জগদীশ-নিবেদিতা সংবাদ (তৃতীয় পর্ব)
পর্ব ৩। কলকাতায় নিবেদিতা: সূচনাকালের কর্মকাণ্ড
.....................
সারা বুল ও মিস ম্যাকলাউডের আগমন
.....................
মার্গারেটের কলকাতায় বসবাস শুরু করবার দিন-কয়েক পরে ফেব্রুয়ারির আট তারিখে বোম্বাই থেকে ট্রেনে এই শহরে এসে উপস্থিত হলেন স্বামীজীর আরও দুই বিদেশি অনুরাগী সারা চ্যাপম্যান বুল (১৮৫০-১৯১১) আর জোসেফাইন ম্যাকলাউড (১৮৫৮-১৯৪৯)।
জগদীশচন্দ্রের গবেষণা-জীবনে সারা বুল নামে এই মহীয়সী মহিলার ভূমিকা আমরা পরে কোনও পর্বে বিস্তারিতভাবেই আলোচনা করব, আপাতত তাঁর জীবনের কিছু পূর্বকথা বলে নেওয়া হচ্ছে। নরওয়ের বিখ্যাত ভায়োলিনবাদক ও সুরকার ওলি বুল-এর স্ত্রী হলেন সারা, বিয়ের আগে তাঁর নাম ছিল সারা থর্প। সারা-র বাবা জোসেফ জি থর্প ছিলেন সে দেশের মস্ত বড় ব্যবসায়ী, পাশাপাশি ব্যস্ত রাজনীতিকও। সারা-র ভাই জোসেফের শ্বশুর আবার বিখ্যাত কবি হেনরি ওয়াডসওয়ার্থ লংফেলো। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম নেওয়া সারা বাড়িরই এক পার্টিতে ষাট বছরের ওলি বুলকে দেখেই প্রেমে পড়ে যান, তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি। সেই প্রেম পরিণতি পেল বিয়েই, এবং এরপরে বিস্তর ঝড়ঝাপটা সহ্য করে দু-জনে সংসার করলেন দশ বছর। বিয়ের বছরখানেক বাদে জন্মাল তাঁদের একমাত্র মেয়ে ওলিয়া-ও।
১৮৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পরে সারা বুল নিজেকে জড়িয়ে নেন নানাবিধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। পাশাপাশি মানসিক শান্তির জন্য পাঠ করতেন বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এবং ভারতীয় দর্শনের বইও। এই সময় থেকেই বেদান্ত-দর্শনের প্রতি তাঁর অনুরাগ গড়ে ওঠে। এই সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার কারণেই ১৮৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কিছু আগে বোস্টনে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় স্বামীজীর, এবং বলতে গেলে ওই সময়ের পর থেকেই তিনি ভারতের কল্যাণে বেশ কিছু কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। স্বামীজী তাঁকে মা (বা কখনও-কখনও ধীরামাতা-ও) বলে ডাকতেন, বয়সে তিনি ছিলেন স্বামীজীর চেয়ে এগারো বছরের বড়। আমরা পরে দেখব, জগদীশচন্দ্রের একমাত্র আমেরিকান পেটেন্ট নেওয়ার ব্যাপারে সারা বুল কত বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন।
সারা বুলের মতোই স্বামীজীর আর এক বিদেশিনী ভক্ত মিস জোসেফাইন ম্যাকলাউডও (১৮৫৮ – ১৯৪৯ খ্রি) আমেরিকান, তাঁর সঙ্গে স্বামীজীর পরিচয় ১৮৯৫ সালের ২৯ জানুয়ারি, নিউ ইয়র্কের এক ভক্তের বাড়িতে। স্বামীজীর চেয়ে বয়সে বছর তিনেকের বড় এই আমেরিকান মহিলা এবং তাঁর বোন দু-জনেই এরপর স্বামীজীর ভক্ত হয়ে পড়েন এবং বেদান্ত দর্শনে আকৃষ্ট হন। পরে স্বামীজী যখন আবার লন্ডনে আসেন, তাঁর সঙ্গেই আসেন জোসেফাইন, এখানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় মার্গারেট, স্বামীজীর ভাই মহেন্দ্রনাথ আর স্বামী সারদানন্দের সঙ্গেও। স্বামীজীর স্টেনোগ্রাফার জোশিয়া জন গুডউইন-এর সঙ্গে তাঁর আলাপ করানোর কাজেও ম্যাকলাউডই ছিলেন অনুঘটক।
মিস ম্যাকলাউড স্বামীজীকে একই সঙ্গে মনে করতেন আধুনিক যুগের বুদ্ধ এবং তাঁর খুব ভালো বন্ধু। ভারতে আসবার পরে যখন স্বামীজীকে ইনি জিজ্ঞেস করেন যে আমি কীভাবে এই দেশের সেবা করতে পারি, তখন স্বামীজী বলেছিলেন, এই দেশকে ভালোবেসে।
সুতরাং প্রায় একই সময়ে স্বামীজীর টানে ভারতে এসে পড়লেন চার বিদেশিনী; কলকাতায় হোটেল কন্টিনেন্টাল-এ সাময়িকভাবে থাকা শুরু করলেন তাঁদের দু-জন— সারা বুল আর মিস ম্যাকলাউড। মার্গারেট সাময়িকভাবে রইলেন পার্ক স্ট্রিটের অন্য এক হোটেলে, আর চতুর্থজন মিস মুলার গেলেন আলমোড়ায়।
মার্গারেট থেকে ‘নিবেদিতা’
সারা বুল-এর সঙ্গে মার্গারেটের সাক্ষাৎ এবং আলাপ ঘটেছিল তাঁর কলকাতায় আসবার দু-একদিনের মধ্যেই। আলাপ করিয়েছিলেন স্বামীজীই। দু-জনের মধ্যে বছর দশেকের তফাৎ সত্ত্বেও পরিচয় বন্ধুত্বে পরিণত হতে দেরি হয়নি। এরপর শুরু হয় তাঁদের একত্রে ঘুরে-ঘুরে শহর চেনার দিন। আলাপ হওয়ার দিন কয়েক বাদে, সেদিন ফেব্রুয়ারির সতেরো তারিখ; মার্গারেট, সারা বুল আর ম্যাকলাউড এলেন উত্তর কলকাতায়। সেদিন তাঁরা ঘুরলেন একটি স্কুল, মন্দির এবং আরও কিছু জায়গায়।
এই স্কুলটির নাম ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়। মূলত নাগরিক ব্রাহ্ম বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত এই স্কুলটি তৈরি হয় ১৮৯০ সালের মে মাসে। তখন এই স্কুলের ক্লাস হত ৫৬ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রিটে। পরে ১৯০৩ সালে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের উলটোদিকে এখন যেখানে অবস্থিত, সেই ভবনে উঠে আসে। এই স্কুলেই বেশ কয়েক বছর (১৯১০ থেকে ১৯৩৬ সাল) সেক্রেটারি ছিলেন লেডি অবলা বসু।
এখানেই মার্গারেটের সঙ্গে আলাপ হয় জগদীশচন্দ্রের দিদি লাবণ্যপ্রভা বসুর (জন্মসাল অজ্ঞাত, মৃত্যু ১৯১৯ সাল)। ওই সময় তিনি ছিলেন এই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। মার্গারেটের মাথায় ততদিনে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল তৈরির পরিকল্পনা বেশ পেকে উঠেছিল। তিনি বোঝেন যে এই কাজে লাবণ্যপ্রভা তাঁকে সাহায্য করতে পারবেন।
ওদিকে কলকাতায় পৌঁছনোর দিন কয়েক পরে সারা বুল আর মিস ম্যাকলাউড এলেন হাওড়ার দিকে বেলুড় নামে এক স্থানে, যেখানে প্রস্তাবিত মঠের জন্য জমি কেনা হবে স্থির হয়েছে। এই জমির কাছেই একটি পুরনো জীর্ণ বাড়ি দেখে দুই বিদেশিনীর বড় পছন্দ হয়ে গেল, তাঁরা স্বামীজীকে অনুরোধ করে সেই বাড়িটিকেই মোটামুটি বসবাসের উপযুক্ত বানিয়ে থাকা শুরু করলেন। সামনেই গঙ্গাতীর, চমৎকার পরিবেশ। কিছুদিন পরে মার্গারেটকেও ডেকে নিলেন তাদের সঙ্গে। এতদিন পর মার্গারেট হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিন বিদেশি রমণী সম্পূর্ণ অচেনা একটি দেশে এসে এইভাবে আস্তে-আস্তে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলেন এ দেশের আবহাওয়া-পরিবেশ-পরিস্থিতি আর মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে। ইতিমধ্যে মার্গারেট মিস মুলারের সঙ্গে ঘুরে এসেছেন দক্ষিণেশ্বর থেকেও, মুগ্ধ হয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরের বাহুল্যহীন পরিপাটি সজ্জা এবং বিশেষ করে দেওয়ালে টাঙানো মেরি ম্যাগডালেনের ছবি দেখে।
মার্গারেট নোব্লের কলকাতায় আসবার প্রায় আড়াই মাস পর স্বামীজীর এই শহরের বিশিষ্ট বাঙালি-সমাজের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি করাবার জন্য স্টার থিয়েটারে ১৮৯৮-এর মার্চ মাসের ১১ তারিখ একটি মিটিং-এর আয়োজন করলেন। সেদিনের সভায় সভাপতি ছিলেন স্বামীজী নিজেই। মার্গারেট নোব্ল তাঁর কাছে ‘ইংল্যান্ডের একটি বিশিষ্ট উপহার’— এইভাবেই সদ্য-আগত বিদেশিনীর পরিচয় দিলেন তিনি। ভারতকে ইংল্যান্ড দিয়েছে অ্যানি বেশান্ত আর মিস মুলার— এই দুটি উপহার; স্বামীজী এই দুটি নাম বলার পরে বলেন, ‘ইংল্যান্ড আমাদের আর একটি উপহার দিয়াছে— মিস মার্গারেট নোব্ল। ইঁহার নিকট আমাদের অনেক আশা। আমি অধিক কথা না বলিয়া আপনাদের সহিত মিস নোব্লের পরিচয় করাইয়া দিতেছি।’ (* প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণার নিবেদিতা জীবনী, ৬৫ পৃ)
মার্গারেট উঠে দাঁড়াতেই উপস্থিত জনতা তুমুল হাততালি দিল, এরপরে মার্গারেট ‘ইংলন্ডে ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রভাব’ বিষয়ে বক্তৃতা দেন। এটাই ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রথম বক্তৃতা।
কোনও-কোনও নিবেদিতা-জীবনীতে এমন তথ্যও রয়েছে যে এই সভায় ছিলেন জগদীশচন্দ্রও। তবে সেদিন তাঁদের আলাপ-পরিচয় ঘটেনি।
এর দিন কয়েক পরে, মার্চের ১৭ তারিখ শুক্রবার মার্গারেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল সারদা মায়ের। শ্রীমা তখন থাকতেন উত্তর কলকাতার বাগবাজারের কাছে বোসপাড়া লেনের ১০।২ নম্বরে। পরে এই বাড়ির কাছেই একটি বাড়িতে মার্গারেট থাকা শুরু করেছিলেন। সেদিন মার্গারেটের সঙ্গে এসেছিলেন মিস ম্যাকলাউড আর সারা বুল-ও। তাঁদের অনুরোধে মা সারদা সকলের সঙ্গে একত্রে খাওয়াদাওয়াও সেরেছিলেন।
আরও এক সপ্তাহ পরে মার্চের ২৫ তারিখে (সেদিনও ছিল শুক্রবার) নীলাম্বর মুখুজ্জের বাগানবাড়িতে ‘অফিসিয়ালি’ মার্গারেট নোব্ল দীক্ষা নিলেন স্বামীজীর কাছ থেকে, এবং প্রবেশ করলেন ব্রহ্মচর্য জীবনে। এই দিনই স্বামীজী তাঁর নাম দিলেন ‘নিবেদিতা’। এর দিন কয়েক পরে স্বামীজী অসুস্থতার কারণে চলে গেলেন দার্জিলিং-এ, আর এর মাস দুয়েক পরে মে মাসে স্বামীজীর সঙ্গে হিমালয় যাওয়ার আগে পর্যন্ত নিবেদিতা যে কয়দিন কলকাতায় ছিলেন, তারই মধ্যে ঘটে গেল আরও অনেকগুলো স্মরণীয় ঘটনা।
.................