ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

সহজ ভাষায় প্রান্তিক মানুষের গল্প বলে ‘সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর’

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Mar 16, 2022 at 5:37 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

সিরিজ: সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর
পরিচালনা: কোরক মুর্মু
প্রযোজনা: পথিকৃৎ সেনগুপ্ত, প্রত্যুষ মণ্ডল
অভিনয়: ঋদ্ধি সেন, উষসী রায়, যুধাজিৎ সরকার, রূপাঞ্জনা মিত্র, শঙ্কর দেবনাথ প্রমুখ

গত কয়েক বছরে সুন্দরবন নিয়ে মানুষের উৎসাহ বেড়েছে। অমিতাভ ঘোষের দ্য হাংরি টাইড বা গান আইল্যান্ড প্রভৃতি উপন্যাস নিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা বা একাধিক সাইক্লোনের কারণে এই এলাকা ঘনঘন সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসবার ফলে শহুরে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই হালফিলে হঠাৎ করে এই অঞ্চলের প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে ত্রাণ বিলি করতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় রকমারি পোস্ট বা শীতের সময় টুক করে সুন্দরবন ঘুরে আসা এই মনোযোগেরই হরেক প্রতিফলন। সুন্দরবনের সাতকাহন বইতে তুষার কাঞ্জিলালের কথা মনে পড়ে, ‘যখন যখন কলকাতার মানুষ সুন্দরবন সম্বন্ধে উৎসাহী হয়ে ওঠেন, আমার ভয় লাগতে শুরু করে।‘

সত্যিই তো, এই মনোযোগের কতটুকু বাস্তবিক সুন্দরবনকে ভালবেসে, তা ভেবে দেখার দরকার। ব্রিটিশ আমলে সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন শুরু হয়েছিল এ অঞ্চল থেকে রাজস্ব আদায় করবার ঔপনিবেশিক পরিকল্পনায়, কিন্তু স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও সুন্দরবন সম্বন্ধে শহুরে মানুষের সেই ঔপনিবেশিক মনোভাবই রয়ে গেল। সুন্দরবন অজানা ভয়ঙ্করের স্থান, সেখানে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ গিজগিজ করছে, মানুষজন নেহাত গরিব মুখ্যু, ওই একটু ত্রাণ ফাণ দিলেই ওদের প্রতি আমাদের কর্তব্য সারা হয়ে গেল। সুন্দরবন আমাদের ছুটির রোমাঞ্চ, টাটকা মাছভাজা আর চাকভাঙা মধুর আড়ত। কলকাতার থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টা দূর হলেও, মনে মনে সুন্দরবনের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব কয়েক আলোকবর্ষ।

এবং এই দূরত্ব ঘোচাবার দায়িত্বটাই ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর ওয়েব সিরিজের নির্মাতারা। এই প্রথম বাংলার পর্দায় উঠে এসেছে সুন্দরবনের মানুষের গল্প, তাদের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার রোজনামচা। প্লট অতি সরল, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে যেকোনো বাজারচলতি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির বাঁধাধরা ছক মেনে তার শুরু। জীবনতলার শহুরে ছেলে কিঙ্কর কর্মকারের জন্ম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে, তার বাবার ভারি ইচ্ছে ছেলে একদিন বিদ্যাসাগরের মত বড় পণ্ডিত হয়ে নাম কিনবে। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশনে মাত্র বিয়াল্লিশ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখানোর জো থাকে না কিঙ্করের, শুভাকাঙ্ক্ষী ভুবনবাবু তাকে বনদপ্তরের ভলান্টিয়ারের চাকরি দিয়ে পাঠিয়ে দেন সুন্দরবনের কুমিরখালি গ্রামে। কিঙ্করের দায়িত্ব, গ্রামের অজস্র বিধবাদের নিয়ে ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের জন্য গড়ে তুলতে হবে সুন্দরী বাহিনী। ওদিকে স্থানীয় স্কুলের প্রিন্সিপাল কল্যাণী গ্রামপ্রধান রাধারাণী এবং মাস্তান মাখনকে সঙ্গে নিয়ে কুমিরখালিকে লোকদেখানো হেরিটেজ ভিলেজে পরিণত করতে চান, যেখানে বিদেশি অর্থসাহায্য হজম করে সামাজিক কাজকর্মের অছিলায় চলবে বিলাসবহুল রিসর্টের ব্যবসা, বিধবাদের স্বনির্ভর করে তোলার নামে পরিণত করা হবে এসকর্টে। রাইডার হ্যাগার্ডের রবার্ট সেইমুর, অ্যান্টনি হোপের রুডলফ রাসেনডিল বা বিভূতিভূষণের শঙ্করের মত নিজেকে কুমিরখালিতে এসে নতুন করে আবিষ্কার করে কিঙ্কর, পার্বতী হাফিজ ভাই সুকুমার আর কালুয়ার সাথে হাত মিলিয়ে লোভী মানুষদের বিরুদ্ধে শুরু হয় তার লড়াই।

সুন্দরবনের জনজীবন নিয়ে লেখালিখি কম হয়নি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, মনোজ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শিবশঙ্কর মিত্র, তাপস গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ একাধিক লেখক কখনো পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস আবার কখনো কিশোর কাহিনির মোড়কে বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবনবাসীর জীবনযাত্রা সম্বন্ধে মানুষকে জানাতে চেয়েছেন। তবে অস্বীকার করে লাভ নেই, অমিতাভ ঘোষের ইংরেজি উপন্যাসগুলি তাদের ভাষার কারণে স্বাভাবিকভাবেই বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীকে সুন্দরবন সম্বন্ধে উৎসাহী করতে পেরেছে, লোকে নতুনভাবে আগ্রহী হয়েছে তুষার কাঞ্জিলালের মত সমাজসেবীদের জীবন নিয়ে। তুষারবাবুর লেখালেখি সংকলিত হচ্ছে, শুধু সুন্দরবন চর্চা জার্নাল বিশ্বমানের গবেষণা করছে এই অঞ্চল নিয়ে, প্রখ্যাত অধ্যাপক লেখক পরিমল ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিকতম ফিল্ড নোটস ফ্রম আ ওয়াটারবোর্ন ল্যান্ড বইতে উঠে আসছে সুন্দরবনের কথা, সাংবাদিক কুণাল ঘোষ অবধি সুন্দরবনের বিধবাদের নিয়ে বাঘবিধবা নামে উপন্যাস লিখছেন।   কিন্তু কাগজে কলমে আগ্রহ বাড়লেও সুন্দরবনের মানুষদের দৈনন্দিন ভোগান্তি কমবার বিশেষ লক্ষণ নেই, চাষের সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে, রোজগারের বিকল্প পথ তৈরি হচ্ছে না, শহুরে ধনতন্ত্র স্বনির্ভরতার পথ দেখানোর বদলে সর্বনাশা ভোগবাদের বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে দিনযাপনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পার্টির চাঁই, ভেড়ি মালিক, দালাল আর মাস্তানদের দাপটে ওষ্ঠাগত সাধারণ মানুষের জীবন। সহজ ভাষায় এই সমস্যাগুলোই তুলে ধরেছে এই সিরিজ, যেখানে বিধবা পার্বতী স্পষ্টভাবে বলে তাদের ত্রাণ চাই না, শিক্ষা চাই, স্বাস্থ্য চাই। বছরকয়েক আগে মুম্বইয়ের বেশ্যাপল্লিতে ঝড়খালির মেয়ে পাবার পর পুলিশ সংবাদপত্র প্রভৃতি দপ্তরে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল, এই সিরিজে পুষ্প পার্বতীর মত বিধবাদের জীবন আবার মনে করিয়ে দেয় সুন্দরবনের মেয়েদের জীবন কী ভয়ানক বিপদসঙ্কুল। ভদ্রবিত্ত বাঙালির প্রিয় পণ্ডিত বিদ্যাসাগর নয়, সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে কিঙ্করের সংগ্রাম মনে করিয়ে দেয় সেই বিদ্যাসাগরের কথাও, বিধবা বিবাহ প্রচলন ছাড়াও যিনি জীবনের শেষ দিনগুলো তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কাটিয়েছিলেন কর্মাটাঁড়ের আদিবাসীদের মাঝে। বিডিও উদাসীন, পুলিশ ক্ষমতার গোলাম, শহরের মানুষের দ্বারা অশিক্ষিত সুন্দরবনবাসীর উত্তরণের ছক এখানে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কিঙ্করের প্রাণ বাঁচায় হাফিজ বা কালুয়ার মত স্থানীয় মানুষ, লড়াইয়ের দরকারি প্রমাণ সে পায় সুকুমার আর পার্বতীর কাছ থেকে। কিঙ্কর কোনো শহুরে পরিত্রাতা নয়, কুমিরখালির বুকে জমে থাকা বারুদে আগুন ধরানোর পলতে। কিঙ্করের ভূমিকায় ঋদ্ধি সেন সুন্দর, যথাযথ অভিনয় করেছেন উষসী রায়। নেতিবাচক চরিত্রে স্বভাবত স্বচ্ছন্দ রূপাঞ্জনা। তবে আলাদা করে বলতে হবে কালুয়ার চরিত্রে সুদীপ ধাড়া এবং মাখনের চরিত্রে শঙ্কর দেবনাথের কথা। গৌরব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীত সুন্দর, অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘সুন্দরী বাহিনির গান’ সুর এবং কথার জন্য মনে দাগ কেটে যায়। গল্পের অভিনব বিষয়বস্তু ছাড়াও টানটান চিত্রনাট্যের জন্য বাহবা পাবেন অর্কদীপ মল্লিকা নাথ।

তা বলে কি এই সিরিজে ভুলভ্রান্তি নেই? অবশ্যই আছে। ভুবনবাবুর ‘তুই বাঘ দেখলেও খেয়াল রাখবি বাঘ যেন তোকে দেখতে না পায়’ কথাটা অত্যন্ত উদ্ভট, কারণ জঙ্গল সম্বন্ধে একটু জ্ঞান থাকলেই জানা যায় যে কোনো মানুষ যদি বাঘকে একবার দেখতে পায়, তবে বুঝতে হবে যে বাঘ তার অধিকতর শক্তিশালী চোখের পাল্লা দিয়ে মানুষটাকে ইতিমধ্যে অনেকবার দেখে নিয়েছে। শেষ এপিসোডে মন্ত্রীমশাই যতটা নিষ্পাপ দেখানো হল, সেটা হজম করতে বেশ কষ্ট হয়। আর আগুনে ফেলে দেবার পরেও পার্বতীর ফোনে আবার বহাল তবিয়তে ভিডিও চলবার দৃশ্যটা তো রীতিমত আজগুবি। তবে কথায় কথায় যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া রমকম বা ঢিমেতাল গোয়েন্দা গল্পের একঘেয়ে ছক ভেঙে হইচই পা বাড়াচ্ছে সুন্দরবনের দিকে, বাঘ কুমির ভূত প্রভৃতি রোমাঞ্চ ঠুসে না দিয়ে সোজাসাপটা ভাবে সেখানে উঠে আসছে স্থানীয় মানুষের বাস্তব সমস্যা, প্রাপ্তি হিসেবে এ বড় কম নয়। বিদেশি কন্টেন্টের অন্ধ অনুকরণ ছেড়ে বাংলার ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো  আরো মৌলিক কাজ করুক, ক্রমশ তৈরি করুক নিজের ভাষা, এটুকুই আশা রাখি।            

 

#সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর #কোরক মুর্মু #ঋদ্ধি সেন #হই চই #ওয়েব সিরিজ #সিলি পয়েন্ট #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

75

Unique Visitors

214956