ফতোয়া, ফুটবল আর বাংলাদেশের মেয়েরা : এক সত্যি-রূপকথার গল্প
সবারই লড়াইয়ের গল্প থাকে। কখনও প্রকাশ্যে কখনও অন্তরালে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আপসের বিপক্ষে আবার কখনও বা নিজের সঙ্গেই। লড়াকু মন কখনও একা থাকে না। জড়িয়ে পড়ে। সমমনস্ক যোদ্ধাদের সঙ্গে। ব্যক্তির লড়াই ক্রমশ জনস্রোতে মিলে গেলে যুদ্ধ শুরু হয়। আর চুপ থাকা নয়, এবার এসপার-ওসপার। অন্তিম প্রত্যাঘাত। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাই তো মারিয়া মান্ডার পাশে এসে দাঁড়ায় মাসুরা পারভিন। সাবিনা খাতুনের হাত ধরে কৃষ্ণারানি সরকার। অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে আসে আনাই মোঙ্গিনী, আনোচিন মোঙ্গিনী, মনিকা চাকমা। ঘাসের উপর বিদ্যুৎ খেলা করে। চকিত ড্রিবলে কেটে যায় কুনজর। তে-কাঠির নিচে দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠে রুপনা চাকমা। বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতার সীমানা ছাড়িয়ে ছুঁয়ে ফেলে উচ্চ পর্যায়ে সাফল্যের শিরোপা। কী দুঃসাহস!
যে দুঃসাহসে ভর করে বাংলাদেশ নারী ফুটবল টিম ২০২২ এর সাফ কাপ মঞ্চ থেকে জিতে ফেরে। এত সাহস আসে কোথা থেকে? মেয়েরা কী জানে না হাফ-প্যান্ট পরে ফুটবল খেলা হারাম! জানে না মেয়েদের এমন বারমুখো হতে নেই? দু চারজন প্রতিবেশীর বাঁকা নজর তো নয়, রোজ দুবেলা সমাজের ছিচ্ছিকার সামলানো যায় কোন মনের জোরে? তারা ভুলে গেল ২০০৩ সালের গোড়ার দিকের অস্থিরতা অথবা ২০১৬-র নাগেশ্বরী জেলা?
ভুলে গেল?
হ্যাঁ! তারা ভুলে গেছে। সামান্য স্পোর্টস বুট কেনার জন্যে ক্লাস থ্রির মারিয়া মাণ্ডা যখন স্কুল ছুটি নিয়ে খেতে দিনমজুরের কাজ করে তখন তার এসব দিকে মাথা ঘামানোর সময় হয় না। সময় পায় না কালোসোনা চাকমার মেয়েও। সাফ কাপ জেতার আগে যার মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের ঠিক ছিল না। প্রতি বর্ষায় ভেসে গেছে ঘর। ডুবে গেছে ভিটে। গোলপোস্ট আগলাতে আগলাতে রূপনা চাকমার কী একবারও মনে পড়েনি, অনেক হল এবার ঘর আগলানো যাক। বেসরকারি সূত্র অনুসারে ক্লাব ফুটবলে পুরুষ ও নারীর খেলোয়াড়ের বেতনের ফারাকটা প্রায় ৪৫ লক্ষ টাকা। আর জাতীয় দলের হয়ে যখন তারা মাঠে নামে? ম্যাচ প্রতি কত পায় তারা! অঙ্কটা ফের ব্যঙ্গ করে। তবু সেই অঙ্কেই তাদের জীবনের হিসেব মিলে যায়। মাসুরা পারভিন দলের পাশাপাশি বাড়ির ডিফেন্স জোনও সামলান। অসুস্থ রাজিব আলি দেখেন একদিন মেয়েকে যে খেলার জন্যে তীব্র শাসন করেছিলেন আজ সেই খেলার সুবাদেই ভাড়া বাড়ির খোঁজে চিরুনিতল্লাসি বন্ধ হয়ে এতদিনে নিজের জমিতে বাড়ি উঠেছে। রোগশয্যায় সাময়িকভাবে অকর্মণ্য হয়ে পড়লে মেয়ে এগিয়ে এসে সংসারের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছে। অথচ যেসব সমাজপতির নিন্দার ভয়ে তিনি ছোটবেলায় মেয়েকে খেলতে দেননি, বিপদের সময় তাদের দেখা মেলেনি। আজ সবাই যখন তাঁকে ফুটবলার মাসুরা পারভিনের বাবা বলে চেনে, রাস্তাঘাটে আঙুল তুলে সঙ্গীকে দেখায়, লজ্জা সরিয়ে ছুটে আসে গর্ব। খুব ভালো লাগে। এই ভালো লাগাটুকুর জন্যেই তো সব কিছু। যার জন্যে দিনরাত টিমের সঙ্গে পড়ে থাকেন গোলাম রব্বানি ছোটন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দলের কোচ। একসময় যাকে টিটকিরি দিয়ে ডাকা হত ‘মহিলা কোচ’ বলে। তবুও কোনও হীনমন্যতাকে তিনি আমল দেননি। একাগ্র ভাবে প্র্যাক্টিসের উপর জোর দিয়েছেন আর অপেক্ষা করেছেন। কারণ তিনি শুরু থেকেই নিশ্চিত ছিলেন সাফল্য আসবেই। সমস্ত ফতোয়ার বিরুদ্ধে মাঠে নামলেই সাফল্য আসবে। সাফল্য আসবে ভালোবাসার জোরে।
ভালোবাসা ছিল বন্ধকী গয়নায়। সংসারের পিছনে মাইনের সবটুকু খরচ হয়ে যাওয়ার পরে শেষ সম্বল হিসেবে যা জমা রেখে ঋতুপর্ণা চাকমার খেলার খরচ যুগিয়ে দিতেন তাঁর দিদি। এই ভালোবাসার জোরেই শখের বশে খেলতে আসা মেয়েটি ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠল। একসময় জেঠুর জেদের চাপে ভর্তি হয়েছিলেন কলসিন্দুর স্কুলে। এই স্কুল সানজিদা আখতার, মারিয়া মাণ্ডারও। মেয়েদের জন্য আয়োজিত বঙ্গমাতা প্রাথমিক স্কুল ফুটবলে চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার হ্যাটট্রিক করা এই স্কুলেই প্রথম পায়ে ফুটবল হয়েছিল ঋতুপর্ণার। তারপরের রুটম্যাপে বাসা বেঁধে আছে অনেকটা শ্রম। জেঠুর জেদ যে কখন নিজের হয়ে গেছে বুঝতেই পারেননি। একইভাবে বলা যায় রাঙ্গামাটি জেলার ঘাগরা হাইস্কুলের হেড মাস্টার চন্দ্রা দেওয়ানের কথা। বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে রুপনাকে খেলতে দেখে নিজের উদ্যোগে স্কুলে এনে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করেন। মাফ হয়ে যায় বেতন। একই সঙ্গে এক শিক্ষকের বাড়িতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দেন। এইসব মানুষগুলোর জন্যেই তো কাপ জিততে চান সাবিনা, কৃষ্ণারা। তাই ফাইনালের আগের রাতের পোস্টে সানজিদা লিখলেন, ‘যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্যে এটি জিততে চাই।’ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, ভালোবাসার পাশে দাঁড়ানো। নিজেদের হেরে গিয়েও তাদের জেতার জন্যে জীবন বাজি রেখেছে যারা তাদের একবার হলেও জিতিয়ে দেওয়ার গল্প। আর কে না জানে ভালবাসার কাছে সকল ফতোয়া মিথ্যে হয়ে যায়। বিদ্বেষ মাথা নামিয়ে রাখে।
আরও পড়ুন : রুপোলি পর্দায় দীর্ঘ চুম্বন ঠাকুরবাড়ির মেয়ের : নিয়ম ভাঙার আরেক নাম দেবিকা রানি / শিরিন বসু
তাই তারা অতীতের বিক্ষোভ ভুলে গেছে। ভুলে গেছে স্টেডিয়াম ঘেরাও করে তৈরি করা ভয়ের পরিবেশের কথা। মেয়েদের খেলার বিরুদ্ধে একের পর এক মিটিং মিছিলের কথা।
আরও পড়ুন : মুথুলক্ষ্মী রেড্ডি কোনো দেবদাসীর নাম নয় / রোহন রায়
প্রতিদিন উঠতে থাকা একের পর এক তির্যক আঙুলকে পাত্তা না দিয়ে তারা শুধু খেলে গেছে আর খেলে গেছে।
‘এই লেগে থাকাই তো বেঁচে থাকা।’
.......................................
সিরিজ-পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র
#SAFF Women's Championship #Bangladesh Football