সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (পঞ্চদশ পর্ব)
[ আগে যা ঘটেছে : হৃষীকেশ কাকুর কাছে গিয়ে অপু আর তপু জানতে পারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারি অফিসার ড্যানিয়েল রিচার্ডসনের ডায়রিতে লিপিবদ্ধ শাহ সুজার চিঠির কথা। তার মধ্যে ছিল সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধনের সংবাদ। এরই মধ্যে রায়পুরের সিমরন হেরিটেজ হোটেলে পাওয়া যায় ড্যানিয়েলের বংশধর ডেরেক রিচার্ডসনের লাশ। এদিকে শাহি খাজানার খবর পেয়ে ব্যগ্র হয়ে উঠেছে হিংসাকুটিল লোভী লুঠেরার দল। অপু তপু আর হৃষীকেশ জড়িয়ে পড়েছেন রহস্যভেদের তদন্তে।]
....................
সাপ্তাহিক উপন্যাস
চতুর্দশ পর্বের পর
.....................
প্রথমবার এরোপ্লেনে চড়ার আনন্দ অর্ধেকটাই মাটি হয়ে গেছে তপুর। টেক অফের মিনিট কুড়ি পরে বিমান-সেবিকারা যখন ট্রলিতে করে খাবার নিয়ে গেল, তপু জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাঁ রে, ভেজ দেবে না ননভেজ?’
অপু বলল, ‘আমাদের দেবে না। ওটা টিকিট কাটার সময়ে যারা অপ্ট করেছে, তাদের জন্য।’
তপু আকাশ থেকে পড়ল।
‘তার মানে?’
‘প্লেনে খাবারের জন্য এক্সট্রা টাকা লাগে। এমনিতেই টিকিটের যা দাম! আর বাড়ি থেকে তো খেয়েই এসেছিস। আবার কী খাবি?’
তপু মনখারাপ করে জানলা দিয়ে মেঘ দেখতে লাগল।
জানলার ধারের এই একটাই সিট কাল ফাঁকা ছিল। তপু আগে কোনোদিন প্লেনে চড়ে নি বলে উইন্ডো সিটটা অপু ওর জন্য বুক করেছে। তিনটে সিট একজায়গায় পাওয়া যায়নি। হৃষীকেশ কাকু বসেছেন কোনাকুনি। প্যাসেজের ওপাশে। কাকুরও এই প্রথম প্লেনে চড়া।
অপু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কাকু ‘হু ওয়াজ শিবাজি’ নামে একটা কমলা রঙের মলাটওয়ালা বই পড়ছেন। হৃষীকেশ কাকুর ডানপাশে ঘিয়ে রঙের সাফারি সুট পরা একটা লোক বসে আছে৷ বছর পঞ্চাশ বয়স। তেল-চুপচুপে ব্যাকব্রাশ-করা চুল। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। গলায় মোটা একখানা সোনার চেন। চেহারাটা অনেকটা ‘কর্ভাস’ গল্পের জাদুকর আর্গাসের মতো।
তপু এখনও মুখ গোমড়া করে আছে। ওর রাগ ভাঙানোর জন্য অপু বলল, ‘ছপ্পন বাজার কটা পর্যন্ত খোলা থাকে রে? হোটেলে পৌঁছে ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়ব।’
***
বুরহানপুরে পৌঁছাতে সওয়া একটা বাজল৷ সকালে অপুরা শুধু চা-বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছিল৷ মাঝরাস্তায় মিনিট পনেরোর জন্য বাস দাঁড়িয়েছিল নর্মদার তীরে খেড়ি ঘাট বলে একটা জায়গায়৷ সেখানেই নাস্তা সেরে নিয়েছিল পুরি-সবজি দিয়ে৷
কাল রাত্রে খাওয়া-দাওয়া কম হয় নি৷ হোটেল থেকে বেরিয়ে তপু বায়না ধরল, গুরুদোয়ারার গলিতে ফুচকা খেতে যাবে৷ তারপরে ছপ্পন বাজারে জিভে-জল-আনা সব স্ট্রিটফুড৷ খিদের মুখে অমৃত৷ শেষে যখন মাহেশ্বরী কুলফি থেকে ম্যাঙ্গো কুলফি খেয়ে সাড়ে দশটার সময়ে ওরা হোটেল গুলমোহর রিজেন্সিতে ফিরল, ফুয়েল ট্যাঙ্ক ফুল৷
বুরহানপুরের হোটেলটার নাম গ্র্যান্ড শিবম৷ একদম লালবাগে ঢোকার মুখেই৷ হাকিমুদ্দিনের দরগা থেকে হাঁটাপথে পাঁচমিনিট৷
ঘরগুলো ফাটাফাটি৷ বাথরুমও সাফসুতরো৷ সব থেকে বড় কথা, এদের নিজস্ব রেস্তোরাঁ আছে৷ যেটা এখানে খুব কম হোটেলেই পাওয়া যায়৷
রুমে মালপত্র রেখে ওরা খেতে ঢুকল৷ হৃষীকেশ বললেন, ‘উজ্জয়িনীতে যদি ট্রেনটা লেট করেও ঢোকে, এতক্ষণে ওরা নিশ্চয়ই চলে এসেছে৷’
অপু বকুনি দিয়ে বলল, ‘অত ভাবতে হবে না৷ মাথা ঠান্ডা করে খাও তো আগে৷’
***
বিকালবেলা অপুরা বেরোল কেল্লা দেখতে৷ বুরহানপুরে দুটো কেল্লা আছে৷ একটা শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে৷ অসিরগড়৷ সেটা এ যাত্রায় দেখা হবে না৷ আরেকটা শাহি কিলা৷ শহরের ভিতরেই৷ কেল্লার ভিতরের গড়নটা একটু ঘোরালো ধরনের বলে এখানকার লোকে বলে ‘ভুলভুলাইয়া’৷
বুরহানপুর খুব প্রাচীন জনপদ৷ হৃষীকেশ কাকু বললেন, এখানে নাকি মাটি খুঁড়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অনেক প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গেছে৷ অষ্টম থেকে দশম শতক পর্যন্ত রাষ্ট্রকূট রাজাদের রাজত্ব ছিল বুরহানপুরে৷ ফারুকি সুলতানদের আমলে জায়গাটা ছিল খান্দেশ রাজ্যের অন্তর্গত৷ ষোলশ এক সালে আকবরের আমলে খান্দেশ মুঘল সুবায় পরিণত হলে বুরহানপুর হয়ে ওঠে দাক্ষিণাত্যের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মুঘল ঘাঁটি৷ আর মুঘলদের পরে হাতবদল হয়ে শহরটা শেষপর্যন্ত যায় ব্রিটিশদের হাতে৷
তপু জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা কাকু, বুরহান কথাটার মানে কী?’
‘বুরহান আরবি শব্দ৷ হজরত মহম্মদের আরেক নাম৷ কথাটার মানে হচ্ছে সাক্ষ্যপ্রমাণ৷ বুরহানপুর নামটা অবশ্য ফারুকি সুলতান মালিক নাসির খান রেখেছিলেন সুফি দরবেশ বুরহানউদ্দিনের স্মৃতিতে৷’
টাঙ্গা থেকে নেমে দুর্গের গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে অপু বলল, ‘এই কেল্লাটাও তো ফারুকি সুলতানদের হাতেই তৈরি৷’
‘হ্যাঁ৷ তবে জাহাঙ্গির আর শাহজাহানের শাসনকালে কেল্লাটা আড়েবহরে আরও বেড়ে ওঠে৷ শাহজাহান বুরহানপুরে অনেক বছর কাটিয়েছিলেন৷ শাহজাহানের দুই ভাই পারভেজ আর খসরু এখানেই নিহত হন৷ আবার এই কেল্লাতেই সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মুমতাজ মহলের মৃত্যু হয় ষোলশ একত্রিশের জুন মাসে৷’
তপু বলল, ‘আমি আগে জানতাম, মুমতাজ আগ্রায় মারা গিয়েছিলেন৷’
‘আগ্রায় মুমতাজের সমাধি আছে বলে ভুল করে অনেকেই এটা ভাবে৷ সবকিছু ঠিক থাকলে কিন্তু তাজমহল এখানেই তৈরি হত৷’
অপু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তাজমহল? বুরহানপুরে? হল না কেন?’
‘তিনটে কারণে৷ এক নম্বর হচ্ছে, গরমকালে তাপ্তী নদীর জল কমে যায়৷ ইমারত বানানোর জন্য প্রচুর জলের প্রয়োজন ছিল৷ যমুনাতে যা পর্যাপ্ত৷ তাছাড়া কনস্ট্রাকশনের কাজে তখনকার দিনে মাটির নিচে কাঠের খুঁটি ব্যবহার করা হয়েছিল৷ বুরহানপুরে ছিল উইপোকার উপদ্রব৷ সব থেকে বড় কথা, সেসময়ে শ্বেতপাথর পাওয়া যেত রাজস্থানের মাকরানায়৷ জায়গাটা বুরহানপুর থেকে প্রায় সাড়ে আটশ কিলোমিটার৷ আগ্রা তার থেকে অনেক কাছে৷’
কেল্লাটা নাকি একসময়ে সাততলা ছিল৷ এখন সব ভেঙেচুরে তিনতলা মাত্র অবশিষ্ট৷ ভিতরের বাগানটা খুব সুন্দর৷ আর দেখার মধ্যে আছে মুমতাজের হামাম বা স্নানঘর৷ হামামের ছাদ আর দেয়াল জুড়ে পারসিক শিল্পরীতির অপূর্ব কারুকার্য ও অলঙ্করণ৷ তপু বলল, ‘এগুলোকে বলে ফ্রেস্কো৷ শান্তিনিকেতনে আছে৷’
সিঁড়ি বেয়ে আরও কিছুটা ওঠার পরে পেল্লায় একটা ছাদ৷ নিচে কেল্লার ঠিক গা ঘেঁষে তাপ্তী নদী এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে৷ বহু দূর অবধি দেখা যায় তার দিগন্তপ্রসারী বিস্তার৷ নদীপথে নৌকা ভেসে চলেছে মন্থর ভাবে খেয়াঘাটের উদ্দেশে৷ নদীর ওপারে আহুখানা৷ নিচে নেমে এসে হৃষীকেশ বললেন, ‘আমরা কাল যাব আহুখানায়৷’
বলতে বলতেই হঠাৎ একটা পাথরের টুকরো ধুপ্ করে এসে পড়ল হাতখানেক দূরে৷ অপু আর তপু ছিটকে সরে গেল দেয়ালের দিকে৷ হৃষীকেশ উপরের দিকে তাকালেন৷ কেউ কোথাও নেই৷ পাথরটা আধলা ইঁটের থেকে অল্প একটু বড়৷ দুয়েক সেকেন্ডের এদিক-ওদিক হলেই মাথার খুলি গুঁড়িয়ে যেত৷
হৃষীকেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘উৎপাত আরম্ভ হল৷’
অপু ব্যাপারটা হালকা করার জন্য বলল, ‘টেনশন করছ কেন? সবাই তো একসঙ্গে আছি৷’
‘একসঙ্গে আছি বলেই আরও বেশি চিন্তা হচ্ছে৷’
***
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল ঘন্টাদেড়েক পরে৷ হাকিমি মসজিদের ঠিক সামনে৷
হোটেলে ফেরার পথে টাঙ্গাওয়ালা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপলোগো নে কালা তাজমহল দেখা?’ অপু আগেই কোথাও একটা পড়েছিল, এখানে তাজমহলের মতো দেখতে কালো পাথরে তৈরি একটা সমাধিসৌধ আছে৷ শাহনওয়াজ খানের৷ তারই নাম কালা তাজ৷
হৃষীকেশ প্রশ্ন করলেন, ‘যাবে?’
তপু উত্তর দিল, ‘গেলেই হয়৷’
অপু বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরেই বা কী করব?’
কালা তাজ দেখে ফেরার সময়ে দরগা রোডের মুখে টাঙ্গাটাকে ছেড়ে দেওয়া হল৷
রাস্তার ধারের একটা চায়ের দোকানে মিনিট পাঁচেকের জন্য দাঁড়িয়েছিল অপুরা৷ চা হচ্ছে৷ দোকানদার বললেন, ‘দো মিনট রুক যাইয়ে ম্যাডাম৷ শক্কর মিলা রহা হুঁ৷’
মাগরিবের নমাজ সেরে তখন মসজিদ থেকে লোক বেরোচ্ছে৷ চার-পাঁচজন জটলা করেছে চায়ের দোকানের সামনেও৷ তাদেরই মধ্যে একজন হঠাৎ হ্যাঁচকা টান মারল হৃষীকেশের হাত ধরে৷ আর সঙ্গে সঙ্গে একটা কালো টয়োটা প্রায় গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল বিদ্যুদ্বেগে৷
মুহূর্তের মধ্যে রাস্তায় লোক জড়ো হয়ে গেল৷ অপরিচিত মানুষ উদ্বিগ্ন ভাবে ঘিরে ধরে কুশল প্রশ্ন করতে লাগলেন৷ দুয়েকজন বললেন, ‘খুদা নে বচা লিয়া৷’
***
হোটেলে ফিরে এসেই অপু রিজওয়ানুর কাকুকে কল করল৷
‘বল৷ কখন পৌঁছালি?’
‘দেড়টার দিকে৷ … তোমার সঙ্গে ওঁর আর কথা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, তোর হোয়াটস্যাপ মেসেজটা ফরোয়ার্ড করে দিয়েছি৷ টেলিফোনেও কথা হয়েছে৷’
‘কিছু বললেন?’
‘মিটিংয়ে ছিল৷ ওইজন্য তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়েছে৷ হোয়াটস্যাপে একটা রিপ্লাই পেলাম একটু আগে ৷’
‘কী লিখেছেন?’
‘ডোন্ট ওরি৷ উই শ্যাল হ্যান্ডল ইট৷’
ফোনটা ছেড়ে দিয়ে অপু অনেকক্ষণ ঘর অন্ধকার করে চুপচাপ বসে থাকল৷ নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলে মানুষ বোধহয় স্তব্ধ হয়ে যায়৷
***
হৃষীকেশ কাকু একটু ভয় পেয়ে গেছেন৷ ডিনারের সময়ে বললেন, ‘মিছিমিছি তোমাদের এই বিপদের মধ্যে নিয়ে এলাম৷ ভীষণ বোকামি করে ফেলেছি৷’
অপু এবার কড়া গলায় বলল, ‘দ্যাখো কাকু, আমাকে কেউ ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসবে, এত ছোট আমি আর নেই৷ রিস্ক আছে জেনেই এসেছি৷ আর এভাবে ওরা অ্যাটেম্পট না করলেই বরং অবাক হতাম৷’
তপু বলল, ‘আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি৷ আমার কাছে দুর্দান্ত একটা জিনিস আছে৷’
অপু জিজ্ঞাসা করল, ‘কী জিনিস?’
‘উঁহু, এখন সেটা ডিসক্লোজ করা যাবে না৷ সারপ্রাইজ৷’
অপু ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘বোকা বোকা কথা৷’
(আগামী সপ্তাহে সমাপ্য)
আগের পর্ব পড়ুন :
সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (চতুর্দশ পর্ব) / তপোব্রত ভাদুড়ি