সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (ত্রয়োদশ পর্ব)
[ আগে যা ঘটেছে : মুম্বই মেলে হাওড়ায় আসার পথে অপরাজিতার এক সহযাত্রীর সুটকেস চুরি হয়৷ লোকটিকে রেলপুলিশের কাছে ডায়রি করতে পরামর্শ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হুমকি চিরকুট পায় অপু। পরে হৃষীকেশ কাকুর কাছে গিয়ে অপু আর ওর মাসতুতো ভাই তপু জানতে পারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারি অফিসার ড্যানিয়েল রিচার্ডসনের ডায়রিতে লিপিবদ্ধ শাহ সুজার চিঠির কথা, যার মধ্যে ছিল সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধনের সংবাদ। এরই মধ্যে রায়পুরের সিমরন হেরিটেজ হোটেলে পাওয়া যায় ড্যানিয়েলের বংশধর ডেরেক রিচার্ডসনের লাশ। ড্যানিয়েলের বিষয়ে অনুসন্ধানের সূত্রে ডেরেকের বাবা ডেনিসের সঙ্গে হৃষীকেশ গুপ্তর সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে সুজার চিঠিটি দেখান। এদিকে রঘুবীরের কাছ থেকে বুরহানপুরের গুপ্তধনের খবর পেয়ে মিস্টার দারুওয়ালার মতো কুটিল মানুষও ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন শাহি খাজানা লুঠ করার লোভে। ডেরেকের হত্যা সম্পর্কে কয়েকটা খটকা দূর করতে অপুরা গেছিল রায়পুরে। ]
....................
সাপ্তাহিক উপন্যাস
দ্বাদশ পর্বের পর
.....................
তপু ভোরেই বেরিয়ে গেছে৷ অপু উঠল সাড়ে আটটায়৷ ট্রেনে একটুও ঘুম হয়নি।
স্নান সেরে অপু অ্যাপামিন আর লিউরোটক্সিনের অ্যামিনো অ্যাসিড সিকুয়েন্সের একটা কমপ্যারিজন টেবল বানাতে বসেছিল৷ এমন সময়ে রিজওয়ানুর কাকু ফোন করলেন।
‘ফিরেছিস?’
‘হ্যাঁ কাকু। আমরা কালই ফিরে এসেছি।’
‘ওদিকের কী খবর?’
‘তোমার সঙ্গে দেখা করব একদিন৷’
‘লালবাজারে?’
‘হ্যাঁ৷’
‘আচ্ছা৷ পরশু আয়৷ কাল মানিকতলায় ভিজিটে বেরোবো৷’
‘ঠিক আছে৷’
***
গড়িয়াহাট-গোলপার্ক-যাদবপুরের দিকটা চিরকালই খুব গোলমেলে লাগে হৃষীকেশের৷ উত্তরের মানুষ দক্ষিণে এলে রাস্তা গুলিয়ে যায়৷ বারো নম্বর যতীন বাগচী রোড খুঁজে বার করতে বেশ খানিকক্ষণ সাদার্ন এভিনিউ ধরে ঘোরাঘুরি করতে হল৷
স্কুল ছুটির পরে মনসুখানির সঙ্গে দেখা করার জন্য বেরিয়েছিলেন৷ লোকটা ডেরেকের ওপরে মহা খাপ্পা৷ নাম শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘এক নম্বার কা শয়তান! উসকি বজা সে মেরা সওয়া তিন লাখ ঝান্ডু হো গ্যয়া৷’ ডেরেকের মৃত্যুসংবাদও উনি পেয়েছেন৷ টেলিগ্রাফে ছোট করে বেরিয়েছিল৷ সেখান থেকে৷
বাড়ি ফিরতে পৌনে আটটা বাজল৷ দেরি দেখে ফাল্গুনি চিন্তা করছিল৷ দরজা খুলেই বলল, ‘এখখুনি ভাবছিলাম ফোন করব৷’
একটু পরে পড়ার ঘরে চা দিতে এসে ফাল্গুনি বলল, ‘তোমাকে বলা হয়নি৷ সেদিন একজন খোঁজ করছিল৷’
‘কে বল তো?’
‘ধারওয়ালা৷’
‘ছুরি-কাঁচি-ধারওয়ালা?’
‘আরে না না৷ লোকটার নাম ধারওয়ালা৷’
‘দেখতে কেমন?’
‘অনেকটা নবদ্বীপ হালদারের মতো৷ তবে চোখের চাউনিটা যেন কেমন৷’
ধারওয়ালা নামে কস্মিনকালেও কাউকে চেনেন বলে হৃষীকেশের মনে পড়ল না৷
চা খেয়ে হৃষীকেশ অমলকে ফোন করলেন৷
‘কী খবর ভায়া?’
‘খবর তো তুই দিবি৷ তোর সিক্রেট সার্ভিস কী বলছে?
‘ফেরার পথে একবার গিয়েছিলাম৷ প্রবেশ-প্রস্থানের খবর নেই৷ তবে রঘুবীরের সঙ্গে বান্টি আজ ভাব পাতিয়েছে৷ লোকটার নাকি বেগুসরাইতে বাড়ি৷ বুড়োটাকে দেখভাল করার জন্য ওকে রেখেছে৷’
‘ভেরি গুড৷’
‘তুই কোথায় এখন?’
‘স্নান করে ধূপ জ্বেলে চুপ করে নীলকুঠুরিতে৷’
‘আমি রুটি কিনতে বেরিয়েছি৷’
‘আচ্ছা৷ তাহলে রাখ এখন৷’
‘টাটা৷’
***
স্কুল থেকে হৃষীকেশ আজ কলেজ স্ট্রিটে গিয়েছিলেন৷ বাড়ি ফিরে দেখলেন, ফাল্গুনি বৈঠকখানায় বসে তপুদের সঙ্গে বিধবা গ্রামের গল্প জুড়েছে৷
‘কখন এসেছ?’
তপু বলল, ‘এই তো খানিকক্ষণ আগে৷’
‘এসো এসো, ভিতরে এসে বোসো৷’
হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে হৃষীকেশ কিছুক্ষণ পরে এলেন৷
অপু বলল, ‘কাল হয়ত আমাদের একবার লালবাজারে যেতে হবে৷ রিজওয়ানুর কাকু ফোন করেছিলেন৷ আমি কিছু বলি নি৷’
‘বেশ তো৷ রিজওয়ানুরকে বলাই যায়৷ তবে এখনই কোনো অ্যাকশন নেওয়ার দরকার নেই৷ হাতেনাতে ধরতে হবে৷’
অপু বলল, ‘পুলিশ তো আমাদের মুখের কথা শুনবেও না৷ কাকুকে এমনি আনঅফিশিয়ালি জানাব৷’
ফাল্গুনি কাকা আজ ঘি আর বাদাম দিয়ে চিড়ে ভাজা বানিয়েছেন৷ কাঁসার বাটিতে করে খাবার দিয়ে বলে গেলেন, ‘গরম আছে কিন্তু৷ আস্তে আস্তে খাও৷’
খেতে খেতে অপু হৃষীকেশকে জিজ্ঞাসা করল, ‘খুনটা কি তাহলে গুপ্তধনের লোভেই?’
‘যদ্দুর মনে হচ্ছে, সেটাই প্রথম এবং প্রধান মোটিভ৷ তবে তার সঙ্গে বোধহয় গা ঢাকা দেওয়ার একটা মতলব ছিল৷’
অপু বলল, ‘গা ঢাকা দেওয়া?’
‘কাল যতীন বাগচী রোডে গিয়েছিলাম৷ মনসুখানি লোকটার কাছে৷’
‘তারপর?’
‘ডেরেক ওর সঙ্গে শেয়ার-ট্রেডিংয়ের কাজ করত৷ সরে পড়ার আগে প্রায় লাখতিনেক টাকা তছরুপ করেছে৷’
তপু প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু খুনের সঙ্গে গা ঢাকা দেওয়ার কী সম্পর্ক?
‘খুবই সহজ৷ আমারই মতো আরেকজনকে আমি গোপনে সরিয়ে দিলাম৷ আর পুরো ব্যাপারটা এমন ভাবে সাজালাম, যাতে মনে হয়, আমিই খুন হয়েছি৷’
অপু বলল, ‘এক ঢিলে দুই পাখি৷’
তপু বিজ্ঞভাবে মন্তব্য করল, ‘আমার কিন্তু মনে হয়, এসব অভিশপ্ত ব্যাপার৷’
অপু জিজ্ঞাসা করল, ‘কীসের অভিশাপ?’
‘এই যে সুজার চিঠি-ফিঠি৷ সুজাকে তো আওরঙ্গজেব খুন করেছিলেন৷ দারাকেও৷’
হৃষীকেশ বললেন, ‘সুজা খুন হয়েছিলেন আরাকানের রাজার হাতে৷ আওরঙ্গজেবের হাতে নিহত হন মুরাদ আর দারা৷ তবে এই খুন আর ওই খুন এক নয়৷ রাজারাজড়াদের মধ্যে এসব খুব কমন৷ ভ্রাতৃহত্যা মহাভারতেই আছে৷ শোনা যায়, ধর্মাশোকও ভাইদের বধ করে নিষ্কন্টক হয়েছিলেন৷ আর মুঘলদের মধ্যেও আওরঙ্গজেবই কিন্তু প্রথম নন৷ শাহজাহানও সিংহাসনে বসার জন্য খসরু, পারভেজ আর শাহরিয়ারকে নির্মম ভাবে সরিয়ে দিয়েছিলেন৷ এসব হচ্ছে সত্তারক্ষার জন্য ধস্তাধস্তি৷ স্ট্রাগল ফর একজিস্ট্যান্স৷ অ্যান্ড সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট৷ ডারউইন৷’
অপু কৌতুক করে বলল, ‘ডারউইন এখন সিলেবাসে নেই৷’
তপু একটুও দমে না গিয়ে বলল, ‘আওরঙ্গজেব এমনিতেও খুব বদমাইশ লোক ছিলেন৷ জিজিয়া চালু করেছিলেন৷ হিন্দু মন্দির ভেঙেছেন৷ বঙ্কিমের নভেলে পড়েছি৷’
অপু বলল, ‘যদুনাথ সরকারও লিখেছেন৷ গানবাজনা পর্যন্ত পছন্দ করতেন না৷’
হৃষীকেশ বললেন, ‘এসব ডাহা মিথ্যা৷ যদুনাথ বায়াসড্৷ শিবাজিকে বড় করতে গিয়ে মুঘল হিস্ট্রিকে ম্যানিপুলেট করেছেন৷’
তপু রুখে উঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘আওরঙ্গজেব জিজিয়া চালু করেন নি?’
‘করেছিলেন৷ ১৬৭৯-তে৷ সিংহাসনে বসার বাইশ বছর পর৷ ধর্মান্ধতার কারণেই যদি করে থাকেন, তাহলে বাইশ বছর অপেক্ষা করার কোনো যুক্তি ছিল কি? আর হিন্দুদের যেমন জিজিয়া দিতে হত, মুসলমানদের তেমনই ছিল জাকাৎ৷ গরিবগুর্বোদের কখখনো জিজিয়া দিতে হত না৷ মিরাতুল আলমে আছে৷ গৌতম ভদ্রের বইতেও পাবে৷’
অপু বলল, ‘বুঝলাম৷ কিন্তু মন্দির ভাঙার ব্যাপারটা?’
হৃষীকেশ উত্তর দিলেন, ‘মথুরায় কেশব রাইয়ের মন্দির ভেঙেছিলেন বীরসিং বুন্দেলার সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের কারণে৷ আকবরের বন্ধু আবুল ফজলকে হত্যা করে বীরসিং তাঁর ধনসম্পদ লুঠ করেন৷ মন্দিরটা তৈরিই হয়েছিল সেই লুঠের টাকায়৷ মিরাতুল খয়ালে আছে৷ আর কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের সঙ্গে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার জড়িয়ে ছিল৷’
তপু জিজ্ঞাসা করল, ‘কী বিচ্ছিরি ব্যাপার?’
‘আওরঙ্গজেবের বাংলা অভিযানের সময়ে অনেক হিন্দু রাজা তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন৷ বেনারসের কাছে এসে রাজমহিষীরা গঙ্গাস্নান করে বিশ্বনাথকে পূজা নিবেদন করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন৷ আওরঙ্গজেব সঙ্গে সঙ্গে যাত্রাবিরতির আদেশ দেন৷’
হৃষীকেশ একটুক্ষণের জন্য নীরব হতেই অপু বলল, ‘তারপর?’
‘পূজা শেষ করে রানিরা শিবিরে ফিরে এলে দেখা গেল, তাঁদের মধ্যে একজন নিখোঁজ৷ কচ্ছের রানি৷ গোটা বেনারস তোলপাড় করে খুঁজে শেষপর্যন্ত তাঁকে পাওয়া গেল মন্দিরের নিচে৷ মাটির তলার একটা গুমঘরে৷ রাজারা ক্রুদ্ধ হয়ে বিহিত চাইলেন৷ আওরঙ্গজেব তখন বিশ্বনাথের বিগ্রহকে অন্য জায়গায় সরিয়ে দিয়ে কলঙ্কিত দেবদেউলটি ভেঙে ফেলার আদেশ দিলেন৷’
অপু বলল, ‘এসব কি সত্যি?’
হৃষীকেশ বললেন, ‘বি এন পান্ডের লেখায় পাবে৷ পট্টভি সীতারামাইয়াও লিখে গেছেন দ্য ফেদার্স অ্যান্ড দ্য স্টোনস বইতে৷’
তপু বলল, ‘আর অন্য মন্দিরগুলো?’
‘তপু, আওরঙ্গজেব যদি সব মন্দির ভেঙে মসজিদ বানাতে চাইতেন, তাহলে ভারতে কোথাও আর একটাও মন্দির থাকত না৷ আওরঙ্গজেব শুধু সেইসব মন্দিরই ভেঙেছিলেন, যেগুলো দেবোত্তর সম্পত্তির ছল করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার লোভে যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছিল৷ কিংবা যেগুলো ধর্মীয় হিংসায় উস্কানি ছড়াত৷’
তপু বলল, ‘এসব মনগড়া কথা৷’
‘আচ্ছা, আওরঙ্গজেবের মন্দির ভেঙে ফেলার কাহিনি তো অনেক শুনেছ৷ তোমরা কি জানো, আওরঙ্গজেব কত মঠ আর মন্দিরকে অকাতরে অর্থসাহায্য করেছিলেন? বঙ্কিম বা যদুনাথকে আমি তত দোষ দিই না৷ তখন নথিপত্র অপ্রতুল ছিল৷ কিন্তু এখন যেসব তথ্য আমাদের হাতে আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, বহু হিন্দু মন্দিরের ভূমিদান সনদে আওরঙ্গজেবের নাম আছে৷ যেমন ধরো, তারকেশ্বরের মন্দিরের জমিটা আওরঙ্গজেব দিয়েছিলেন৷ তারপর উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দির, গৌহাটির উমানন্দ মন্দির৷ এরকম আরও অনেক মন্দিরে আওরঙ্গজেবের ফরমান আছে৷ ফরমানগুলো বেশ মজার৷ বেশিরভাগ ফরমানেরই শেষে লেখা হচ্ছে — অতএব আমাদের শাহি হুকুম হল, আমাদের আল্লাহ-প্রদত্ত সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য পূজক ব্রাহ্মণরা যেন প্রশান্ত চিত্তে পূজার্চনা চালিয়ে যেতে পারে৷ বোঝো কাণ্ড!’
অপু হেসে বলল, ‘এসব কোথায় পাবো?’
‘বি এন পান্ডের বইতে পাবে৷ রেখা জোশিও লিখেছেন৷ আর খুব ভালো কাজ আছে জ্ঞানচন্দ্রের৷ তবে সেগুলো ছাপা হয়েছে জার্নাল অফ পাকিস্তান হিস্টোরিকাল সোসাইটিতে৷’
‘আচ্ছা৷’
‘আর গানবাজনার কথা বলছিলে? বার্নিয়ের লিখেছেন, ছাদে দাঁড়ালে সম্রাটের প্রাসাদ থেকে সুন্দর নহবত শোনা যায়৷ আওরঙ্গজেবের নির্দেশ হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওপর অসামান্য একটা বই লিখেছিলেন মির্জা খান৷ তোহফাতুল হিন্দ৷ ফকিরুল্লার রাগদর্পণ বইটা উৎসর্গ করা হয়েছে খোদ আওরঙ্গজেবকেই৷ আর আওরঙ্গজেব নিজে খুব সুন্দর বীণা বাজাতেন৷ সে খবর অনেকেই জানে না৷’
তপু কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘এতকিছু সত্যিই জানতাম না৷’
হৃষীকেশ হেসে বললেন, ‘এসব তো জানতে হবে মিস্টার জটায়ু৷ না হলে সবই যে উটের পাকস্থলী হয়ে যাবে৷’
(চলবে)
আগের পর্ব পড়ুন :
সম্রাট শাহজাহানের গুপ্তধন (দ্বাদশ পর্ব)