্যেক লাইনের প্রথম শব্দের প্রথম অক্ষরগুলো জুড়ে দেখুন।’
মিনিটখানেক বিড়বিড় করার পর জটায়ুর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, ‘কী কাণ্ড! এলেম আছে মশাই আপনার, তবে এ বড়ো শক্ত খেলা।’
‘শক্ত কোথায়? আর-একটা দেখুন– তমলুক গেলে ভাই/ পেট পুরে খাওয়া চাই/ শরবৎ-এ-জলপাই। মিলল?’
‘মিলল তো বটেই। উত্তর দিতে সমস্যা নেই, প্রশ্ন বানাতেই যত ঝঞ্ঝাট যে।’
আরও কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর ফেলুদা ঘড়ি দেখতে শুরু করল। ঘড়ির ছোটো কাঁটা যখন প্রায় নয়ের ঘরে, ফেলুদা দেখলাম আঙুল মটকাতে শুরু করেছে। ও কি কারও জন্য অপেক্ষা করছে? আরও দশ-বারো মিনিট অপেক্ষা করার পর ফেলুদা বলল, ‘তোপসে-লালমোহনবাবু, আমাদের আবার ওই পুল পেরোতে হবে।’
পুল পেরিয়ে উশ্রীর ওদিকে জঙ্গলে?
ফেলুদা যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারল, ‘হুঁ, মন্দিরে একবার যাওয়া দরকার।’
হিতেনবাবুর আজ আমাদের মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার কথা। ওঁর জন্যই কি উশ্রীর ধারে অপেক্ষা করছিলাম আমরা?
লালমোহনবাবু রহস্যের খোঁজে বেরিয়ে এতক্ষণ বেশ চনমনে ছিলেন। পুল পেরিয়ে আবার জঙ্গলে ঢুকতে হবে শুনে মুখটা দেখলাম একটু শুকিয়ে গেল।
[ক্রমশ]
পড়ুন - টেরাকোটা টালমাটাল (প্রথম পর্ব) / প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
..........................................
অলংকরণ: অভীক কুমার মৈত্র