স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা সংবাদপাঠক সাইদা বানো
ঘরে বানানো ব্রাউন ব্রেডে নিজের হাতে মাখন লাগাচ্ছিলেন যিনি, সেসময়ে তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই চলে গোটা দেশ। তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। অথচ কোনও বেয়ারা কিংবা খানসামা নয়, সামনে বসা মহিলার প্লেটে নিজের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন তিনি। ওই মহিলাই যে আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর ব্রেকফাস্ট টেবলের সম্মানিত অতিথি! নেহরু নিজে তাঁর অফিসে গিয়ে তাঁকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, রোজ সকালে অফিসে ছুটতে হয় বলে ভাল করে খাওয়াদাওয়া হয় না এই যুবতির। সেই কারণেই এমন আকস্মিক নিমন্ত্রণ।
খোদ পণ্ডিত নেহরু যাঁকে নিজের বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান, কে এই মহিলা?
তাঁর পরিচয়, একটা ছোট্ট চুড়ির আওয়াজ। রেডিওতে সকালের খবর শুরু হওয়ার আগে যে রিনরিন শব্দটুকু কানে আসে। যে সময়ে সংবাদপাঠকদের মুখ দেখা যেত না, কেবল গলা শোনা যেত, এ সেই যুগের কথা। ওই শব্দটুকু যেন ইঙ্গিত। যা শুনে রেডিওর গায়ে কান পেতে থাকা শ্রোতারা বুঝতে পারতেন, খবর পড়বেন সাইদা বানো। দেশের প্রথম মহিলা সংবাদপাঠিকা।
সাইদা প্রথমে কাজ করতেন লখনউ রেডিও স্টেশনে। প্রবাদপ্রতিম শিল্পী বেগম আখতারকে লখনউয়ের অভিজাত সমাজে পরিচিত করিয়েছিলেন সাইদা-ই। এমনকি ইশতিয়াক আব্বাসির সঙ্গে তাঁর বিয়ের ঘটকালিও করেন। আবার সেই বিয়ে ভাঙার পর অবসাদে ডুবে যাওয়া বেগম আখতারকে ফের গানের দুনিয়ায় ফিরিয়ে এনেছিলেন সাইদা।
বিয়ে ভেঙেছিল তাঁর নিজেরও। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পাঁচ দিন আগে, লখনউ থেকে বিদায় নিয়ে যখন নতুন শহরে এসে পা রাখলেন সাইদা, তখন তাঁর সঙ্গে কেবল দুই শিশুপুত্র। বিচারপতি আব্বাস রাজার সঙ্গে দশ বছরের বিবাহিত জীবনে আইনিভাবে ইতি পড়েছিল সেই বছরেই। সাইদার বয়স তখন মাত্র ২৭। এরপরে আইনজীবী এবং পরবর্তীতে দিল্লির মেয়র নুরুদ্দিন আহমেদ-এর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে চলেছিল সেই সম্পর্ক। কিন্তু আর বিয়ের বাঁধনে নিজেকে জড়াননি সাইদা।
আরও পড়ুন : রুপোলি পর্দায় দীর্ঘ চুম্বন ঠাকুরবাড়ির মেয়ের : নিয়ম ভাঙার আরেক নাম দেবিকা রানি / শিরিন বসু
বিবাহবিচ্ছেদের জেরেই আসলে লখনউ ছাড়তে চেয়েছিলেন সাইদা। সেই সূত্রেই ভেবেছিলেন খোদ রাজধানীর অল ইন্ডিয়া রেডিও স্টেশনে কাজ করার কথাও। যেখানে তখনও পর্যন্ত কোনও মহিলাকে খবর পড়ার জন্য বহাল করা হয়নি। নিজের জীবনের মতোই, এই ক্ষেত্রেও ছক ভেঙে দেন সাইদা বানো। বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতকে ইচ্ছের কথা জানাতেই, ব্যবস্থা হয়ে যায়। ১৩ অগস্ট সকালে, দিল্লির অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে প্রথমবারের জন্য ভেসে আসে মহিলা কণ্ঠে সংবাদপাঠ।
আরও পড়ুন : ফতোয়া, ফুটবল আর বাংলাদেশের মেয়েরা : এক সত্যি-রূপকথার গল্প / বিয়াস বসু
যখন দেশের অধিকাংশ মেয়ের জীবন অন্দরমহলের বাইরে আসার সুযোগ পেত না, সেই সময়ে সব বাঁধা ছক ভেঙেচুরে নিজের শর্তে জীবন বেঁচেছিলেন সাইদা। খানদানি মুসলিম পরিবারের মেয়ে সব রক্ষণশীলতার পর্দা উড়িয়ে একা গাড়ি চালাতেন। নতুন শহরে এসে বাস করতে শুরু করেছিলেন একাই। সম্পর্কও বেছে নিয়েছেন নিজেই। কাটিয়েছেন সিঙ্গল মাদারের জীবন। আর এই সবকিছু মিলিয়েই বিপুলসংখ্যক মানুষের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন এই সাহসী মহিলা।
আরও পড়ুন : প্রথম এভারেস্টজয়ী মহিলা : জুনকো তাবেই / মন্দিরা চৌধুরী
বর্তমান শতাব্দীতেও যখন বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগে আমাদের সমাজ বিন্দুমাত্র ভাবে না, ভাবে না নিজের শর্তে নিজের জীবন কাটাতে চাওয়া একজন নারীরও সাংবিধানিক অধিকার, তখন সাইদা বানোর মত মহিলারাই বারবার ফিরে ফিরে আসেন। ফিরে আসেন এই ঠুনকো সংস্কার সর্বস্ব সমাজের গালে কষিয়ে থাপ্পড় মারতে।
........................
সিরিজ-পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র
#Saeeda Bano #news broadcaster #All India Radio #silly পয়েন্ট #নারীপক্ষ