<b>এক হৃদয়ের দুই অলিন্দ : তিলোত্তমা ও ইস্ট-মোহন দ্বন্দ্ব</b>
খেলার পরিভাষায় সাধারণত একই শহর বা অঞ্চলের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে আয়োজিত ম্যাচকে ‘ডার্বি’ বলা হয়। ‘ডার্বি’ শব্দটা কানে এলেই মনে ভেসে ওঠে তিলধারণের জায়গা না থাকা এক স্টেডিয়ামে দর্শকদের গগনভেদী চিৎকারে-উল্লাসে বিপক্ষের খেলোয়াড়, দর্শক উভয়েরই বাপ-বাপান্ত থেকে শাপ-শাপান্ত ঘটে যাওয়ার এক চরমভাবাপন্ন ময়দানি ছবি। এ লড়াই যতটা খেলার মাঠে, ততটাই বাসে-ট্রেনে, অফিস -কাছারিতে কিংবা পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে। আধুনিক প্রযুক্তি-বিপ্লব দু-পক্ষের এই আবহমান ‘ব্র্যাগিং রাইটস’-এর লড়াইকে একধাক্কায় এনে দিয়েছে ভার্চুয়ালের খোলা ময়দানে। তত্ত্ব আর তথ্যের মাঞ্জায় ক্রমাগত চলছে বিপক্ষকে পর্যুদস্ত করার খেলা। সময়ের আবর্তনে ট্রোল-মিমের মোড়কে আজ ‘ডার্বি’র আড়ালে থাকা আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক স্তরগুলি অনেক বেশি করে উঠে আসছে। খেলা যে নিছক বিনোদন নয়, আস্ত একটা সামাজিক ইতিহাস সে বয়ে নিয়ে চলেছে তার গর্ভে - এ কথা প্রতিদিনই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ফুটবলে এক শহরের দুই দলের মধ্যে ডার্বির উদাহরণ অজস্র রয়েছে। রিয়াল-আটলেটিকোর ‘মাদ্রিদ ডার্বি’ বা ম্যানচেস্টারে ইউনাইটেড ও সিটির ডার্বি সুপরিচিত। ফুটবলে ডার্বির প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে সর্বদাই অবস্থানগত লড়াই থেকে উঠে আসে তা নয়। অনেকক্ষেত্রেই তা আঞ্চলিকতার গন্ডি পেরিয়ে ব্যাপ্ততর বিভেদের শিকড় থেকে দ্বন্দ্বের মহীরুহে পরিণত হয়। বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের ‘এল ক্লাসিকো’ যেমন। পৃথিবী-ব্যাপী নানাবিধ ডার্বির মাঝে বিশেষ সম্মানের জায়গা অধিকার করে নিয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ডার্বি, কলকাতার শতবর্ষ-প্রাচীন ‘বড় ম্যাচ’ – ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দ্বৈরথ। এ ম্যাচ একাধারে যেমন এক শহরের দুই দলের মধ্যে লড়াই তেমনই এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিভেদের এক অসাধারণ ককটেল।
সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাঙালির ডার্বি স্কটল্যান্ডের রেঞ্জার্স বনাম কেল্টিক, ‘ওল্ড ফার্ম’ বা ‘গ্লাসগো’ ডার্বির সমতুল্য। রেঞ্জার্স সমর্থকেরা যেমন ‘নেটিভ আলস্টার স্কট’ তেমনই মোহনবাগান সমর্থকদের বেশিরভাগই এপার বাংলার জন্মগত অধিবাসী বা ‘ঘটি’। অন্যদিকে কেল্টিক অনুরাগীরা যেমন ‘আইরিশ স্কট’ তেমনই ইস্টবেঙ্গল অনুরাগীরা মূলত এপার বাংলায় ‘পরিযায়ী’ বা ‘বাঙাল’। তবে এই ব্যবধানের উল্টোটাও লক্ষণীয়। ১৮৮৯-এ পথ চলতে শুরু করা মোহনবাগান ১৯১১-তে আইএফএ শিল্ড জিতে ঔপনিবেশিক ভারতের ফুটবলমহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে। আরও কয়েক বছর পর ১৯২০ সালে ইস্টবেঙ্গলের জন্ম কিছুটা নাটকীয়ভাবেই। জোড়াবাগান ক্লাবের সেইসময়ের দুই ফুটবলার শৈলেশ বসু ও নশা সেন পূর্ববঙ্গীয় হওয়ার সূত্রে বৈষম্যের সম্মুখীন হন। ক্ষোভে তাঁরা সেই ক্লাব ছেড়ে দিয়ে সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাব।
১৯২১-এ দুই দলের প্রথম মুখোমুখি হওয়া থেকে যে ঐতিহাসিক ‘রাইভালরি’ শুরু হয়েছিল, তার ক্ষেত্র প্রশস্ত করে দেয় লিগের নিয়মনীতি পরিবর্তনের প্রশ্নে ভারতের ইউরোপীয় ক্লাবগুলি ও প্রথম সারির দেশীয় ক্লাবগুলির বিরোধ। তিন- চারের দশকে মহামেডান স্পোর্টিংয়ের উত্থানে এই দ্বৈরথে সামান্য ভাটা পড়লেও ১৯৪৬-এর অশান্ত কলকাতা ও ’৪৭-এর দেশভাগ ফের ডার্বির গুরুত্বে ভরা কোটাল এনে দেয়। ওপার বাংলার ভিটেমাটি ছেড়ে কাতারে কাতারে মানুষ এপারে এসে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের সম্মুখীন হলে এই দ্বৈরথের শিকড় আরও গভীর হয়, তীব্রতর হয় ঘটি-বাঙালের দ্বন্দ্ব। শুধু ফুটবলের দিকে তাকালে, ছয়ের দশক ছিল মোহনবাগানের স্বর্ণযুগ। তেমনই গোটা সাতের দশক সুসময় ছিল ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে। ১৯৭০ থেকে ’৭৫ সমস্ত ডার্বিতে টানা ১৯৩২ দিন অপরাজিত থাকে তারা, যার মধ্যে ছিল ডার্বির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়। ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ তারিখে আই.এফ.এ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগান মাঠে ইস্টবেঙ্গলের ঐতিহাসিক ৫-০ জয়ের জেরে আত্মহত্যা করেছিলেন কট্টর মোহনবাগান সমর্থক উমাকান্ত পালধি। সুইসাইড নোটে উমাকান্ত লিখে গেছিলেন, পরজন্মে তিনি ফুটবলার হিসেবে জন্মাতে চান, প্রতিশোধ নিতে চান এই হারের। ডার্বি সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে কতটা একাকার হয়ে গিয়েছিল তা বুঝতে এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট। দু-পক্ষেই এমন উন্মাদনার উদাহরণ সুপ্রচুর।
ডার্বির স্মরণীয় মুহূর্তও অসংখ্য। ১৯৯৭-এর ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে এক লক্ষ একত্রিশ হাজার দর্শকসম্বলিত যুবভারতীতে ইস্টবেঙ্গলের বাইচুংয়ের হ্যাট্রিকে অমল দত্তের ডায়মন্ড ফর্মেশনের চূর্ণ হওয়া যেমন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কাছে সবচেয়ে ‘আইকনিক’ মুহূর্ত, তেমনই মোহনবাগানিরা ভুলতে পারবেন না ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর ৫-৩ গোলে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে ’৭৫-এর পাঁচ গোলের প্রতিশোধগ্রহণ। আবার ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট ম্যাচ চলাকালীন ষোলো জন সমর্থকের পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা এই ডার্বির অন্ধকারতম অধ্যায়। ডার্বিতে মিশেছে সমকালীন রাজনীতির রঙ আর লড়াইয়ের ময়দানে সেই দিকগুলোকেই পতাকা-ফেস্টুন-ব্যানার বা হালআমলের ‘টিফো’র মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন দুই ক্লাবের সভ্য-সমর্থকেরা।
ইস্ট-মোহন ডার্বি কিন্তু সারা বিশ্বে বাঙালির অন্যতম অভিজ্ঞান। পশ্চিমের বহু দেশে এমনকি আফ্রিকার বহু জায়গায় বাঙালির পরিচয় কলকাতা এবং ডার্বির সূত্রেই। পৃথিবীর নানাপ্রান্তের ডার্বিগুলো যখন স্রেফ তারকাদের ডুয়েল বা কর্পোরেট সংস্থাদের মানি পাওয়ারের আর্ম রেসলিং হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন বাঙালির এই ডার্বি কোথাও যেন আলাদা, কোথাও যেন সাধারণের জীবনের খুব কাছের। ছাপোষা দৈনন্দিনের ঘেমো গন্ধ লেগে থাকে তার গায়ে। কলকাতা ডার্বি তো এক অর্থে রবীন্দ্রনাথের দেখা ‘মহামানবের সাগরতীর’। কলকাতার ফুটবল আপন করে নিয়েছে পৃথিবীর মানচিত্রের অনেকটা অংশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার আল-আমনা, আফ্রিকার চিমা, মুসা, ওডাফা, জাপানের কাটসুমি , সুদূর সাম্বার দেশের কিংবদন্তী ‘সবুজ তোতা’ ব্যারেটো কিংবা আরও আগে মধ্যপ্রাচ্যের মজিদ, জামশিদ দেশ-জাতি-ভাষার গণ্ডি ভুলে কলকাতারই মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই বিদেশিরা বাঙালি সুব্রত- মনোরঞ্জন-নবি-মেহতাব-দীপেন্দু কিংবা পাহাড়ের বাইচুং- সঞ্জু প্রধানের সঙ্গে মাঠে নেমেছেন। দশকের পর দশক ধরে বিশ্বমানবতার মিলনক্ষেত্র হয়ে থেকেছে বাঙালির এই দ্বৈরথ। এখনও অনেকের নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে এখানে। আমরা জেনে আপ্লুত হয়েছি যে এখনও তাঁরা বুকের মধ্যে রেখে দিয়েছেন একটুকরো কলকাতা।
যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ফুটবলের বিশ্বব্যাপী নানা পরিবর্তনের আগ্রাসী প্রভাব থেকে বাঁচতে পারেনি এই ভিন্টেজ দ্বৈরথও। নিয়মনীতি, পরিকাঠামো, স্পনসর - নানা প্রশ্নে বিদ্ধ হয়েছে দু-পক্ষই। এক পক্ষ টিকে থাকার তাগিদে নামের সামনে লেজুড় মেনে নিয়ে পরিবর্তনের পথে পা বাড়িয়েছে। অন্য পক্ষ রয়ে গেছে পুরোনো জায়গা আঁকড়ে, ঘুরে দাঁড়ানোর শপথের সঙ্গে একরাশ আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তা বুকে নিয়ে। আজ এই শতাব্দী-প্রাচীন দ্বৈরথের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে। আসলে তো প্রশ্নের সম্মুখীন এ শহরের এক চলমান ইতিহাস। কলকাতার হৃদয়ের দুই অলিন্দের মতো গঙ্গাপাড়ের দুই ক্লাবকে ফের ময়দানে মুখোমুখি দেখার জন্য অগণিত ফুটবলভক্ত তাকিয়ে রয়েছেন আগামীর দিকে। আশা রাখছেন সুসময়ের স্রোতে পালতোলা নৌকায় বাঙালির ফুটবলের মশাল জ্বলবে। আসলে দুয়ে মিলেই তো একটা বৃত্তের সম্পূর্ণতা। টম আর জেরি যেমন। এমনিতে সাপে-নেউলে হলে কী হবে, আসলে দুজনের দুজনকে ছাড়া চলে নাকি?
দু-জনে মিলে কি পারবে এই ম্যাচটা জিতে যেতে? বহু সমর্থকের জীবনের সমার্থক হয়ে যাওয়া কলকাতা ডার্বি কি ফিরে আসতে পারবে তার পুরনো কৌলীন্যে? কেনারাম-বেচারামদের বিছানো আদিগন্ত ফাঁদ থেকে ভারতীয় ফুটবল নিজেকে বাঁচাতে পারবে কিনা, তার উপরেই নির্ভর করছে এ প্রশ্নের উত্তর।
[পোস্টার : অর্পণ দাস]