কার্ডাসবংশ : ক্রিকেটকুলের ডোডোপাখি?
![](https://firebasestorage.googleapis.com/v0/b/sillypoint-3.appspot.com/o/images%2Fthumbs%2FE0AMv1605264629851250px-Neville_Cardus_1366x1366.jpg?alt=media)
ইডেন, ১৯৭৯। গাভাসকারের ভারতের বিরুদ্ধে খেলছে কিম হিউজের অস্ট্রেলিয়া। কপিলদেবের নামের পাশে পাঁচ উইকেট। তখনও সাধারণ মধ্যবিত্তের ঘরে টিভি দূরের নক্ষত্র। তার চেয়ে অনেক লোভনীয় সকালের চা আর আনন্দবাজারের ম্যাচ রিপোর্ট। তা কী আছে সেখানে? কপিলের বোলিং খুব সামান্যই জায়গা পেয়েছে। বরং একটা বিশাল প্যারাগ্রাফ ক্লাব হাউসের সামনে ফুটে থাকা দৃষ্টিনন্দন ডালিয়া নিয়ে।
প্রেসক্লাবের সবাই জানত, “খেলায় কী হল সেটা তো তেমনভাবে নেই” জাতীয় অভিযোগকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মাঠের বাইরে পাঠাতেন সেই প্রতিবেদক, যিনি কিনা বাংলার সর্বকালের সেরা সাংবাদিক-সাহিত্যিক। কারণ একটা বিশেষ স্কুলিং-এ তাঁর ট্রেইনিশিপ হয়েছে, যাঁর উদ্ভাবকের নাম স্যার নেভিল কার্ডাস। পুরোনো দিনের ইংল্যাণ্ড সংবাদমাধ্যম পাঁচ জ্যোতিষ্ককে ক্রিকেটের পঞ্চপুত্র বলেছে - গ্রেস, রনজি, ট্রাম্পার, হবস আর ব্র্যাডম্যান। ছয়ে কার্ডাসসাহেবকে রাখলে কোনও অন্যায় হত না, কারণ তিনি পঞ্চাশ বছর ধরে একইসঙ্গে ক্রিকেট-যুদ্ধের সঞ্জয় এবং ক্রিকেট-সাহিত্যের ব্যাসদেব।
কার্ডাসের যে কাগজে কাজ করতেন, তার নাম ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’। মোটা পাউন্ডের অফার দিয়েছিল সানডে টাইমস, অবজারভার, ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের মতো আরও অনেক নামীদামি কাগজ। কিন্তু গার্ডিয়ানে যা লিখে তৃপ্তি পেতেন, সেটা ছাড়তে চাননি। অবশ্য স্বাচ্ছন্দ্য খুবই প্রয়োজন ছিল তাঁর। জন্মেছিলেন দক্ষিণ ম্যাঞ্চেস্টারের বস্তিতে, বড় হওয়া গণিকাপল্লীতে। জীবনের ক্লেদাক্ত ছবিটা ছোটো থেকেই চোখের সামনে স্পষ্ট ছিল। জ্ঞান হওয়ার সময় থেকেই বাবা লোকটা নিশ্চিহ্ন, মা এবং দুই মাসি অভিসারে ব্যস্ত। একাকীত্বে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। প্রথাগত শিক্ষার কোনও সুযোগ হয়নি, তবে বাড়ির সামনের একটি অবৈতনিক পাঠাগার এবং একটি ক্রিকেট পিচ তাঁর লাইফলাইন হয়ে উঠেছিল। আরেকটা দিক থেকে সৌভাগ্যবান বলা যায় তাঁকে। এমন একটা সময়ে তাঁর জন্ম, যখন উনিশ শতক শেষের ইংল্যান্ড সংস্কৃতির প্রত্যেকটা ক্ষেত্র হীরের দ্যুতি নিয়ে হাজির। সিংহাসনে ভিক্টোরিয়া, মঞ্চে ওয়াশিংটন আরভিং, কবিতায় সুইনবার্ন, উপন্যাসে হার্ডি আর এইচ জি ওয়েলস। ইটন আর হ্যারোর মাঠ তখন ইংরেজ বালকের চরিত্র গঠন করে, ক্রিকেটমাঠে স্বপ্নিল ছবি আঁকেন ডব্লু জি গ্রেস, আর্চি ম্যাকলারেন, রনজিৎ সিংজীরা।
আরও পড়ুন : মজার ক্রিকেট, ক্রিকেটের মজা / সুদেব বোস
কার্ডাস ভালোবেসেছিলেন বইকে। সিসার টাইপ ধোয়া, চকলেট বিক্রি, ফুটপাথে ছবি আঁকা, কী না করেছেন? আধপেটা খেয়ে রাস্তায় কাটিয়েছেন ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডায়, একটা ছেঁড়া কোট আর ‘ডেভিড কপারফিল্ড’-কে নিয়ে। পড়তে পড়তে হয়তো ভেবেছেন - “এই তো জীবন কালীদা!”
কার্ডাসের জীবনে ‘কালীদা’ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন সি.পি.স্কট, গার্ডিয়ানের সম্পাদক। স্কট তাঁর হাতে দায়িত্ব দেন ঐ কাগজের সঙ্গীত সমালোচনা এবং ক্রিকেট ম্যাচ রিপোর্ট লেখার। সেটা ১৯১৯ সাল। ক্রিকেট-সঙ্গীতের সেরা গায়কের জন্ম হল সেদিন। বালক কার্ডাস মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন ফুটপাথ ধরে হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন টেস্ট ক্যাপ্টেন আর্চি ম্যাকলারেন। আর কিশোর কার্ডাস কোলরিজের কাব্যসংগ্রহ বেচে দিলেন - মাঠে বসে ভিক্টর ট্রাম্পারের খেলা দেখবেন তিনি।
১৯১৯ সালে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড মাঠে বসে একটা দুদিনের ম্যাচ দেখে দায়সারা রিপোর্ট লিখলেন। সে লেখায় কোনো সাহিত্যসুষমা নেই, কেঠো রসকষহীন লেখা। আবার কয়েক বছর পর ঐ একই মাঠে ফ্র্যাঙ্ক উলীর ব্যাটিং দেখে তাঁর লেখা - “উলীর ব্যাটিংয়ের ক্ষণস্থায়ীত্ব স্পন্দন ও প্রেরণার বস্তু, ঘড়ির দ্বারা মিলিয়ে নেবার জিনিস নয়, শুধু কল্পনা দ্বারাই অনুভব করা সম্ভব”। খেলার মধ্য থেকে নীরস তথ্য আর টেকনিক্যাল কচকচি সরিয়ে একটা নান্দনিক দৃষ্টিকোণ বের করে আনতে সুপটু হয়ে উঠেছিলেন কার্ডাস। রনজিকে নিয়ে তাঁর বিখ্যাত মন্তব্য - “তিনি কি সত্যিই ছিলেন? না সবটাই মিড সামার নাইটস ড্রিম?” হবসের ব্যাটিং নিয়ে তাঁর রিপোর্ট পড়ে পাঠকের চিঠি - “আপনার লেখায় বেটোভেনের সংগীত নিয়ে দুর্দান্ত বিশ্লেষণ পেলাম। কিন্তু হবস কেমন ব্যাট করেছেন তা কিছুই বুঝলাম না!” কার্ডাসের উত্তর - “সেটা বুঝতে হলে আমার সবকটা সঙ্গীত সমালোচনা পড়ে দেখুন”। এমন মজা আরও আছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে টেলেক্সে রিপোর্ট পাঠালেন যতিচিহ্ন সহ, নাহলে সেই পজ এফেক্টটা তাঁর আসত না। অফিস থেকে বলল “যতিচিহ্ন দিয়ে বিল বাড়াবেন না, ওটা আমরা বসিয়ে নেব”। কার্ডাসের উত্তর- “যতিচিহ্নগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছি, লেখাটা বসিয়ে নেবেন। বিল আরো কম হবে।”
আরও পড়ুন : চের্নোবিল থেকে প্যারা অলিম্পিক্স : ওকসানা মাস্টার্সের আশ্চর্য গল্প / শিবাজী আইচ
১৮৮২ এর বিখ্যাত ওভাল টেস্ট যেখান থেকে অ্যাসেজ সিরিজের জন্ম, তার রিপোর্ট লিখলেন কার্ডাস, তথ্য আর কল্পনাকে মিশিয়ে, ৩৯ বছর পরে বসে - সাংবাদিকতা হাতে গরম জিনিস, এই ধারণাকে সপাটে থাপ্পড় মেরে। পরিসংখ্যান? সে তো কেরানির কাজ! তিনি তো শিল্পী। তাঁর কাজ এমন একটা অমর সৃষ্টি রেখে যাওয়া যাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যাবে পরের শতাব্দী অবধি। ১৯২১ এর জুনের ম্যাচ রিপোর্টটা ক্রিকেটরসিক নয়, সাহিত্যরসিকরা মনে রেখে দেবেন - “হ্যালোজ আর মেকপিস যখন ল্যাঙ্কাশায়রের হয়ে ওপেন করতে নামলেন তখন আমি ওল্ড ট্র্যাফোর্ড মাঠ ছাড়লাম। তারপর ট্যাক্সি নিলাম, রেজিস্ট্রি অফিস এ গেলাম, বিয়ে করলাম। তারপর মাঠে এসে দেখলাম রান উঠেছে বিনা উইকেটে ১৭।”
হাসি চাপতে চাপতে যদি তথ্যটা চেক করেন দেখবেন তার আদৌ সত্যতা নেই। কিন্তু কার্ডাস তো আসল কাজটা সেরে রেখেছেন, গোলাপের যুদ্ধে যে ব্যাটসম্যান সামান্যতম ঝুঁকিও নেবে না তা স্পষ্ট। এমন সব ঘটনা তাঁর অসামান্য বইগুলো ওলটালে বারবার পাওয়া যাবে- ‘Second Innings’, ‘Daus in the Sun’, ‘Australian Summer’, ‘Ten composers’, ‘Autobiography’. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের কার্ডাস অবশ্য অনেক যুক্তিনিষ্ঠ, তখন তাঁর কৈশোরের রনজি, ম্যাকলারেন, ট্রাম্পার, হবসের জায়গা নিয়েছেন সোবার্স, বেনো, ট্রুম্যান, স্ট্যাথাম, কম্পটন , হার্ভেরা। তেমনই সব মায়াবী লেখা তাঁদের নিয়েও।
আরও পড়ুন : এক হৃদয়ের দুই অলিন্দ : তিলোত্তমা ও ইস্ট-মোহন দ্বন্দ্ব / অলর্ক বড়াল
কার্ডাস ক্রিকেটের শিল্পের সঙ্গে সঙ্গীতের মাধুর্য মিলিয়ে যে অনবদ্য লেখাগুলো সৃষ্টি করতেন সেগুলো সে যুগে তো বটেই, আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রে রবিনসন, জ্যাক ফিঙ্গলটন বা পরের যুগের জন আর্লটরা ক্রিকেট নিয়ে লিখে যশস্বী, কিন্তু তাঁদের কেউই কার্ডাস নন। যদি তিনি আজ জন্মাতেন? আইপিএলের চিৎকৃত গ্ল্যামারের মঞ্চে কি চলত পিয়ানো-স্নিগ্ধ ক্রিকেটের লেখা? বলা বাহুল্য আজকের পৃথিবীতে ক্রিকেট লিখিয়ের কাজটা সাতগুণ শক্ত। সেই ১৯৯২-তেই চ্যানেল নাইনের ক্রিকেট সম্প্রচার এবং রিচি বেনো আর মাইকেল হোল্ডিং-এর বিশ্লেষণ সাংবাদিককে পিছনের পায়ে ঠেলে দিয়েছিল। টিভিতে সবটা পেয়ে গেলে পরদিন কাগজটা খোলার দরকারটা কী - এমন ভাবনা থেকে সাংবাদিককে যেতেই হল এক্সক্লুসিভ খুঁজতে। ক্রিকেট স্বভাবতই আর ‘ইডেনে শীতের দুপুর’ রইল না। বরং তা এসে পড়ল চূড়ান্ত কঠোর প্রতিযোগিতার বারোমাস্যায়। কার্ডাসসাহেবের বাঙালি ভাবশিষ্য মতি নন্দী বাহাত্তরের ইংল্যাণ্ড সিরিজে লিখলেন “ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে সোলকারের মর্মরমূর্তি স্থাপন করা উচিত।” সবাই মোহিত হল। আজ হলে অন্তত দশটা কমেন্ট এসে ধাক্কা মারত ফেসবুকে, কারণ সোলকার দাঁড়াতেন ফরোয়ার্ড শর্টলেগে। তথ্যে মারাত্মক ভুল।
কার্ডাস তাই ক্রিকেট-সাহিত্যের শেষকথা। কিন্তু ক্রিকেট-সাংবাদিকতার? উত্তর দেবার আগে বলুন, বিধানচন্দ্র রায়ের ব্যবহৃত টেক্সটবই পড়ে কি এখন ডাক্তারি পাশ করা যাবে?
#Neville Cardus #The Manchester Guardian #cricket correspondent #Cricket Critic #Cricket #নেভিল কার্ডাস #মতি নন্দী #ক্রিকেট-সাহিত্য #ক্রিকেট-সাংবাদিকতা #সুদেব বোস #সিলি পয়েন্ট