জগদীশ-নিবেদিতা সংবাদ (দ্বিতীয় পর্ব)
...............
পর্ব ২। কলকাতায় নিবেদিতার আগমন
স্বামীজীর সঙ্গে মার্গারেটের সাক্ষাৎ ও তাঁর মানসিক পরিবর্তন
তখন মার্গারেট সদ্য হারিয়েছেন তাঁর প্রেমিককে। যাঁকে বিয়ে করে তিনি সংসার জীবনে প্রবেশ করবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন সদ্য। তরুণ সেই ইঞ্জিনিয়ারকে হঠাৎই বিদায় নিতে হয় পৃথিবী থেকে। বিষণ্ণ, নিঃসঙ্গ মেয়েটি যখন থিতু হতে চলেছেন স্কুল-শিক্ষিকা হিসেবে, তখনই তাঁর জীবনে এল সম্পূর্ণ নতুন এক বাঁক।
এক হিন্দু ভারতীয় সন্ন্যাসী বেদান্ত প্রচারের উদ্দেশ্যে আমেরিকা থেকে তখন এসেছেন লন্ডনে। সেটা ১৮৯৫-এর সেপ্টেম্বর মাস। উঠেছেন ক্যাভারশ্যাম এলাকায় মিঃ এডওয়ার্ড স্টার্ডি-র বাড়িতে (ক্যাভারশ্যাম গ্রামে এই বাড়িটি যে পাড়ায়, সেটা অনেকের মতে ছিল ক্যাভারশ্যাম প্লেস পার্ক নামে একটা আবাসন-এলাকায়, যদিও ঠিক কোন বাড়ি, সেটা আজ আর স্থির করা যায় না)। সুন্দর সাজানোগোছানো এক গ্রাম এই ক্যাভারশ্যাম, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে থেমস নদী। আর তার ওপর দিয়ে এক-এক জায়গায় বানানো রয়েছে ছোট ছোট সাঁকো।
এখানে আসবার পর এই প্রাচ্যদেশীয় সন্ন্যাসীর কথা শুনতে আস্তে-আস্তে মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। লন্ডনের ধনী শিক্ষিত পরিবারগুলিতে প্রায়ই তাঁর ডাক পড়তে থাকে, এই ‘হিন্দু যোগী’কে দেখবার আর তাঁর কথা শুনবার জন্য অনেকেই অধীর আগ্রহে জমায়েত হন সে সব জায়গায়। সে দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রেও তাঁর কথা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে তখন।
সুতরাং এই সন্ন্যাসী ততদিনে ইউরোপে, বিশেষ করে লন্ডনে অপরিচিত নন মোটেই। বছর দুই আগে আমেরিকার শিকাগোয় অনুষ্ঠিত কলাম্বিয়ান এক্সপোজিশন-এ আয়োজিত বিশ্ব ধর্মমহাসম্মেলনে হিন্দু ধর্মের স্বপক্ষে বক্তৃতা দিয়ে ইনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। সম্পূর্ণ অখ্যাত এক বাঙালি সন্ন্যাসী এখন লন্ডনের ঘরে-ঘরে সুপরিচিত নাম।
এবেন্জার কুক নামে তাঁর ওই শিল্পী-বন্ধুর কাছে মার্গারেট একদিন খবর পেলেন, ভারত থেকে আসা এই হিন্দু সন্ন্যাসী এখন লন্ডনে আছেন, আর ইনি এবার আসছেন তাঁদেরই পরিচিত এক ভদ্রমহিলার বাড়ি। তিনি ভাবলেন, একবার দেখেই আসা যাক।
সেই ধনী ভদ্রমহিলাটিরই নাম লেডি ইসাবেল মার্জেসন, যাঁর কথা আমরা একটু আগেই বলেছিলাম। তাঁরই বাড়িতে মার্গারেট প্রথমবার দেখলেন সেই ভারতীয় সন্ন্যাসীকে। সেটা নভেম্বরের দশ তারিখ, এক রবিবারের শীত-বিকেল। লেডি মার্জেসনের বাড়িতে সেদিন এসেছেন বেশ কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত বিশিষ্ট ব্যক্তিও।
যে ঘরটায় গিয়ে তিনি বসলেন নির্ধারিত দিনের বিকেলবেলা, সেখানে তখন জনা-পনেরো লোক। গেরুয়া আলখাল্লা পরা সন্ন্যাসীটির দিকে মুখ করে সকলে তাঁকে ঘিরে গোল হয়ে বসে। মার্গারেট সসংকোচে বসেছেন পিছনের দিকে। শুনছেন সন্ন্যাসীর ভরাট গলার কথা। কথার মাঝখানে প্রশ্নোত্তরপর্বও চলছে। মনোরম এক দৃশ্য হিসেবে সব মিলিয়ে ব্যাপারটা ভালো লাগলেও সন্ন্যাসীর কথায় কিন্তু মন টলল না তাঁর। চুপচাপ চলে এলেন বাড়িতে। তবে সন্ন্যাসীকে মন থেকে মোটেই মুছতে পারলেন না।
এরপরে ওই নভেম্বরেই স্বামীজীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল আরও দুবার; ১৬ এবং ২৩ তারিখে আরও দুটি ঘরোয়া সভায় উপস্থিত থাকলেন তিনি। তক্ষুনি টের না পেলেও স্বামীজীর প্রভাবে তাঁর ভিতরে এক আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে ততদিনে।
দিনকয়েক বাদে নভেম্বরের সাতাশ তারিখে স্বামীজী চলে গেলেন আমেরিকায়, পরের বছর এপ্রিল মাসে যখন আবার ফিরে এলেন, এসে দেখলেন ততদিনে মার্গারেট বদলে গেছেন একেবারে। ভারতীয় ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে নিবিড় ভাবে পড়াশুনো করেছেন এই কয়েক মাস ধরে, এবং মনে-মনে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন সেই দেশে পাকাপাকিভাবে চলে যাওয়ার ব্যাপারে। ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে মিস হেনরিয়েটা মুলার (১৮৪৬ - ১৯০৬) নামে এক ধনী ব্রিটিশ সমাজকর্মীর, ইনিও ভারতে এসে বসবাসের জন্য ততদিনে প্রস্তুত।
স্বামীজীর সঙ্গে কিছু চিঠিপত্র চালাচালির পর মার্গারেটের মনেও এখন আর স্বামীজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করবার ব্যাপারে কোনও দ্বিধা নেই, ভারত-যাত্রার জন্য তিনিও সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
সুতরাং, জানুয়ারি এক শীতল সকালে উইম্বলডনের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে মার্গারেট রওনা দিলেন সম্পূর্ণ নতুন এক দেশের উদ্দেশ্যে। আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধবেরা স্টেশনে এসেছেন তাঁকে বিদায় জানাতে, সকলেরই মন বিষাদে পূর্ণ। মার্গারেট প্রত্যেকের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। ট্রেন আস্তে-আস্তে মিলিয়ে গেল ঘন কুয়াশার মধ্যে।
ভারতে মার্গারেটের আগমন
‘মোম্বাসা’ নামের এক জাহাজে চেপে মাতৃভূমি ছেড়ে অচেনা এক দেশের দিকে একদিন যাত্রা করলেন সেই তরুণী। উজ্জ্বল নীল তাঁর চোখ-দুটো, বাদামী-সোনালি রঙের চুল ছড়িয়ে আছে পিঠ জুড়ে। আইরিশ এই তরুণীর মনের মধ্যে তখন অজস্র চিন্তার জাল।
তাঁর গন্তব্য ভারতবর্ষ। তাঁর আগে অনেক কাল থেকেই এরকম বহু বিদেশি এই দেশে এসেছেন, খ্রিস্টান যাঁরা, প্রচার করেছেন খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম্য। কিন্তু তাঁর আসবার কারণ সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি আসছেন ভারতের দীর্ঘ দিনের দর্শন আর সাংস্কৃতিক মহিমাকে আত্মস্থ করবার তাগিদে। আর অবশ্যই সেই অসামান্য আলোকপুরুষের সান্নিধ্য পেতে। যিনি তাঁকে চিঠিতে জানিয়েছেন, ভারতে এলে তিনি আমরণ সাহায্য করবেন। অবশ্য অন্য একটি চিঠিতে ছিল সতর্ক পরামর্শও: ‘তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হইবে।’ সুতরাং মার্গারেটের মন নানান অজানা আশঙ্কায় পূর্ণ থাকাই স্বাভাবিক।
ভারতের মাটিতে মিস মার্গারেট নোব্ল-এর পা পড়ল ১৮৯৮-এর ২৮ জানুয়ারি। প্রথমে জাহাজ আসে মাদ্রাজে, তার দিন চারেক পর খিদিরপুরের বন্দরে এসে নোঙর করল ‘মোম্বাসা’ নামে সেই জাহাজ। অচেনা দেশের মাটিতে প্রথমবার পা রাখবার আগে তাঁর মনে যেটুকু ভয় সংশয় বা দুশ্চিন্তা, সেটা এক লহমায় কেটে গেল; যখন মার্গারেট দেখলেন যে জেটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং স্বামীজি!
জগদীশচন্দ্রের চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট এই তরুণ সন্ন্যাসী অল্প বয়সেই পেয়ে গিয়েছেন জগৎজোড়া খ্যাতি। যার সূচনা বছর পাঁচেক আগে। ১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে শিকাগো শহরের সেই বিশ্ব ধর্মমহাসম্মেলনে তাঁর বক্তৃতা নজর কেড়ে নিয়েছিল সে দেশের অগণিত সাধারণ মানুষ থেকে প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলোর। এরপরে দীর্ঘদিন তিনি সে দেশে বহু বক্তৃতা দিয়েছেন, তারপর ইংল্যান্ডে গিয়ে সেখানেও নিজস্ব প্রভার জোরে খ্যাতি অর্জন করেছেন। মার্গারেটের এ দেশে আসবার বছরখানেক আগে, ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দীর্ঘ দিনের ব্যবধানে ভারতে ফেরবার পর তাঁকে যেভাবে নানা স্থানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, তাতেই স্পষ্ট যে তিনি সে আমলের প্রেক্ষিতে প্রায় রাতারাতিই জাতীয় ‘স্টার’-এর তকমা পেয়ে গিয়েছিলেন। তখন এতটাই তাঁর জনপ্রিয়তা যে কলকাতায় তাঁর প্রথম আগমনের দিন তাঁর ঘোড়ার গাড়ির সামনে থেকে ঘোড়া খুলে রিপন কলেজের ছাত্রেরা নিজেরাই গাড়িটা টেনেছিলেন। তারপরে গোটা শহর জুড়ে সাধারণ মানুষ থেকে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা, তাঁর সংবর্ধনায় যেন একটা বিপুল জোয়ারের টানে সকলেই প্রায় ভেসে বেড়িয়েছিলেন।
কলকাতায় মার্গারেট নোবেল প্রথম বাসা নেন চৌরঙ্গী এলাকার ৪৯ নম্বর পার্ক স্ট্রিট ঠিকানার একটি হোটেলে। তখন তাঁকে থাকতে হচ্ছিল একাই, দিন কয়েক পরে আলমোড়া থেকে মিস মুলার ফিরে এলে দুজনে একসঙ্গে থাকা শুরু করেন। প্রথম-প্রথম মার্গারেট ঘুরে বেড়াতেন চৌরঙ্গী এলাকার অভিজাত পাড়াগুলোতে, এবং মূলত সাহেবদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন কলকাতার দ্রষ্টব্য বিভিন্ন জায়গায়। পরে স্বামীজীর উদ্যোগে এক ব্রহ্মচারীর কাছে বাংলা শিখতে শুরু করেন এবং এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হতে কয়েকটি স্কুলেও যাতায়াত করেন।
মার্গারেট যখন কলকাতায় আসেন, তখন স্বামীজী একাধিক স্থানে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বসবাস করছেন। কখনও বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়ি, কখনও আবার বেলুড়ে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। কলকাতায় থাকলে তিনি মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসতেন মার্গারেটের সঙ্গে। তখনও মার্গারেটের পরিচয় ঘটেনি কলকাতার বাঙালি-সমাজের সঙ্গে। তবে এটা তিনি নিশ্চিত জানতেন যে কলকাতার নেটিভ এলাকায় যাতায়াত এবং মেলামেশা শুরু না করা অবধি তিনি এ দেশের আসল ‘স্পন্দন’ মোটেই টের পাবেন না।
আগের পর্ব পড়ুন : জগদীশ-নিবেদিতা সংবাদ (প্রথম পর্ব)
পরের পর্ব পড়ুন : জগদীশ-নিবেদিতা সংবাদ (তৃতীয় পর্ব)
..................
[হেডপিস : ওয়াসিম রাজা]