ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

চমরী গাই আর পাঠশালার গল্প

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য May 20, 2022 at 5:44 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ছবি: লুনানা: আ ইয়াক ইন দ্য ক্লাসরুম
পরিচালনা: পাও চয়নিং দোরজি
পরিবেশনা: থ্রি পিগস এন্টারটেনমেন্ট
মুক্তি: ২০১৯
অভিনয়: শেরাব দোরজি, কেলদন
ল্হামো গুরুং, পেম জাম, উগয়েন নোরবু লেণ্ডুপ

ভুটানের রাজধানী থিম্পু শহরের বাসিন্দা উগয়েন। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের অজস্র তরুণের মত তার চোখেও ভাসে ধনতান্ত্রিক  সমাজের দেখানো স্বপ্ন - উগয়েন গায়ক হতে চায়। সুখের সন্ধানে সে যেতে চায় অনেক দূরের দেশ অস্ট্রেলিয়ায়, তার ঘরে অষ্টপ্রহরের সঙ্গী সে দেশের এক রঙচঙে ব্রোশিওর। কিন্তু মানুষ যা চায়, তা সে কবেই বা সহজে পেয়েছে? উগয়েনকেও তাই আমরা দেখি এমন একটা কাজ করতে, যা তার একেবারেই পছন্দের নয়। উগয়েন সরকারি কর্মচারি। ভুটান সরকারের হ্যাপিনেস প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে তার উপর লুনানা সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ানোর ভার পড়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত লুনানা শুধু ভুটান নয়, সম্ভবত সারা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রত্যন্ত ইস্কুল। উগয়েনের দেহ-মন বিদ্রোহ করতে থাকে। সে এই চাকরি থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। কিন্তু গরিব দেশের ছেলেমেয়েরা কি অত সহজে সরকারি চাকরির নিশ্চিন্ত ছাতা পায়ে ঠেলতে পারে? ঠাকুমার ধাতানি খেয়ে গজগজ করতে করতে উগয়েন রওনা দেয় পাণ্ডববর্জিত লুনানার পানে।

আরও পড়ুন: সহজ ভাষায় প্রান্তিক মানুষের গল্প বলে ‘সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর’/ বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য  

হ্যাঁ মশাই, এই অবধি পড়ে নিশ্চয়ই এই গল্পের সঙ্গে আমাজন প্রাইমের শোরগোল ফেলে দেওয়া ‘পঞ্চায়েত’ ওয়েব সিরিজের সঙ্গে মিল পাচ্ছেন। কিন্তু শুধু এটুকু হলেই কি আর এ ছবি ভুটানের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কারে মনোনয়ন পেত? গাসা অবধি বাসপথে আসার পর উগয়েন দেখে, তাকে নিতে লুনানা থেকে হাজির মিশেন। ছ’দিনের হাঁটাপথে মারাত্মক পরিশ্রমের ফর উগয়েন পৌঁছয় লুনানা গ্রামে। পাহাড়ের কোলে এ এক আশ্চর্য জগত, আধুনিক শহরে বসে যার কল্পনা করাও কষ্টের। মাত্র কয়েক ঘর লোকের বাস, তাদের বংশানুক্রমিক পেশা চমরী গাই চরানো। বিদ্যুৎ এখানে রূপকথা, দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী, কাগজ টাকার নোটের মত মূল্যবান। প্রথম প্রথম এসে রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টারের মত দশা হলেও আস্তে আস্তে লুনানার জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করে উগয়েন। সে চমরী গাইয়ের ঘুঁটে পুড়িয়ে আগুন করতে শেখে, সর্বক্ষণের সঙ্গী মোবাইলের দিকে ফিরেও তাকায় না। লুনানার স্কুলবাড়িও তাজ্জব লাগবার মত, একখানা ব্ল্যাকবোর্ডও সেখানে নেই। সাকুল্যে কয়েকজন ছাত্রছাত্রী হলেও নতুন মাস্টারকে নিয়ে তাদের উৎসাহের অন্ত নেই, উগয়েন এসে পৌঁছবার পরের দিনই একরত্তি ক্লাস ক্যাপ্টেন পেন জাম সক্কাল সক্কাল তাকে জাগাতে দোরগোড়ায় হাজির। সামর্থ্য কম হলেও ছোট্ট শিশুদের চোখজোড়া স্বপ্ন- কেউ হতে চায় গায়ক, কেউ শিক্ষক, কেউ সরকারি অফিসার। ধীরে ধীরে এই কচিকাঁচাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে উগয়েন, কখনও তাদের গিটার বাজিয়ে নাচগান করায়, কখনও রঙিন চার্ট বানাতে দিয়ে ভরিয়ে তোলে ক্লাসরুমের দেওয়াল। ‘সি ফর কার’ পড়াতে গিয়ে তার খেয়াল হয়, আরে এরা তো কোনোদিন গাড়ি জিনিসটাই চোখে দেখেনি। লুনানা গ্রামে শিক্ষকের প্রতি সকলের অসম্ভব শ্রদ্ধা দেখে অবাক হয়ে যায় উগয়েন, শহরে থেকে সে তো কোনোদিন শিক্ষাদানকে আর পাঁচটা কারবারের থেকে আলাদা করে দেখতে শেখেনি। মোড়ল তাকে ভারি সুন্দর একখানা কথা বলেন, শিক্ষক সবসময়ই সম্মানের পাত্র, কারণ তার কাছেই রয়েছে ভবিষ্যতের চাবি। উগয়েন আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘আমি যখন স্কুলে ছিলাম তখন তো এ কথা আমাদের কেউ বলে নি!’ রাখালদের সাহায্যে আলকাতরায় কাঠ চুবিয়ে তৈরি হয় ব্ল্যাকবোর্ড, কুকুরের বিষ্ঠা শুকিয়ে চকখড়ি। গতে বাঁধা সিলেবাসের চর্বিতচর্বণের বাইরে গিয়ে জীবনযাপনের যথার্থ অঙ্গ হয়ে ওঠে শিক্ষা, মুখর হয়ে ওঠে স্কুলবাড়ির আঙিনা।

আরও পড়ুন : প্রত্যাবর্তন নয়, কাকাবাবুর হাতে হ্যারিকেন /বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য

     কিন্তু উগয়েন যা শেখায়, নিজে শেখে তার থেকে অনেক বেশি। শহুরে তাচ্ছিল্য এবং অবিশ্বাসের অভ্যাস ত্যাগ করে সে বুঝতে শেখে প্রকৃতিকে প্রতি মুহূর্তে সঙ্গে নিয়েও চলা যায় জীবনের পথে। গ্রামের মেয়ে সালদন তাকে শেখায় ‘ইয়াক ল্হেবি ল্হাদার’ বা চমরী গাইয়ের গান। মোড়লের লেখা এই গানে এক চমরী গাই মরে যাবার আগে রাখালকে বলছে, পরের জন্মে আমাদের নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। চমরী গাই এই প্রত্যন্ত প্রদেশে মানুষের সবচেয়ে বড় সহায়, মরুভূমিতে মানুষ আর উটের মতোই তাই এখানে চমরী গাইয়ের সাথে রাখালের সম্পর্ক পোষ্য আর মালিকের নয়, বন্ধুত্বের। সেলদন তাই উপহার হিসেবে উগয়েনকে দেয় একখানা চমরী গাই, তার ঠাঁই হয় ক্লাসঘরের ভেতরেই। প্রকৃতির সঙ্গে পঠনপাঠনকে মিলিয়ে দেবার এই শিক্ষাই তো শান্তিনিকেতনে কবিগুরু চালু করেন। তাবড় তাত্ত্বিকদের মত বিরাট রচনা লেখার বদলে মিশেনের মুখের মাত্র কয়েক শব্দে পরিচালক বুঝিয়ে দেন বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জীববৈচিত্র্য লোপের আশঙ্কার কথা।

   এ ছবির শেষে লুনানাতে থেকে যেতেই পারত উগয়েন, ছাত্রছাত্রীদের ভালবাসা আর গ্রামবাসীদের সম্মানকে পাথেয় করে। কিন্তু গোটা ছবিকে সহজ সরল পাহাড়িয়া গানের ছন্দে বুনলেও এখানে পরিচালক দর্শককে খুশি করবার শর্টকাট পথ নিতে গিয়ে ছবির বাস্তববোধ ঢিলে হতে দেননি। আগন্তুক ছবির মনমোহন মিত্র সারাজীবন বনেবাদাড়ে ঘুরেও মনমজ্জা থেকে আধুনিকতার ভূতকে তাড়াতে পারেন নি, বদলির আশায় মগ্ন রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার বুঝেই উঠতে পারেনি রতনের আবেগ, আর উগয়েনের তিন বছরের স্বপ্ন কি অত সহজেই ছেড়ে যাবার পাত্র? অস্ট্রেলিয়ার ভিসা মকুব হবার খবর পেতেই ছটফটিয়ে ওঠে উগয়েন, ময়লা মোবাইল ফোন ঝেড়েপুঁছে তড়িঘড়ি গোছাতে শুরু করে মালপত্র। সালদনের কষ্ট, মোড়লের হতাশা, ছাত্রছাত্রীদের অনুনয়, কিছুই শেষ অবধি আটকে রাখতে পারে না তাকে। ছবির শেষে দেখা যায়, সিডনির অপেরা হাউসের কাছেই এক পানশালায় গিটার বাজিয়ে পশ্চিমি গান গাইছে উগয়েন। অতিথিরা খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না তাকে, তারা নিজেদের মধ্যে গল্পে মগ্ন। অবশেষে ইংরেজি গান থামিয়ে ‘ইয়াক ল্হেবি ল্হাদার’ গাইতে শুরু করে উগয়েন, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে গোটা পানশালা। এদিকে লুনানার ক্লাসঘর শুনশান, বোর্ডের লেখায় জমতে শুরু করেছে শ্যাওলা, দেয়াল থেকে খুলে ঝুলছে ছাত্রছাত্রীদের বানানো চার্ট।

    এরকমই তো হয়, এরকমটাই তো স্বাভাবিক। গ্রামীণ প্রান্তের সঙ্গে শহুরে কেন্দ্রের সম্পর্ক সবসময়ই শোষণের। আধুনিক সভ্যতা প্রান্তিক মানুষকে শিখিয়েছে পরিযায়ী হবার সহজ পথ- গ্রাম থেকে শহর থেকে প্রথম বিশ্বের দেশ। তাই আমেরিকায় আইটি কুলির কাজ করা ছেলের মা বাবা কলার তুলে সন্তানের ‘স্টেটসে’ যাবার খবর জাহির করেন, আর গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে সরকারি চাকরি করা মেয়ের বাবা মা চুপ করে সেই বারফট্টাই হজম করেন। লুনানার সম্মান থেকে উগয়েনের জীবন নেমে এসেছে পানশালার মালিকের ধমক খাবার রোজনামচায়, তবু অস্ট্রেলিয়া তো! লুনানার সঙ্গেও তার সম্পর্ক অবশেষে হয়ে দাঁড়ায় শোষকের, সেখানকার চমরী গাইয়ের গান তার গলায় হয়ে দাঁড়ায় শহুরে সমাজের হাততালি কুড়োবার পণ্য। যেভাবে প্রতি মুহূর্তে লোকসঙ্গীত থেকে ফায়দা তোলে শহুরে শিল্পীদের দল, রতন কাহারের গান বেমালুম পাচার হয়ে তৈরি হয় কোটি কোটি টাকার মিউজিক ভিডিও।

আরও পড়ুন: নস্টালজিয়ার মাকড়সা মানুষ / বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য

     এ ছবির অভিনেতাদের মূল্যায়ন প্রথাগতভাবে করা নিরর্থক, কারণ একাধিক অভিনেতা আদতে লুনানার বাসিন্দা, জীবনে প্রথম তাঁরা ক্যামেরার সংস্পর্শে এসেছেন। দৈনন্দিন যাপনচিত্র তুলে ধরেছেন বলেই বোধহয় তাঁদের কাজ এত সুন্দর, এত সাবলীল। স্কুল ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করা ছোট্ট পেম জাম নিজেও লুনানা প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রী, ছবির কাহিনির মত তার বাবাও মদ্যপ, এবং সে সত্যিই গায়িকা হবার স্বপ্ন দেখে। উগয়েনের ভূমিকায় শেরাব দোরজি সুন্দর, বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে সালদনের চরিত্রে কেলডেন ল্হামো গুরুং এবং মিশেনের ভূমিকায় উগয়েন নোরবু লেণ্ডুপের কথা। পাও চয়নিং দোরজির গল্পের বিষয়বস্তুর পাশাপাশি চিত্রনাট্যের সারল্য এ ছবিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।  বর্তমান সময়ে চিন্তাবিদরা বারবার বলছেন আধুনিকতার বিষে অসুস্থ সমাজকে অন্য ভাবে বাঁচতে শেখানোর জন্য তত্ত্বের কচকচানি থেকে বেরিয়ে এসে গল্পের ভাষার উপর জোর দিতে হবে, সলমন রুশদির ‘হারুন অ্যান্ড দ্য সি অফ স্টোরিজ’ বা অমিতাভ ঘোষের সাম্প্রতিক ‘জঙ্গলনামা’ বা ‘দ্য লিভিং মাউন্টেন’ সেই চেষ্টার সাক্ষ্য দেয়। নিজের বক্তব্য পেশ করতে তাই এ ছবিও তাই সেলুলয়েডে গল্প বোনে সহজ পাহাড়ি ছন্দে। 

   

     

        

#সিলি পয়েন্ট #Lunana: A Yak in the Classroom #Pawo Choyning Dorji #Film Review #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

62

Unique Visitors

214940