উপন্যাস

সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (চতুর্দশ পর্ব)

তপোব্রত ভাদুড়ি June 25, 2023 at 4:28 am উপন্যাস

[ আগে যা ঘটেছে : হৃষীকেশ কাকুর কাছে গিয়ে অপু আর তপু জানতে পারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারি অফিসার ড্যানিয়েল রিচার্ডসনের ডায়রিতে লিপিবদ্ধ শাহ সুজার চিঠির কথা৷ তার মধ্যে ছিল সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধনের সংবাদ। এরই মধ্যে রায়পুরের সিমরন হেরিটেজ হোটেলে পাওয়া যায় ড্যানিয়েলের বংশধর ডেরেক রিচার্ডসনের লাশ। এদিকে শাহি খাজানার খবর পেয়ে ব্যগ্র হয়ে উঠেছে হিংসাকুটিল লোভী লুঠেরার দল। অপু তপু আর হৃষীকেশ জড়িয়ে পড়েছেন রহস্যভেদের তদন্তে।]

....................

সাপ্তাহিক উপন্যাস 

ত্রয়োদশ পর্বের পর 

..................... 

চেয়ারটা পিছন দিকে হেলিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে দোল খেতে খেতে রিজওয়ানুর বললেন, ‘ব্যাপারটা একটু রিস্কি হয়ে যাচ্ছে না?’

অপু জবাব দিল, ‘তা একটু হচ্ছে৷ কিন্তু উপায় কী বলো। ডেথ সার্টিফিকেট বেরিয়ে গেছে। কেস ফাইল ক্লোজড। আর শোনা কথার ওপরে ভরসা করে তো তুমি হুটহাট সার্চ করতে পারো না।’

‘দ্যাটস দ্য পয়েন্ট।’

তপু বলল, ‘এটা ছাড়া আর অপশন নেই।’

‘যদি স্পেকুলেশনটা ফেল করে? সবটাই তখন পণ্ডশ্রম।’

অপু বলল, ‘তাহলে তো চুপচাপ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। উই কান্ট অ্যাফোর্ড দ্যাট।’

রিজওয়ানুর বললেন, ‘আচ্ছা, কী করতে হবে বল৷’

‘ওখানে তোমার চেনাজানা কেউ আছেন?’ 

‘অ্যাডিশনাল ডিসিপি হেডকোয়ার্টারকে চিনি৷ এসভিপির অ্যালুমনা৷ ফেজ টু-তে আলাপ হয়েছিল।’

অপু বলল, ‘একটু দ্যাখো না গো কনট্যাক্ট করে। খুব সুবিধা হয় তাহলে।’

‘দেখছি। দাঁড়া।’

‘শিডিউলটা তোমাকে পরে হোয়াটস্যাপ করে দেব।’

রিজওয়ানুর চেয়ার সোজা করে তপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দর্পণ, তোমার গান আর শোনা হচ্ছে না।’

 

***

ডেনিস রিচার্ডসনের নম্বরটা হৃষীকেশ আগের দিনই ফোনে তুলে রেখেছিলেন। স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় একবার কল করলেন৷ তিনবার রিং হওয়ার পরে ওপ্রান্ত থেকে সেই অদ্ভুত ফ্যাঁশফ্যাঁশে গলাটা ভেসে এল।

‘হ্যালো।’

‘নমস্কার৷ আমি হৃষীকেশ গুপ্ত বলছি। চিনতে পারছেন?’

‘বলুন মিস্টার গুপ্ত।’

‘আপনাকে এমনি একটা দরকারে ফোন করেছিলাম।’

‘কী ব্যাপার?’

‘ড্যানিয়েলের ডায়রিটা পড়তে গিয়ে ভিতরে আপনাদের একটা গ্রুপ ফোটো পেলাম৷’

‘হোয়াট?’

‘বোধহয় কোনো ফ্যামিলি পিকনিকের৷ পিছনে বোটানিকাল গার্ডেন নাইনটি এইট লেখা৷’

‘ও৷’

‘আচ্ছা, আপনার কি দুই ছেলে? টুইন? ফোটোতে দেখলাম৷ পিছনে ডেভিড রিচার্ডসন বলে একজনের সই রয়েছে৷’

উল্টোদিক থেকে মিনিটখানেক কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে হৃষীকেশ আবার বললেন, ‘একদিন সময় করে আপনাকে ফোটোটা ফেরত দিয়ে আসব৷ আমি আসলে কয়েকটা দিন থাকছি না৷ বুরহানপুরে যাচ্ছি৷’ 

‘আপনি কি এখন রয়্যাল ট্রেজার নিয়ে রিসার্চ করছেন?’

‘ঠিক রিসার্চ নয়৷ ডায়রিতে বেশ কয়েকটা ইন্ডিকেশন পাচ্ছি৷ একবার তাই ফিল্ড ভিজিট করে আসব ভাবলাম৷’

‘কবে যাচ্ছেন?’

হৃষীকেশ বললেন, ‘চব্বিশে বেরোচ্ছি৷ স্যাটারডে৷ সমরসত্তায়৷ ভুসাওয়াল থেকে চেঞ্জ করব৷ ছাব্বিশে পৌঁছে আবার আঠাশে ব্যাক করছি৷ মুম্বই মেলে৷’

‘হোটেল বুক করেছেন?’

‘না৷ হোটেল পেয়ে যাব৷ চিন্তা নেই৷ এখন তো অফ সিজন৷ এমনিতেও ওখানে টুরিস্টের রাশ কম৷’

‘একা যাচ্ছেন?’

‘সেইরকমই পরিকল্পনা৷’

‘নাইস৷ করে আসুন ফিল্ড ভিজিট৷’

হৃষীকেশ বললেন, ‘ফিরে এসে ফোটোটা দিয়ে আসব৷’

‘টেক ইয়োর টাইম৷ আয়্যাম নট ইন হারি৷’

‘আচ্ছা৷ রাখছি’ বলে হৃষীকেশ ফোন ছেড়ে দিলেন৷ 


***

উবরে উঠে তপু প্রশ্ন করল, ‘তোর কি মনে হয়, ওখানে গেলে গুপ্তধন পাওয়া যাবে?’

অপু বলল, ‘কেন? তোর লাগবে?’

‘আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না৷ শাহজাহান তো অনেকদিন আগে পুঁতে রেখেছিলেন৷ এর মধ্যে যদি কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে থাকে? দ্যাখ, হয়ত ওঁর ছেলেপুলেরাই সরিয়ে ফেলেছে৷ আওরঙ্গজেবের শুনেছি শেষের দিকে হাত খালি হয়ে গেছিল৷’

‘আমি একটা অন্য কথা ভাবছি৷’

তপু জিজ্ঞাসা করল, ‘কী কথা?’

‘সুজা চিঠিটা লিখেছেন ষোলশ একত্রিশে৷ শাহজাহান তখন দাক্ষিণাত্য অভিযানে গিয়েছিলেন৷ বুরহানপুর ছিল ডেকানের হেডকোয়ার্টার৷’

একটু থেমে অপু আবার বলল, ‘একটা আনরিজলভড মিলিটারি ক্যামপেনের সময়ে খামখা দিল্লি থেকে বহুমূল্য ধনরত্ন নিয়ে গিয়ে শাহজাহান বুরহানপুরে লুকিয়ে রাখবেন, এটার কোনো অর্থ হয় না৷’

‘তার মানে গুপ্তধন নেই বলছিস?’

‘শাহজাহানই জানেন৷’

তপু হেসে বলল, ‘তাহলে প্ল্যানচেট করে ডাকতে হবে শাহজাহানকে৷’

অপু বলল, ‘হ্যাঁ, এসে তোকে বলে দিয়ে যাবেন৷ তেঁতুল-বটের কোলে দক্ষিণে যাও চলে৷’


***

পান্নালালের গলায় ‘ওই শ্যামা বামা কে’ শেষ হতেই জগন্নাথ বসু বললেন, ‘শুনছেন মির্চি কালী-কথা’৷ এখন ঝাড়া একমিনিট অ্যাড হবে৷ চটপট তিনটে দুধের প্যাকেট সসপ্যানে চাপিয়ে দিল বান্টি৷ সেইসময় অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে আড়মোড়া ভেঙে দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল রঘুবীর৷

বান্টি খোশগল্পের ছলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কা হাল বা?’

‘হাম ত বঢ়িয়া বানি৷’

‘চায়ে চাহিঁ কা?’

‘না, এক শান্তি আ এক শেখর দে দিঁ৷’


ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মসলার পুরিয়া মুখে ঢেলে পকেট থেকে ফোনটা বার করল রঘুবীর৷ 

‘রাম রাম সাহিব৷’

বান্টি এফএমের ভলিউমটা কমিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কান খাড়া করল৷ 

‘হাম আজ উজ্জয়িন যা রহে হ্যায়৷ টিরেন সে৷’ 

চাপা গলায় কথা বলতে বলতে কয়েক পা দূরে আরেকটু নিরিবিলিতে সরে গেল রঘুবীর৷


***

স্কুলে বেরোনোর মুখেই অমলের ফোন পেলেন হৃষীকেশ৷ 

‘শিগগিরি বল৷ এখখুনি বেরোব৷’

‘উজ্জয়িনী যাচ্ছে৷ ট্রেনে৷’ 

হৃষীকেশ ঘাড় কাত করে জুতোর ফিতেয় গেরো বাঁধতে বাঁধতে উত্তেজনায় অধীর হয়ে বললেন, ‘কনফার্মড?’

‘ওইটুকুই ওর কানে এসেছে৷’

‘দুজনেই বেরিয়ে গেছে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

‘তোকে যে কী বলে—’

অমলকান্তি বললেন, ‘ধ্যাৎ৷ রাখ৷ তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে৷’

‘আচ্ছা, তোকে বিকালে ফিরে ফোন করব৷’


***

হেডমাস্টার বললেন, ‘আবার ছুটি? এই তো কদিন আগে ছুটি নিয়ে ঘুরে এলেন৷’

হৃষীকেশ একটু অপ্রতিভ হয়ে বললেন, ‘আসলে খুব দরকারি একটা কাজ পড়ে গেছে, স্যার৷ সেইজন্যই৷’


স্কুল শেষ৷ ছাত্ররা অনেকক্ষণ বাড়ি চলে গেছে৷ স্টাফরুমও ফাঁকা৷ ছুটির কথাটা হেডস্যারকে একটু আলাদা করে বলবেন বলে হৃষীকেশ বিকালের দিকের এই সময়টা বেছে নিয়েছিলেন৷  


‘এত ছুটি নিলে সিলেবাস শেষ হবে কী করে? এমনিতেই এবারে সামার ভ্যাকেশনে এতগুলো দিন নষ্ট হল৷’

‘শেষ করে ফেলব স্যার৷ সিলেবাস অনেকটাই হয়ে গেছে৷’

‘ক্লাস টেনের কী অবস্থা?’

‘ওদের এখন টেস্টপেপার করাচ্ছি৷’

‘কদিন ছুটি নেবেন?’

হৃষীকেশ বললেন, ‘ছাব্বিশ থেকে আঠাশ৷ পরের দিন ইদের ছুটি আছে৷’

‘সিএল?’

‘হ্যাঁ স্যার৷’

‘আচ্ছা, একটা দরখাস্ত করে দিন৷’


স্কুলের গেট দিয়ে সূর্য সেন স্ট্রিটে বেরিয়ে এসে হৃষীকেশ তপুকে ফোন করলেন৷

‘তর্পণ, তোমরা চলে এসেছ?’

‘এই জাস্ট ঢুকলাম৷ তুমি কখন ফিরবে?’

‘আমি মিনিট কুড়ির মধ্যেই ঢুকছি৷ আর বোলো না, ছুটি চাইতে গেলেই হেডস্যার এমন ঝামেলা করেন৷ … বোসো একটু৷’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এসো৷’


***

অপু জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা কি তাহলে ভোপাল হয়ে যাচ্ছি?’

হৃষীকেশ বললেন, ‘ইন্দোর৷ ওরা যদ্দুর সম্ভব দুপুরে আহমেদাবাদ উইকলি ধরেছে৷ উজ্জয়িনী থেকে বাস কিংবা গাড়িতে যাবে৷’ 

অপু বলল, ‘ট্রেনে গেলে তো আমাদের দুদিন লেগে যাবে৷’

তপু প্রশ্ন করল, ‘বন্দেভারত টাইপের হাইস্পিড কিছু নেই?’

হৃষীকেশ উত্তর দিলেন, ‘ফ্লাইটে যেতে হবে৷’

অপু বলল, ‘দাঁড়াও, এখখুনি দেখছি৷ … কাল সাড়ে পাঁচটায় একটা ফ্লাইট আছে৷ বিকালে৷ ননস্টপ৷ ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের৷ বুক করব?’

হৃষীকেশ বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কেটে ফ্যালো৷ আমার কার্ডটা দিচ্ছি, দাঁড়াও৷’

তপু জিজ্ঞাসা করল, ‘ইন্দোর থেকে কীভাবে যাবে?’

‘ভলভো বাস পাওয়া যাবে৷ চার-পাঁচ ঘন্টার জার্নি৷’

তপু বলল, ‘রেডবাসে দেখব?’

‘দ্যাখো৷’

অপু বলল, ‘টিকিট ফেয়ার অনেক চাইছে, কাকু৷’

‘কত বলছে?’

‘সাড়ে নয় মতো৷’

তপু জিজ্ঞাসা করল, ‘তিনজনের?’

‘তোর মুন্ডু৷ এক একজনের৷’

হৃষীকেশ বললেন, ‘ওসব ভেবে এখন লাভ নেই৷ কালকের টিকিট আজকে তো হাই হবেই৷ এখখুনি বুক করে দাও৷’

তপু অপুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইন্দোরে অ্যারাইভাল কটায় রে?’

‘সাতটা পঁয়তাল্লিশ৷’

‘আচ্ছা কাকু, বুরহানপুরটা কোথায়? এখানে তিনটে বুরহানপুর দেখাচ্ছে৷ ইউপি, এমপি আর মহারাষ্ট্র৷’

‘মধ্যপ্রদেশ৷’

‘আচ্ছা৷ নটা পঁয়তাল্লিশে আছে সিটিজেন ট্রাভেলসের ননএসি স্লিপার৷ টু প্লাস ওয়ান৷’

অপু বলল, ‘এসি দ্যাখ৷’

‘আটটা কুড়িতে আছে, তারপরে সাড়ে আটটায় …’

অপু বলল, ‘না না, এয়ারপোর্ট থেকে অত তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে না৷ তুই আমাকে দে৷’

‘আরে, আমি দেখছি তো৷’

হৃষীকেশ বললেন, ‘আমার মনে হয়, নাইট জার্নি না করে ইন্দোরে যদি আমরা স্টে করি, ভালো হবে৷ পরেরদিন ভোর ভোর বেরিয়ে যাব৷ নাহলে একটানা অতক্ষণ জার্নি৷ ঘুম হবে না৷ খাওয়া হবে না৷ খুব এগজস্টেড লাগবে৷’

তপু বলল, ‘সকালে সওয়া সাতটা আর আটটায় বাস আছে৷’

অপু বলল, ‘আটটারটাই বুক কর৷’

তপু বলল, ‘এটা কিন্তু আর তুমি দেবে না, কাকু৷’

হৃষীকেশ হাসলেন৷

তপু বলল, ‘বেশ একটা উত্তেজনা হচ্ছে৷ হোটেলটাও বুক করে ফেলতে হবে৷’

অপু বলল, ‘তুই একদম হোটেল বুক করবি না৷ বাথরুম নোংরা থাকলে খুব ঘেন্না করে আমার৷’

‘আচ্ছা৷ তুই করিস৷’

‘করবই তো৷ গত মাসেই ফেলোশিপের অ্যালাউন্স পেয়েছি৷’


তপু নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, ‘ইন্দোরে নাইট স্টে করার প্ল্যানটা ভালো হয়েছে৷ ওখানে ছপ্পন বাজার বলে একটা খুব সুন্দর জায়গা আছে, বুঝলে কাকু৷ খুব ভালো ভালো খাবার পাওয়া যায়৷ এইমাত্র গুগলে দেখলাম।’


(চলবে)


আগের পর্ব পড়ুন : 

সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (ত্রয়োদশ পর্ব)

........................  

[অলংকরণ : বিবস্বান]  



#সাপ্তাহিক উপন্যাস #রহস্য উপন্যাস #Thriller #Crime Thriller #কিশোর রহস্য উপন্যাস #সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন #তপোব্রত ভাদুড়ি #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

91

Unique Visitors

183111