টেরাকোটা টালমাটাল (শেষ পর্ব)
শেষ পর্ব
.................................
বারগণ্ডার এই দিকটার অবস্থা বেশ পড়তির দিকে। খান দুই বড় বাড়ির বিশাল থামগুলো দেখলাম ভেঙে পড়েছে; যত্রতত্র আবর্জনা, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা চায়ের দোকান সবই চোখে পড়ল। গলিগুলোও বেশ সরু, এবং সেসব গলিতে লোকের বাস কম নেই।
লালমোহনবাবু বলেই ফেললেন, ‘মশাই, সেই ছড়াটা মনে পড়ে গেল- ‘অলিগলি চলি রাম, ফুটপাথে ধুমধাম।’
ফেলুদা একটা তিনরাস্তা থুড়ি তিনগলির মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, তারপর বাঁদিকে কিছু একটা চোখে পড়তেই ওর চোখ নেচে উঠল, ‘ঠিক! আর কালি দিয়ে না হলেও যে বাড়িটা মোটের ওপর সদ্য চুনকাম হয়েছে ওখানেই আমরা যাব।’
সাদা একতলা বাড়ি, টিনের চালা। সে বাড়ির একটু আগেই একটা চায়ের দোকান। আমরা দোকানটা পেরোতে যাব, শুনতে পেলাম, ‘মিস্টার মিটার?’
রোদচশমা পরা যে ভদ্রলোক ডেকেছেন তিনি নিজেই এগিয়ে এলেন। এসে হিন্দিতে যা বললেন তার অর্থ হল, পাখি বাড়িতেই আছে, উড়ে যায়নি। ইনি যে চুনিলালের লোক, তা বুঝতে ভুল হওয়ার কথা নয়।
আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম কার বাড়িতে ঢুকতে চলেছি। কিন্তু কড়া খটখটানির আধ মিনিটের মধ্যে যিনি দরজা খুললেন তিনি সম্ভবত আমাদের এক্সপেক্ট করেননি। হিতেন সান্যাল প্রায় ভূত দেখার মতন চমকে উঠলেন, ‘আপনারা!’
‘আসতেই হল হিতেনবাবু। আপনার মিথ্যে কথা যে শেষ হচ্ছে না।’
হিতেন সান্যাল দু-পা পিছিয়ে গেছেন, ‘আজ্ঞে, সেদিনের পর আর কোনও কথাই তো হয়নি।’
ফেলুদা ঢুকে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে, ‘যে চিঠি সুধাংশুবাবু পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছিঁড়ে ফেলেছেন, তা আপনার হাতে আসে কী করে হিতেনবাবু?’
হিতেন সান্যাল ধপ করে তক্তপোশের বসে পড়লেন, মুখটা প্রায় রক্তশূন্য।
‘চিঠির কথা আপনাকে কে বলেছিল হিতেনবাবু?’
হিতেন সান্যাল মাথা নাড়লেন, ‘কেউ বলেনি প্রদোষবাবু! ও চিঠি আমারই লেখা।’
ফেলুদা যেন ভূত দেখেছে, ‘আপনার লেখা? আপনিই ব্ল্যাকমেল করছিলেন সুধাংশুবাবুকে!’
‘ব্ল্যাকমেল নয় প্রদোষবাবু! শুধু ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। যাতে জাতীয় সম্পত্তি বাঁচাতে পারি।’
ফেলুদাও এবার হিতেন সান্যালের পাশে বসে পড়েছে, ‘আর সেই কারণেই আপনি আমাকেও ওই চিঠির কথা বলেছিলেন!’
‘হ্যাঁ, আমার চিঠিতে তো কোনও কাজের কাজ হয়নি। তাই ভাবলাম যদি আপনাকে চিঠির কথাটা বললে কিছু কাজ হয়!’
‘হোয়াট আ ফুল আই অ্যাম! হিতেনবাবু, পরের বার দেশের সম্পত্তি বাঁচাতে চাইলে গোয়েন্দার সঙ্গে অন্তত হেঁয়ালি করবেন না, কেমন?’
হিতেনবাবু মাথা নামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে, ‘আমি দুঃখিত প্রদোষবাবু। আপনি সুধাংশুবাবুর অতিথি, প্রথম দিনেই কি এসব কথা বলা যায়! যদিও আপনি ওই চিঠির ব্যাপারে আর উচ্চবাচ্য করলেন না দেখে আমাকে অন্য একজনকে সব কথা চিঠি লিখেই বলতে হয়েছে।’
ফেলুদার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ও প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছে, ‘কার কথা বলছেন আপনি?’
‘যার পূর্বপুরুষের জমিতে টেরাকোটার মন্দির গড়ে উঠেছে।’
‘অর্থাৎ রণবীর রায়!’ ফেলুদা রগ ধরে আছে। শিরাগুলো দপদপ করছে।
এবার হিতেন সান্যালের অবাক হওয়ার পালা, ‘আপনি জানেন?’
‘হ্যাঁ হিতেনবাবু। আমাকেও রিসার্চ করতে হয়েছে বইকি! রণবীর রায়ের পূর্বপুরুষরাই যে শ্রীরামপুরের রাজা ছিলেন সে কথা আমি জানি। রায়বাড়ির বৈঠকখানার ওই বিশাল বিশাল ঝাড়বাতি যে কোনও রাজবাড়ি থেকেই এসেছে সে কথা আমার প্রথম দিনেই মনে হয়েছিল।’
‘রণবীরবাবু তাহলে জানেন টেরাকোটার ইটগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে?’ এবার প্রশ্নটা এল লালমোহনবাবুর দিক থেকে। তাকিয়ে দেখি উত্তেজনার চোটে ভদ্রলোকের চোখের পলক অবধি পড়ছে না।
হিতেন সান্যাল ভীষণ অবাক হয়ে তাকালেন, ‘টেরাকোটার ইট? কই সে ব্যাপারে তো কিছু জানি না।’
‘আপনি তাহলে কোন চুরির কথা বলছেন হিতেনবাবু?’ ফেলুদার গলায় প্রবল উত্তেজনা।
‘আমি বলছি টেরাকোটার বিষ্ণুমূর্তির কথা!’
‘যে বিষ্ণুমূর্তি এসেছে জোড়বাংলার ধ্বসে যাওয়া দ্বিতীয় মন্দির থেকে!’ ফেলুদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ সকালে এই মন্দিরের কথাই সিধুজ্যাঠা জানিয়েছিলেন আমাকে। গিরিডির জোড়বাংলা মন্দিরের এক অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য, প্রথম মন্দিরে শিবলিঙ্গ থাকলেও ভেঙে পড়া দ্বিতীয় মন্দিরে করা হত বিষ্ণুর উপাসনা। আর সেই কারণেই সে মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছিল অনন্যসুন্দর বিষ্ণুমূর্তি, সেও টেরাকোটায় তৈরি। বছর একশো-দেড়শো আগে অবধি এই মন্দিরকে তাই হরিহরের মন্দির বলে ডাকত লোকে।’
ফেলুদা এবার হিতেন সান্যালের দিকে ঘুরে বসল, ‘আর কলকাতায় বসে সিদ্ধেশ্বর বোস যা থেকে বিষ্ণুমন্দিরের কথা জেনেছেন, গিরিডিতে বসে আপনিও বোধহয় সেই লেখাতেই বিষ্ণুমূর্তির কথা জেনেছেন। আসল হিতেন্দ্রনাথ সান্যালের লেখা প্রবন্ধ, তাই না?’
হিতেন সান্যাল চুপ করে আছেন।
‘আপনিও লোভে পড়ে সেই মূর্তির সন্ধানেই গেছিলেন, নয় কি? গিয়ে দেখলেন মূর্তি ভ্যানিশ!’
হিতেন সান্যাল নড়ে উঠেছেন, ‘ভ্যানিশ নয় প্রদোষবাবু, সে মূর্তি যে আমি দেখেছি। ভোররাতের অন্ধকারেও সেই প্রায় বুজে যাওয়া সুড়ঙ্গের মধ্যে চোরকে চিনে নিতে ভুল হয়নি আমার।’
ফেলুদা তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়িয়েছে, ‘কিন্তু, সে মানুষ তো শুধু চোর নয়, সে খুনিও বটে! কেশে মাখো কুন্তলীন, অঙ্গবাসে দেলখোস…। আপনার ফোনটা কোথায় হিতেনবাবু?’
লালমোহনবাবু হতভম্ব, আমাকে ফিসফিস করে বললেন, ‘তোমার দাদা কি পাগল হয়ে গেলেন তপেশ? হেমেন বোস আবার কোথা থেকে এলেন?’
সে প্রশ্নের উত্তর আমিও জানি না।
ফেলুদার ফোন করা হয়ে গেছে। ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘ক্যুইক তোপসে, মৈত্রবাড়ি পৌঁছতে হবে যত শীঘ্র সম্ভব।’
১১
হিতেন সান্যালের বাড়ি থেকে মৈত্রবাড়ি বেশি দূর নয়, হেঁটে হয়তো মিনিট পনেরোর রাস্তা। দৌড়োলে হয়তো সাত-আট মিনিট লাগত। কিন্তু গলি থেকে বড়রাস্তায় পড়তেই একটা রিকশা পাওয়া গেল, আর সেটা না পেলে জটায়ুকে অ্যাডভেঞ্চারের শেষ ভাগে দেখা যেত না।
রিকশা থেকে পড়ি কি মরি করে নামতে না নামতেই দেখি গেটের সামনেই লালমোহনবাবুর গাড়ি। হরিপদবাবু গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বার করে ডাকছেন, ‘শিগগির আসুন স্যার, একটু আগেই গাড়ি বেরিয়ে গেছে।’
কোন গাড়ির কথা বলছেন হরিপদবাবু? সুধাংশুবাবুর গাড়ি তো কাজ করছে না, চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি পোর্টিকোর নিচে সে গাড়ি দাঁড়িয়ে। আর হরিপদবাবুই বা কী করছেন এখানে?
‘এবারের গল্পটা যখন লিখবি, হরিপদবাবুকে একটা গ্র্যান্ড থ্যাংক ইউ দিতে ভুলিস না’, গাড়িতে উঠতে উঠে বলল ফেলুদা।
আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে তাকিয়ে আছি দেখে ফেলুদা হেসে ফেলল, ‘এই কদিন যে টানা গেটের বাইরে থেকে নজর রাখছিলেন সেটার কোনও দাম নেই? আমি যদিও হরিপদবাবুকে খেয়াল রাখতে বলেছিলাম হিতেন সান্যালের ওপর, কখন ঢুকছেন, কখন বেরোচ্ছেন সেগুলো জানা দরকার ছিল। ওই প্রথম দিনের জোড়বাংলা রেফারেন্সের পর থেকেই ওঁর প্রতি একটা সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। আর রায়বাড়িতে কথা কাটাকাটির পর সুধাংশুবাবুর প্রতিও একটা সন্দেহ তৈরি হয়েছিল বটে।’
হরিপদবাবু উশ্রীর দিকে যাচ্ছেন দেখে ফেলুদা অবাক, ‘গাড়ি ধরমপুর-জামতাড়া হাইওয়ের দিকে যায়নি?’
‘না স্যার, সামনে টায়ারের দাগ দেখুন। মনে হয় পচম্বার দিকে যাচ্ছে।’
একে নতুন গাড়ি, তার ওপর হরিপদবাবু এত জোরে চালাচ্ছিলেন যে মিনিট সাতেকের মধ্যেই সেই গাড়িকে সামনে দেখা গেল।
‘ও মশাই!’ এত স্পিডে গাড়ি চলছিল যে লালমোহনবাবু বিশেষ কথাবার্তা বলছিলেন না, কিন্তু সামনের গাড়িটাকে দেখে উনি আর চুপ করে থাকতে পারলেন না।
আমি জানি ভদ্রলোক কেন অবাক হয়েছেন। সামনে দেখা যাচ্ছে রণবীর রায়ের সেই ফিটন গাড়ি!
হরিপদবাবু প্রায় ধরে ফেলতে চলেছেন দেখে গাড়িটা এবার মেন রোড ছেড়ে উশ্রীর বালির ওপর নেমে পড়েছে।
ফেলুদা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘গাড়ির ব্রিজে উঠতে পারবে না বুঝতে পেরে এবার তারের পুল দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যাওয়ার মতলব।’
ফেলুদা ঠিকই বলেছে। আর-একটু এগোতেই দেখা গেল ফিটন গাড়িটা উশ্রীর ধারে দাঁড় করিয়ে গাড়ির চালক প্রাণপণে তারের পুলের দিকে দৌড়ে চলেছে। হাতে একটা মস্ত স্যুটকেস।
আমরা গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়োতে শুরু করতে করতে সে মানুষটা পুলের ওপরে উঠে পড়েছে। ফেলুদার কথায় হরিপদবাবু গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা রওনা দিলেন থানার দিকে।
লালমোহনবাবু হাঁফ ধরে যাওয়া গলায় বললেন, ‘তোমার দাদা যন্তরটা সঙ্গে করে এনেছেন নাকি তপেশ? না হলে একে থামাব কী করে? উশ্রীর ওদিকে গেলেই তো ঘন জঙ্গল।’ আমার মনেও সেই একই প্রশ্ন। আমি যতদূর জানি ছুটি কাটাতে আসছে বলে ফেলুদা এবারে ওর পিস্তলটা সঙ্গে আনেনি। তাহলে কি পাথর ছুড়বে নাকি দৌড়েই ধরতে চায়?
ফেলুদা অবশ্য দুটোর কোনোটাই করল না, উলটে পুলের সামনে গিয়ে দুদিকের তার দুটো ধরে প্রবল ঝাঁকাতে শুরু করল। অন্য মানুষটা পুলের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে, কিন্তু প্রবল ঝাঁকুনির ফলে আর এগোতে পারছে না। আমি ফেলুদার কাছে পৌঁছোতে আমাকে বলল, ‘তার দুটো ঝাঁকাতে থাক। যতক্ষণ না ওদিকে পৌঁছোচ্ছি, থামিস না।’
খুব বেশিক্ষণ অবশ্য ঝাঁকাতে হলও না। সেই মানুষটা পুলের ওপরেই বসে পড়েছে।
লালমোহনবাবু আর আমি যতক্ষণে পৌঁছোলাম, ফেলুদা ততক্ষণে স্যুটকেসটা খুলে ফেলেছে। স্যুটকেস থেকে বেরিয়ে এসেছে এক অপূর্ব মূর্তি। না, একটা মূর্তি বললে ভুল বলা হবে। দশখানা মূর্তি একটা চালের মধ্যে খোদাই করা। আমি এই মূর্তিগুলো চিনি– মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ…
‘আপনি ভুল করছেন প্রদোষবাবু। এই দশাবতার মূর্তি আমার পৈতৃক সম্পত্তি।’ হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন সুধাংশু মৈত্র।
‘ভুল আমি নই সুধাংশুবাবু, করছেন আপনি। আশা করি আমার বন্ধু, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রও ভবিষ্যতে একই কথা বলবে। দ্বিতীয় মন্দির যদি আপনার পূর্বপুরুষের টাকায় বানানো হয়েও থাকে, তাহলেও এই মূর্তি মন্দির থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কোনও অধিকার আপনার নেই সুধাংশুবাবু। আর অপরাধ তো আপনার একটা নয় সুধাংশুবাবু, অপরাধ যে অনেকগুলো। খুন…’
উশ্রীর স্রোতের তীব্রতা বাড়ছে, সুধাংশুবাবু সেদিকেই তাকিয়ে ছিলেন। ফেলুদাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে এবার ক্লান্ত স্বরে বলে উঠলেন, ‘ডেভিডকে খুন আমি করিনি। আমি জানি না কোথা থেকে এত আজগুবি কথার আমদানি করছেন আপনি।’
ফেলুদা মাথা নাড়ল, ‘খুন হয়তো করেননি আপনি। কিন্তু খুনের সময় যে সেখানে ছিলেন আপনি। আপনি খুনির দোসর, খুনির স্যাঙাত।’
সুধাংশুবাবুর চোখ জ্বলছে।
‘আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও নাককে দিতে পারেননি সুধাংশুবাবু। হেমেন বোসের কোম্পানির এসেন্সগুলো কি আপনার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া? এই এসেন্সের গন্ধ যে অন্য কোথাও পাওয়া যায় না মিস্টার মৈত্র। যে গন্ধ এই মুহূর্তে আপনার পোশাক থেকে আসছে, ঠিক সেই একই গন্ধ যে খুনের দিন মন্দিরের ভেতরেও পেয়েছিলাম।’
তাই তো! এ যে সেই মিষ্টি গন্ধ যা আমি আর লালমোহনবাবু রায়বাড়ির বাগানে পেয়েছিলাম।
লালমোহনবাবু পুলে ওঠা ইস্তক সামান্য আড়ষ্ট হয়েছিলেন, বোধহয় পুলটা তখনও একটু একটু দুলছিল বলে। এবার এক দিকের তারটা প্রায় আঁকড়ে ধরে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সবই তো বুঝলাম। কিন্তু খুনটা তাহলে কে করল ফেলুবাবু?’
ফেলুদা সুধাংশু মৈত্রকে দাঁড় করাতে করাতে বলল, ‘চিন্তা নেই লালমোহনবাবু। হিতেন সান্যালের বাড়ি থেকে আমি চুনিলাল তেওয়ারিকে ফোন করেছিলাম। খুনির পালানোর সুযোগ নেই। আর চোরাই মাল তারও তো কম নেই। ‘
ফেলুদা পুল থেকে নেমে এবার ফিটনের দিকে তাকিয়ে আছে।
‘সুধাংশুবাবু, আপনি হয়তো জানেন না যে গাড়ি নিয়ে আমার একটু আধটু চর্চা আছে। রণবীর রায়ের বাড়িতে শেভ্রোলের এই মডেলটা দেখেই আমার একটা সন্দেহ হয়েছিল। আজ আর কোনও সন্দেহই নেই। এ বোধহয় শেভ্রোলের হাতে গোনা সেই কয়েকটা মডেলের একটা, যাতে এক্সটেনশন ট্রাঙ্ক রয়েছে। ঠিক বলছি তো?’
সুধাংশুবাবু নিরুত্তর।
‘ট্রাঙ্ক? গাড়ির কোম্পানি ট্রাঙ্কও দেয় বুঝি?’ জটায়ু ভালোই অবাক হয়েছেন।
‘ট্রাঙ্ক মার্কিনি শব্দ লালমোহনবাবু। ডিকি বোঝেন তো, গাড়ির ডিকি? এই গাড়িতে যে ডিকি দেখতে পাচ্ছেন সেটা ছাড়াও যে একটা গোপন ডিকি আছে।’
‘বলেন কী!’
ফেলুদা হাত বাড়াতে সুধাংশুবাবু বিনা বাক্যব্যয়ে একটা চাবি তুলে দিলেন ওর হাতে। বিশাল ফিটনের ডিকিটাও বিশাল। আর খুব খেয়াল করে না তাকালে বোঝা সম্ভব নয় যে ডিকির মধ্যেই রয়ে গেছে একটা ছোটো ক্যাবিনেট। ফেলুদা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সুধাংশুবাবুর চাবি দিয়ে সেই ক্যাবিনেট খুলে ফেলেছে।
আর সেই ক্যাবিনেটের মধ্যে সার দিয়ে রাখা বস্তুগুলোকে এক ঝলক দেখেই বলে দেওয়া যায় যে ডেভিড ম্যাককালামের ক্যামেরা এদেরকেই খুঁজে পায়নি। একের পর এক টেরাকোটা টাইল। দূর থেকেও বেশ বুঝতে পারছি একদম ওপরের টাইলে শিব আর পার্বতীর বিয়ে দেখানো হয়েছে, শিবের পায়ের নিচে নন্দী-ভৃঙ্গী বসে।
‘জয় বাবা গিরিরাজ’, দুহাত জড়ো করে পেল্লায় একটা প্রণাম ঠুকলেন লালমোহন গাঙ্গুলি, ‘শিবের নামেই গিরিডির নাম নাকি মশাই?’
‘গিরি থেকেই গিরিডি, কিন্তু শ্বশুর আর জামাইয়ের আইডেন্টিটি বদলাবদলি করে দিলে আপনার পুণ্যের ভাগে কিছু কম পড়তে পারে লালমোহনবাবু।’
১২
হিতেন সান্যালের বাড়ি থেকে ফেলুদার ফোন পেয়েই চুনিলালের লোকেরা রায়বাড়ির ওপরে নজর রাখতে শুরু করেছিল। সুধাংশু মৈত্রকে বমাল ধরার পর রণবীর রায়কেও গ্রেপ্তার করতে আর বেশি সময় লাগেনি।
চুনিলাল তেওয়ারির মুখটা দেখে মনে হচ্ছিল উনি কিছুটা আপসেট। ফেলুদা জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, ‘গিরিডির এতদিনের বাসিন্দা দুজনেই। এরকম বনেদি বাড়ির লোক সব। তারাও যে এরকম জঘন্য সব অপরাধ করতে পারে, কে বিশ্বাস করতে পারে বলুন।’
ফেলুদা একটা একপেশে হাসি হেসে বলল, ‘গিরিডির অবস্থা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এঁদেরও অবস্থা পড়েছিল, সন্দেহ নেই। তবে লোভের মোটিভ যে চিরন্তন। আর এই কেসে ক্রস-কানেকশনের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে।’
‘ক্রস-কানেকশন?’
ফেলুদা মাথা নাড়ল, ‘হিতেন সান্যালের সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করতে ডেভিড গিরিডি এসেছিলেন। এদিকে মন্দির ঘুরতে গিয়ে ডেভিডের মনে সন্দেহ জেগে উঠল, একাধিক জায়গায় দেখতে পেলেন টেরাকোটার টাইল কেউ বা কারা তুলে নিয়ে গেছে। এখন কাকে উনি এই সন্দেহের কথা বলতে পারেন?’
চুনিলালের ভুরু কুঁচকে উঠেছে, ‘সুধাংশুবাবু?’
‘একজ্যাক্টলি সো, মিস্টার তেওয়ারি! একে সুধাংশু ওঁর প্রাক্তন সহকর্মী, তার ওপর ডেভিড জানতেন রণবীর রায়ের পূর্বপুরুষের জমিতেই গড়ে উঠেছিল এই মন্দির। ডেভিড ভেবেছিলেন রণবীরের থেকে সুধাংশুকে জানানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যেটা ডেভিড কেন, আমরা কেউই জানতাম না, যে, শুধু শ্রীরামপুরের রায়বাড়ি নয়, ঢাকার মৈত্রবাড়ি থেকেও পয়সা এসেছিল এই মন্দির গড়ে তুলতে। মৈত্ররা ছিলেন বৈষ্ণব, যে কারণে জোড়বাংলার দ্বিতীয় মন্দিরে বিষ্ণু-উপাসনা হত।’
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘গিরিডির ওই বৈষ্ণবসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কি এই মৈত্ররাই?’
‘না, এ হল গৌড়ীয় বৈষ্ণবসমাজ। অর্থাৎ গৌড়বাংলা, সম্ভবত নবদ্বীপের বৈষ্ণবরা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। আমার মনে ছিল বিষ্ণুপুরের যে বিখ্যাত জোড়বাংলা মন্দির আছে তা বিষ্ণুমন্দির। গিরিডিতে বৈষ্ণবসমাজ আছে দেখে ভাবছিলাম তারা এখানকার জোড়বাংলা মন্দির নিয়ে কিছু জানে কি না। গিয়ে দেখলাম কেউই কিছু জানে না, তবে শুনলাম সুধাংশুবাবু বৈষ্ণবসমাজের অন্যতম সম্মাননীয় সদস্য।’
মনে পড়ল ফেলুদা বলেছিল বৈষ্ণবসমাজে গিয়ে উত্তর পাওয়ার বদলে প্রশ্ন বেড়ে গেছে।
‘কিন্তু একটা কথা বলুন মিস্টার মিটার’, চুনিলালের কপালে চিন্তার ভাঁজ, ‘এই যে দ্বিতীয় মন্দিরটা নষ্ট হয়ে গেল, এ নিয়ে মৈত্ররা কোনও অ্যাকশন নিলেন না কেন?’
‘ডিসট্যান্স মিস্টার তেওয়ারি, দূরত্ব। তখনকার দিনে পূর্ববঙ্গে থেকে গিরিডির মন্দির নিয়ে বেশি খোঁজখবর রাখা সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া দেবত্র সম্পত্তি, তাই জন্যও বোধহয় বেশি মাথা ঘামাননি। আর দেশি মন্দিরের শিল্পকলা এভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাবে এ কথাই বা কে ভাবতে পারত সে সময়ে?’
‘মশাই, ক্রস-কানেকশনের কথাটা তো শেষ হল না’, জটায়ু একটু কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেললেন।
‘হ্যাঁ, ক্রস-কানেকশনের কথায় ফিরি। শিবমন্দিরের চুরির কথা ডেভিড জানালেন সুধাংশুকে। ওদিকে বিষ্ণুমূর্তি হাপিস হয়ে যেতে দেখে শেষ চেষ্টা হিসাবে হিতেন সান্যাল জানালেন রণবীর রায়কে। যেদিন আমরা রায়বাড়ি গেলাম সেদিন বিকালে রণবীর চুরির অভিযোগে চেপে ধরলেন সুধাংশুকে। সুধাংশুও মরিয়া হয়ে জানালেন যে ডেভিড টেরাকোটার টাইলসের চুরির কথা জেনে গেছেন। নিজেদেরকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে দুজনে মিলে ঠিক করলেন ডেভিডকে সরাতে হবে। হিতেন সান্যাল দু-জায়গাতেই বেনামি চিঠি লিখে বেঁচে গেছিলেন। না হলে তাঁর ভাগ্যও যে বিরূপ হত না সে কথা কে-ই বা বলতে পারে!’
‘একজন পরিচিত লোককে এরকমভাবে খুন করতে বাধল না এদের?’ লালমোহনবাবুর গলাটা কেঁপে গেল।
‘ভয়, লালমোহনবাবু। ডেভিড শেষ কিছু বছরে এই টেরাকোটা চোরাচালান নিয়ে এত লেখালেখি করেছেন যে এঁরা জানতেন ডেভিড এই রহস্যের শেষ দেখে ছাড়বেন। আর সেটা ঘটলে দুজনের ভাগ্যেই লেখা ছিল বহু বছরের হাজতবাস। ডেভিডের প্যাশনই ওর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল।’
ফেলুদা একটু থেমে চুনিলাল তেওয়ারির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মিস্টার তেওয়ারি। আপনি সুধাংশু মৈত্রকে জিজ্ঞাসা করে কনফার্ম করতে পারেন- আমার ধারণা যেদিন উনি রায়বাড়ি থেকে আগে চলে এসেছিলেন সেই রাতেই উনি ডেভিডকে ফোন করে সাতসকালে মন্দিরে আসতে বলেন। রণবীর আগে থেকেই জানতেন এই প্ল্যান। সকালবেলা ডেভিড ঢুকলেন মন্দিরের সামনের দিক থেকে, আর রণবীর ও সুধাংশু এলেন জোড়বাংলার দ্বিতীয় মন্দিরের সুড়ঙ্গ দিয়ে। তারপর সবই পরিকল্পনা মোতাবেক এগোচ্ছিল। যেটা সুধাংশু বা রণবীর জানতেন না, যে, ডেভিড প্রায় ওই একই সময়ে হিতেন সান্যালকেও ওখানেই ডেকেছিলেন। হিতেনের সঙ্গে ডেভিড হয়তো টেরাকোটার টাইলস নিয়েও কথা বলতে চেয়েছিলেন। সেদিন আমাকে চুরির ব্যাপারে বিশদে কিছু না বললেও আমার মনে হয়েছিল উনি হিতেনকে সন্দেহ করছিলেন। হিতেন চুরির ব্যাপারে দোষ স্বীকার না করলে ডেভিড হয়তো আমাকে অনুরোধ করতেন রহস্য উন্মোচন করতে।’
‘হিতেনকে সুধাংশু আর রণবীর দেখতে পেয়েছিলেন?’ জিজ্ঞাসা করলেন চুনিলাল।
ফেলুদা বলল, ‘আমার ধারণা তাই। আর যদি দেখতে নাও পেয়ে থাকেন পায়ের শব্দ তো নিশ্চিতভাবে পেয়েছিলেন। হিতেনের পায়ের শব্দ পেয়েই দুজনে তড়িঘড়ি ওই সুড়ঙ্গ ধরেই ফিরে যান। খেয়ালও করেননি ডেভিডের ক্যামেরা ছিটকে মন্দিরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে।’
চুনিলাল একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘রণবীর রায় স্বীকার করেছেন ডেভিডের মাথায় লোহার রড মেরে উনিই খুন করেছেন। আর ফিটনে সমস্ত চোরাই মাল তুলে গিরিডি ছেড়ে পালানোর মতলব-ও ওঁরই।’
ফেলুদা মাথা নাড়ল, ‘দুজনের মধ্যে যে রণবীর বেশি রগচটা মানুষ সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। লোহার রডটি ওই সুড়ঙ্গে বা পেছনের জঙ্গলে পেয়ে যাবেন। কিন্তু চোরাই মালের ব্যাপারটায় আর-একটু জটিলতা রয়েছে।’
‘আরও জটিলতা?’ এবার চুনিলালও হাঁ হয়ে গেছেন।
‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন, মিস্টার তেওয়ারি’, ফেলুদা আমাদের দেখিয়ে বলল, ‘রায়বাড়ির বাগানে আমার ভাই আর লালমোহনবাবু শুনেছিলেন একজন আর-একজনকে বলছে ‘আমাকে ব্ল্যাকমেল করে পার পাবে না’, সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে কী মানে দাঁড়ায়?’
‘কী বলুন তো?’
আমি বুঝতে পারছি আমার মতনই লালমোহনবাবু আর চুনিলাল তেওয়ারির-ও হার্টবিট মিস হওয়ার দশা।
'মানে এই যে, সুধাংশু এবং রণবীর এই চোরাচালানের কারবার আরও আগে থেকেই চালিয়ে আসছেন। এবারের ঘটনাটা নেহাত কাকতালীয় নয়। আমি অবাক হব না যদি শুনি স্রেফ আরও টাকার লোভে সুধাংশু তাঁর চাকরি ছেড়ে গিরিডি চলে এসেছিলেন। শান্তিনিকেতনে কিছু অশান্তি পাকিয়ে উঠতেই পারে, কিন্তু সুধাংশুর দিক থেকে ইচ্ছাকৃত ইন্ধন ছিল কি না তা বার করার দায়িত্ব এখন আপনার মিস্টার তেওয়ারি’, ফেলুদার মুখে একটা আলগা হাসি লেগে। কিন্তু ইন্সপেক্টর চুনিলাল তেওয়ারির মুখে একফোঁটাও হাসি নেই। বলা বাহুল্য যে তাঁর কাজ আরও বাড়ল।
আমাদের গাড়ি এখন চলেছে মধুপুরের পথে। গিরিডিতে আর থাকতে ইচ্ছে না করলেও ছুটির পর্ব শেষ করে দিতে আমাদের কারোরই মন চাইছিল না।
লালমোহনবাবুর হাতে আবার সেই রেলের বই, ‘নামগুলো শুনুন মশাই একবার– মহেশমণ্ডা, ভাণ্ডারিডি, সুগাপাহাড়ি। শুনলেই মনে হয় একটা অ্যাডভেঞ্চার না হয়ে যায় না। আপনার কিপলিং সাহেব মধুপুর নিয়ে কিছু বলেছেন নাকি?’
‘আরও অ্যাডভেঞ্চার চাই? এ তো সুনির্মলবাবুর মৌমাছিদের মতন অবস্থা আপনার।’
জটায়ুর একটু থতোমতো খেয়ে বললেন, ‘কার কথা বলছেন?’
“সুনির্মল বসু। ওঁর লেখা ছড়া শোনেননি?
‘উড়কি ধানের মুড়কি, ইঁদুর চাটে গুড় কি/টিকটিকিটা বানায় বাড়ি, ফড়িং ভাঙে সুরকি/ মৌমাছিরা মধুর লোভে যাচ্ছে মধুপুর কি?”
ফেলুদার ছড়া শুনে জটায়ু ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসলেন, ‘দেখেছেন কাণ্ড। আপনাকে তো আসল কথাটাই বলা হয়নি।’
‘এখনও আসল কথা বাকি?’ ফেলুদা অবাক।
‘হেঁ-হেঁ, আমিও যে একখানা অ্যাক্রস্টিক বানিয়ে ফেলেছি মশাই- ফেল কভু করে না/ লুটেরাদের ডরে না/ বাগে তাকে পায় কে/ বুদ্ধি আর ধরে না।’
(সমাপ্ত)
.....................................
আগের পর্বগুলি পড়ুন: টেরাকোটা টালমাটাল (চতুর্থ পর্ব)
টেরাকোটা টালমাটাল (তৃতীয় পর্ব)
টেরাকোটা টালমাটাল (দ্বিতীয় পর্ব)
টেরাকোটা টালমাটাল (প্রথম পর্ব)
......................................
অলংকরণ: অভীক কুমার মৈত্র