ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

নস্টালজিয়ার মাকড়সা মানুষ

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Dec 31, 2021 at 8:25 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ছবি: স্পাইডারম্যান: নো ওয়ে হোম
পরিচালক: জন ওয়াটস
প্রযোজনা: মার্ভেল স্টুডিওজ, কলম্বিয়া
পিকচার্স, পাস্কাল পিকচার্স
শ্রেষ্ঠাংশে: টম হল্যান্ড, জেন্ডায়া,
জেকব ব্যাটালান, বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ, মারিসা টোমেই, অ্যান্ড্রু গারফিল্ড, টোবি ম্যাগোয়ার, উইলেম ডাফো, অ্যালফ্রেড মোলিনা, জেমি ফক্স

সেই ষাটের দশক থেকে মার্কিন কমিকসের বাজার বরাবর সরগরম থেকেছে ডিসি আর মার্ভেলের প্রতিযোগিতায়। একদিকে যেমন ডিসির পাতা ভরিয়েছেন অ্যালান মূর, ফ্র্যাঙ্ক মিলারের মত প্রবাদপ্রতিম কমিক স্রষ্টারা, মার্ভেলের পক্ষে রয়েছেন স্টিভ ডিটকো, মার্ক মিলার এবং সর্বোপরি প্রাণপুরুষ স্ট্যান লি। জনপ্রিয়তার নিরিখে ডিসির সেরা বাজি যেখানে জেরি সিগাল আর জো শুস্টারের কিংবদন্তি অতিমানব সুপারম্যান, মার্ভেলের সর্বাধিক পরিচিত মুখ বলতে সেখানে একবাক্যে উচ্চারিত হবে একটাই নাম- স্পাইডারম্যান।

        কেন এত জনপ্রিয় মাকড়সা মানুষ? উত্তর হিসেবে বেশ কিছু কারণ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ঘোরাফেরা করলেও, প্রধানত একটাই বিষয় উঠে আসবে বারবার। স্পাইডারম্যান আদতে ক্যাল এলের মত অন্য গ্রহের প্রাণী বা ব্রুস ওয়েনের মত কোটিপতি বাবার সন্তান নয়, পিটার পার্কার নামের নিউ ইয়র্ক শহরের এক নেহাত ছাপোষা কলেজপড়ুয়া। মা বাবা মারা গেছেন বিমান দুর্ঘটনায়, বেন কাকা আর মে কাকিমার কাছে বড় হয়ে ওঠা অভাবী পিটার হঠাৎই একদিন  মাকড়সার কামড় খেয়ে হয়ে ওঠে অতিমানব। কিন্তু মহাশক্তিধর হবার পরেও সে ভোলে না তার শিকড়কে, নিউ ইয়র্কের ঘিঞ্জি মহল্লায় থেকে সে চালিয়ে যায় ব্যক্তিগত নুন আনতে পান্তা ফুরনোর জীবন আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার অতিমানবিক লড়াই, কারণ বেনকাকা যে মরবার আগে বলে গেছেন, “With great power comes great responsibility”। মাকড়সা মানুষ একটা বিশ্বাস, যা বুঝতে শেখায় নিতান্ত সাধারণ একজন মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে নায়ক।

         স্যাম রাইমির বিপুল জনপ্রিয় স্পাইডারম্যান ট্রিলজি ঠিক এই জায়গাটার উপরেই জোর দিয়েছিল। রাইমির পিটার পার্কার গরিব, ‘স্পাইডারম্যান’ ছবি শুরুই হচ্ছে বেনকাকার চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের খবর দিয়ে। খরচ চালানোর জন্য পিৎজা ডেলিভারি থেকে সংবাদপত্রের অফিসে স্পাইডারম্যানের ছবি বিক্রি, হরেক রকম কাজ করে বেড়ায় পিটার, তার বান্ধবী মেরি জেন রেস্তোরাঁয় বেয়ারার কাজ করে। প্রযুক্তি এখানে ক্ষতিকারক, প্রযুক্তিনির্ভর ওসকোর্পের মালিক নরম্যান ওসবোর্ন বা বৈজ্ঞানিক ডঃ অটো অক্টেভিয়াস দুজনেই এখানে খলনায়ক। মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য তড়িঘড়ি অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র তৈরি করতে গিয়েই ঘটে ওসবোর্নের দুর্গতি, বারবার সতর্ক করে দেওয়া হয় অতিরিক্ত প্রযুক্তি নির্ভরতার বিপদ সম্বন্ধে।

              ডিজনির সহায়তায় হালফিলে মার্ভেল যে বিপুল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স গড়ে তুলেছে, সেখানে অবশ্য এমন বৈপ্লবিক উপাদানের জায়গা নেই বললেই চলে। অ্যাভেঞ্জার্স দলের অতিমানবেরা এখানে সরাসরি মার্কিন সেনাবাহিনীর সহায়ক দল হিসেবে কাজ করে। তাদের পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন সেনাধ্যক্ষ নিক ফিউরি, ‘এজ অফ আলট্রন’ ছবির শেষে অ্যাভেঞ্জারদের ঝাঁ চকচকে প্রশিক্ষণ শিবিরে কুচকাওয়াজ করে যায় সেনাবাহিনি। সমস্ত অত্যাধুনিক মিলিটারি প্রযুক্তি ব্যবহারে অ্যাভেঞ্জারদের অবাধ অধিকার। ক্যাপ্টেন আমেরিকা নিজেই একজন প্রাক্তন সেনা, আয়রন ম্যান তথা টনি স্টার্কের বাবা হাওয়ার্ডের বিপুল সম্পদ এসেছে পৃথিবী জুড়ে প্রাণঘাতী অস্ত্র বিক্রি করে। টনির নিজস্ব কোনো অতিমানবিক ক্ষমতা নেই, তার শক্তি পুরোটাই প্রযুক্তিনির্ভর। অ্যাভেঞ্জারদের প্রত্যেক অভিযানে চলে বিধ্বংসী প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাশুল গুনতে অকুস্থলে প্রতিবার বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সোকোভিয়া অ্যাকর্ড জনিত ঝামেলার সূত্রপাত তো এই কোল্যাটারাল ড্যামেজ জনিত বিবাদের জেরেই।

      এমসিইউয়ের মাকড়সা মানুষও তাই অ্যাভেঞ্জারদের মূল দর্শনের দাবি মেনে অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর। ম্যাগোয়ারের স্পাইডারম্যানের দেহে স্বাভাবিক জৈব উপায়ে তৈরি হত জালের উপাদান, গারফিল্ড বা হল্যান্ড কিন্তু জাল ছুঁড়বার জন্য গবেষণাগারে তৈরি কৃত্রিম ওয়েব শুটারের উপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তিবিদ এখানে খলনায়ক নয়, বরং টনি স্টার্ক তরুণ পিটারের গডফাদার, তার কাছে জীবন্ত অনুপ্রেরণা। স্টার্কের মহিমায় নিত্যনতুন অত্যাধুনিক বাহারি স্পাইডার স্যুট প্রাপ্তি হয় তার, না চাইতেই মিলে যায় এমআইটিতে ভর্তি হবার সুযোগ। ‘হোমকামিং’ ছবিতে মেহনতি আদ্রিয়ান টুমসের কারবার ডুবে যায় স্টার্ক ইন্ডাস্ট্রিজ এবং সরকারের খেয়ালখুশির মূল্য চোকাতে, অথচ কাহিনির শেষে তাকে প্রায় পুরোপুরি খলনায়ক বানিয়ে দেওয়া হয়। পিটার বিলাসবহুল অ্যাভেঞ্জার্স ম্যানসনে থাকার লোভনীয় প্রস্তাব খারিজ করে দিলেও  নিউ ইয়র্কে সে প্রায় থাকেই না, স্টার্কের স্নেহধন্য হবার সুবাদে অনায়াসে ইউরোপ টিউরোপ ঘুরে বেড়ানোর ভিসা জুটে যায় তার, এমনকি অ্যাভেঞ্জারদের সাহায্য করতে সে অন্তরীক্ষেও পৌঁছে যায়। স্টার্কের প্রশংসা পেতে সে সবসময় উদগ্রীব, মেহনতি মানুষের নায়ক স্পাইডারম্যানের নিজস্ব তকমা সেখানে অনেকটাই লোপ পেয়ে যায়।

     ‘ফার ফ্রম হোম’ ছবির শেষে মিস্টিরিওর ভিডিওতে সবাই জেনে যায়, স্পাইডারম্যান আসলে পিটার পার্কার। ঠিক এখান থেকেই শুরু হয় ‘নো ওয়ে হোম’ ছবির গল্প। পরিচয় ফাঁস হয়ে যাবার ফলে ব্যক্তিগত জীবনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায় পিটার, মিস্টিরিও হত্যার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে বাতিল হয়ে যায় তার এমআইটিতে ভর্তির আবেদন, বাদ যায় না প্রিয় বন্ধু নেড আর বান্ধবী এমজেও। নিরুপায় পিটার জাদুসম্রাট ডক্টর স্ট্রেঞ্জকে অনুরোধ করে, জাদুমন্ত্রের সাহায্যে সবাইকে তার পরিচয় ভুলিয়ে দিতে। কিন্তু মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে বারবার সিদ্ধান্ত বদল করতে থাকে পিটার। তার বাধা দেবার ফলে মন্ত্র গোলমাল হয়ে বিভিন্ন ফাঁক তৈরি হয় মাল্টিভার্সে, বিকল্প বিশ্ব থেকে স্পাইডারম্যানের খোঁজে হাজির হয় ডক্টর অক্টোপাস, গ্রিন গবলিন, ইলেক্ট্রো, লিজার্ড প্রভৃতি খলনায়ক। সব্বাইকে নিজের নিজের বিশ্বে ফেরত পাঠিয়ে আবার কিভাবে ফাঁকফোকর মেরামত করে স্পাইডারম্যান আর ডক্টর স্ট্রেঞ্জ, এ নিয়েই তৈরি হয়েছে ছবির গল্প।

    প্রথমেই বলে রাখা যাক, এ ছবির ভাবনায় বিশেষ নতুনত্ব নেই, পুরোটাই ইচ্ছেপূরণের গল্প। দর্শককে ভাবানো নয়, যে কোনো প্রকারে বিভিন্ন জনপ্রিয় চরিত্রকে একসঙ্গে পর্দায় জড়ো করে দর্শকের হাততালি কুড়নোই এ ছবির মূল উদ্দেশ্য। ‘ইনফিনিটি ওয়ার’ এবং ‘এন্ডগেম’ ছবির দুর্দান্ত সাফল্য এই ছবির নির্মাতাদের এভাবে ভাবতে প্রভাবিত করেছে, বোঝাই যায়। এতদিনে প্রায় সবাই জেনে গেছেন, এ ছবিতে দেখা গেছে অ্যান্ড্রু গারফিল্ড আর টোবি ম্যাগোয়ারের স্পাইডারম্যানকেও। বলে রাখা যাক, গারফিল্ড আর ম্যাগোয়ারের উপস্থিতি কিন্তু একেবারেই ক্যামিওতে সীমাবদ্ধ নয়, রীতিমতো দীর্ঘ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেওয়া হয়েছে তাদের। পুরনো ছবির নস্টালজিয়া আরো উসকে দেবার জন্য রয়েছে চেনা সংলাপের ব্যবহার, আগের অভিযানগুলোর স্মৃতি রোমন্থন।

      তবে বিষয়বস্তুর দিক থেকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপাদান নিঃসন্দেহে এ ছবিতে খলনায়কদের প্রতি মনোভাব। পরিচিত খলনায়কদের এখানে সংশোধনের অযোগ্য শয়তান বলে নিকেশ করে দেওয়া হয় নি, বরং সারিয়ে তুলে সমাজের মূলস্রোতে ফেরাবার কথা বলা হয়েছে। সারিয়ে তুলবার পদ্ধতি সেই বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির চেনা ছকে বাঁধা হলেও, যে মার্কিন সভ্যতা সর্বদা নেটিভ আমেরিকান, কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান, মুসলিম প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়কে অপরায়িত এবং দানবায়িত করতে মুখিয়ে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে এমন মনোভাব তাৎপর্যপূর্ণ তো বটেই। ইলেক্ট্রো যখন গারফিল্ডের স্পাইডারম্যানকে বলে, ‘তুমি গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াও, আমি ভেবেছিলাম তুমি কৃষ্ণাঙ্গ’, কোথাও যেন তা ছুঁয়ে যায় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকেও। সঙ্গে উঠে আসে আরেকটা প্রশ্ন, এমসিইউতে কি এবার তবে অ্যানিমেশনের মাইলস মোরালেস-কে স্পাইডারম্যান হিসেবে দেখা যাবে?

    মার্ভেলের ক্যামেরার কাজ নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই, এমসিইউ অনেকদিন ধরেই ভিএফএক্স ব্যাপারটাকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে। ক্রিস ম্যাকেনা ও এরিক সমার্সের চিত্রনাট্য এতগুলো চরিত্রকে ধরাতে গিয়ে মাঝেমধ্যে অসুবিধায় পড়েছে, দ্বিতীয়ার্ধের খানিকক্ষণ ছবির গতি বেশ ঝুলে গিয়েছিল। তিনজন মাকড়সা মানুষকে একসঙ্গে অতক্ষণ  পর্দায় সময় দেওয়া আদৌ চিত্রনাট্যের সাথে যুক্তিসঙ্গত হয়েছে কিনা, এ নিয়েও তর্ক উঠতে পারে। ভালো লেগেছে মাইকেল জিয়াচ্চিনোর আবহসঙ্গীত, বিশেষ করে ‘স্পাইডারম্যান, স্পাইডারম্যান’ থিমের যথাযথ ব্যবহার প্রশংসনীয়। অভিনয়ে প্রত্যেকেই সুন্দর, এতজন বাঘা শিল্পীদের মধ্যে একবারের জন্যও চাপা পড়ে যাননি তরুণ টম হল্যান্ড, সপ্রতিভ অভিব্যক্তির জোরে পাল্লা দিয়ে নজর আদায় করে নিয়েছেন। বিশেষ করে বলতে হবে উইলেম ডাফোর কথা, ছেষট্টি বছর বয়সেও যেসব স্টান্ট তিনি পর্দায় উপহার দিলেন, শুধু সেজন্যই তাঁর মুগ্ধতা প্রাপ্য। একগাদা পুরুষের মাঝে দুর্দান্ত অভিনয়ে আলাদা করে নজর কেড়ে নিয়েছেন জেন্ডায়া ও মারিসা টোমেই। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এ ছবির শেষে পিটার কিন্তু তার সুবিধাভোগী অবস্থান অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। কাকিমা নেই, টনি নেই, গোটা পৃথিবীতে কেউ নেই যে তাকে স্পাইডারম্যান হিসেবে চেনে। ঘুপচি ফ্ল্যাটের ঘরে শুরু হয় মুখোশধারী যোদ্ধা হিসেবে তার একা লড়াই। আগামী ছবিগুলোয় কি তবে আবার দেখা যাবে মেহনতি মানুষের বন্ধু সেই চেনা ‘friendly neighbourhood spider-man’কে? দেখা যাক! 

                

#স্পাইডারম্যান: নো ওয়ে হোম #রিভিউ #সিলি পয়েন্ট #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

8

Unique Visitors

181900