ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

প্রত্যাবর্তন নয়, কাকাবাবুর হাতে হ্যারিকেন

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Feb 13, 2022 at 6:00 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ছবি: কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন
পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
প্রযোজনা: শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস
শ্রেষ্ঠাংশে: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, আরিয়ান ভৌমিক, অনির্বাণ চক্রবর্তী, আলোন্সো গ্রান্দিও

মাসাইমারার জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে সন্তুর পায়ে জড়িয়ে গেছে সাপ। প্রসেনজিতের কাকাবাবু খালি হাতে রীতিমতো খামচে টামচে সাপটাকে ছাড়ানোর পরেও তাঁর কিছুই হয় না, উল্টে মাথা ঘুরে উল্টে পড়ে সন্তু। তার প্যান্ট গুটিয়ে খানিকক্ষণ মুখ দিয়ে বিষ টানবার ভঙ্গি করবার পর শুয়ে পড়েন কাকাবাবু। গদগদ গলায় বলেন, ‘বিষটা দু’জনে শেয়ার করে নিলাম।‘ মাগো, কী সেন্টু!

      এমন অজস্র ভুলভাল, অপ্রয়োজনীয় মুহূর্তে ভরা সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জঙ্গলের মধ্যে এক হোটেল গল্পে হয়তো পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক বা বিজয়নগরের হিরে গল্পের মত মারামারি নেই, কিন্তু বিষয়বস্তুর তাৎপর্যের বিচারে এ গল্প নিঃসন্দেহে কাকাবাবু সিরিজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ। মনোযোগী পাঠক মাত্রেই লক্ষ্য করে থাকবেন, কাকাবাবুর গল্পে মাঝেমধ্যেই এসেছে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এবং পরিবেশ সচেতনতার পাঠ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রাপ্তবয়স্ক সাহিত্যে সরাসরি রাজনৈতিক অনুষঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়, ছোটদের জন্য কাকাবাবু লিখতে বসেও তিনি সত্যজিতের মত রাজনীতিকে সাবধানে দূরে সরিয়ে রাখেননি, বরং রীতিমতো ধারাবাহিকভাবে কাহিনির পরতে পরতে গুঁজে দিয়েছেন। সবুজ দ্বীপের রাজা গল্পেই সভ্য/অসভ্য সম্বন্ধে বাজারচালু ধারণাকে দস্তুরমত চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল, এবং গল্পের শেষে গুণদা তালুকদারের মৃত্যুর সাথে যথেষ্ট অস্বস্তিকর একটি প্রশ্ন পাঠকের মনে ঘুরপাক খেতে থাকে, ‘আমরা কি সত্যিই স্বাধীন?’ পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক গল্পে রয়েছে বিদেশি গুপ্তচরবৃত্তি, মিশর রহস্য গল্পে বিপ্লবী রাজনীতি, নীলমূর্তি রহস্য গল্পে দণ্ডকারণ্যের বাঙালি উদ্বাস্তুদের কথা (এরাই পরে মরিচঝাঁপি গণহত্যার শিকার হয়) , সন্তু কোথায়, কাকাবাবু কোথায়  গল্পে তামিল টাইগার, কাকাবাবু ও ব্ল্যাক প্যান্থার গল্পে বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্রপন্থা। বারবার নাগরিক সভ্যতার যথার্থতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছে সবুজ দ্বীপের রাজা, খালি জাহাজের রহস্য, কাকাবাবু ও বাঘের গল্প প্রভৃতি গল্পে, জঙ্গলের মধ্যে এক হোটেল, কাকাবাবু বনাম চোরাশিকারি, আগ্নেয়গিরির পেটের মধ্যে প্রভৃতি একাধিক গল্পে কাকাবাবুর বিপক্ষে রয়েছে পশু হত্যাকারীর দল। জঙ্গলের মধ্যে এক হোটেল গল্পে লিটল ভাইসরয় হোটেলের গঠনপ্রণালীটাই অসম্ভব সুন্দর একটি ভাবনা, পরিবেশের সামঞ্জস্য রক্ষা করে টুরিস্টকে ভ্রমণের আনন্দ দেবার ব্যতিক্রমী একটি প্রয়াস। আজ যখন মুনাফার লোভে হোটেল ব্যবসায়ীরা নির্মমভাবে পরিবেশের ভারসাম্য সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিচ্ছে, এ দেশের শেরনি, আরণ্যক প্রভৃতি সিনেমা বা সিরিজে উঠে আসছে সেই প্রসঙ্গ, সৃজিতের কাছে একটা ভালো সুযোগ ছিল লিটল ভাইসরয় হোটেলের গঠন সম্পর্কে অল্পবয়সী দর্শককে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল করে দিয়ে পরিবেশ সচেতনতার পাঠ দেবার। এছাড়া আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের অবিচারের কথাও আস্তে আস্তে স্থান পাচ্ছে ভারতীয় ছবিতে, তৈরি হচ্ছে চক্রব্যূহ, নিউটন, সোনচিড়িয়া, শেরনি প্রভৃতি ছবি। ইংরেজি ভাষায় আফ্রিকার আভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে ব্লাড ডায়মণ্ড, হোটেল রোয়াণ্ডা বা বিস্টস অফ নো নেশন তো রয়েছেই। মাসাইদের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরোধ ও মৈত্রীর যে প্রসঙ্গ জঙ্গলের মধ্যে এক হোটেল গল্পে রয়েছে, সৃজিতের কাছে দারুণ সুযোগ ছিল প্রথম থেকেই সেই ব্যপারটা সামনে নিয়ে এসে থ্রিলারের মাধ্যমে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পর্দায় তুলে ধরবার। বলা বাহুল্য, সৃজিত সেসব কিছুই করেননি। তার জায়গায় আমরা কী পেলাম? সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়ভাবে অনির্বাণ চক্রবর্তীর চেহারার সঙ্গে জটায়ুর সাদৃশ্যের প্রসঙ্গ টেনে এনে ফেলুদার একগাদা অনুষঙ্গ, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের অন্যান্য ছবির নাম উত্থাপন, ক্যাডবেরি হানিটাস প্রভৃতি প্রোডাক্টের বেখাপ্পা প্লেসমেন্ট। বছরের পর বছর ধরে সৃজিতের সংলাপে যেখানে সেখানে জোর করে গুঁজে দেওয়া একই ধরনের কথার খেলা এখন অসহ্য বিরক্তির উদ্রেক করে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে পরিবেশ সচেতনতা, সভ্যতার অভিশাপ, হিংস্র প্রাণী সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে যে শক্তিশালী কথোপকথন ছিল, সৃজিত সেগুলোর প্রত্যেকটা ধরে ধরে বাদ দিয়ে নিজের উল্টোপাল্টা কথা ঢুকিয়েছেন। অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তার চোটে গল্পের প্লটই দানা বাঁধে না, চিত্রনাট্য পুরো ঝুলে গিয়ে প্রথমার্ধেই হাই উঠবার জোগাড়। মাসাইমারা সাফারির ড্রোন এবং প্যানোরামিক শট দিয়ে দর্শককে মুগ্ধ করবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট, ডিসকভারি চ্যানেল বা ইন্টারনেটের ট্র্যাভেল ভ্লগ দেখে পোক্ত বর্তমান প্রজন্মের কাছে শুধু এইসব দৃশ্য দেখিয়ে আর বাজিমাত করা সম্ভব নয়, আজ থেকে অন্তত দশ বছর আগে হলে হয়তো প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যেত। একমাত্র অনির্বাণ চক্রবর্তীর অভিনয় দ্বিতীয়ার্ধে খানিকক্ষণের জন্য একটু আগ্রহের সৃষ্টি করে, কিন্তু অকারণে তাঁর মুখে মগনলালের সংলাপ বসিয়ে সৃজিত নিজেই সেটাকে তৎক্ষণাৎ আবার ধ্বংস করে দিয়েছেন। লোহিয়ার চরিত্রে নিজের ক্যামিওর গুরুত্ব বাড়াতে গিয়ে পরিচালক অশোক দেশাই শ্যাম নিনজানে প্রভৃতি চরিত্রগুলোকে বেমালুম বাদ দিয়ে দিয়েছেন, ফলে আরো খানিক জৌলুস হারিয়েছে চিত্রনাট্য। এতটাই দায়সারা এ ছবির কাজ যে গুনার ওলেনের মত সুন্দর একটা চরিত্রর আগাগোড়া বাদ দিয়ে তাকে একটা উদ্ভট দু’মিনিটের উপস্থিতি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ডিটেলিংয়ের নামগন্ধ নেই। আসল গল্পে সন্তু কাকাবাবু আফ্রিকার প্রান্তরে পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়ায় কয়েক ঘন্টা, রাত নেমে এলে যে এখানে তাদের মত শহুরে মানুষের একা একা  বাঁচা অসম্ভব এ কথা একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। সৃজিতের কাকাবাবু সুপারম্যান, তাই গোরখশেপের গম্বুজে আটকে পড়বার মত আফ্রিকার প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময়কালটাকেও সৃজিত অকারণে টেনে কয়েকদিন করলেন,কুমির চিতাবাঘ সিংহ প্রভৃতির গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স দেখলাম আমরা। গরিলা বা বুনিপ যে নিয়ে আসা হয়নি, এই চোদ্দপুরুষের ভাগ্য। অথচ পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়ানোর যে মারাত্মক সাসপেন্স সুনীলের গল্পে ছিল, তার লেশমাত্র ছবিতে তৈরি হয়নি। কাকাবাবু আর সন্তু দিব্যি হাসি হাসি মুখে পার্কে বেড়ানোর মত ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, মাঝেমধ্যে ঠাট্টা তামাশা চলছে। উন্মাদ নাকি? এছাড়া মূল গল্পে ফিলিপ (এ ছবিতে কোনো কারণে সে ফিলিপস হয়ে গেছে) কাকাবাবুর ক্রাচ কেড়ে নিয়েছিল, প্রসেনজিৎ সম্ভবত অতক্ষণ ধরে একপায়ে লাফাতে রাজি হননি।

     এইসব বালখিল্যপনার শেষে মাসাইদের আগমন, এবং জঙ্গলের বন্ধু হিসেবে তাদের যে পরিচয় আমরা মূল গল্পে পাই, সেটাকে প্রথমেই ঘেঁটে দেওয়া হয়েছে বেফালতু একটা সিংহ হত্যার দৃশ্য দেখিয়ে। আফ্রিকা মানেই গোটাকয়েক সিংহ মেরে দিতে হবে, এটা এডগার রাইস বারোজ প্রভৃতি সাহেবদের সৃষ্ট ধারণা, সারাজীবন একবারের জন্যও আফ্রিকার ধার না মাড়িয়েই যাঁরা উষ্টুম ধুষ্টুম গপ্পো বানিয়ে গেছেন। মাসাইদের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার মত অত্যন্ত শক্তিশালী একটা দৃশ্যকে একেবারে নমো নমো করে সেরে দেওয়া হল। ডেভিড ইয়েটসের দ্য লেজেন্ড অফ টারজান কোনোভাবেই নিখুঁত ছবি নয়, কিন্তু সেখা পরিচালক মুক্ত আফ্রিকান ক্রীতদাসদের বিজয়োল্লাসের মুহূর্তগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করে দৃশ্যগুলোকে যথার্থ প্রাধান্য দিয়েছেন। দ্য লায়ন কিং ছবিকে কায়দা মেরে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ওয়াইল্ড বিস্টের ঝাঁকের মাঝে অবিশ্বাস্য একটা ক্লাইম্যাক্স ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বহুদিন ধরেই যেখানে কেনিয়ার নিজস্ব ক্রিকেট দল আছে, সেখানে মাসাইদের ক্রিকেট শেখাতে কাকাবাবুর দরকার পড়ল, এমন ধারণা শহুরে ঔদ্ধত্যের পরিচয় নয় কি? পুনর্সৃষ্টি খুবই ভালো জিনিস, কিন্তু উদ্ভাবনের আগে প্রথমে  মূল ভাবনাটা বোঝা দরকার। ওপরচালাকির জন্য উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখাতে গেলে তার পরিণাম দাঁড়ায় মূল টেক্সট না পড়ে শুধু নোটবইতে চোখ বুলিয়ে পরীক্ষায় উত্তর লিখে দেবার মত। নিজেকে যিনি নিজেই বাংলা ছবির ফার্স্ট বয় তকমা দেন, তাঁর মাথায় এটুকু ঢোকে না কেন?

    প্রসেনজিৎ এতদিন ধরে লাগাতার বাংলা ছবিতে কাজ করে চলেছেন, কাকাবাবুর ক্ষেত্রে যে বাণিজ্যিক ছবির ভুরু কাঁপিয়ে ডায়লগ বলা চলবে না এই সহজ সত্য তাঁর বোঝা উচিত। আরিয়ানের সঙ্গে সন্তুর চেহারার সাদৃশ্য আছে বটে, কিন্তু অভিনয়টা তিনি একেবারেই পারেন না। বিদেশি অভিনেতাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই আরো যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল। সৌমিক হালদারের ক্যামেরার কাজ ভালো হলেও শুধু তা দিয়ে চিঁড়ে ভেজানো সম্ভব নয়, আগেই বলেছি। অনিন্দ্য চন্দ্রিল উপলের গলায় কাকাবাবু ট্রিলজির ফেয়ারওয়েল সং মনে সেভাবে দাগই কাটে না। সৃজিতের এই ছবি দেখে খোদ রাজা রায়চৌধুরীর কেমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভাবতে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষদিকের একটি রদ্দি গল্পের শিরোনাম মনে আসছিল- ‘কাকাবাবুর চোখে জল’। চটকদারি ছেড়ে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের অবিলম্বে নিজের শিল্পের প্রতি সৎ হওয়া দরকার। করোনাকালে এমনিতেই দীর্ঘদিন সিনেমা হল বন্ধ ছিল, এছাড়া ছুটির মরসুমে মুক্তি পাওয়া বড় বাজেটের পারিবারিক ছবি হবার ফলে এবং ভেঙ্কটেশের আগ্রাসী বিপণনের সুবাদে ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ বক্স অফিসে খুব সম্ভবত ভালোই ফল করবে। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেরা সময়ের কাকাবাবু কাহিনি যাঁরা মন দিয়ে পড়েছেন তাঁরা ঠিকই বুঝবেন যে প্রত্যাবর্তনের নামে সৃজিত একেবারে কাকাবাবুর হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে ছেড়েছেন।       

           

আরও পড়ুন: নস্টালজিয়ার মাকড়সা মানুষ       


#কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন #সৃজিত মুখোপাধ্যায় #সিনেমা #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য #রিভিউ #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

182743