আখ্যানের খোঁজ (ষষ্ঠ পর্ব)
[পঞ্চম পর্বের পর]
.....................
১২
শেঠ আর বসাকদের কাছে যেটুকু জমি ছিল সেসব ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে। বড্ড যুদ্ধ লেগেছে নাকি! কোন এক তেইশ বছরের নবাব জ্বালিয়ে দিয়েছে ইংরেজদের প্রিয় দুর্গ। তাই তৈরি হবে নতুন দুর্গ। সেখানে থাকবে অত্যাধুনিক কামান। কামানের গোলা যাতে সরাসরি আঘাত হানতে পারে তাই জঙ্গল পরিষ্কার করতে হবে। গোবিন্দপুরের বাসিন্দাদের উঠে যেতে হবে এখনকার শোভাবাজার, তালতলার দিকে। অবশ্য খুব বেশি মানুষ তো নয়। প্রায় জঙ্গলই বলা চলে। সেই জঙ্গলে কাঠ কাটার অনুমতি দেওয়া হল দেশীয় মানুষদের। গড়ের মাঠ জন্ম নিল। সব গাছই কাটা হয়েছিল সেসময়। শুধু কিছু বটগাছের শিকড় থেকে গেছিল মাটির অনেক নিচে, আশ্চর্য শিকড় সেসব। ওদের মরণ নেই। ওপরের গাছ কাটা পড়েছে কয়েক শতাব্দী আগে। কিন্তু মাটির নিচে বেড়ে চলেছে শিকড়। যত সময় গেছে তত আরও গভীরে চারিয়ে গেছে। আর এইভাবেই কলকাতার নিচে গড়ে উঠেছে এক আশ্চর্য জঙ্গল। এই পৃথিবীর মানুষ তার খোঁজ পায়নি কোনোদিনই। কিন্তু সমস্ত জঙ্গলেরই নিজস্ব বাস্তুতন্ত্র আছে। প্রাণ আছে। যে প্রাণ অভিশপ্ত। সরীসৃপের দেহ নিয়ে যে প্রাণ খুঁজে চলবে আলো ও হাওয়া। ছটফট করবে। কিন্তু মরবে না।
-“ওপরের কলকাতার মানুষদের মধ্যেও অনেক সরীসৃপ আছে। স্যাঁতসেঁতে শরীর তাদের। আলো আর হাওয়ার মধ্যে থেকেও যাদের আলো ও হাওয়ার অধিকার নেই। যাদের ছায়া শুষে নিয়েছে পৃথিবীর মাটি। যারা আসলে ওই নিচের তলার লোক। কিন্তু নিচে যাওয়ার দরজাটা শুধু খুঁজে পায়নি বলে তারা আমাদের মধ্যেই রয়ে গেছে। মরণ তাদের ছোঁয় না। জীবনও তাদের ব্রাত্য করে রেখেছে। কত শতাব্দী ধরে তারা একটা দরজা খুঁজছে। যে দরজা রাখা আছে বিশেষ কোনও ঘরে। সেই ঘর দুই পৃথিবীর মাঝখানে। ঘরটা কোথায় আমি জানি না। জানলেই…”
গড়ের মাঠে সন্ধে নেমেছিল অনেকক্ষণ। বাঁশিওয়ালা সন্ধের হাওয়ায় গল্প ভাসিয়ে দিচ্ছিল। আখ্যান শুনছিল চুপ করে। সে বাঁশিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, “ওই ঘরটাই কি খুঁজছি আমি?”
বাঁশিওয়ালা ভাবলেশহীন মুখে বলল, “আমরা কি সত্যিই জানি আমরা আসলে ঠিক কী খুঁজছি?”
সন্ধের গড়ের মাঠ। ঘন হয়ে আসা যুগলের দল। ওরা প্রেম করে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ঘর বাঁধবে। কারও কারও আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। অনেকেই ভুলে যাবে এই সন্ধেটা। কেউ কেউ আবার কোনোদিন ভুলতে পারবে না। এই পৃথিবীর কত সাধারণ সন্ধে, কত সাধারণ বিকেল মানুষ নিজের মনের ঘরে যত্নে সাজিয়ে রাখে আমরা কি জানি? আমরা কি জানি কেন বাঁশিওয়ালার কথা শুনতে শুনতে আখ্যানের মনে পড়ে যাচ্ছে তার ফেলে আসা প্রেমিকার কথা! যাকে আখ্যান ছেড়ে এসেছে। যে আখ্যানকে ছেড়ে গিয়েছে। তাদের মধ্যে এখন শুধু কয়েকটা বিকেল ছড়িয়ে আছে কদমফুলের মতো।
আখ্যান কোনোদিনও তাকে বলতে পারেনি তার নিজের পরিবার আসলে একটা যুদ্ধক্ষেত্র। সন্দেহের সাপ ঘুরে বেড়ায় সেখানে। তাদের তীব্র বিষে বড়ো জ্বালা। সেই বিষ ঘুম শুষে নেয়। যতক্ষণ বাড়ি থাকতে হয় ততক্ষণই থাকতে হয় সেই গনগনে যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে। রাত্রি সেখানে কোনও স্নিগ্ধ যুদ্ধবিরতি নিয়ে আসে না। আখ্যান ভয় পেত। যুদ্ধের সমস্ত বিষ ও আগুন পান করে ভাবত এসব তার নিজস্ব চিতা। এই দহন দেখছে না আর কেউ, এই তার একমাত্র শান্তি।
কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের মানুষ জানতেই পারেনি কখন প্রেম সরে গেছে শেষ বিকেলের মতো। সন্ধে নেমেছে সম্পর্কে। ক্লান্ত সৈনিক একবার শুধু চোখ তুলে দেখেছে অনেক দূরে, কী সুন্দর কৃষ্ণচূড়া বিকেল শেষ হয়ে যাচ্ছে।
১৩
বাঁশিওয়ালা লোকটাও জানে না ঘরের সন্ধান। না জানাই স্বাভাবিক। তবু আখ্যানের কেন যে মনে হল ওকে জিজ্ঞেস করি! আখ্যানের কেন যে মনে হয়, এই পৃথিবীর কোনও না কোনও ছন্নছাড়া মানুষের কাছে রাখা আছে ঘরটার ঠিকানা! সেসব যাক। প্রচণ্ড গরমের দিন গেছে আজ। আমাদের আখ্যান পুড়েই গেছে বলা যায়। এই বিয়াল্লিশ ডিগ্রির গরমে রোজ পুড়তে পুড়তে আখ্যান যেন হয়ে উঠছে অন্য মানুষ। এদিকে রাতগুলোও ঘুমহীন। শুধু ঘুম না আসার বিরক্তি কাটাতে আখ্যান এইসময়গুলোতে ডেটিং অ্যাপ খোলে। ভারী মজার জিনিস এই ডেটিং অ্যাপ। পছন্দ হলে রাইট সোয়াইপ। পছন্দ না হলে লেফট সোয়াইপ। দুপ্রান্তের পছন্দ মিলে গেলে ম্যাচ। আখ্যান প্রত্যেক দিনের অভ্যাসে এই রাইট সোয়াইপ লেফট সোয়াইপ করে। করতে করতে ভাবে, মানুষ ঠিক কতটা একা হলে ডেটিং অ্যাপে বন্ধু খোঁজে!
ম্যাচ আখ্যানের হয় না তেমন। আখ্যানকে তো আহামরি দেখতে নয়। তার সেই যে প্রিয় বন্ধু মিছিল, তার মতো দেখতে হলে নাহয় কথা ছিল। কিন্তু আবার কখনও-সখনও ম্যাচ হয়েও যায়। দু-চারটে কথার পর কখনও কখনও কোনও পোড়া বিকেলে আখ্যান দেখা করে নতুন মেয়ের সঙ্গে। হালকা গল্পের ক্যাফে। একরকম লোকজন। আখ্যানের মনে পড়ে যায় অনেকদিন আগে এক বিকেলের কফি হাউস। আখ্যান তার জীবনের প্রথম মেয়েকে পাবলো নেরুদার কবিতা শুনিয়েছিল। …leaning into this afternoon I cast my saddest nest towords your oceanic eyes. সেইসব বিকেল হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। এখনকার বিকেল যান্ত্রিক। ফোন থেকে উঠে আসা। রোজকার একঘেয়ে খোঁজের ফাঁকে সামান্য আড্ডা। নতুন মানুষের চোখে নিজের কোনও নতুন ছায়া দেখে বাড়ি ফিরে আসা। এর বেশি কোনোদিন কিছু চায়নি আখ্যান। চায়নি। তবে হয়ে গেছে। সেবার এক গবেষকের সঙ্গে আখ্যানের দেখা করার কথা। সেটা যদিও বিকেল নয়। দুপুর। আখ্যান তালতলার কাছে ছিল। গবেষক পিএইচডির থিসিস লেখা শেষ করেছেন। বাঁধাতে এসেছেন বিখ্যাত থিসিস বাইন্ডিংয়ের দোকান ধর ব্রাদার্সে। বললেন, এইখানেই চলে এসো, সারাদিন এইখানেই যাবে। আখ্যান গেল। সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়ের পাশে বসে সারাদিন সম্পূর্ণ অপরিচিত বিষয়ের গবেষণাপত্র সাজিয়ে দিতে সাহায্য করল। এর দু-একদিন পরেই সেই মেয়ে গবেষণাপত্র জমা করে উড়ে যাবে চেন্নাইতে। নতুন চাকরি, নতুন জায়গা। অসমের মেয়ে গবেষণার সূত্রে কলকাতা। এইবার চেন্নাই। পাকা গমের মতো রং তার। কপালে লাল টিপ। চোখে চশমা। আর পিঠে লাগানো একজোড়া অদৃশ্য ডানা। এইসব পাখি এখনও রয়েছে পৃথিবীতে। হালকা তাদের শরীর। ডানায় লেগে আছে ঝড়ের স্মৃতি। সেসব ঝড় ডানাকে আরও শক্তি দিয়েছে।
সেও ছিল এক গরমের দিন। আসলে সন্ধে। ধরের কাজ শেষ করে ওরা দুজনে নেমেছিল রাস্তায়। এইবার একটু পরিচয়ের সুযোগ ঘটল। মেয়েটি প্রথমেই বলেছিল আখ্যান নাকি এক অদ্ভুত মানুষ। এইরকম অপরিচিতার গবেষণাপত্র এডিট করতে সাহায্য করা, তাও সারাদিন ধরে.... এসব নাকি খুব রেয়ার ঘটনা। আখ্যান কিছু বলেনি। হেসেছিল শুধু। আসলে ওইদিন তার আর রাস্তায় রাস্তায় ঘর খুঁজে বেড়াতে ইচ্ছে করছিল না। তাই সদ্য ম্যাচ হওয়া ডেটের সঙ্গে দেখা করতে চলে এসেছিল থিসিস বাঁধাইয়ের দোকানে।
রামমোহন রায় স্ট্রিট থেকে সেদিন ওরা হেঁটে এসেছিল মধ্য কলকাতার এক বেশ পুরোনো বারে। ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই বার । লাল বড়ো বড়ো জানলা। ভেতরে হলুদ আলো। টেবিলের ওপর পেতে রাখা হলুদ চাদর। শেষ হয়ে যাওয়া মদের বোতলে জল। ওরা নিয়েছিল ড্রট বিয়ার। সঙ্গে বাদাম মাখা। গল্পের সন্ধে নেমেছিল সেদিন। আবছা নেশা ঢেকে দিচ্ছিল মাথা। আখ্যানের শার্টের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা ঘাসজমির দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলছিল, আর দুদিনের মধ্যেই তার কাছে কলকাতা ফুরিয়ে যাবে।
বাড়ি ফেরার কোনও ইচ্ছে আখ্যানের কোনোদিনই থাকে না। নিতান্ত ফেরার কোনও জায়গা নেই বলেই সে বাড়িতে ফেরে। বাড়ি না ফেরার ইচ্ছা আখ্যানের তীব্রতর হল। ওরা উজিয়ে গেল ধর্মতলার এক মোটের ওপর ভদ্রস্থ সরাইখানায়। কলকাতার রাত তখন ভ্যান গঘের ক্যানভাস। তীব্র ব্রাশের টান তৈরি করছে তারার রাত।
সরাইখানার ঘরের ভেতরে তুমুল ঝড়। পাখির ডানা ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে আমাদের আখ্যান। তার শরীর থেকে খসে পড়ছে ঘাম। আখ্যান ভুলে যাচ্ছে খোঁজের কথা। এমনকি ঘরের কোনায়, অন্ধকারে ভীষণ রেগে তাকিয়ে থাকা সাপেদের দিকেও তার নজর যাচ্ছে না। পাশে রাখা মোবাইলে বেজে চলেছেন বেঠোভেন। জ্যোৎস্না-ঝড়ের সুর মিশে যাচ্ছে ঘরের আলোয়। অস্ফুট চিৎকারে ঘোর কেটে যায় আখ্যানের। গবেষক শুয়ে আছেন তাঁর ওপর। মাথার চুলে ঝড়ের কুটো।
তিনি কাঁদছেন। ফিসফিস করে আখ্যানকে বললেন, তাঁকে ফিরে যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে এক্ষুনি। আখ্যানের সমনামী এক প্রেমিক রয়েছেন তাঁর। তিনি জার্মানিতে। সেই প্রেমিক নৈতিক বহুগামিতায় বিশ্বাসী। গবেষিকার মনে হয়েছিল সেই স্রোত লাগিয়ে নেবেন নিজের ডানায়। কিন্তু তাঁর ডানা ভিজে গেল খুব। ওড়ার জন্য বড্ড ভারী হয়ে গেল ডানা। আখ্যান সেই প্রথম বুঝেছিল তার ভেতর একটা পাহাড়ি ঝরনা আছে। প্রচণ্ড শক্তি তার। পাখিদের ডানা ভিজিয়ে তাদের টেনে আনে মাটির বুকে।
খুব তাড়াতাড়ি অ্যাপ ক্যাব বুক করতে করতে সেই মেয়ে যেন শুকিয়ে নিচ্ছিল নিজের ডানা। ফিরে পাচ্ছিল নিজস্ব পাখিজন্ম। ডানায় শক্তি। আখ্যান দেখছিল কলকাতার আকাশে ডানা মেলেছে এক আশ্চর্য রাতপাখি। সে আর কোনোদিন কলকাতায় ফিরবে না।
১৪
প্রচণ্ড রোদের টিলা। দুহাত ছড়িয়ে শুয়ে রয়েছেন যযাতি। তাঁর খোলা শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে মধ্যাহ্ন সূর্য। প্রবল উত্তাপ যেন শুষে নিচ্ছে চুরি করা যৌবন। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে
ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি।
হবিষা কৃষ্ণবর্ত্নেব ভূয় এবাভিবর্দ্ধতে।।
পৃথিবী রত্নসম্পূর্ণা হিরণ্যং পশবঃ স্ত্রিয়ঃ ।
নালমেকস্য তৎ সর্ব্বমিতি মত্বা শমং ব্রজেৎ।।
কত সহস্র বছরের ভোগ তৃষিত অগ্নির মতো। এখনও অনির্বাণ। অথচ ভোগ শেষের ক্লান্তি? সে জমে উঠছে হিমালয়ের মতো। নিজের অস্তিত্বকে বড্ড ভারী মনে হয় তাঁর। চকিতে মনে পড়ে যায় কিছু মুখ। তীব্রতম আগুনের তাড়না টেনে নিয়ে গেছে তাঁকে। অথচ প্রতিবার ফিরে তাকিয়েছেন সেই দহন শেষের শান্তির দিকে। এই আশ্চর্য যাত্রাপথে ক্লান্তি থেকে যায়। শান্তি পড়ে থাকে।
এই যাত্রাপথটুকুই যযাতির জীবন। এই রাস্তায় প্রত্যেকদিন যযাতি একা হয়েছেন। তাঁর জীবনটাই যেন এক অনিঃশেষ গ্রীষ্মকাল। সেখানে তৃষ্ণা আছে। কিন্তু জল নেই কোথাও।
সেই গনগনে আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে দুঃখকে কীভাবে দেখেন যযাতি? যখন ছোটার নেশা উন্মত্ত ছিল তখন দুঃখকে মনে হত পথের ধুলো। চলার বেগই উড়িয়ে দেবে ওদের। তারপর ধীরে ধীরে যযাতি বুঝলেন, দুঃখ তো ধুলোই। তবে সোনার ধুলো। দুঃখহীন মানুষের মতো নির্ধন আর নেই। তখন তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন উড়ন্ত দুঃখদের দিকে। দুঃখ তাঁকে ধরা দিল না।
অ্যান্টিকের ব্যবসা চলতে লাগল নিজের নিয়মে। যযাতির ছন্নছাড়া জীবনটাও। মোকাম কলিকাতার সবচেয়ে পুরোনো পানশালায় তবু প্রত্যেক সন্ধেতে কীসের খোঁজে যান যযাতি? কার মুখের ছবি আঁকেন?
ছবি আঁকায় প্রথাগত দীক্ষা যযাতির ছিল না। এক আশ্চর্য মানুষ ছোটোবেলায় তাঁর বাড়ি আসতেন। তাঁর আঙুলে জাদু ছিল। পেশায় তিনি ভ্যানচালক। অথচ যখনতখন ভ্যান থেমে যেত তাঁর। রাস্তাঘাটে, যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতেন তিনি। যযাতিকে বলতেন, গান শেখার জন্য গলার থেকেও বেশি প্রয়োজন কান। আর ছবির জন্য বেশি প্রয়োজন চোখ। দেখতে না শিখলে আঁকা যায় না। তাই যযাতি দেখতেন। সেই লোক যখন ছবি আঁকত পাশে বসে থাকতেন যযাতি। সেই মানুষই যযাতিকে শিখিয়েছিলেন চিত্রকরেরা আসলে জাদুকর। এই যে সাদা পাতা, এত সমান। অথচ সেখানেই জন্ম নেয় পাহাড়। নদী। মাটির ওপর বেড়ে ওঠে গাছ। সেই গাছের ছায়া পড়ে। এ যদি জাদু না হয় তাহলে জাদু কী?
দেখে দেখেই যযাতি শিখেছেন তুলি আর পেনসিলের টান। তারপর একদিন আঁকার খাতাই হয়ে উঠল যযাতির নিজস্ব ডায়েরি। সেই খাতাকেই তিনি বলেন ফেলে আসা মুখের কথা। অথবা যে মুখ একদিন ফেলে গিয়েছিল তাঁকে, তার কথা।
ভালোবাসা কড়া নেড়েছিল দুয়ারে। একাধিকবার। অথচ কয়েকদিনের সম্পর্কের পরেই যযাতির মনে লাগত এক আশ্চর্য টান। খানিক যেন ভেসে যেতেন তিনি।
চিঠি লিখতে ভালোবাসতেন যযাতি। আসলে যযাতি সেই সময়ের মানুষ, যখন চিঠি গুরুত্বহীন হয়ে যায়নি। সমস্ত বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের নাম আর ঠিকানা লেখা থাকত এক লাল রঙের খাতায়। সেই খাতায় একবার এক অপরিচিত নাম আশ্চর্য করে দিয়েছিল তাঁকে। যযাতির স্মৃতিশক্তি অসামান্য। কিছু ভোলেন না তিনি। এই তাঁর অভিশাপ। লাল খাতার সমস্ত নাম ঠিকানা নিজে হাতে লিখেছেন তিনি। যারা তাঁর কাছের, যাদের সময়ে অসময়ে চিঠি লেখা যায়, তারা ছাড়া আর কেউই ওই খাতায় জায়গা পায়নি। তবু কীভাবে যেন এক অপরিচিতার নাম পাওয়া গেল সেই লাল খাতায়। ঠিকানাটা কলকাতার কাছেই। নিতান্ত কৌতূহলের বশেই তাঁকে চিঠি লিখলেন যযাতি।
আপনাকে পত্র লিখিতে সঙ্কোচ হইতেছে। আপনি নিশ্চয়ই বিরক্ত হইবেন। তথাপি কৌতূহল দমন করিতে অপারগ হইলাম। আসলে ঘটনা হইল এই যে…
এমন করেই শুরু। তারপর একদিন সেই অপরিচিতাই দেখা করার কথা বললেন। কদমফুলের গন্ধে সন্ধে নেমেছিল সেদিন। চায়ের দুটো কাপের মধ্যে বইছিল হালকা গল্পের হাওয়া। তারপর সেই গল্পের হাওয়া একদিন ঝড় তুলল।
ভেসে গেলেন যযাতি। জানতেন এ প্রেম পরিণতিহীন। অপরিচিতাও যে জানতেন না এমন নয়। কিন্তু তবু তো পরিণতি এল। আর সেই পরিণতির সঙ্গেই এল অভিশাপ।
প্রিয় মুখের থেকে দূরে সরে যেতে হল তাঁকে। সন্তানও এসেছিল। তারাও দূরেই গেল। ভেসে গেল যযাতির পূর্ব সংসার। উত্তর সংসার তো তৈরিই হল না। তার আগেই নিভে গেল একসঙ্গে বাজার করা। হাতে হাতে রান্নাবাটি। সূর্যাস্তের রান্নাঘর। পশ্চিমের রোদ এসে পড়েছে লোহার কড়ায়। ডিম, পিঁয়াজ, আদা-রসুনবাটা দিয়ে ম্যারিনেট করা মৌরলা মাছ যযাতি ছেড়ে দিচ্ছেন তপ্ত তেলে। অপরিচিতা স্নান করে এলেন। রান্নাঘরে সুগন্ধ। যযাতির কাঁধে একটা ভেজা আর ঠান্ডা গাল।
তারপর একদিন সেই সূর্যাস্তের রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন যযাতি।
(ক্রমশ)
...........................
[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]