চের্নোবিল থেকে প্যারা অলিম্পিক্স : ওকসানা মাস্টার্সের আশ্চর্য গল্প
মেয়েটা ফাঁক পেলেই কোনোরকমে চলে যেত সর্ষেক্ষেতের মধ্যে। ছয় বছরের একটা পুঁচকে মেয়ে, ওই বিরাট হলুদ অরণ্যে বুঝি হারিয়েই যায়। মেয়েটা আরও একটা কাজ করত। চুরি করে প্লাম গাছের ফল কুড়িয়ে খেত। উপায় ছিল না যে! অনাথাশ্রমের ওইটুকু খাবারে কি কারো পেট ভরে? হ্যাঁ, মেয়েটি প্রায় জন্ম থেকেই অনাথাশ্রমে বড়ো হচ্ছে। সবাই বলে, ওর মা-বাবা নাকি ওকে ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েটি অবশ্য আন্দাজ করতে পারে কেন তার জীবনেই এই দুর্ভোগ। সে যে বিশেষ ভাবে সক্ষম। আর তাঁর সেই ‘সক্ষমতার’ চিহ্ন তার শরীরের ভিতরে-বাইরে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু তাতে তার কী দোষ? তার জন্মের তিন বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে তৎকালীন রাশিয়া বা বর্তমান ইউক্রেনের চের্নোবিল শহরে যে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই তেজস্ক্রিয়তার চিহ্ন নিয়েই তার জন্ম। যার ফলে তার পায়ে ছ’টা আঙুল, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ হীন হাতের আঙুলগুলো পরস্পর জোড়া, একটা কিডনি অকেজো, বাঁ পা ডান পায়ের থেকে প্রায় ৬ ইঞ্চি ছোট, দুটি পায়ের ওজন বহনকারী শিন-বোন (টিবিয়া) নেই এবং হাত ও কাঁধের পেশিও যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
কিন্তু, তাতে কি তার দুষ্টুমির কমতি আছে? অনাথাশ্রমের লোকেরা তাকে শান্ত করার জন্য একজন মহিলার ছবি দেখিয়ে বলে যে ইনি তার মা, সে দুষ্টুমি না করলে তার মা তাকে এসে নিয়ে যাবে। মেয়েটি ভেবেছিল, এগুলো নিতান্তই স্তোকবাক্য। এর আগেও দু-তিনজনের সঙ্গে কথা হয়েছিল, কিন্তু তারা রাজি হননি। কিন্তু একদিন সেই ছবির মা অর্থাৎ আমেরিকার বাফেলো শহরের প্রফেসর গে মাস্টার্স এসে হাজির হলেন ইউক্রেনে। ১৯৯৮ সালে ৮ বছর বয়সে মেয়েটি এক সিঙ্গেল মাদারের কোলে চেপে পূর্ব ইউরোপ ছেড়ে রওনা দিল দূর আমেরিকায়। মেয়েটি তখনও জানত না, একদিন তাকে তার দেশের খুব কাছে রাশিয়ার সোচি শহরে ফিরে আসতে হবে অলিম্পিকের পদক জয় করবার জন্য।
মেয়েটির নাম ওকসানা মাস্টার্স। চের্নোবিলের দুঃসহ অতীতকে পিছনে ফেলে এবার তার নতুন লড়াইয়ের ময়দানে নামার পালা। সে ও তার মা, শুরু হল ‘দুই নারী হাতে তরবারি’র গল্প। ৯ বছর বয়সে ডাক্তাররা ওকসানার বাঁ পা কেটে বাদ দেন। ১৩ বছর বয়সে ডান পা-ও বাদ দিয়ে কৃত্রিম পা বসাতে হল। বুড়ো আঙুলও জোড়া হলো কৃত্রিম ভাবে। অস্ত্রোপচার হলো শরীরের বিভিন্ন অংশে। ওকসানার নিজের বয়ানে, “It's the end of the world if you're having a bad hair day or you have a pimple on your face for school picture day, let alone if you have prosthetic legs and hands that are hard to cover up.” ওই বয়সেই ওকসানা ঠিক করল ‘প্রতিবন্ধকতা’ শব্দটাকে সে অভিধান থেকে মুছে দেবে। সে প্রথম মুক্তির ঠিকানা পেল জলে নেমে। রোয়িং-এর অনুশীলন তাকে যেন তার গতজন্মের শক্তি আর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিল। বৈঠার প্রতিটা টানে সে তার শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে পৌঁছে গেল ২০১২ সালের লন্ডন প্যারা-অলিম্পিকের মঞ্চে।
২০১১ সালে সে ও তার রোয়িং পার্টনার রব জোনস তৈরি করে ‘টিম ব্যাড কোম্পানি’। তারা লন্ডন প্যারা-অলিম্পিকের trunk and arms mixed double sculls অর্থাৎ শুধুমাত্র কাঁধ ও হাতের সাহায্যে দু-জোড়া বৈঠার ১০০০ মি. রোয়িং, যা প্যারা-অলিম্পিকের ৯টি বিভাগের মধ্যে অন্যতম, সেই ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করল। পিঠের চোট তাকে রোয়িং ছাড়তে বাধ্য করলে ওকসানা মুক্তির নতুন উপায় খুঁজে নিল। এবার শুরু হলো স্কিইং (skiing)। মাত্র ১৪ মাসের প্রস্তুতিতে সে আমেরিকার হয়ে যোগ্যতা অর্জন করল ২০১৪ সালের রাশিয়ার শীতকালীন প্যারা-অলিম্পিকে। সে নাম দিল মূলত দুটো ইভেন্টের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। প্রথমটি ক্রশ-কান্ট্রি নর্ডিক স্কিইং (cross-country Nordic skiing) অর্থাৎ যেখানে প্রতিযোগীর বুটের পাতার দিকের অংশটি স্কি-র সঙ্গে যুক্ত থাকলেও গোড়ালির অংশ খোলা থাকে এবং এই ভাবে একটি নির্দিষ্ট ট্র্যাকে প্রতিযোগীকে এগোতে হয়; দ্বিতীয়টি বিয়াথলন (biathlon) অর্থাৎ বসে বা দাঁড়িয়ে স্কিইং-এর প্রতিটি ল্যাপের শেষে ১০ মি. দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে রাইফেল চালানো। ওকসানা এই প্রতিযোগিতায় ১২ কিমি নর্ডিকে রোপ্য পদক এবং ৫ কিমি নর্ডিকে ব্রোঞ্জ পদক জয় করে। যে জন্মভূমিকে (যেহেতু ইউক্রেন তখন রাশিয়ার অন্তবর্তী ছিল) সে বহুদিন আগে ফেলে এসেছিল, সেই দেশের মাটিতে অলিম্পিক পদক জয়ের পর সে বলেছিল, "It wasn't my gold-medal moment, but it sure felt like it."
পিঠের চোট কিন্তু তার সঙ্গ ছাড়েনি। অদম্য ওকসামা পেশীর শক্তি বাড়ানোর জন্য হ্যান্ড-সাইক্লিং শুরু করল। আর সেখানেও সাফল্য। বিশ্বকাপে দুটি ব্রোঞ্জ পদক, ইউ.সি.আই প্যারা-সাইক্লিং-এ একটি ব্রোঞ্জ পদক তার ঝুলিতে। ২০১৬ সালের ব্রাজিলের রিও প্যারা-অলিম্পিকের হ্যান্ড-সাইক্লিং বিভাগেও সে চতুর্থ স্থান অর্জন করে।
এইভাবে এসে পড়ল ২০১৮-র দক্ষিণ কোরিয়ার পিয়ংচ্যাং শহরের শীতকালীন প্যারা-অলিম্পিক। ওকসানা তখন তিন সপ্তাহ আগে পাওয়া কনুইয়ের চোটে কাহিল—এমনকি একটি বিয়াথলন ইভেন্ট থেকে নামও প্রত্যাহার করে নিতে হয়। কিন্তু মাতৃজঠরের অন্ধকার থেকে যার লড়াই শুরু হয়েছে, সে তো এভাবে হার মেনে নিতে পারে না। ওকসানা ১.৫ কিমি ক্রশ-কান্ট্রি ক্লাসিকাল স্কিইং ও বসে ক্রশ-কান্ট্রি স্কিইং-এ জিতলো সোনা; ৬ কিমি এবং ১২.৫ কিমি বিয়াথলনে জিতলো রূপো এবং বসে ১২ কিমি ক্রশ-কান্ট্রি প্রতিযোগিতায় জিতলো ব্রোঞ্জ। ২০১৯ সালে প্যারা-নর্ডিক স্কিইং বিশ্বকাপের ক্রশ-কান্ট্রি বিভাগে সে সর্বাধিক স্বর্ণপদক প্রাপ্ত।
৩১ বছর বয়সী ওকসানা আপাতত ব্যস্ত আছে টোকিও অলিম্পিকসের প্রস্তুতিতে। যা করোনা অতিমারির কারণে পিছিয়ে গেছে। প্যারা-সাইক্লিং-এ এখনও পদক না জিততে পারার যন্ত্রণা তাকে আজও কুরে কুরে খাচ্ছে। অলিম্পিকসের পদক জয়ই অবশ্য ওকসানার একমাত্র লক্ষ্য নয়। সেই ১৩ বছর বয়সে প্রথম জলে নামার দিন থেকে সে একটা স্বপ্ন দেখে এসেছে। 'disability' নামক যে শব্দটা আমাদের সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে বৈষম্য ছড়িয়ে রেখেছে, তাকে মুছে দেওয়া। জেদ আর স্পর্ধা থাকলে যে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেও জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়, সেটা প্রমাণ করার জন্যই তার লড়াই শুরু হয়েছিল। যে মেয়েটি একদিন চুরি করে ফল খেতে বাধ্য হত, চের্নোবিলে তেজস্ক্রীয়তার মাত্রা বাড়লে যাকে বাসে করে দূরে রেখে আসা হতো, একের পর এক গঞ্জনা শুনতে শুনতে যার মা-কে নিউ ইয়র্ক ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল কেনটাকি-তে, অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে যে দু-হাত মুঠো করে তীরবেগে ছুটে গিয়েছিল বরফে দাগ কেটে, সেই মেয়েটি আজ অলিম্পিকের পদকের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছে। তার মতো লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের জন্য এক স্বপ্নের রাস্তা নির্মাণের লড়াই। তাই, সম্প্রতি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা কৃত্রিম পা পরিহিত ছুটন্ত ওকসানার ছবির ক্যাপশনে লেখা থাকে, “One step forward from the past and a giant leap towards my dreams.”
তথ্যসূত্র- www.oksanamastersusa.com
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Oksana_Masters
https://www.bbc.com/sport/amp/disability-sport/50220303
চিত্রঋণ- www.oksanamastersusa.com
#ওকসানা মাস্টার্স #প্যারা অলিম্পিক #চেরনোবিল # Oksana Masters #Paralympic #rower #skier #শিবাজী আইচ # খেলা #ফিচার